মুসলিম বিশ্বে ঈদ আসে, গাজায় ঈদ আসে না
মুসলিম বিশ্ব যখন উৎসবের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত, তখন ফিলিস্তিনের গাজায় ঈদের কোনো আনন্দ নেই। যুদ্ধবিধ্বস্ত এই ভূখণ্ডের মানুষের কাছে এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো বেঁচে থাকা।
যুদ্ধের আগুনে পুড়ছে গাজা
প্রায় দেড় বছর ধরে ইসরায়েলের অব্যাহত হামলায় গাজা পরিণত হয়েছে এক ধ্বংসস্তূপে। গত ১৮ মার্চ থেকে নতুন করে শুরু হওয়া হামলায় এখন পর্যন্ত ৯২০ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন ২ হাজারেরও বেশি। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর যুদ্ধ শুরুর পর থেকে এই সংখ্যা ছাড়িয়ে গেছে ৫০ হাজারেরও বেশি, আর আহতের সংখ্যা পৌঁছেছে ১ লাখ ১৪ হাজারে।
গাজার উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলজুড়ে ধ্বংসস্তূপের মধ্যে ঈদের খুশি যেন এক মরীচীকা। ঈদ মানে নতুন পোশাক, মিষ্টি খাবার, পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানো। কিন্তু গাজার মানুষের কাছে এসব এখন বিলাসিতা।
‘আমাদের ঈদ নেই’
গাজার বাসিন্দা মোহামেদ আল সারকা বলছিলেন, ঈদ আমাদের জন্য নয়। আমাদের শিশুদের জন্যও নয়। তাদের জন্য একটি নতুন কাপড়ও কিনতে পারিনি। যেখানে খাবার জোটানোই দুষ্কর, সেখানে ঈদের আয়োজনের কথা ভাবাই অসম্ভব।
তিনি আরও জানান, ইসরায়েলি হামলায় তার তিন সন্তান নিহত হয়েছে। এখন বেঁচে থাকা চার সন্তানকে নিয়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন তিনি।
৪৭ বছর বয়সী নোয়া আবু হানি যুদ্ধের কারণে উদ্বাস্তু হয়েছেন। তিনি আগে জাবালিয়া ক্যাম্পে ছিলেন, কিন্তু ইসরায়েলি হামলায় ক্যাম্প বিধ্বস্ত হওয়ায় এখন আশ্রয় নিয়েছেন উনরোয়া ক্যাম্পে।
স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, আগে ঈদের সময় কা’ক (ফিলিস্তিনের ঐতিহ্যবাহী কুকিজ) তৈরি করতাম। সেগুলো বিক্রি করতাম রোজার শেষ দিনে, রাস্তার পাশে ছিল উৎসবের আমেজ। কিন্তু এখন কিচ্ছু নেই। শুধু বেঁচে থাকার লড়াই।
ফিলিস্তিনি শিশুরাও ভুলে গেছে ঈদের আনন্দ
সাত বছরের হানিন তার পোড়া ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদছিল। কারণ জিজ্ঞেস করতেই সে বলল, ‘আমার জামা নেই, পুতুল নেই, আমাদের ঘরও নেই। আমি ঈদ পছন্দ করি না।’
শুধু হানিন নয়, গাজার শত শত শিশুর মুখে হাসি নেই। তারা জানেই না ঈদের খুশি কেমন হতে পারে। খাদ্য সংকটের কারণে তাদের ঈদের দিনে বিশেষ কিছু খাওয়ার সুযোগও নেই।
যুদ্ধের মধ্যে সামান্য আনন্দের চেষ্টা
উম্মে মোহামেদ নামের এক ফিলিস্তিনি মা তার সন্তানদের জন্য সামান্য কিছু কুকিজ বানানোর চেষ্টা করছেন। তিনি বলেন, বাচ্চাদের মুখে সামান্য হাসি ফোটাতে চাচ্ছি। ঈদ নেই, কিন্তু ঈদের কথা ভুলিয়ে দিতে পারি না।
গাজার পরিস্থিতি এমন যে ঈদের দিনও মানুষ খাবার-পানির সংস্থানের জন্য সংগ্রাম করছে। নতুন পোশাকের পরিবর্তে এখন সবচেয়ে প্রয়োজনীয় জিনিস হলো খাবার ও বিশুদ্ধ পানি।
গাজার ঈদ : বেঁচে থাকার সংগ্রাম
গাজার প্রতিটি পরিবার আজ নিদারুণ কষ্টের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। ইসরায়েলের অবরোধের কারণে খাদ্যের দাম বেড়ে গেছে, বিদ্যুৎ নেই, পানি নেই, আশ্রয়ের অভাব চরমে। ঈদ তাই এখন গাজার মানুষের জন্য আরেকটি কঠিন দিন, যেখানে আনন্দের বদলে বুকভরা বেদনা আর বেঁচে থাকার যুদ্ধই একমাত্র বাস্তবতা।
‘ঈদ আসে, ঈদ যায়। কিন্তু গাজায় ঈদ আসে না।’—এভাবেই দীর্ঘশ্বাস ফেলেন গাজার এক বাসিন্দা, যেন তার কথায় ফুটে ওঠে পুরো ফিলিস্তিনের যন্ত্রণার প্রতিচ্ছবি।
সূত্র : মিডল ইস্ট মনিটর ও গালফ নিউজ
যুদ্ধের মাঝে ‘বেঁচে থাকাটাই’ ফিলিস্তিনিদের ঈদ আনন্দ
মুসলিমদের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর আবারও দরজায় কড়া নাড়ছে, তবে অন্যান্য দেশের মতো ঈদের আনন্দ উপভোগ করতে পারে না ফিলিস্তিনিরা। এবারও গাজা উপত্যকায় যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ফিলিস্তিনি নাগরিকরা ঈদ উদযাপন করবে। তবে, এই ঈদ তাদের কাছে আলাদা—তারা স্বজনদের লাশ কাঁধে বয়ে ঈদ উদযাপন করবে, এমনকি অনেকের কাছে বেঁচে থাকাটাই সবচেয়ে বড় আনন্দ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
গাজা উপত্যকায় চলমান সংঘর্ষের মধ্যেই ১৮ মার্চ যুদ্ধবিরতি ভেঙে ইসরায়েলি বাহিনী নির্বিচারে বোমাবর্ষণ চালিয়ে যাচ্ছে। এখন পর্যন্ত ৯০০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে, ফিলিস্তিনিদের জন্য ঈদের আনন্দ কতটুকু থাকবে, সেই প্রশ্ন ওঠা অস্বাভাবিক নয়।
এদিকে, ইসরায়েল এবং যুক্তরাষ্ট্র জানিয়ে দিয়েছে, গাজা উপত্যকায় ঈদ উপলক্ষে কোনো যুদ্ধবিরতি হবে না। ফলে ফিলিস্তিনিরা ঈদ উদযাপনে আর কিছু ভাবতে পারছে না।
ঈদে সাধারণত যে প্রীতিভোজের আয়োজন করা হয়, সেই খাওয়ার চিন্তা এখন ফিলিস্তিনিদের জন্য অবাস্তব হয়ে দাঁড়িয়েছে। গাজার খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে গেছে। খাদ্য উপকরণ থাকলেও সেগুলো রান্না করার পরিস্থিতি নেই। গাজায় বিদ্যুৎ বন্ধ, জ্বালানি সংকট এবং যুদ্ধের কারণে কৃষি ব্যবস্থা ধ্বংস হওয়ার ফলে খাবার পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে।
ঈদের সকালে ফিলিস্তিনিরা ঐতিহ্যবাহী সুম্মাকিয়া রান্না করে থাকে—যেখানে ভেড়ার মাংস, গরুর মাংস, তিল, ছোলা এবং শাক দিয়ে একটি বিশেষ ঝোল তৈরি করা হয়। তবে এই খাবারটি তৈরি করার জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ এখন গাজার বাজারে পাওয়া যাচ্ছে না।
যখন তাদের মাতৃভূমি থেকে নির্মূল হওয়ার চেষ্টা চলছে, তখন ফিলিস্তিনিরা তাদের ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে চায়। প্রতিদিনই তারা তাদের স্বজনদের জীবনের নিরাপত্তা হারাতে দেখছে। তারপরও, এ ধরনের কঠিন পরিস্থিতিতে নিজের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখতে তাদের চেষ্টার কোনো কমতি নেই।
ঈদের দিন, গাজার ফিলিস্তিনি পরিবারগুলো অনেক কষ্টের মধ্যে তাদের ছোট ছোট সন্তানদের জন্য ঈদের আনন্দ তৈরি করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে। কিন্তু, অধিকাংশ শিশু এক বেলা খেয়েই ঈদের দিন কাটাবে। খাদ্য সংকট এবং যুদ্ধের কারণে তাদের আনন্দের জায়গা হয়ে দাঁড়িয়েছে শুধু বেঁচে থাকা, আর তাই তাদের জন্য এবারের ঈদ কোনো প্রীতিভোজ নয়, বরং জীবন বাঁচানোর এবং শোক প্রকাশের দিন।
সূত্র : আল জাজিরা
![]() |
ঈদের জামাতে অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকার ফিলিস্তিনিরা। ছবি : সংগৃহীত |
No comments