জাতীয় সংসদ নির্বাচন: সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তা প্রশ্ন
আমরা
সকলেই অবগত আছি, গণতান্ত্রিক চর্চা ও প্রক্রিয়ার গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হিসেবে
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক প্রস্তুতি সকল পর্যায়ে শুরু হয়ে
গেছে। ইতিমধ্যে সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের
ঘোষণামতে আগামী ৩০শে ডিসেম্বর নির্বাচনের দিন নির্ধারণ করা হয়েছে। নাগরিক
সমাজের পক্ষ থেকে আমাদের সকলের প্রত্যাশা আগামী নির্বাচন হবে শান্তিপূর্ণ,
অংশগ্রহণমূলক, স্বচ্ছ ও অবাধ-নিরপেক্ষ যেখানে সব নাগরিক নির্বিঘেœ তাদের
ভোটাধিকার সুষ্ঠুভাবে প্রয়োগ করতে পারবে। গণতান্ত্রিক এই প্রক্রিয়া যাতে
সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয় তা নির্বাচন কমিশনসহ সকল রাজনৈতিক দলকে নিশ্চিত করতে
হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যে স্বাধীন দেশ
আমরা পেয়েছি সেখানে এখনো গণতন্ত্র কিংবা গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান শক্ত
ভিত্তির ওপর সুরক্ষিত নয়।
এটা আমাদের জনদুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য। স্বাধীনতা-পরবর্তী প্রায় প্রতিটি নির্বাচনেই আমরা প্রত্যক্ষ করেছি, নির্বাচন পূর্ব ও পরবর্তী সময়ে ধর্মীয় সংখালঘু, আদিবাসী এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠী তাদের প্রান্তিকতার কারণে বারংবার নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
কখনওই তারা নির্ভয়ে এবং স্বাধীনভাবে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন না। বিভিন্ন রাজনৈতিক স্বার্থান্বেষী মহল বারবার তাদের হীনস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য বিভিন্ন অজুহাতে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্মম নির্যাতন, অত্যাচার, খুন, ধর্ষণ, রুটপাট, অগ্নিসংযোগসহ অনেক ধরনের মানবতাবিরোধী কর্মকা- চালিয়েছে। এই ঘটনা বারংবার ঘটার পেছনে রাজনৈতিক ইন্ধন থাকে বলে জনমনে অভিযোগ ও ক্ষোভ রয়েছে। পাশাপাশি রাষ্ট্রের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যর্থতা বা উদাসীনতাও এই ধরনের সহিংসতা বিস্তার লাভে বড় ভূমিকা রাখেন। এক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনও বিভিন্ন সময়ে তার সঠিক ভূমিকা পালন করতে পারেনি। এমন অভিযোগ বার বার সাধারণ নাগরিকদের কাছ থেকেই উঠে এসেছে।
বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে সংখালঘু সমপ্রদায়ের ওপর হামলা ও আক্রমণের চিত্র পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, সংখ্যালঘু নির্যাতনের অধিকাংশ সহিংস ঘটনাই সংগঠিত হয়েছে নির্বাচনকালে, তার আগে অথবা নির্বাচনের পর। স্বাধীনতা-উত্তরকালে সত্তর ও আশির দশকের বিভিন্ন নির্বাচনে সংখ্যালঘুদের হয়রানি-নির্যাতনের মতোই ১৯৯০ সালে যখন সামরিক স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে গণ-আন্দলন চলছিল তখনো অক্টোবর মাসে গণ-আন্দোলনকে বিপথগামী ও কলঙ্কিত করতে আক্রমণ করা হয় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে। ২০০১-এর জাতীয় সংসদের নির্বাচন পরবর্তী ভয়াবহ সহিংসতার শিকার হয় এদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, তখন সিরাজগঞ্জে, ভোলায় এবং অন্যান্য স্থানে সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ ও নির্যাতনের ঘটনায় নাগরিক সমাজ সোচ্চার হলেও নির্যাতনের শিকার পূর্ণিমা-সীমাদের ধর্ষণ পরবর্তী আহাজারি তদানীন্তন সরকার, প্রশাসন বা রাজনৈতিক মহলের আনেকেই শুনতে পাননি বা শোনার প্রয়োজনও বোধ করেননি। সে সময়ে দায়েরকৃত মামলাসমূহের তদন্ত রিপোর্ট আজও জনসম্মুখে প্রকাশ করা হয়নি।
২০১০ সালের মাননীয় হাইকোর্টের নির্দেশনায় গঠিত শাহাবুদ্দিন কমিশন ২০১২ সালে সরকারের কাছে সুপারিশ সংবলিত রিপোর্ট পেশ করলেও তা আজো আলোর মুখ দেখেনি। দেশের জনগণ জানতে পারলনা প্রকৃতপক্ষে নির্যাতনের তান্ডবের মধ্যে কি ঘটেছিল, কারা এর সাথে জড়িত ছিল। অপরাধীদের শনাক্ত করা হলো না, সুনির্দিষ্ট শাস্তি প্রদান তো দূরের ব্যাপার ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারির নির্বাচন পরবর্তী হামলার ঘটনাও সুবিদিত। নির্বাচনের আগে ও নির্বাচন পরবর্তী সময়ে খুবই পরিকল্পিতভাবে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা হয়েছে। নির্বাচনের দিন রাতেই যশোরের অভয়নগরে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা হয়েছে। পরদিন ৬ই জানুয়ারি ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, রংপুর, রাজশাহী, লালমনিরহাট, বগুড়া, চট্টগ্রামসহ নানা জায়গায় সংখ্যালঘু হিন্দু ও অন্যান্য প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ওপর হামলা হয়েছে। তাদের বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে লুটপাট চলেছে অবাধে। অগ্নিসংযোগ হয়েছে। ওইসব বাড়ির নারী-পুরুষ শিশুদের উপর নির্যাতন হয়েছে। তাদের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করার হুমকি দেয়া হয়েছে। তারা বিভিন্ন মন্দির, স্কুল কিংবা মুসলমান প্রতিবেশীর বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে প্রাণে বাঁচিয়েছেন। প্রশাসন নির্বাচনকালীন সময়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর এই আক্রমণরোধে বেশিরভাগ সময় সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে। নির্বাচন পরবর্তী এ সব সহিংসতার সুষ্ঠু কোন তদন্ত বা মামলার কোনো অগ্রগতি হয়নি। বিচারের মুখোমুখি জনগণকে বা ভুক্তভোগীদের তা জানানো হয়নি।
শুধু নির্বাচনকালীন সহিংসতা নয়, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতনের আরো একটি নতুন মাত্রা দেখতে পাওয়া যায় সাম্প্রতিক বাংলাদেশে। ফেসবুকে মিথ্যা স্ট্যাটাস দিয়ে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা হয়েছে এই অছিলায় সংখ্যালঘুদের বাড়ি ঘরে হামলা করা হয়। পাবনার সাঁথিয়া (২০১৩ সাল), কক্সবাজারের রামু (২০১২ সাল), ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরসহ (২০১৬ সাল) বহু স্থানে এমন সব ঘটনা ঘটেছে। সব ক্ষেত্রে একই ধরনের গল্প তৈরির প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়। রংপুরের গংগাচড়া ও সদর ইউনিয়নে একই ঘটনা ঘটেছে। ৬ই নভেম্বর, ২০১৭ তারিখে স্থানীয় মুদি ব্যবসায়ী রাজু মিঞা বাদী হয়ে আইসিটি অ্যাক্টে’র অধীনে টিটু রায়ের বিরুদ্ধে ধর্মীয় অবমাননার অভিযোগে গঙ্গাচড়া থানায় মামলা দায়ের করেন। ৭ই নভেম্বর, ২০১৭ তারিখে স্থানীয় পর্যায়ে একটি পূর্বপরিকল্পিত সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয় এবং হাজার হাজার লোক সেখান থেকে লাঠি, দা অন্যান্য অস্ত্রসহ টিটু রায়ের পরিবারসহ পার্শ্ববর্তী সংখ্যালঘুপাড়ায় ঢুকে ৩০টি বাড়িতে হামলা করে ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের তা-ব চালায়।
সবই ঘটে স্থানীয় জেলা প্রশাসন ও পুলিশ কর্তৃপক্ষের জ্ঞাতসারে। প্রতিটি ঘটনার সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো ব্যতিক্রমধর্মী কিছু প্রগতিশীল দল বাদে উগ্র সাম্প্রদায়িক দল-জনগোষ্ঠীসহ প্রায় সব প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলের স্থানীয় নেতাদের প্রত্যক্ষ মদতে কিংবা প্রশ্রয়ে এই হামলা চালানো হয়। শেষ পর্যন্ত যার নামে ফেসবুকে কথিত স্ট্যাটাস দেয়ার কথা বলা হয়, পুলিশ তাকেই গ্রেপ্তার করে জেল হাজতে পাঠিয়ে দেয়। এইসব ঘটনার তদন্ত কখনও শেষ হয় না। এ ধরনের ঘটনায় যাদের বিরুদ্ধে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়ার অভিযোগ, তারা নিরাপরাধী হয়েও বছরের পর বছর জেল খেটেছে কিংবা নিখোঁজ হয়েছেন। নাসিরনগরের রসরাজ এবং রামু’র উত্তম বড়ুয়ার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। রংপুরের টিটু রায়ের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। সংখ্যালঘুদের উপর এ ধরনের হামলা, নির্যাতনের ঘটনা পাকিস্তানি শাসনের ২৪ বছরেও চলেছে। তবে তার রূপ ছিল ভিন্ন। কখনো কখনো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাও মোকাবেলা করতে হয়েছে ওই সময়। স্বাধীন বাংলাদেশে দাঙ্গা হয় না, তবে সংখ্যালঘুদের হয়রানি নির্যাতন চলেছে অবাধে দিনের পর দিন। এর ফলাফল কি?
আমরা যদি আদমশুমারি’র দিকে তাকাই তবে দেখতে পাব, ১৯৫১ সালের আদমশুমারি অনুসারে বাংলাদেশ ভূখ-ে শতকরা ২৮ ভাগ মানুষ ছিলেন সংখ্যালঘু তথা হিন্দু সম্প্রদায়ের। কিন্তু তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের সাম্প্রদায়িক বৈষম্যপূর্ণ আচরণের কারণে এবং মুসলিম লীগ শাসিত পূর্ব বাংলায় সাম্প্রদায়িক প্রচার, উত্তেজনা ও দাঙ্গা ইত্যাদির ফলে ভীতসন্ত্রস্ত সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক দেশ ছেড়ে ভারত চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন।
যার প্রমাণ ১৯৬১ সালের আদমশুমারি। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর শত্রু সম্পত্তি আইনের নামে যে নির্যাতনের নতুন হাতিয়ার তুলে দেয়া হলো ভূমি প্রশাসন ও দুর্বৃত্তদের হাতে, তার ফলে দেয়া যায় দেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের সংখ্যা ষাটের দশকে শতকরা ১৮.৫ ভাগে নেমে এসেছে। মহান মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর অর্পিত সম্পত্তি আইনসহ বিভিন্ন ধরনের নির্যাতনের কারণে, কখনও নির্বাচন কেন্দ্রিক অথবা অন্য কোন অজুহাতে এই নির্যাতনের ধারা অব্যাহত থাকে। ১৯৭৪ সালের আদমশুমারি অনুসারে এদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক ছিল শতকরা ১৩.৫ ভাগ যা ১৯৮১ সালে এসে দাঁড়ায় ১২.১৩ ভাগ এবং ২০০১ সালের আদমশুমারি অনুসারে তা ছিল ৯.৫ ভাগ। সর্বশেষ ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুসারে তা হলো শতকরা মাত্র ৮ ভাগ। বিশিষ্ট গবেষক ড. আবুল বারাকাতের গবেষণা মতে এভাবে চলতে থাকলে আগামী ২০ বছরের মধ্যে বাংলাদেশে আর কোনো হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক থাকবে না। এ অবস্থা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। এদেশের ভাষার সংগ্রাম, স্বাধিকার, গণতন্ত্র কিংবা মহা মুক্তিযুদ্ধ-প্রতিটি ক্ষেত্রেই উজ্জ্বল অবদান রেখেছেন, সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছেন আমাদের দেশের ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে।
নিরপেক্ষভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগ করা তাদের অপরাধ নয়। তবু তাদের ভোটের আগে-পরে এবং ভোটের সময় কেন নির্যাতনের মুখোমুখি হতে হবে? সংখ্যালঘুরা কোন ভরসায় আমাদের পাশে বসবাস করবে, যদি আমরা হিংস্র থাবার মুখে দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও অদিবাসী, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার মুখোমুখি হওয়ার সংস্কৃতি থেকে সুরক্ষা দিতে না পারি? এই দায় যেমন রাজনৈতিক দলগুলো এড়াতে পারে না তেমনি রাষ্ট্র তথা নির্বাচনকালীন সরকারও এ দায় থেকে রেহাই পেতে পারে না। নাগরিক সমাজও তাদের দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারে না। নির্বাচন কমিশনের তো এই ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি দায়িত্ব নেবার কথা। কারণ রাষ্ট্রের যে কোন নাগরিকের ভয়-ডরহীনভাবে ভোট প্রদানের পরিবেশ নিশ্চিত করার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনেরই।
আজকের এই গোলটেবিল আলোচনা সভায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের গুরুত্বপূর্ণ সম্মানীয় ব্যক্তিবর্গ, সুশীল সমাজের নেতৃবৃন্দও অন্যান্য পেশার প্রতিনিধিগণ উপস্থিত আছেন। আমরা এই গোলটেবিল আলোচনা সভা থেকে বলতে চাই, সংখ্যালঘুদের উপর নির্বাচনকেন্দ্রিক সহিংসতার যে ধারাবাহিকতা চলে এসেছে তা জাতির জন্য অত্যন্ত লজ্জাজনক। এ লজ্জাজনক কলঙ্কের অবসান চাই। যেহেতু এখানে রাজনৈতিক দলসমূহের নেতৃবর্গ ও বিশিষ্টজনেরা উপস্থিত আছেন তাই তাদের কাছে আমরা আমাদের প্রত্যাশা ও দাবির কথা জানাতে চাই। ইতিমধ্যে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে যে সকল দাবি রাজনৈতিক দলসমূহের কাছে উত্থাপন করা হয়েছে তার প্রতি যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে তা পূরণের লক্ষ্যে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের প্রতিশ্রুতি তারা দেবেন সেই আশা আমরা করি। আমরা আরো আশা করি সকল গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর নির্বাচনকালীন বা পরবর্তীতে সহিংসা আক্রমণ প্রতিরোধে তাদের অঙ্গীকার নির্বাচনী ইশতেহারে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গীকার হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করবে।
তাদের কাছে আমাদের সবিনয় নিবেদন, নির্বাচন পরবর্তীতে আপনাদের অবস্থান সরকারি দলেই হোক কিংবা বিরোধী দলে সংখ্যালঘুদের উপর সহিংসতা প্রতিরোধে আমরা আপনাদের সুদৃঢ় ভূমিকা দেখতে চাই। কারণ এই সহিংসতার দায় ক্ষমতাসীন দলের উপর যেমন বর্তাবে, তেমনি বিরোধী দলও তা এড়াতে পারবে না। পাশাপাশি সুধী সমাজ বা নাগরিক সমাজের ব্যক্তিবর্গও এ দায় এড়িয়ে নিজেদের সভ্য বা দায়িত্বশীল বলে দাবি করতে পারেন না। সকল ধর্ম, সম্প্রদায় ও জাতিগত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর সামাজিক-রাজনৈতিক নিরাপত্তা, সম মর্যাদা ও নাগরিক অধিকারের সুরক্ষা যেমন রাষ্ট্রকে দিতে হবে, সকল দায়িত্বশীল রাজনৈতিক দলকে তা নিশ্চিত করতে হবে। তেমনি এক্ষেত্রে সকল পর্যায়ে দলমত-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে নাগরিকদেরও অবশ্যপালনীয় কর্তব্য যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে পালন করতে হবে। সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার সমস্যা শুধুমাত্র সংখ্যালঘুদের সমস্যা নয়। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় সমস্যা। তাই একে অবশ্যই সকলে মিলে অগ্রাধিকারের তালিকায় রেখে-এর টেকসই সম্মানজনক সমাধান সুনিশ্চিত করতে হবে। সে লক্ষ্যে আমরা মূল সমস্যার প্রতি দৃষ্টিপাত করার পাশাপাশি কতিপয় জরুরি সুপারিশও সকলের বিবেচনার জন্য তুলে ধরছি।
১. নির্বাচন পূর্ব ও পরবর্তী সময়ে সংখ্যালঘু বিরোধী সহিংসতা প্রতিরোধে রাষ্ট্র তথা পুলিশ প্রশাসনকে আগাম ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। প্রয়োজনে বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন করে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
২. ইতিপূর্বে নির্বাচনকালীন যে সকল সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে তার সুষ্ঠু, স্বচ্ছ ও দ্রুত তদন্ত সম্পন্ন করে দোষী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। ক্ষতিগ্রস্তদের পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
৩. সকল রাজনৈতিক দলকে অঙ্গীকার করতে হবে, যে সকল নেতার বিরুদ্ধে সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে কোন রাজনৈতিক দল তাদের আসন্ন নির্বাচনে মনোনয়নতো দেবেই না, দলের কোনো পদেও তাদের স্থান দেয়া চলবে না।
৪. নির্বাচনে ধর্ম ও সম্প্রদায়িকতার ব্যবহার নিষিদ্ধ করতে হবে এবং মন্দির-মসজিদ-গির্জা প্যাগোডাসহ সকল ধর্মীয় উপাসনালয়কে নির্বাচনী কর্মকা-ের বাইরে রাখতে হবে।
৫. সকল দলের নির্বাচনী ইশতেহারে সংখ্যালঘুদের নাগরিক স্বার্থ ও নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে সুস্পষ্ট অঙ্গীকার ব্যক্ত করতে হবে। যাতে কোনো দলই নির্বাচন পূর্ব বা পরবর্তী সময়ে সংখ্যালঘু নির্যাতনের কোন ঘটনার সাথে প্রত্যক্ষ, পরোক্ষ কোনভাবেই সম্পৃক্ত না হয় তার জন্য মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের সতর্ক থাকতে নির্দেশনা দিতে হবে।
৬. সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে প্রশাসনের উদ্যোগে সকল জেলা-উপজেলা পর্যায়ে রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে একটি মনিটরিং কমিটি গঠন করতে হবে এবং এই কমিটি সংখ্যালঘু নিরাপত্তার বিষয়ে সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণের পাশাপাশি দ্রুত যে কোন স্থানে প্রশাসনের সহায়তায় উপস্থিত হয়ে জরুরি পদক্ষেপ নিশ্চিত করবে।
৭. নির্বাচনী প্রচারণায় সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষমূলক যে কোন প্রচারণা করা থেকে সব দলকে বিরত থাকতে হবে এবং নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসনকে এই নির্বাচনী বিধি মেনে চলার বিষয়টি কঠোরভাবে তদারকি ও নিশ্চিত করবে।
৮. ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার অছিলায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর অত্যাচার, নির্যাতনের সকল ঘটনার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত করে দোষীদের কঠোর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। ভবিষ্যতে আইনের সংস্কার করতে হবে। যারা উস্কানিমূলক কর্মকা- চালাতে ভুয়া ফেসবুক আইডি খুলে অন্যদের উপর দায় চাপায় তাদের দ্রুত শনাক্ত করে কঠোরতম শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। উস্কানি দেয়া সকল ভুয়া অনলাইন আইডি শনাক্ত করে তা বন্ধ করতে হবে। এ ব্যাপারে জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে গণমাধ্যমে নিয়মিত প্রচার চালাতে হবে যাতে সাধারণ মানুষ তাদের ভ্রান্ত উদ্দেশ্যমূলক প্রচারে প্রভাবিত না হয়।
৯. ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর দাবিমতো ‘সংখ্যালঘু কমিশন’ গঠন করতে হবে, যাতে সংখ্যালঘু নির্যাতনের কোন ঘটনা সংগঠিত হলে এ কমিশনতা স্বাধীনভাবে তদন্ত করে তা প্রতিকারের যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। একই সাথে সংখ্যালঘুদের সুরক্ষায় বিশেষ আইন প্রণয়ন ও পৃথক মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
১০. সকল ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার মাধ্যমে সংখ্যালঘু নির্যাতন প্রতিরোধে ব্যাপক জনসচেতনা তৈরির জন্য গণমাধ্যম কর্তৃপক্ষের সহযোগিতায় প্রচার কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে।
[১৭ নভেম্বর, ২০১৮ তারিখে নাগরিক সমাজ আয়োজিত এবং তোপখানা রোডের সিরডাপ মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত গোলটেবিল আলোচনায় উপস্থাপিত]
এটা আমাদের জনদুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য। স্বাধীনতা-পরবর্তী প্রায় প্রতিটি নির্বাচনেই আমরা প্রত্যক্ষ করেছি, নির্বাচন পূর্ব ও পরবর্তী সময়ে ধর্মীয় সংখালঘু, আদিবাসী এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠী তাদের প্রান্তিকতার কারণে বারংবার নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
কখনওই তারা নির্ভয়ে এবং স্বাধীনভাবে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন না। বিভিন্ন রাজনৈতিক স্বার্থান্বেষী মহল বারবার তাদের হীনস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য বিভিন্ন অজুহাতে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্মম নির্যাতন, অত্যাচার, খুন, ধর্ষণ, রুটপাট, অগ্নিসংযোগসহ অনেক ধরনের মানবতাবিরোধী কর্মকা- চালিয়েছে। এই ঘটনা বারংবার ঘটার পেছনে রাজনৈতিক ইন্ধন থাকে বলে জনমনে অভিযোগ ও ক্ষোভ রয়েছে। পাশাপাশি রাষ্ট্রের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যর্থতা বা উদাসীনতাও এই ধরনের সহিংসতা বিস্তার লাভে বড় ভূমিকা রাখেন। এক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনও বিভিন্ন সময়ে তার সঠিক ভূমিকা পালন করতে পারেনি। এমন অভিযোগ বার বার সাধারণ নাগরিকদের কাছ থেকেই উঠে এসেছে।
বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে সংখালঘু সমপ্রদায়ের ওপর হামলা ও আক্রমণের চিত্র পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, সংখ্যালঘু নির্যাতনের অধিকাংশ সহিংস ঘটনাই সংগঠিত হয়েছে নির্বাচনকালে, তার আগে অথবা নির্বাচনের পর। স্বাধীনতা-উত্তরকালে সত্তর ও আশির দশকের বিভিন্ন নির্বাচনে সংখ্যালঘুদের হয়রানি-নির্যাতনের মতোই ১৯৯০ সালে যখন সামরিক স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে গণ-আন্দলন চলছিল তখনো অক্টোবর মাসে গণ-আন্দোলনকে বিপথগামী ও কলঙ্কিত করতে আক্রমণ করা হয় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে। ২০০১-এর জাতীয় সংসদের নির্বাচন পরবর্তী ভয়াবহ সহিংসতার শিকার হয় এদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, তখন সিরাজগঞ্জে, ভোলায় এবং অন্যান্য স্থানে সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ ও নির্যাতনের ঘটনায় নাগরিক সমাজ সোচ্চার হলেও নির্যাতনের শিকার পূর্ণিমা-সীমাদের ধর্ষণ পরবর্তী আহাজারি তদানীন্তন সরকার, প্রশাসন বা রাজনৈতিক মহলের আনেকেই শুনতে পাননি বা শোনার প্রয়োজনও বোধ করেননি। সে সময়ে দায়েরকৃত মামলাসমূহের তদন্ত রিপোর্ট আজও জনসম্মুখে প্রকাশ করা হয়নি।
২০১০ সালের মাননীয় হাইকোর্টের নির্দেশনায় গঠিত শাহাবুদ্দিন কমিশন ২০১২ সালে সরকারের কাছে সুপারিশ সংবলিত রিপোর্ট পেশ করলেও তা আজো আলোর মুখ দেখেনি। দেশের জনগণ জানতে পারলনা প্রকৃতপক্ষে নির্যাতনের তান্ডবের মধ্যে কি ঘটেছিল, কারা এর সাথে জড়িত ছিল। অপরাধীদের শনাক্ত করা হলো না, সুনির্দিষ্ট শাস্তি প্রদান তো দূরের ব্যাপার ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারির নির্বাচন পরবর্তী হামলার ঘটনাও সুবিদিত। নির্বাচনের আগে ও নির্বাচন পরবর্তী সময়ে খুবই পরিকল্পিতভাবে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা হয়েছে। নির্বাচনের দিন রাতেই যশোরের অভয়নগরে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা হয়েছে। পরদিন ৬ই জানুয়ারি ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, রংপুর, রাজশাহী, লালমনিরহাট, বগুড়া, চট্টগ্রামসহ নানা জায়গায় সংখ্যালঘু হিন্দু ও অন্যান্য প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ওপর হামলা হয়েছে। তাদের বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে লুটপাট চলেছে অবাধে। অগ্নিসংযোগ হয়েছে। ওইসব বাড়ির নারী-পুরুষ শিশুদের উপর নির্যাতন হয়েছে। তাদের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করার হুমকি দেয়া হয়েছে। তারা বিভিন্ন মন্দির, স্কুল কিংবা মুসলমান প্রতিবেশীর বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে প্রাণে বাঁচিয়েছেন। প্রশাসন নির্বাচনকালীন সময়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর এই আক্রমণরোধে বেশিরভাগ সময় সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে। নির্বাচন পরবর্তী এ সব সহিংসতার সুষ্ঠু কোন তদন্ত বা মামলার কোনো অগ্রগতি হয়নি। বিচারের মুখোমুখি জনগণকে বা ভুক্তভোগীদের তা জানানো হয়নি।
শুধু নির্বাচনকালীন সহিংসতা নয়, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতনের আরো একটি নতুন মাত্রা দেখতে পাওয়া যায় সাম্প্রতিক বাংলাদেশে। ফেসবুকে মিথ্যা স্ট্যাটাস দিয়ে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা হয়েছে এই অছিলায় সংখ্যালঘুদের বাড়ি ঘরে হামলা করা হয়। পাবনার সাঁথিয়া (২০১৩ সাল), কক্সবাজারের রামু (২০১২ সাল), ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরসহ (২০১৬ সাল) বহু স্থানে এমন সব ঘটনা ঘটেছে। সব ক্ষেত্রে একই ধরনের গল্প তৈরির প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়। রংপুরের গংগাচড়া ও সদর ইউনিয়নে একই ঘটনা ঘটেছে। ৬ই নভেম্বর, ২০১৭ তারিখে স্থানীয় মুদি ব্যবসায়ী রাজু মিঞা বাদী হয়ে আইসিটি অ্যাক্টে’র অধীনে টিটু রায়ের বিরুদ্ধে ধর্মীয় অবমাননার অভিযোগে গঙ্গাচড়া থানায় মামলা দায়ের করেন। ৭ই নভেম্বর, ২০১৭ তারিখে স্থানীয় পর্যায়ে একটি পূর্বপরিকল্পিত সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয় এবং হাজার হাজার লোক সেখান থেকে লাঠি, দা অন্যান্য অস্ত্রসহ টিটু রায়ের পরিবারসহ পার্শ্ববর্তী সংখ্যালঘুপাড়ায় ঢুকে ৩০টি বাড়িতে হামলা করে ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের তা-ব চালায়।
সবই ঘটে স্থানীয় জেলা প্রশাসন ও পুলিশ কর্তৃপক্ষের জ্ঞাতসারে। প্রতিটি ঘটনার সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো ব্যতিক্রমধর্মী কিছু প্রগতিশীল দল বাদে উগ্র সাম্প্রদায়িক দল-জনগোষ্ঠীসহ প্রায় সব প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলের স্থানীয় নেতাদের প্রত্যক্ষ মদতে কিংবা প্রশ্রয়ে এই হামলা চালানো হয়। শেষ পর্যন্ত যার নামে ফেসবুকে কথিত স্ট্যাটাস দেয়ার কথা বলা হয়, পুলিশ তাকেই গ্রেপ্তার করে জেল হাজতে পাঠিয়ে দেয়। এইসব ঘটনার তদন্ত কখনও শেষ হয় না। এ ধরনের ঘটনায় যাদের বিরুদ্ধে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়ার অভিযোগ, তারা নিরাপরাধী হয়েও বছরের পর বছর জেল খেটেছে কিংবা নিখোঁজ হয়েছেন। নাসিরনগরের রসরাজ এবং রামু’র উত্তম বড়ুয়ার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। রংপুরের টিটু রায়ের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। সংখ্যালঘুদের উপর এ ধরনের হামলা, নির্যাতনের ঘটনা পাকিস্তানি শাসনের ২৪ বছরেও চলেছে। তবে তার রূপ ছিল ভিন্ন। কখনো কখনো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাও মোকাবেলা করতে হয়েছে ওই সময়। স্বাধীন বাংলাদেশে দাঙ্গা হয় না, তবে সংখ্যালঘুদের হয়রানি নির্যাতন চলেছে অবাধে দিনের পর দিন। এর ফলাফল কি?
আমরা যদি আদমশুমারি’র দিকে তাকাই তবে দেখতে পাব, ১৯৫১ সালের আদমশুমারি অনুসারে বাংলাদেশ ভূখ-ে শতকরা ২৮ ভাগ মানুষ ছিলেন সংখ্যালঘু তথা হিন্দু সম্প্রদায়ের। কিন্তু তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের সাম্প্রদায়িক বৈষম্যপূর্ণ আচরণের কারণে এবং মুসলিম লীগ শাসিত পূর্ব বাংলায় সাম্প্রদায়িক প্রচার, উত্তেজনা ও দাঙ্গা ইত্যাদির ফলে ভীতসন্ত্রস্ত সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক দেশ ছেড়ে ভারত চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন।
যার প্রমাণ ১৯৬১ সালের আদমশুমারি। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর শত্রু সম্পত্তি আইনের নামে যে নির্যাতনের নতুন হাতিয়ার তুলে দেয়া হলো ভূমি প্রশাসন ও দুর্বৃত্তদের হাতে, তার ফলে দেয়া যায় দেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের সংখ্যা ষাটের দশকে শতকরা ১৮.৫ ভাগে নেমে এসেছে। মহান মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর অর্পিত সম্পত্তি আইনসহ বিভিন্ন ধরনের নির্যাতনের কারণে, কখনও নির্বাচন কেন্দ্রিক অথবা অন্য কোন অজুহাতে এই নির্যাতনের ধারা অব্যাহত থাকে। ১৯৭৪ সালের আদমশুমারি অনুসারে এদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক ছিল শতকরা ১৩.৫ ভাগ যা ১৯৮১ সালে এসে দাঁড়ায় ১২.১৩ ভাগ এবং ২০০১ সালের আদমশুমারি অনুসারে তা ছিল ৯.৫ ভাগ। সর্বশেষ ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুসারে তা হলো শতকরা মাত্র ৮ ভাগ। বিশিষ্ট গবেষক ড. আবুল বারাকাতের গবেষণা মতে এভাবে চলতে থাকলে আগামী ২০ বছরের মধ্যে বাংলাদেশে আর কোনো হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক থাকবে না। এ অবস্থা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। এদেশের ভাষার সংগ্রাম, স্বাধিকার, গণতন্ত্র কিংবা মহা মুক্তিযুদ্ধ-প্রতিটি ক্ষেত্রেই উজ্জ্বল অবদান রেখেছেন, সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছেন আমাদের দেশের ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে।
নিরপেক্ষভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগ করা তাদের অপরাধ নয়। তবু তাদের ভোটের আগে-পরে এবং ভোটের সময় কেন নির্যাতনের মুখোমুখি হতে হবে? সংখ্যালঘুরা কোন ভরসায় আমাদের পাশে বসবাস করবে, যদি আমরা হিংস্র থাবার মুখে দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও অদিবাসী, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার মুখোমুখি হওয়ার সংস্কৃতি থেকে সুরক্ষা দিতে না পারি? এই দায় যেমন রাজনৈতিক দলগুলো এড়াতে পারে না তেমনি রাষ্ট্র তথা নির্বাচনকালীন সরকারও এ দায় থেকে রেহাই পেতে পারে না। নাগরিক সমাজও তাদের দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারে না। নির্বাচন কমিশনের তো এই ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি দায়িত্ব নেবার কথা। কারণ রাষ্ট্রের যে কোন নাগরিকের ভয়-ডরহীনভাবে ভোট প্রদানের পরিবেশ নিশ্চিত করার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনেরই।
আজকের এই গোলটেবিল আলোচনা সভায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের গুরুত্বপূর্ণ সম্মানীয় ব্যক্তিবর্গ, সুশীল সমাজের নেতৃবৃন্দও অন্যান্য পেশার প্রতিনিধিগণ উপস্থিত আছেন। আমরা এই গোলটেবিল আলোচনা সভা থেকে বলতে চাই, সংখ্যালঘুদের উপর নির্বাচনকেন্দ্রিক সহিংসতার যে ধারাবাহিকতা চলে এসেছে তা জাতির জন্য অত্যন্ত লজ্জাজনক। এ লজ্জাজনক কলঙ্কের অবসান চাই। যেহেতু এখানে রাজনৈতিক দলসমূহের নেতৃবর্গ ও বিশিষ্টজনেরা উপস্থিত আছেন তাই তাদের কাছে আমরা আমাদের প্রত্যাশা ও দাবির কথা জানাতে চাই। ইতিমধ্যে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে যে সকল দাবি রাজনৈতিক দলসমূহের কাছে উত্থাপন করা হয়েছে তার প্রতি যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে তা পূরণের লক্ষ্যে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের প্রতিশ্রুতি তারা দেবেন সেই আশা আমরা করি। আমরা আরো আশা করি সকল গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর নির্বাচনকালীন বা পরবর্তীতে সহিংসা আক্রমণ প্রতিরোধে তাদের অঙ্গীকার নির্বাচনী ইশতেহারে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গীকার হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করবে।
তাদের কাছে আমাদের সবিনয় নিবেদন, নির্বাচন পরবর্তীতে আপনাদের অবস্থান সরকারি দলেই হোক কিংবা বিরোধী দলে সংখ্যালঘুদের উপর সহিংসতা প্রতিরোধে আমরা আপনাদের সুদৃঢ় ভূমিকা দেখতে চাই। কারণ এই সহিংসতার দায় ক্ষমতাসীন দলের উপর যেমন বর্তাবে, তেমনি বিরোধী দলও তা এড়াতে পারবে না। পাশাপাশি সুধী সমাজ বা নাগরিক সমাজের ব্যক্তিবর্গও এ দায় এড়িয়ে নিজেদের সভ্য বা দায়িত্বশীল বলে দাবি করতে পারেন না। সকল ধর্ম, সম্প্রদায় ও জাতিগত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর সামাজিক-রাজনৈতিক নিরাপত্তা, সম মর্যাদা ও নাগরিক অধিকারের সুরক্ষা যেমন রাষ্ট্রকে দিতে হবে, সকল দায়িত্বশীল রাজনৈতিক দলকে তা নিশ্চিত করতে হবে। তেমনি এক্ষেত্রে সকল পর্যায়ে দলমত-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে নাগরিকদেরও অবশ্যপালনীয় কর্তব্য যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে পালন করতে হবে। সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার সমস্যা শুধুমাত্র সংখ্যালঘুদের সমস্যা নয়। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় সমস্যা। তাই একে অবশ্যই সকলে মিলে অগ্রাধিকারের তালিকায় রেখে-এর টেকসই সম্মানজনক সমাধান সুনিশ্চিত করতে হবে। সে লক্ষ্যে আমরা মূল সমস্যার প্রতি দৃষ্টিপাত করার পাশাপাশি কতিপয় জরুরি সুপারিশও সকলের বিবেচনার জন্য তুলে ধরছি।
১. নির্বাচন পূর্ব ও পরবর্তী সময়ে সংখ্যালঘু বিরোধী সহিংসতা প্রতিরোধে রাষ্ট্র তথা পুলিশ প্রশাসনকে আগাম ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। প্রয়োজনে বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন করে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
২. ইতিপূর্বে নির্বাচনকালীন যে সকল সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে তার সুষ্ঠু, স্বচ্ছ ও দ্রুত তদন্ত সম্পন্ন করে দোষী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। ক্ষতিগ্রস্তদের পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
৩. সকল রাজনৈতিক দলকে অঙ্গীকার করতে হবে, যে সকল নেতার বিরুদ্ধে সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে কোন রাজনৈতিক দল তাদের আসন্ন নির্বাচনে মনোনয়নতো দেবেই না, দলের কোনো পদেও তাদের স্থান দেয়া চলবে না।
৪. নির্বাচনে ধর্ম ও সম্প্রদায়িকতার ব্যবহার নিষিদ্ধ করতে হবে এবং মন্দির-মসজিদ-গির্জা প্যাগোডাসহ সকল ধর্মীয় উপাসনালয়কে নির্বাচনী কর্মকা-ের বাইরে রাখতে হবে।
৫. সকল দলের নির্বাচনী ইশতেহারে সংখ্যালঘুদের নাগরিক স্বার্থ ও নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে সুস্পষ্ট অঙ্গীকার ব্যক্ত করতে হবে। যাতে কোনো দলই নির্বাচন পূর্ব বা পরবর্তী সময়ে সংখ্যালঘু নির্যাতনের কোন ঘটনার সাথে প্রত্যক্ষ, পরোক্ষ কোনভাবেই সম্পৃক্ত না হয় তার জন্য মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের সতর্ক থাকতে নির্দেশনা দিতে হবে।
৬. সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে প্রশাসনের উদ্যোগে সকল জেলা-উপজেলা পর্যায়ে রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে একটি মনিটরিং কমিটি গঠন করতে হবে এবং এই কমিটি সংখ্যালঘু নিরাপত্তার বিষয়ে সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণের পাশাপাশি দ্রুত যে কোন স্থানে প্রশাসনের সহায়তায় উপস্থিত হয়ে জরুরি পদক্ষেপ নিশ্চিত করবে।
৭. নির্বাচনী প্রচারণায় সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষমূলক যে কোন প্রচারণা করা থেকে সব দলকে বিরত থাকতে হবে এবং নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসনকে এই নির্বাচনী বিধি মেনে চলার বিষয়টি কঠোরভাবে তদারকি ও নিশ্চিত করবে।
৮. ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার অছিলায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর অত্যাচার, নির্যাতনের সকল ঘটনার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত করে দোষীদের কঠোর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। ভবিষ্যতে আইনের সংস্কার করতে হবে। যারা উস্কানিমূলক কর্মকা- চালাতে ভুয়া ফেসবুক আইডি খুলে অন্যদের উপর দায় চাপায় তাদের দ্রুত শনাক্ত করে কঠোরতম শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। উস্কানি দেয়া সকল ভুয়া অনলাইন আইডি শনাক্ত করে তা বন্ধ করতে হবে। এ ব্যাপারে জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে গণমাধ্যমে নিয়মিত প্রচার চালাতে হবে যাতে সাধারণ মানুষ তাদের ভ্রান্ত উদ্দেশ্যমূলক প্রচারে প্রভাবিত না হয়।
৯. ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর দাবিমতো ‘সংখ্যালঘু কমিশন’ গঠন করতে হবে, যাতে সংখ্যালঘু নির্যাতনের কোন ঘটনা সংগঠিত হলে এ কমিশনতা স্বাধীনভাবে তদন্ত করে তা প্রতিকারের যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। একই সাথে সংখ্যালঘুদের সুরক্ষায় বিশেষ আইন প্রণয়ন ও পৃথক মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
১০. সকল ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার মাধ্যমে সংখ্যালঘু নির্যাতন প্রতিরোধে ব্যাপক জনসচেতনা তৈরির জন্য গণমাধ্যম কর্তৃপক্ষের সহযোগিতায় প্রচার কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে।
[১৭ নভেম্বর, ২০১৮ তারিখে নাগরিক সমাজ আয়োজিত এবং তোপখানা রোডের সিরডাপ মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত গোলটেবিল আলোচনায় উপস্থাপিত]
No comments