খালেদা জিয়া ঘরে ফিরেছেন, ‘ওঁরা’ ফিরবেন না by নূহ-উল-আলম লেনিন
‘হাসিনা
সরকারকে ক্ষমতা থেকে বিদায় না করে আমি আর ঘরে ফিরব না।’ হাসিনা সরকার
বিদায় নেয়নি। কিন্তু তিনি ঘরে ফিরেছেন। ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা ছিল, ধনুর্ভঙ্গপণ
করেছিলেন বেগম খালেদা জিয়া। ধনুক ভাঙেনি, ভেঙেছেন প্রতিজ্ঞা। তিনি
হারেননি, হেরেছে অশুভ বুদ্ধি। তিনি শুভাশুভ, ভালো-মন্দ জ্ঞান হারিয়েছিলেন।
তিনি অশুভ শক্তির ওপর ভর করেছিলেন। তারা তাঁকে লঙ্কা জয়ের প্ররোচনা
দিয়েছে; তিনি সেই প্ররোচনার ফাঁদে পা দিয়েছিলেন। অশুভ শক্তির এই
প্ররোচনার ফাঁদ ভেঙে তিনি যদি অন্ধকার গলি-ঘুপচি বাদ দিয়ে রাজনীতির
আলোকোজ্জ্বল মহাসড়কে ফিরে থাকেন, তাহলে তাঁকে পরাজিত বলব কেন? আমি বলব,
সত্যিই যদি তিনি অন্ধকারের শক্তির রাহুগ্রাস থেকে নিজেকে বের করে নিয়ে আসতে
পারেন, তাহলে আত্মঘাতিনী হওয়ার ‘পাপ’ থেকে রক্ষা পেয়েছেন।
দীর্ঘ তিন মাসের ভয়ভীতি, আতঙ্ক ও অস্বাভাবিক পরিবেশের অবসান শেষে বাংলাদেশ এখন নির্বাচনী যুদ্ধে মাতোয়ারা। সারা দেশ না হোক, রাজধানী ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হয়েছে উৎসবমুখর পরিবেশ। নির্দলীয় ভিত্তিতে হলেও এসব নির্বাচনে শাসক দল আওয়ামী লীগ, বিরোধী দল বিএনপি, জাতীয় পার্টি এবং সিপিবি-বাসদের মতো ক্ষুদ্র বাম দলগুলোর সমর্থিত প্রার্থীরা অংশ নিয়েছেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো হরতাল-অবরোধের মতো চরমপন্থা বাদ দিয়ে বিএনপি সুস্থ গণতান্ত্রিক ধারায় সাংবিধানিক নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির ধারায় ফিরে এসেছে। বিএনপির প্রার্থীরা নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। ২০১৪ সালের নির্বাচনেও যদি তাঁরা অংশ নিতেন, তাহলে বাংলাদেশের রাজনীতির দৃশ্যপট হয়তো ভিন্নতর হতে পারত। ‘সংলাপ সংলাপ’ বলে রাস্তায় চিৎকার না করে জাতীয় সংসদই হতে পারত গণতন্ত্র ও বহুমতচর্চার প্রাণকেন্দ্র। যা হোক, নিঃসন্দেহে এবারের করপোরেশন নির্বাচন সুস্থ গণতান্ত্রিক বিকাশের চমৎকার সুযোগ সৃষ্টি করেছে। দেশবাসীর প্রত্যাশা, কোনো অজুহাতে বিএনপি বা অন্য কোনো পক্ষ নির্বাচনী প্রক্রিয়া থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেবে না। নির্বাচনে হার-জিত আছে। হার-জিতের সম্ভাবনাকে মেনে নিয়েই চ্যালেঞ্জ নিতে হবে। শুনেছি খালেদা জিয়া নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নেবেন। আমরা তাঁকে স্বাগত জানাব। জনগণকে সম্পৃক্ত করার এবং লক্ষ্য অর্জনের এটাই যথার্থ পথ। সন্ত্রাস ও গণবিচ্ছিন্ন অপরাজনীতির পথ থেকে ফিরে এসে, আবার গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে নিজেকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার এই সুযোগ তিনি নষ্ট করবেন না বলেই সবার প্রত্যাশা।
টানা ৯০ দিন খালেদা জিয়া যে পথ অনুসরণ করেছেন, সেটা ছিল রাজনৈতিক আত্মহত্যার পথ। এবার অবাস্তব প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ না করলে, কল্যাণবোধের সঙ্গে ‘আপস’ না করলে তো তাঁর রাজনৈতিক অপমৃত্যু হতো। বেগম জিয়া পুত্রশোক, আন্দোলনে ব্যর্থতার গ্লানি এবং প্রতিজ্ঞাভঙ্গের বেদনাবোধ নিয়ে ঘরে ফিরেছেন। তবু আমরা তাঁকে স্বাগত জানাই।
কিন্তু যাঁরা ঘরে ফেরেননি, আর কোনো দিন ঘরে ফিরবেন না, তাঁদের ঘরের মানুষদের বেগম জিয়া কী জবাব দেবেন? তাঁর ছোট ছেলের অকালমৃত্যু হয়েছে, অপমৃত্যু নয়। বুকে পাষাণ বেঁধে কী অসীম ধৈর্য নিয়ে তিনি পুত্রশোকেও ভেঙে পড়েননি; রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের আন্দোলন থেকে একচুল সরে আসেননি। কিন্তু ৯০ দিনে যে ১৩৮ জন মা সন্তান হারালেন, ক্ষমতার লড়াইয়ের বলি হলেন, খালেদা জিয়া তাঁদের কী সান্ত্বনা দেবেন? সাংবিধানিক ধারায় রাজনীতি করলে বেগম জিয়া আবার হয়তো দেশের প্রধানমন্ত্রীর পদ ফিরে পাবেন। কিন্তু এই ১৩৮টি পরিবার কী পাবে? মৃত্যুর ওপার থেকে তাদের স্বজনদের কাউকে তো তিনি ফিরিয়ে দিতে পারবেন না।
খালেদা জিয়াকে এখন গভীরভাবে ভাবতে হবে, যে পথে তিনি হেঁটেছেন, সে পথ সঠিক ছিল কি না। জনগণকে সম্পৃক্ত করে পরীক্ষিত গণ-আন্দোলনের পথ পরিহার করে অশুভ শক্তিকে লেলিয়ে দিয়ে চোরাগোপ্তা হামলা, পেট্রলবোমা, ককটেল, অগ্নিসংযোগ ও গোলাগুলি করে ১৩৮ জনকে হত্যা, ৩৫০ জনকে অগ্নিদগ্ধ ও ১ হাজার ৫০০ জনকে গুরুতরভাবে আহত করে তাঁর কী লাভ হলো? সম্ভবত ২০১৩ সালে বগুড়ার এক জনসমাবেশে বেগম জিয়া বলেছিলেন, আন্দোলনের জন্য রক্ত দিতে হবে। মানুষ তো রক্ত দিল, কিন্তু তাতে দেশের কী লাভ হলো? সত্য বটে বাংলাদেশের অতীতের অনেক গণ-আন্দোলনে অনেক মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছে। আত্মদান ছাড়া কোনো মহৎ অর্জন হয়নি। তবে কোনো গণ-আন্দোলনেই এত মানুষ নিহত হয়নি। চোরাগোপ্তা হামলা, পেট্রলবোমা মেরে বাসযাত্রী, ট্রেনযাত্রী হত্যা অথবা নাশকতা তো গণ-আন্দোলনের পথ নয়। এটা নিছক সন্ত্রাস। বস্তুত গত ৯০ দিনে তো কোনো গণ-আন্দোলন হয়নি। বিএনপি ও ২০-দলীয় নেতা-কর্মীরা কেউ রাজপথে নামেননি। মানুষ হরতাল-অবরোধে সাড়া দেয়নি।
দেশের প্রধান বণিক সভা এফবিসিসিআই হরতালে ৮১ দিনের অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতির একটা খতিয়ান দিয়েছে। এতে দেখা যাচ্ছে, হরতাল-অবরোধের জন্য দৈনিক ক্ষতির পরিমাণ ২ হাজার ২৭৭ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। এ হিসাবে ৯০ দিনে মোট ক্ষতির পরিমাণ ২ লাখ ৫ হাজার কোটি টাকা। আবার গবেষণাপ্রতিষ্ঠান, সিপিডির হিসাবে উৎপাদনের ক্ষতি ৪ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। পোশাকশিল্পের ক্ষতি ১ হাজার ৩১৮ কোটি টাকা। কৃষি খাতে ক্ষতি ৩৯৮ কোটি টাকা। পোলট্রি খাতে ক্ষতি ৬০৬ কোটি টাকা। চিংড়ি খাতে ৭৪১ কোটি টাকা। পরিবহন খাতে ক্ষতির পরিমাণ ৭৪৪ কোটি টাকা, পর্যটনে ৮২৫ কোটি, ব্যাংক-বিমায় ১৫৬ কোটি এবং ক্ষুদ্র ও পাইকারি ব্যবসায় ক্ষতির পরিমাণ ৪৪৮ কোটি টাকা। অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে আমাদের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের। শিক্ষাবর্ষের শুরুতেই স্কুলগুলো বন্ধ ছিল প্রায় আড়াই মাস। ৩৯ দিনে সমাপ্য মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হয়েছে ৫৭ দিনে।
বেগম জিয়াকে আমি বলব, নিজ গৃহে স্থিত হয়ে, শান্ত হয়ে ভেবে দেখুন তো এত প্রাণহানি, জাতীয় অর্থনীতির বিপুল ক্ষতি ও শিক্ষাজীবন বিপর্যস্ত করে তিনি কী পেলেন? নিজের নাক কাটা গেল বটে, কিন্তু পরের যাত্রা ভঙ্গ তো করা গেল না।
বেগম জিয়া প্রথম থেকেই ভুল করেছেন। প্রথম ভুল জামায়াতের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধা। তিনি তরুণ সমাজের মনস্তত্ত্ব বুঝতে পারেননি। ২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে যখন বিপুল গণজাগরণ সৃষ্টি হয়েছে, আন্দোলিত হয়েছে বিএনপি-সমর্থক তরুণ ও জনগোষ্ঠী; যখন দলের ভেতর থেকেই জামায়াতের সংস্পর্শ ত্যাগ করার চাপ সৃষ্টি হয়েছে, তখনো খালেদা জিয়া জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ না করার প্রশ্নে অটল ছিলেন। আইনজীবী রফিক–উল হক যথার্থই বলেছেন, বিএনপি জামায়াতকে ছাড়লেই অর্ধেক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।
খালেদা জিয়ার দ্বিতীয় ভুল ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ না নেওয়া। খালেদা জিয়া বলেছেন, ৫ জানুয়ারির পর আন্দোলন মুলতবি রেখে তিনি ভুল করেছেন। আমরা বলব, অংশ না নেওয়াটাই ছিল বড় ভুল। বিএনপির কোনো কোনো উপদেষ্টা ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলেছেন, শেখ হাসিনা বা আওয়ামী লীগ চায়নি ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিএনপি ও ২০-দলীয় জোট অংশ নিক। বেশ তো, এটা যদি বুঝেই থাকেন, তাহলে পাল্টা চাল হিসেবে যেকোনোভাবে নির্বাচনে অংশ নিয়ে আওয়ামী লীগের কৌশল বানচাল করলেন না কেন? তখন বলেছেন, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া, শেখ হাসিনার অধীনে কোনো নির্বাচনে বিএনপি জোট অংশ নেবে না। এখন কী বলছেন? বিএনপির থিঙ্কট্যাংক এবং এ যাত্রায় ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ ১২ এপ্রিল প্রথম আলোয় দেওয়া সাক্ষাৎকারে যা বলেছেন, তার নির্গলিতার্থ এবং নির্বাচনকালে দেওয়া শেখ হাসিনার প্রস্তাবের মধ্যে তো মৌলিক কোনো পার্থক্য দেখছি না।
শেখ হাসিনার কৌশল থেকেই তিনি শিক্ষা নিতে পারতেন। ২০০৬ সালে খালেদা জিয়ার পরামর্শে তাঁরই বশংবদ রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন নিজেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান বলে একতরফা ঘোষণা দেন। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহাজোট সাংবিধানিক সংকট ও সংঘাত এড়াতে ইয়াজউদ্দিনকে মেনে নেয়। সে সময় শেখ হাসিনা গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমরা রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিনকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে তাঁর নিরপেক্ষতা প্রমাণের সুযোগ দিতে চাই।’ ইয়াজউদ্দিনের অধীনেই নির্বাচনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করে এনেছিল আওয়ামী লীগ ও মহাজোট। কিন্তু ইয়াজউদ্দিন তাঁর নিরপেক্ষতা প্রমাণে ব্যর্থ হন। ফলে কয়েকজন উপদেষ্টা পদত্যাগ করেন। দেশবাসীও ইয়াজউদ্দিনের ওপর আস্থা হারায়। শেষ পর্যন্ত মহাজোট ইয়াজউদ্দিনের অধীনে নির্বাচন না করার ঘোষণা দেয়। পরের ইতিহাস সবার জানা।
প্রসঙ্গত আরেকটি অভিজ্ঞতার কথা বলি, ১৯৭২ সালে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার নির্বাচনে কংগ্রেসের কাছে বামফ্রন্ট পরাজিত হয়। বামফ্রন্ট নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি ও জোর-জবরদস্তির অভিযোগ উত্থাপন করে। স্বয়ং জ্যোতি বসুকে পর্যন্ত জিততে দেওয়া হয়নি। নির্বাচনের পর বামফ্রন্ট শপথ না নিয়ে বিধানসভা বয়কট করে। চরম নির্যাতন ও দমন-পীড়নের মধ্যেও তারা গণ-আন্দোলনের পথে অনড় থাকে। তারা নকশালদের সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ডের প্ররোচনার ফাঁদে পা দেয়নি, তেমনি কংগ্রেসের মোকাবিলায় কোনো সহিংস সন্ত্রাসের পথও গ্রহণ করেনি। ফলে দীর্ঘ গণ-আন্দোলন পটভূমিতে ১৯৭৭ সালের নির্বাচনে বামফ্রন্ট নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করে।
এত সব অভিজ্ঞতা ও শিক্ষা থাকা সত্ত্বেও বেগম জিয়া গণ-আন্দোলনের পথ পরিহার করে সন্ত্রাসের পথ গ্রহণ করলেন কেন? তিনি চেয়েছিলেন অব্যাহত সন্ত্রাস, হত্যাকাণ্ড, জ্বালাও-পোড়াও করে দেশে এমন একটা অস্থিতিশীল ও অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করবেন, যার সুবাদে সেনাবাহিনী হস্তক্ষেপ করবে। অসাংবিধানিক পন্থায় ক্ষমতার পালাবদল হবে। অশুভ শক্তি সম্ভবত এটাই তাঁকে বুঝিয়েছিল। তিনি ভুলে গেছেন, এটা সত্তর বা আশির দশক নয়। আমাদের সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি যে বদলে গেছে, দেশবাসী যে আর পাকিস্তানি ধারায় প্রত্যাবর্তন করবে না—এই সত্যটুকু তাঁকে উপলব্ধি করতে হবে। পলাতক পুত্র তারেকের হিংসাশ্রয়ী সন্ত্রাসের পথ পরিহার করতে হবে। জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ করে দলকে নতুন প্রজন্মের জন্য উন্মুক্ত করে দিতে হবে। সর্বোপরি বেগম জিয়াকে সাংবিধানিক ধারায়, অহিংস ও জনসম্পৃক্ত রাজনীতির পথে ফিরে আসতে হবে। সব দলের অংশগ্রহণে অবাধ নিরপেক্ষ আরেকটি নির্বাচনের জন্য তাঁকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
নূহ-উল-আলম লেনিন: বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য।
দীর্ঘ তিন মাসের ভয়ভীতি, আতঙ্ক ও অস্বাভাবিক পরিবেশের অবসান শেষে বাংলাদেশ এখন নির্বাচনী যুদ্ধে মাতোয়ারা। সারা দেশ না হোক, রাজধানী ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হয়েছে উৎসবমুখর পরিবেশ। নির্দলীয় ভিত্তিতে হলেও এসব নির্বাচনে শাসক দল আওয়ামী লীগ, বিরোধী দল বিএনপি, জাতীয় পার্টি এবং সিপিবি-বাসদের মতো ক্ষুদ্র বাম দলগুলোর সমর্থিত প্রার্থীরা অংশ নিয়েছেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো হরতাল-অবরোধের মতো চরমপন্থা বাদ দিয়ে বিএনপি সুস্থ গণতান্ত্রিক ধারায় সাংবিধানিক নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির ধারায় ফিরে এসেছে। বিএনপির প্রার্থীরা নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। ২০১৪ সালের নির্বাচনেও যদি তাঁরা অংশ নিতেন, তাহলে বাংলাদেশের রাজনীতির দৃশ্যপট হয়তো ভিন্নতর হতে পারত। ‘সংলাপ সংলাপ’ বলে রাস্তায় চিৎকার না করে জাতীয় সংসদই হতে পারত গণতন্ত্র ও বহুমতচর্চার প্রাণকেন্দ্র। যা হোক, নিঃসন্দেহে এবারের করপোরেশন নির্বাচন সুস্থ গণতান্ত্রিক বিকাশের চমৎকার সুযোগ সৃষ্টি করেছে। দেশবাসীর প্রত্যাশা, কোনো অজুহাতে বিএনপি বা অন্য কোনো পক্ষ নির্বাচনী প্রক্রিয়া থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেবে না। নির্বাচনে হার-জিত আছে। হার-জিতের সম্ভাবনাকে মেনে নিয়েই চ্যালেঞ্জ নিতে হবে। শুনেছি খালেদা জিয়া নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নেবেন। আমরা তাঁকে স্বাগত জানাব। জনগণকে সম্পৃক্ত করার এবং লক্ষ্য অর্জনের এটাই যথার্থ পথ। সন্ত্রাস ও গণবিচ্ছিন্ন অপরাজনীতির পথ থেকে ফিরে এসে, আবার গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে নিজেকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার এই সুযোগ তিনি নষ্ট করবেন না বলেই সবার প্রত্যাশা।
টানা ৯০ দিন খালেদা জিয়া যে পথ অনুসরণ করেছেন, সেটা ছিল রাজনৈতিক আত্মহত্যার পথ। এবার অবাস্তব প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ না করলে, কল্যাণবোধের সঙ্গে ‘আপস’ না করলে তো তাঁর রাজনৈতিক অপমৃত্যু হতো। বেগম জিয়া পুত্রশোক, আন্দোলনে ব্যর্থতার গ্লানি এবং প্রতিজ্ঞাভঙ্গের বেদনাবোধ নিয়ে ঘরে ফিরেছেন। তবু আমরা তাঁকে স্বাগত জানাই।
কিন্তু যাঁরা ঘরে ফেরেননি, আর কোনো দিন ঘরে ফিরবেন না, তাঁদের ঘরের মানুষদের বেগম জিয়া কী জবাব দেবেন? তাঁর ছোট ছেলের অকালমৃত্যু হয়েছে, অপমৃত্যু নয়। বুকে পাষাণ বেঁধে কী অসীম ধৈর্য নিয়ে তিনি পুত্রশোকেও ভেঙে পড়েননি; রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের আন্দোলন থেকে একচুল সরে আসেননি। কিন্তু ৯০ দিনে যে ১৩৮ জন মা সন্তান হারালেন, ক্ষমতার লড়াইয়ের বলি হলেন, খালেদা জিয়া তাঁদের কী সান্ত্বনা দেবেন? সাংবিধানিক ধারায় রাজনীতি করলে বেগম জিয়া আবার হয়তো দেশের প্রধানমন্ত্রীর পদ ফিরে পাবেন। কিন্তু এই ১৩৮টি পরিবার কী পাবে? মৃত্যুর ওপার থেকে তাদের স্বজনদের কাউকে তো তিনি ফিরিয়ে দিতে পারবেন না।
খালেদা জিয়াকে এখন গভীরভাবে ভাবতে হবে, যে পথে তিনি হেঁটেছেন, সে পথ সঠিক ছিল কি না। জনগণকে সম্পৃক্ত করে পরীক্ষিত গণ-আন্দোলনের পথ পরিহার করে অশুভ শক্তিকে লেলিয়ে দিয়ে চোরাগোপ্তা হামলা, পেট্রলবোমা, ককটেল, অগ্নিসংযোগ ও গোলাগুলি করে ১৩৮ জনকে হত্যা, ৩৫০ জনকে অগ্নিদগ্ধ ও ১ হাজার ৫০০ জনকে গুরুতরভাবে আহত করে তাঁর কী লাভ হলো? সম্ভবত ২০১৩ সালে বগুড়ার এক জনসমাবেশে বেগম জিয়া বলেছিলেন, আন্দোলনের জন্য রক্ত দিতে হবে। মানুষ তো রক্ত দিল, কিন্তু তাতে দেশের কী লাভ হলো? সত্য বটে বাংলাদেশের অতীতের অনেক গণ-আন্দোলনে অনেক মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছে। আত্মদান ছাড়া কোনো মহৎ অর্জন হয়নি। তবে কোনো গণ-আন্দোলনেই এত মানুষ নিহত হয়নি। চোরাগোপ্তা হামলা, পেট্রলবোমা মেরে বাসযাত্রী, ট্রেনযাত্রী হত্যা অথবা নাশকতা তো গণ-আন্দোলনের পথ নয়। এটা নিছক সন্ত্রাস। বস্তুত গত ৯০ দিনে তো কোনো গণ-আন্দোলন হয়নি। বিএনপি ও ২০-দলীয় নেতা-কর্মীরা কেউ রাজপথে নামেননি। মানুষ হরতাল-অবরোধে সাড়া দেয়নি।
দেশের প্রধান বণিক সভা এফবিসিসিআই হরতালে ৮১ দিনের অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতির একটা খতিয়ান দিয়েছে। এতে দেখা যাচ্ছে, হরতাল-অবরোধের জন্য দৈনিক ক্ষতির পরিমাণ ২ হাজার ২৭৭ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। এ হিসাবে ৯০ দিনে মোট ক্ষতির পরিমাণ ২ লাখ ৫ হাজার কোটি টাকা। আবার গবেষণাপ্রতিষ্ঠান, সিপিডির হিসাবে উৎপাদনের ক্ষতি ৪ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। পোশাকশিল্পের ক্ষতি ১ হাজার ৩১৮ কোটি টাকা। কৃষি খাতে ক্ষতি ৩৯৮ কোটি টাকা। পোলট্রি খাতে ক্ষতি ৬০৬ কোটি টাকা। চিংড়ি খাতে ৭৪১ কোটি টাকা। পরিবহন খাতে ক্ষতির পরিমাণ ৭৪৪ কোটি টাকা, পর্যটনে ৮২৫ কোটি, ব্যাংক-বিমায় ১৫৬ কোটি এবং ক্ষুদ্র ও পাইকারি ব্যবসায় ক্ষতির পরিমাণ ৪৪৮ কোটি টাকা। অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে আমাদের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের। শিক্ষাবর্ষের শুরুতেই স্কুলগুলো বন্ধ ছিল প্রায় আড়াই মাস। ৩৯ দিনে সমাপ্য মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হয়েছে ৫৭ দিনে।
বেগম জিয়াকে আমি বলব, নিজ গৃহে স্থিত হয়ে, শান্ত হয়ে ভেবে দেখুন তো এত প্রাণহানি, জাতীয় অর্থনীতির বিপুল ক্ষতি ও শিক্ষাজীবন বিপর্যস্ত করে তিনি কী পেলেন? নিজের নাক কাটা গেল বটে, কিন্তু পরের যাত্রা ভঙ্গ তো করা গেল না।
বেগম জিয়া প্রথম থেকেই ভুল করেছেন। প্রথম ভুল জামায়াতের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধা। তিনি তরুণ সমাজের মনস্তত্ত্ব বুঝতে পারেননি। ২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে যখন বিপুল গণজাগরণ সৃষ্টি হয়েছে, আন্দোলিত হয়েছে বিএনপি-সমর্থক তরুণ ও জনগোষ্ঠী; যখন দলের ভেতর থেকেই জামায়াতের সংস্পর্শ ত্যাগ করার চাপ সৃষ্টি হয়েছে, তখনো খালেদা জিয়া জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ না করার প্রশ্নে অটল ছিলেন। আইনজীবী রফিক–উল হক যথার্থই বলেছেন, বিএনপি জামায়াতকে ছাড়লেই অর্ধেক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।
খালেদা জিয়ার দ্বিতীয় ভুল ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ না নেওয়া। খালেদা জিয়া বলেছেন, ৫ জানুয়ারির পর আন্দোলন মুলতবি রেখে তিনি ভুল করেছেন। আমরা বলব, অংশ না নেওয়াটাই ছিল বড় ভুল। বিএনপির কোনো কোনো উপদেষ্টা ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলেছেন, শেখ হাসিনা বা আওয়ামী লীগ চায়নি ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিএনপি ও ২০-দলীয় জোট অংশ নিক। বেশ তো, এটা যদি বুঝেই থাকেন, তাহলে পাল্টা চাল হিসেবে যেকোনোভাবে নির্বাচনে অংশ নিয়ে আওয়ামী লীগের কৌশল বানচাল করলেন না কেন? তখন বলেছেন, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া, শেখ হাসিনার অধীনে কোনো নির্বাচনে বিএনপি জোট অংশ নেবে না। এখন কী বলছেন? বিএনপির থিঙ্কট্যাংক এবং এ যাত্রায় ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ ১২ এপ্রিল প্রথম আলোয় দেওয়া সাক্ষাৎকারে যা বলেছেন, তার নির্গলিতার্থ এবং নির্বাচনকালে দেওয়া শেখ হাসিনার প্রস্তাবের মধ্যে তো মৌলিক কোনো পার্থক্য দেখছি না।
শেখ হাসিনার কৌশল থেকেই তিনি শিক্ষা নিতে পারতেন। ২০০৬ সালে খালেদা জিয়ার পরামর্শে তাঁরই বশংবদ রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন নিজেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান বলে একতরফা ঘোষণা দেন। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহাজোট সাংবিধানিক সংকট ও সংঘাত এড়াতে ইয়াজউদ্দিনকে মেনে নেয়। সে সময় শেখ হাসিনা গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমরা রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিনকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে তাঁর নিরপেক্ষতা প্রমাণের সুযোগ দিতে চাই।’ ইয়াজউদ্দিনের অধীনেই নির্বাচনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করে এনেছিল আওয়ামী লীগ ও মহাজোট। কিন্তু ইয়াজউদ্দিন তাঁর নিরপেক্ষতা প্রমাণে ব্যর্থ হন। ফলে কয়েকজন উপদেষ্টা পদত্যাগ করেন। দেশবাসীও ইয়াজউদ্দিনের ওপর আস্থা হারায়। শেষ পর্যন্ত মহাজোট ইয়াজউদ্দিনের অধীনে নির্বাচন না করার ঘোষণা দেয়। পরের ইতিহাস সবার জানা।
প্রসঙ্গত আরেকটি অভিজ্ঞতার কথা বলি, ১৯৭২ সালে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার নির্বাচনে কংগ্রেসের কাছে বামফ্রন্ট পরাজিত হয়। বামফ্রন্ট নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি ও জোর-জবরদস্তির অভিযোগ উত্থাপন করে। স্বয়ং জ্যোতি বসুকে পর্যন্ত জিততে দেওয়া হয়নি। নির্বাচনের পর বামফ্রন্ট শপথ না নিয়ে বিধানসভা বয়কট করে। চরম নির্যাতন ও দমন-পীড়নের মধ্যেও তারা গণ-আন্দোলনের পথে অনড় থাকে। তারা নকশালদের সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ডের প্ররোচনার ফাঁদে পা দেয়নি, তেমনি কংগ্রেসের মোকাবিলায় কোনো সহিংস সন্ত্রাসের পথও গ্রহণ করেনি। ফলে দীর্ঘ গণ-আন্দোলন পটভূমিতে ১৯৭৭ সালের নির্বাচনে বামফ্রন্ট নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করে।
এত সব অভিজ্ঞতা ও শিক্ষা থাকা সত্ত্বেও বেগম জিয়া গণ-আন্দোলনের পথ পরিহার করে সন্ত্রাসের পথ গ্রহণ করলেন কেন? তিনি চেয়েছিলেন অব্যাহত সন্ত্রাস, হত্যাকাণ্ড, জ্বালাও-পোড়াও করে দেশে এমন একটা অস্থিতিশীল ও অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করবেন, যার সুবাদে সেনাবাহিনী হস্তক্ষেপ করবে। অসাংবিধানিক পন্থায় ক্ষমতার পালাবদল হবে। অশুভ শক্তি সম্ভবত এটাই তাঁকে বুঝিয়েছিল। তিনি ভুলে গেছেন, এটা সত্তর বা আশির দশক নয়। আমাদের সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি যে বদলে গেছে, দেশবাসী যে আর পাকিস্তানি ধারায় প্রত্যাবর্তন করবে না—এই সত্যটুকু তাঁকে উপলব্ধি করতে হবে। পলাতক পুত্র তারেকের হিংসাশ্রয়ী সন্ত্রাসের পথ পরিহার করতে হবে। জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ করে দলকে নতুন প্রজন্মের জন্য উন্মুক্ত করে দিতে হবে। সর্বোপরি বেগম জিয়াকে সাংবিধানিক ধারায়, অহিংস ও জনসম্পৃক্ত রাজনীতির পথে ফিরে আসতে হবে। সব দলের অংশগ্রহণে অবাধ নিরপেক্ষ আরেকটি নির্বাচনের জন্য তাঁকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
নূহ-উল-আলম লেনিন: বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য।
No comments