‘আমার ভোট আমি দেব, যাকে খুশি তাকে দেব’ মন্ত্র কই? by কামাল আহমেদ
গত
শতকের শেষ দশকে আমাদের জাতীয় রাজনীতিতে মোড় ঘোরানো পরিবর্তন আনায় ভূমিকা
রেখেছিল ‘আমার ভোট আমি দেব, যাকে খুশি তাকে দেব’ স্লোগানটি। ওই স্লোগানটিকে
জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল আমাদের সুশীল সমাজ এবং
রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আওয়ামী লীগ। ওই স্লোগানটি বাস্তবায়নের সবচেয়ে বেশি
সুফলও পেয়েছে আওয়ামী লীগ। আবার সেই ভোটের ফল যাতে না পাল্টায়, সে জন্য আরও
একধাপ এগিয়ে গণনা শেষ না হওয়া পর্যন্ত ভোটগুলো পাহারার ব্যবস্থাও করেছিলেন
চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী। মহিউদ্দিন চৌধুরী এখন
চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি। কিন্তু দলের ভেতরে ওই স্লোগানের
মন্ত্র এখন কেউ উচ্চারণ করেন কি না, সে প্রশ্নের কোনো জবাব তাঁর কাছে নেই।
ভোটের লড়াইয়ে এ ধরনের মূল্যবোধ কিংবা ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা রক্ষা গৌণ বিষয়।
‘যেকোনো মূল্যে মেয়র নির্বাচনে জিততে হবে’—একজন মন্ত্রীর এই সদম্ভ ঘোষণার
প্রভাবেই এমনটি ঘটছে কি না, সে প্রশ্ন নাহয় না-ই করলাম।
মহিউদ্দিন চৌধুরীর কথা দিয়ে লেখাটি শুরু করছি এ কারণে যে সপ্তাহ খানেক আগে আমি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে চট্টগ্রামে গিয়ে আসন্ন নির্বাচনকে ঘিরে যে ধরনের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা লক্ষ করেছি, তা আমাকে অবাক করেছে। এমনটি মোটেও প্রত্যাশিত ছিল না। বিমানবন্দর থেকে বেরোনোর পর যে গাড়িটিতে আমি শহরে গেলাম, তার চালকের কাছ থেকে নির্বাচনের হাওয়া বোঝার চেষ্টা করেই কিছুটা ধাক্কা খেলাম। চালক গফুরের প্রথম কথাতেই আমাদের রাজনৈতিক আলোচনা আর বেশিদূর এগোয়নি। তাঁর কথায় ভোটের হাওয়া কার দিকে, সেটা ভেবে লাভ নেই। ভোট দিতে পারবেন কি না, সেটা নিয়েই তিনি চিন্তিত। তাঁর আশঙ্কা, ভোটকেন্দ্র দখল হবে অথবা ভোটাররা কেন্দ্রেই যেতে পারবেন না। অথচ সন্ধ্যা নাগাদ শোনা যাবে বিপুল হারে ভোট পড়েছে।
চট্টগ্রামে দুই দিনের অবস্থানকালে একদিন সন্ধ্যায় একের পর এক তিনজন শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিকের সঙ্গে আলাদা করে দেখা করি। বিএনপির আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও আবদুল্লাহ আল নোমান, আর আওয়ামী লীগের এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী। ভোটাররা নিরাপদ-নিশ্চিন্তে ভোট দিতে পারবেন কি না, সাধারণ মানুষের এই উদ্বেগ সম্পর্কে তাঁদের মতামত জানতে চাইলে কেউই তা দৃঢ়তার সঙ্গে নাকচ করতে পারেননি। বরং তাঁরাও বলেছেন যে কেন্দ্র দখলের চেষ্টা হলে রক্তারক্তি হয়ে যাবে। চট্টগ্রামে ‘যাঁর ভোট তিনি দিতে পারবেন’ কি না, সেই শঙ্কা আরও জোরদার হয়েছে সেখানকার একটি হাউজিং কো-অপারেটিভ সোসাইটির নির্বাচনের পর। ৫ এপ্রিল অনুষ্ঠিত দ্য চিটাগাং হাউজিং কো-অপারেটিভ সোসাইটির নির্বাচনে সভাপতির পদে প্রতিদ্বন্দ্বীরা অজ্ঞাত এক কারণে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে সরে দাঁড়ালেও সেখানে ব্যাপক জাল ভোট পড়ার ঘটনা ঘটে (দুই সভাপতি প্রার্থী সরে গেলেন, তবু জাল ভোট; প্রথম আলো, ৫ এপ্রিল, ২০১৫)। সংগঠনটির বিদায়ী সভাপতি, দৈনিক আজাদীর সম্পাদক আব্দুল মালেক এবং চৌধুরী মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন কী কারণে ভোটের আগে আগে সরে দাঁড়ালেন, তা অবশ্য এখনো রহস্যাবৃত। স্থানীয় মানুষের ধারণা, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী আ জ ম নাছির উদ্দিন পুরো সমিতিতে একক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চান বলেই অন্য পদগুলোতেও ভিন্নমতাবলম্বী কারও জেতার পথ বন্ধ করে দিয়েছেন। এই ধারণাটিকে তাঁর দল আওয়ামী লীগের নেতারাও নাকচ করে দিতে পারেননি। তিনি এখন এ মাসে তাঁর দ্বিতীয় নির্বাচনে মেয়র পদের জন্য লড়ছেন। ছোট নির্বাচনটি যে বড় নির্বাচনের মহড়া ছিল না, সেটা প্রমাণ করা অবশ্য এখন তাঁরই দায়িত্ব।
চট্টগ্রামের নির্বাচনে আপাতদৃশ্যে একটি বড় ইস্যু হচ্ছে জলাবদ্ধতার সংকট। পুনর্নির্বাচনপ্রত্যাশী মোহাম্মদ মনজুর আলমের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ যে গত পাঁচ বছরে তিনি এই জলাবদ্ধতা দূর করায় কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেননি। গত সপ্তাহের আগাম কালবৈশাখীর দিনে অল্পক্ষণের বৃষ্টিতে মহানগরের রাস্তাঘাটের কোথাও কোথাও বুকসমান পানি জমে যাওয়ায় নাগরিক ভোগান্তির যেসব ছবি সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় ফলাও করে ছাপা হয়েছে, ভোটের দিন অথবা তার আগের কয়েক দিনে সে রকম ভোগান্তির পুনরাবৃত্তি নিঃসন্দেহে তাঁর জন্য শুভ হবে না। তাঁর বিরুদ্ধে করপোরেশনকে দলীয় আখড়ায় রূপান্তরের কোনো অভিযোগ নেই, এটা সত্য। কিন্তু গাড়িচালক গফুরের চোখে তাঁর ভাবমূর্তিটা একজন অক্ষম মেয়রের রূপক। হতে পারে উন্নয়ন বরাদ্দ দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকার তাঁর প্রতি অবিচার করেছে। কিন্তু সাধারণ নাগরিকেরা তা সেই রাজনীতির গভীরে যাবেন না। তাঁদের কাছে নগরের দৃশ্যমান চেহারাটিই মেয়রের সামর্থ্য বা অসামর্থ্য এবং যোগ্যতা বা অযোগ্যতার স্মারক নমুনা।
অবশ্য সেখানকার রাজনীতিকদের বিশ্বাস, জাতীয় রাজনীতির সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ এই নির্বাচনে ভোটারদের অনেকটাই প্রভাবিত করবে। বিএনপির দুই নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও আবদুল্লাহ আল নোমান এবং আওয়ামী লীগের মহিউদ্দিন চৌধুরী—তাঁরা সবাই অন্তত এই একটি বিষয়ে একমত। মহিউদ্দিন চৌধুরী অবশ্য এই নির্বাচনে তাঁর মনোনয়ন না পাওয়ার বিষয়ে আমার প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, এই নির্বাচনে চট্টগ্রামের আসল সমস্যার কোনো সমাধান হবে না। তাঁর মতে, চট্টগ্রামের সমৃদ্ধি যে বন্দরের ওপর নির্ভরশীল, সেই বন্দর রক্ষার বিষয়টি নির্বাচনে উপেক্ষিত থেকে যাওয়াটা দুর্ভাগ্যজনক। চট্টগ্রাম বন্দর পরিচালনায় বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণের বিরুদ্ধে সরব প্রতিবাদের জন্য বিশেষ পরিচিতি পাওয়া মহিউদ্দিন চৌধুরীর বিশ্বাস, গভীর সমুদ্রে একাধিক বন্দর নির্মাণের পরিকল্পনা চট্টগ্রামের স্বার্থ ক্ষুণ্ন করবে। তিনি মনে করেন যে মেয়র হলে তিনি সরকারের ওই পরিকল্পনায় বাধা হয়ে দাঁড়াবেন বলেই ক্ষমতাসীন দল তাঁকে মনোনয়ন দেয়নি। তাঁর এই মর্মপীড়া কিংবা ক্ষোভ আপাতদৃশ্যে তিনি ঝেড়ে ফেললেও তাঁর ভক্ত-সমর্থকেরা যে সেটা মানতে পারছেন না, তা বেশ ভালোই টের পাওয়া যায়। মহিউদ্দিন-ভক্তরা যে সবাই আবার দলের লোক, তা-ও নয়। তাঁরা আ জ ম নাছিরের অতীতের প্রতি ইঙ্গিত করে যে আশঙ্কার কথা বলছেন, তা সম্ভবত উপেক্ষণীয় নয়। তাঁর বিরুদ্ধে যে হত্যাচেষ্টার মামলা রয়েছে, সেটি হচ্ছে নিজ দলের কর্মীর ওপর হামলার অভিযোগ এবং তা-ও ঘটেছিল ১৯৯৩ সালের ২৪ জানুয়ারি দলীয় প্রধানের এক জনসভায়। এখন প্রায় ২২ বছর পর তিনি দলীয় মনোনয়নে প্রার্থী হওয়ার পর মামলার বাদী সুফিয়ান সিদ্দিকী পুরো ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গেছেন। তিনি এখন আর এজাহারের সই চিনতে পারেন না এবং আসামির গাড়িতে করে আদালত ছাড়েন। হাউজিং সোসাইটির নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বীদের সরে যাওয়ার মতো একের পর এক সব বাধা অপসারিত হয়ে যাওয়াটা কি কোনো ইঙ্গিত বহন করে?
আমার ভোটটি আমি দিতে পারব কি না, সেই শঙ্কাটি যে শুধু চট্টগ্রামেই সীমাবদ্ধ, তা নয়। বেসরকারি সংগঠন, সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) এক সভায় ৫ এপ্রিল ঢাকায় তরুণেরা সে রকম আশঙ্কাই প্রকাশ করেছেন (প্রথম আলো, ৬ এপ্রিল, ২০১৫)। পিপলস বিশ্ববিদ্যালয়ের এক আলোচনায় ওই সব তরুণ ৫ জানুয়ারি ভোটারবিহীন নির্বাচন এবং পরে উপজেলা নির্বাচনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে নিজেদের ভোট নিজেরা দিতে পারবেন কি না, সেই আশঙ্কার কথা বলেছেন। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম, যিনি আগের মেয়াদে ছিলেন প্রশাসনের দায়িত্বে, ছাত্রলীগের এক সভায় তাঁর বহুল আলোচিত বেফাঁস স্বীকারোক্তির কথাই-বা কীভাবে উপেক্ষা করা যায়? এবারে চট্টগ্রামের রাজনীতির বিষয়ে অভিজ্ঞ একজন সাংবাদিক নির্বাচন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ওই উপদেষ্টার আরেকটি কীর্তির কথা আমাকে শোনালেন। তিনি জানালেন, ২০১০ সালের মেয়র নির্বাচনের সময়েও ওই উপদেষ্টা চট্টগ্রামে কয়েকটি ভোটকেন্দ্র দখলে নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু মহিউদ্দিন চৌধুরী তা নাকচ করে দিয়ে তাঁকে বলেছিলেন যে ভোটকেন্দ্র দখলের রাজনীতিতে তিনি বিশ্বাস করেন না এবং শেষ পর্যন্ত তিনি পরাজিত হন। অবশ্য, বিষয়টি সম্পর্কে ওই উপদেষ্টার কাছে জানতে চাইলে প্রথম আলোর কাছে তিনি তা স্রেফ অপপ্রচার বলে নাকচ করে দিয়েছেন।
ভোট, ভোটার ও ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং গণরায়ের যথাযথ প্রতিফলন ঘটার বিষয়গুলো নিয়ে সবাই যখন এক অনিশ্চয়তার দোলাচলে, তখন স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, ‘আমার ভোট আমি দেব, যাকে খুশি তাকে দেব’ মন্ত্রটির উচ্চারণ কি আবারও আমরা শুনতে পাব? নাকি ভোট দখলের কোনো প্রহসন রাজনীতিকে আবারও রক্তারক্তির পথে ঠেলে দেবে?
কামাল আহমেদ, সাংবাদিক।
মহিউদ্দিন চৌধুরীর কথা দিয়ে লেখাটি শুরু করছি এ কারণে যে সপ্তাহ খানেক আগে আমি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে চট্টগ্রামে গিয়ে আসন্ন নির্বাচনকে ঘিরে যে ধরনের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা লক্ষ করেছি, তা আমাকে অবাক করেছে। এমনটি মোটেও প্রত্যাশিত ছিল না। বিমানবন্দর থেকে বেরোনোর পর যে গাড়িটিতে আমি শহরে গেলাম, তার চালকের কাছ থেকে নির্বাচনের হাওয়া বোঝার চেষ্টা করেই কিছুটা ধাক্কা খেলাম। চালক গফুরের প্রথম কথাতেই আমাদের রাজনৈতিক আলোচনা আর বেশিদূর এগোয়নি। তাঁর কথায় ভোটের হাওয়া কার দিকে, সেটা ভেবে লাভ নেই। ভোট দিতে পারবেন কি না, সেটা নিয়েই তিনি চিন্তিত। তাঁর আশঙ্কা, ভোটকেন্দ্র দখল হবে অথবা ভোটাররা কেন্দ্রেই যেতে পারবেন না। অথচ সন্ধ্যা নাগাদ শোনা যাবে বিপুল হারে ভোট পড়েছে।
চট্টগ্রামে দুই দিনের অবস্থানকালে একদিন সন্ধ্যায় একের পর এক তিনজন শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিকের সঙ্গে আলাদা করে দেখা করি। বিএনপির আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও আবদুল্লাহ আল নোমান, আর আওয়ামী লীগের এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী। ভোটাররা নিরাপদ-নিশ্চিন্তে ভোট দিতে পারবেন কি না, সাধারণ মানুষের এই উদ্বেগ সম্পর্কে তাঁদের মতামত জানতে চাইলে কেউই তা দৃঢ়তার সঙ্গে নাকচ করতে পারেননি। বরং তাঁরাও বলেছেন যে কেন্দ্র দখলের চেষ্টা হলে রক্তারক্তি হয়ে যাবে। চট্টগ্রামে ‘যাঁর ভোট তিনি দিতে পারবেন’ কি না, সেই শঙ্কা আরও জোরদার হয়েছে সেখানকার একটি হাউজিং কো-অপারেটিভ সোসাইটির নির্বাচনের পর। ৫ এপ্রিল অনুষ্ঠিত দ্য চিটাগাং হাউজিং কো-অপারেটিভ সোসাইটির নির্বাচনে সভাপতির পদে প্রতিদ্বন্দ্বীরা অজ্ঞাত এক কারণে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে সরে দাঁড়ালেও সেখানে ব্যাপক জাল ভোট পড়ার ঘটনা ঘটে (দুই সভাপতি প্রার্থী সরে গেলেন, তবু জাল ভোট; প্রথম আলো, ৫ এপ্রিল, ২০১৫)। সংগঠনটির বিদায়ী সভাপতি, দৈনিক আজাদীর সম্পাদক আব্দুল মালেক এবং চৌধুরী মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন কী কারণে ভোটের আগে আগে সরে দাঁড়ালেন, তা অবশ্য এখনো রহস্যাবৃত। স্থানীয় মানুষের ধারণা, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী আ জ ম নাছির উদ্দিন পুরো সমিতিতে একক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চান বলেই অন্য পদগুলোতেও ভিন্নমতাবলম্বী কারও জেতার পথ বন্ধ করে দিয়েছেন। এই ধারণাটিকে তাঁর দল আওয়ামী লীগের নেতারাও নাকচ করে দিতে পারেননি। তিনি এখন এ মাসে তাঁর দ্বিতীয় নির্বাচনে মেয়র পদের জন্য লড়ছেন। ছোট নির্বাচনটি যে বড় নির্বাচনের মহড়া ছিল না, সেটা প্রমাণ করা অবশ্য এখন তাঁরই দায়িত্ব।
চট্টগ্রামের নির্বাচনে আপাতদৃশ্যে একটি বড় ইস্যু হচ্ছে জলাবদ্ধতার সংকট। পুনর্নির্বাচনপ্রত্যাশী মোহাম্মদ মনজুর আলমের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ যে গত পাঁচ বছরে তিনি এই জলাবদ্ধতা দূর করায় কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেননি। গত সপ্তাহের আগাম কালবৈশাখীর দিনে অল্পক্ষণের বৃষ্টিতে মহানগরের রাস্তাঘাটের কোথাও কোথাও বুকসমান পানি জমে যাওয়ায় নাগরিক ভোগান্তির যেসব ছবি সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় ফলাও করে ছাপা হয়েছে, ভোটের দিন অথবা তার আগের কয়েক দিনে সে রকম ভোগান্তির পুনরাবৃত্তি নিঃসন্দেহে তাঁর জন্য শুভ হবে না। তাঁর বিরুদ্ধে করপোরেশনকে দলীয় আখড়ায় রূপান্তরের কোনো অভিযোগ নেই, এটা সত্য। কিন্তু গাড়িচালক গফুরের চোখে তাঁর ভাবমূর্তিটা একজন অক্ষম মেয়রের রূপক। হতে পারে উন্নয়ন বরাদ্দ দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকার তাঁর প্রতি অবিচার করেছে। কিন্তু সাধারণ নাগরিকেরা তা সেই রাজনীতির গভীরে যাবেন না। তাঁদের কাছে নগরের দৃশ্যমান চেহারাটিই মেয়রের সামর্থ্য বা অসামর্থ্য এবং যোগ্যতা বা অযোগ্যতার স্মারক নমুনা।
অবশ্য সেখানকার রাজনীতিকদের বিশ্বাস, জাতীয় রাজনীতির সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ এই নির্বাচনে ভোটারদের অনেকটাই প্রভাবিত করবে। বিএনপির দুই নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও আবদুল্লাহ আল নোমান এবং আওয়ামী লীগের মহিউদ্দিন চৌধুরী—তাঁরা সবাই অন্তত এই একটি বিষয়ে একমত। মহিউদ্দিন চৌধুরী অবশ্য এই নির্বাচনে তাঁর মনোনয়ন না পাওয়ার বিষয়ে আমার প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, এই নির্বাচনে চট্টগ্রামের আসল সমস্যার কোনো সমাধান হবে না। তাঁর মতে, চট্টগ্রামের সমৃদ্ধি যে বন্দরের ওপর নির্ভরশীল, সেই বন্দর রক্ষার বিষয়টি নির্বাচনে উপেক্ষিত থেকে যাওয়াটা দুর্ভাগ্যজনক। চট্টগ্রাম বন্দর পরিচালনায় বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণের বিরুদ্ধে সরব প্রতিবাদের জন্য বিশেষ পরিচিতি পাওয়া মহিউদ্দিন চৌধুরীর বিশ্বাস, গভীর সমুদ্রে একাধিক বন্দর নির্মাণের পরিকল্পনা চট্টগ্রামের স্বার্থ ক্ষুণ্ন করবে। তিনি মনে করেন যে মেয়র হলে তিনি সরকারের ওই পরিকল্পনায় বাধা হয়ে দাঁড়াবেন বলেই ক্ষমতাসীন দল তাঁকে মনোনয়ন দেয়নি। তাঁর এই মর্মপীড়া কিংবা ক্ষোভ আপাতদৃশ্যে তিনি ঝেড়ে ফেললেও তাঁর ভক্ত-সমর্থকেরা যে সেটা মানতে পারছেন না, তা বেশ ভালোই টের পাওয়া যায়। মহিউদ্দিন-ভক্তরা যে সবাই আবার দলের লোক, তা-ও নয়। তাঁরা আ জ ম নাছিরের অতীতের প্রতি ইঙ্গিত করে যে আশঙ্কার কথা বলছেন, তা সম্ভবত উপেক্ষণীয় নয়। তাঁর বিরুদ্ধে যে হত্যাচেষ্টার মামলা রয়েছে, সেটি হচ্ছে নিজ দলের কর্মীর ওপর হামলার অভিযোগ এবং তা-ও ঘটেছিল ১৯৯৩ সালের ২৪ জানুয়ারি দলীয় প্রধানের এক জনসভায়। এখন প্রায় ২২ বছর পর তিনি দলীয় মনোনয়নে প্রার্থী হওয়ার পর মামলার বাদী সুফিয়ান সিদ্দিকী পুরো ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গেছেন। তিনি এখন আর এজাহারের সই চিনতে পারেন না এবং আসামির গাড়িতে করে আদালত ছাড়েন। হাউজিং সোসাইটির নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বীদের সরে যাওয়ার মতো একের পর এক সব বাধা অপসারিত হয়ে যাওয়াটা কি কোনো ইঙ্গিত বহন করে?
আমার ভোটটি আমি দিতে পারব কি না, সেই শঙ্কাটি যে শুধু চট্টগ্রামেই সীমাবদ্ধ, তা নয়। বেসরকারি সংগঠন, সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) এক সভায় ৫ এপ্রিল ঢাকায় তরুণেরা সে রকম আশঙ্কাই প্রকাশ করেছেন (প্রথম আলো, ৬ এপ্রিল, ২০১৫)। পিপলস বিশ্ববিদ্যালয়ের এক আলোচনায় ওই সব তরুণ ৫ জানুয়ারি ভোটারবিহীন নির্বাচন এবং পরে উপজেলা নির্বাচনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে নিজেদের ভোট নিজেরা দিতে পারবেন কি না, সেই আশঙ্কার কথা বলেছেন। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম, যিনি আগের মেয়াদে ছিলেন প্রশাসনের দায়িত্বে, ছাত্রলীগের এক সভায় তাঁর বহুল আলোচিত বেফাঁস স্বীকারোক্তির কথাই-বা কীভাবে উপেক্ষা করা যায়? এবারে চট্টগ্রামের রাজনীতির বিষয়ে অভিজ্ঞ একজন সাংবাদিক নির্বাচন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ওই উপদেষ্টার আরেকটি কীর্তির কথা আমাকে শোনালেন। তিনি জানালেন, ২০১০ সালের মেয়র নির্বাচনের সময়েও ওই উপদেষ্টা চট্টগ্রামে কয়েকটি ভোটকেন্দ্র দখলে নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু মহিউদ্দিন চৌধুরী তা নাকচ করে দিয়ে তাঁকে বলেছিলেন যে ভোটকেন্দ্র দখলের রাজনীতিতে তিনি বিশ্বাস করেন না এবং শেষ পর্যন্ত তিনি পরাজিত হন। অবশ্য, বিষয়টি সম্পর্কে ওই উপদেষ্টার কাছে জানতে চাইলে প্রথম আলোর কাছে তিনি তা স্রেফ অপপ্রচার বলে নাকচ করে দিয়েছেন।
ভোট, ভোটার ও ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং গণরায়ের যথাযথ প্রতিফলন ঘটার বিষয়গুলো নিয়ে সবাই যখন এক অনিশ্চয়তার দোলাচলে, তখন স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, ‘আমার ভোট আমি দেব, যাকে খুশি তাকে দেব’ মন্ত্রটির উচ্চারণ কি আবারও আমরা শুনতে পাব? নাকি ভোট দখলের কোনো প্রহসন রাজনীতিকে আবারও রক্তারক্তির পথে ঠেলে দেবে?
কামাল আহমেদ, সাংবাদিক।
No comments