লুটেরা ও অনুপ্রবেশকারীরা আওয়ামী লীগের জন্য অভিশাপ by মো: মাইনুল হক

১৯৬৫ সালে রাজশাহী কলেজে যখন বিএসসি কাসে ভর্তি হলাম, তখন দলীয় রাজনীতির কোনো জ্ঞানই আমার ছিল না। ভর্তি হওয়ার পর এনএসএফের স্থানীয় কিছু ছাত্রের আচরণ আমাদের কাছে ছাত্রসুলভ মনে হয়নি। যদিও তারা আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে প্রতিপক্ষকে বর্তমানের মতো হত্যা করেনি। তারা মাঝে মধ্যে বিরোধী মতের ছাত্রনেতাদের চড়থাপ্পড় মারত। আবার কখনো কখনো হকিস্টিক নিয়ে বিরোধীদের তাড়া করত। তাদের এরূপ কর্মকাণ্ডই আমাদের কাছে অসহনীয় হয়ে ওঠে, যা বর্তমানের তুলনায় কিছুই না। তাই আমরা বন্ধুবান্ধব মিলে এমন কর্মকাণ্ড রোখার জন্য ছাত্রলীগে যোগদান করি। তারপর গ্রামে গিয়ে মানুষজনকে আইউববিরোধী আন্দোলনের জন্য উদ্বুদ্ধ করি। ধাপে ধাপে মুক্তিযুদ্ধের ক্ষেত্র তৈরি হয়ে যায়। পাকিস্তান সরকারের নির্বোধ ও অসুস্থ মানসিকতার প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ও ক্ষমতালিপ্সু ভুট্টো আমাদের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দিলো। আমরা ন্যায়সঙ্গত দাবি আদায়ের জন্য মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিলাম। দেশ স্বাধীন হয়ে গেল। পাকিস্তানি বাহিনী পরাজিত হয়ে বিদায় নিলো। তার সাথে যেন আমাদের নেতাদের ন্যায়-অন্যায় বোধও বিদায় হয়ে গেল। যুদ্ধের সময়ই চক্রান্ত হতে লাগল কারা রাজদরবারের অধিকারী হবে, আর কারা আজ্ঞাবহ প্রজা হবে। বর্তমান আমলে আওয়ামী ঘরানার লোকদের চরিত্রের একটি দিক তুলে ধরা দরকার। সেটা হলো অর্থবৃত্ত আহরণের জন্য মরিয়া হয়ে নিজেদের মধ্যে মারামারি । এতে আমরা আওয়ামী লীগের সাধারণ সমর্থকেরা মনে করি লুটেরা এবং দলে অনুপ্রবেশকারীরা আর বহিরাগত যারা নিজ দল নিয়ে নির্বাচন করলে ইউপি চেয়ারম্যানও হতে পারতেন না, তারা মন্ত্রী হয়ে, প্রশাসনের মধ্যকার লুটেরাদের মদদ দিয়ে জাতির মাথায় চেপে বসেছে। ফলে প্রতিদিন লোকজন খুন ও গুম হচ্ছে। চাঁদাবাজির ও ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। ৩১ জুলাই ২০১৪ কুষ্টিয়ার মিরপুরে উপজেলা আওয়ামী লীগের বিশ্বাস গ্রুপ ও মাথিলা গ্রুপের মধ্যে সরকারি জলমহাল দখল নিয়ে সংঘর্ষে আওয়ামী লীগ কর্মী ইয়াকুব সরদারের ছেলে ওহাব ও শহীদুল মারা যায় এবং ১০ জন গুরুতর আহত হয়। একই দিনের খবর মাগুরার শ্রীপুরের সদর ইউনিয়নের আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও ইউপি চেয়ারম্যান মশিয়ার রহমান ও জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি হাসানুজ্জামান হান্নানের গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষে ১০ পুলিশসহ ৪০ জন আহত এবং উভয় পক্ষের ৩০টি বাড়িতে লুটপাট ও ভাঙচুর হয়। ১৩ জুলাই ২০১৪ যশোর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের বাপ্পি গ্রুপের রিয়াদকে শামীম গ্রুপের ক্যাডাররা পেটে ছোরা মেরে হত্যা করে। ওই দিনের খবর চৌদ্দগ্রাম উপজেলার আলকরা ইউনিয়নের যুবলীগ নেতা, ওয়ার্ড ছাত্রলীগের নুরুল আলম দলীয় কোন্দলে নিহত হয়েছে। ১১ জুলাই ২০১৪ রাজবাড়ীর একটি ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগ সভাপতি আবদুস সাত্তার জুমার নামাজ পড়ে ফেরার পথে দলীয় কোন্দলে নিহত হন । ১ জুলাই ২০১৪ দখল-বেদখলকে কেন্দ্র করে কক্সবাজার খুঁটাখালীতে আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে যুবলীগ নেতা মিজানুর রহমান নিহত হন। এদিনের খবরÑ পাবনা জেলার বেড়ার একটি ইউনিয়নের আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক মোকসেদ আলী দলীয় কোন্দলে নিহত। এদিনের অপর একটি খবরÑ ঝিনাইদহের ফুরসন্দি ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগ নেতা শহীদুল ইসলাম ও পরাজিত প্রার্থী জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য আবদুল মালেকের মধ্যে দীর্ঘ দিনের সংঘর্ষে এ যাবত চারজন মারা গেছে। ওই তারিখের সংঘর্ষে ২০০ বাড়িঘরে লুটপাট আর ভাঙচুর হয়। নিরপেক্ষ মানুষের বাড়িতেও লুটপাট ও ভাঙচুর চালায় সন্ত্রাসীরা। ২৩ জুন ২০১৪ চুয়াডাঙ্গা হাউলী ইউনিয়নের আওয়ামী লীগ নেতা সিরাজুল ইসলাম বন্ধুদের সাথে গল্প করছিলেন। এমন সময় ছাত্রলীগ নেতা রাসেল ও ডনসহ কয়েকজন তার কাছে ৫০ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করে। সিরাজুল চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানালে তাকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে মাটিতে ফেলে চলে যায়। ১৬ জুন ২০১৪ রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার আওয়ামী লীগ নেতা আবদুস সালামকে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে স্থানীয় আওয়ামী লীগ সভাপতি আলমগীর ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা মেরে পা দুটো থেঁতলে পঙ্গু করে দিয়েছে। ২ জুন ২০১৪ খবরÑ পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জে আওয়ামী লীগ নেতা হালিম মোল্লার ডান পা কেটে নিয়ে গেছে তার দলীয় শত্রুরা। এদিন খবর এসেছে, সিদ্ধিরগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেতা নূর হোসেন, (নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের আসামি) তার ছেলে বিপ্লবকে পিটিয়ে হত্যা করেছে। ৩১ মে ২০১৪ খবরÑ কুমিল্লা সদর আসনের এমপি বাহাউদ্দিন বাহারের ভাতিজা আহসান হাবিবকে হত্যা করেছে ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক সালেহ আহমেদ ও তার সহযোগীরা। ২৭ মে ১০১৪ ফেনী শহরের রাজপথে ফেনীর ফুলগাজী উপজেলার চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ সভাপতি একরামুল হককে তার গাড়ি থামিয়ে গুলি করে নিজ দলের লোকেরাই। তারপর গাড়িতে পেট্রল ঢেলে আগুন লাগিয়ে তার লাশ পুড়িয়ে ফেলে। কী পৈশাচিকতা! নারায়ণগঞ্জে অন্তর্কলহে আওয়ামী লীগ সদস্য কাউন্সিলর মো: নজরুল ইসলামসহ একসাথে সাতজন নিহত হলেন। যারা এই খুনের ঘটনা দেখে ফেলে তাদেরও খুন করা হয়। এ হত্যাকাণ্ডের মূল আসামি নূর হোসেনকে সরকার ১১টি আগ্নেয়াস্ত্র কেনার জন্য লাইসেন্স দিয়েছে। এই হত্যাকাণ্ডে মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন মায়ার জামাতা, র‌্যাব কমান্ডার ছয় কোটি টাকা ঘুষ খেয়ে কয়েকজন র‌্যাব সদস্য নিয়ে হত্যাকারীদের সাথে এই কিলিং মিশনে অংশ নেয়। ১৭ মে ২০১৪ গাজীপুরের কাপাসিয়ায় আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের সংঘর্ষে ওসিসহ ২০ জন গুরুতর আহত হন। ২৩ মে ২০১৪ লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার চরশাহী ইউনিয়নের আওয়ামী লীগ সভাপতি আবদুল মান্নানকে মোবাইলে ডেকে নিয়ে তার গলা কেটে হত্যা এবং ওই জেলার চরপাতা ইউনিয়নের আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল মজিদকে হত্যা দলের অন্তর্দ্বন্দ্বে সংঘটিত হয়েছে বলে খবরে এসেছে। এভাবে দেখা যাবে, বিরোধী দলের হাজার হাজার লোক নিহত হওয়াসহ আওয়ামী লীগের অন্তর্দ্বন্দ্বে শত শত লোক নিহত হয়েছে। শুধু টেন্ডারবাজির কারণে আওয়ামী ঘরানার বহু লোক নিহত হয়েছে। এ সংখ্যা শতাধিক হবে বলে ধারণা। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগের অন্তর্দ্বন্দ্বে বহু ছাত্র মারা গেছে। যখন লিখছি, তখনই হাতে সংবাদপত্র এলো। দেখলাম, যশোরে স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি আবদুল মান্নানকে গুলি করে, ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার আওয়ামী লীগ সভাপতি আতাউর রহমানকে বোমা মেরে হত্যা করা হয়েছে। এই সরকার যত দিন ক্ষমতায় থাকবে তত দিনই লাশের মিছিল লম্বা হবে। কাজেই লুটেরা সন্ত্রাসীদের হাত থেকে দেশ, জাতি, নিষ্ঠাবান আওয়ামী লীগারদের এবং এর গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য ও সম্মান বাঁচাতে হলে বিবেকবান কর্মীদের রাজপথে নামতে হবে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ

No comments

Powered by Blogger.