এতিমখানার অবহেলায় হাত হারালো শিশু সুমন
শিশুটির বয়স মাত্র ১২। এ বয়সে তার
হেসেখেলে বেড়ানোর কথা। আর দশটা শিশুর মতো পড়াশোনা করে বড় হয়ে ‘কী হতে
চাই’ স্বপ্নে বিভোর হওয়ার কথা। কিন্তু নিজের ডান হাত খুইয়ে এখন সে
হাসপাতালের বিছানায়।
>>ডান হাত হারানো শিশু সুমন কাজী। ছবি: আলীমুজ্জামান রনি
তবে নিজের দোষে নয়, এতিমখানার স্বাস্থ্য সহকারী ও কর্তৃপক্ষের অবহেলায় পিতৃহারা শিশু সুমন কাজীর ডান হাতটি কনুই থেকে কেটে ফেলতে হয়েছে। সম্প্রতি মর্মান্তিক এ ঘটনাটি ঘটেছে ফরিদপুর শহরতলির কোমরপুরে অবস্থিত মুসলিম মিশন এতিমখানায়।
ফরিদপুরের সালথা উপজেলার ভাওয়াল ইউনিয়নের দড়জা গ্রামের ছোবরন নেছা (সুমনের মা) স্বামী হারানোর পর চার মেয়ে ও দুই ছেলে নিয়ে চরম অভাব-অনটনে পড়েন। তিনি জানান, স্বামী কৃষক রহমান পাঁচ বছর আগে ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। এত বড় সংসারের ভার সামলাতে না পেরে তিনি ছোট ছেলে সুমনকে ফরিদপুর মুসলিম মিশন এতিমখানায় ভর্তি করেন। সুমন বর্তমানে মিশনের দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র।
ফরিদপুর ট্রমা সেন্টারে চিকিত্সাধীন সুমন প্রথম আলোকে জানায়, ১২ জুন দুপুরে জোহরের নামাজের জন্য ওজু করতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে যায় সে। এতে তার ডান হাত ভেঙে যায়। পরে মিশনের স্বাস্থ্য সহকারী সুকুমার প্রামাণিক সুমনের চিকিত্সা করেন। তিনি এক্সরে বা কোনো ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করেই সুমনের ভেঙে যাওয়া হাতের অংশ শক্ত করে বেঁধে প্লাস্টার করে দেন। এর পর থেকে সুমনের হাতের অবস্থা ক্রমশ খারাপ হতে থাকে। ওই দিন রাতে এবং পরদিন অর্থাত্ ১৩ জুন সকালে হাতে তীব্র ব্যথার কথা সুকুমার প্রামাণিককে জানায় সুমন। কিন্তু সুকুমার তাকে কোনো চিকিত্সা না দিয়ে বকা দিয়ে কক্ষ থেকে বের করে দেন। সুমন বলে, ‘এজন্য ভয়ে আমি কাউকে কিছু বলিনি।’
ঘটনার তিন দিন পর গত ১৫ জুন সুমন গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে ফরিদপুর জেনারেল হাসপাতালে আনা হয়। হাসপাতালের চিকিত্সকেরা সুমনকে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করেন।
ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দুই দিন চিকিত্সার পরও সুমনের অবস্থার কোনো উন্নতি না হওয়ায় চিকিত্সকেরা ১৭ জুন অস্ত্রোপচার করে তার ডান হাতটি কনুই থেকে কেটে ফেলেন।
এ বিষয়ে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অধ্যক্ষ আ স ম জাহাঙ্গীর চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঘটনার তিন-চার দিন পর যখন সুমনকে মেডিকেল হাসপাতালে আনা হয়, ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। তার হাতের ভাঙা অংশে গ্যাংগ্রিন হয়ে যায়। ফলে হাত কেটে ফেলা ছাড়া অন্য উপায় ছিল না। হাতটি রেখে দিলে কিডনি বিকল হয়ে শিশুটির মৃত্যুও ঘটতে পারত।’
সুমনের বোন সাবিনা বেগম অভিযোগ করেন, ‘হাত ভেঙে যাওয়া খুবই সাধারণ দুর্ঘটনা। সঠিক চিকিত্সার ব্যবস্থা করা হলে কিছুতেই আমার ভাইয়ের হাত কাটতে হতো না। মিশনের লোকজনের অবহেলার কারণে আমার ভাইয়ের জীবনটা নষ্ট হয়ে গেল।’
সুমনের মা ছোবরন নেছা অভিযোগ করেন, ‘ছেলের অসুস্থতার কথা শুনে ঘটনার তিন দিন পর ১৪ জুন মিশনে ছেলেকে দেখতে গেলে আমাকে ভেতরে ঢুকতে দেয়নি। অনেক অনুরোধ করলেও শোনেনি। শেষমেশ ফিরে যেতে হয়েছে। আমার ছেলের জীবনটা শেষ করার পর আমাকে ফোন করে ডেকে আনা হয়েছে। আমি এ অবহেলার সাথে জড়িতদের শাস্তি চাই।’
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে মুসলিম মিশনের স্বাস্থ্য সহকারী সুকুমার প্রামাণিক বলেন, ‘আমি এমবিবিএস চিকিত্সক নই। শুধু কম্পাউন্ডার হিসেবে ট্রেনিং নিয়েছি। সুমনের হাত ভেঙে গেলে আমি তুলা ব্যান্ডেজ করে হাতটি ঝুলিয়ে রাখার ব্যবস্থা করি, যাতে সে ব্যথা না পায়। এ ছাড়া সুমনকে বিশেষজ্ঞ চিকিত্সক দেখাতে আমি মিশনের অভ্যন্তরীণ তত্ত্বাবধায়ক ওমর ফারুককে পরামর্শ দিই।’
তবে দাবি নাকচ করে মুসলিম মিশনের অভ্যন্তরীণ তত্ত্বাবধায়ক ওমর ফারুক বলেন, ‘সুকুমার আমাকে কোনো পরামর্শ দেননি।’ তিনি বলেন, ‘মিশনে যে হাসপাতাল রয়েছে, সেখানে এমবিবিএস পাস করা কোনো চিকিত্সক নেই। স্বাস্থ্য সহকারী সুকুমারের শুধু প্রাথমিক চিকিত্সা দিয়ে চিকিত্সার জন্য রোগীদের বাইরের হাসপাতালে নেওয়ার কথা। কিন্তু সে ব্যান্ডেজ করে আমাদের জানায়, কোনো সমস্যা নেই। পরে শিশুটির হাত কালো হয়ে গেলে ১৫ জুন আমরা তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাই।’
ফরিদপুর মুসলিম মিশনের সাধারণ সম্পাদক এম এ সামাদ বলেন, ‘১২ তারিখে ঘটনা ঘটলেও আমি জানতে পারি ১৪ জুন রাতে। আমি জানার পর অবহেলার কোনো ঘটনা ঘটেনি। সুকুমার ভুল করেছে। তাঁর উচিত ছিল শিশুটিকে হাসপাতালে পাঠানো। তা না করে সে শিশুটির ভাঙা হাত টান করে বেঁধে দিয়েছে। আমাদের দুঃখ, আমরা শিশুটির হাত রক্ষা করতে পারিনি। এ জন্য সুকুমারকে কারণ দর্শানো নোটিশ দেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে সে এর জবাবও দিয়েছে। আগামী শনিবার মুসলিম মিশনের ব্যবস্থাপনা কমিটির জরুরি সভায় এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’
No comments