‘ঘটনা ধামাচাপা দিতে লাশ নদীতে ফেলতে বলি’ by বিল্লাল হোসেন রবিন
অবশেষে ৩২ দিনের রিমান্ড শেষে আদালতে
জবানবন্দি দিয়েছেন র্যাব ১১-এর সাবেক অধিনায়ক তারেক সাঈদ মোহাম্মদ।
জবানবন্দিতে ঘটনার দায় স্বীকার করলেও তিনি বলেছেন, নূর হোসেনের সঙ্গে
যোগসাজশে আরিফ ও রানা এই ঘটনা ঘটিয়েছে। তিনি যখন ঘটনা জানতে পারেন তখন তার
আর কিছুই করার ছিল না। তারেক বলেন, সাত জনের খুনের পর তিনি ঘটনা ধামাচাপা
দিতে লাশ নদীতে ফেলে দেয়ার নির্দেশ দেন।
গতকাল সকাল ১১টা থেকে বিকাল সাড়ে ৩টা পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জ সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কেএম মহিউদ্দিনের খাসকামরায় সাত খুনের ঘটনায় দায়ের করা দু’টি মামলায় তারেক সাঈদের জবানবন্দি গ্রহণ করা হয়। জবানবন্দি শেষে বিচারক তারেক সাঈদকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। এর আগে একই আদালতে গত ৪ঠা জুন আরিফ হোসেন ও ৫ই জুন এমএম রানা হত্যার দায় স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।
সকাল ৮টায় নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশ লাইন থেকে তারেক সাঈদকে কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে নারায়ণগঞ্জ আদালতে আনা হয়। পরে তাকে নেয়া হয় সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কেএম মহিউদ্দিনের আদালতে। সেখানে তাকে প্রথমে জবানবন্দি দেয়ার ব্যাপারে চিন্তাভাবনার সুযোগ দেয়া হয়। সকাল ১১টা থেকে জবানবন্দি দেয়া শুরু করেন তারেক সাঈদ। আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে তিনি বলেন, সাতজনকে অপহরণের বিষয়টি তিনি জানলেও সকলকে হত্যার বিষয়টি তাকে জানানো হয়নি। অপহরণের পর তাদেরকে ভয়ভীতি দেখিয়ে ছেড়ে দেয়া হবে তেমনটাই তাকে জানানো হয়েছিল। কিন্তু রাতের বেলায় সাতজনকে হত্যার পর বিষয়টি জানানো হয়। আর এ কাজটি করেন মেজর আরিফ ও নূর হোসেনসহ র্যাবের কিছু সদস্য। কিন্তু সাতজনকে মারার পর আমি অনেকটাই হতবিহ্বল হয়ে পড়ি। সাতজনকে হত্যার পর বিষয়টি ধামাচাপা দেয়ার জন্য লাশ নদীতে ফেলে দেয়ার কথা বলি আরিফকে।
সাত খুনের ঘটনায় দু’টি মামলা হয়। প্রথমে প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম ও তার ৪ সহযোগীকে হত্যার ঘটনায় নজরুলের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটির দায়ের করা হত্যা মামলায় প্রথমে জবানবন্দি দেন তারেক সাঈদ। পরে তারেক সাঈদ সেভেন মার্ডারের ঘটনায় নিহত এডভোকেট চন্দন সরকার ও তার গাড়িচালক হত্যার ঘটনায় চন্দন সরকারের জামাতা বিজয় পালের দায়ের করা মামলায় জবানবন্দি দেন।
নারায়ণগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি সাখাওয়াত হোসেন খান জানান, নারায়ণগঞ্জ সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের খাসখামরায় তারেক সাঈদের জবানবন্দি রেকর্ড করা হয়েছে। এতে সে বেশ কিছু তথ্য দিয়েছে। জবানবন্দি গ্রহণ শেষে বিকাল সাড়ে তিনটায় তাকে কারাগারে পাঠিয়ে দেন বিচারক। সূত্র জানায়, তারেক পুরো ঘটনারই বর্ণনা দিয়েছেন তার জবানবন্দিতে। দুই কর্মকর্তা মেজর আরিফ ও কমান্ডার রানা জবানবন্দি দিলেও তারেক সময়ক্ষেপণ করছিলেন। ভারতের কলকাতায় ঘটনার মূল হোতা নূর হোসেন গ্রেপ্তারের পর অনেকটা নাটকীয়ভাবেই স্বীকারোক্তি দিতে রাজি হন তারেক সাঈদ।
তারেক যা বলেন: নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সেভেন মার্ডারের ঘটনায় সাতজনকে অপহরণ করা হলেও র্যাবের সাবেক কর্মকর্তা লে. কর্নেল তারেক সাঈদ জানতো ৪ জনের কথা। কিন্তু সাতজনকে হত্যার পর বিষয়টি যখন তারেক সাঈদকে জানানো হয় তখন তিনি আঁতকে ওঠেন। কারণ মেজর (অব.) আরিফ হোসেন কোন সাক্ষী রাখতে চাননি। ফলে ৭ জনকেই হত্যা করা হয়। হত্যা ও লাশ গুমের স্থান বেছে নেয়া হয় নরসিংদী জেলাকে। কিন্তু নরসিংদীর র্যাব ক্যাম্প রাজি না হওয়ায় সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করা হয়। বিভিন্ন পয়েন্টে পুলিশের চেক পোস্ট থাকায় তারেক সাঈদ একটি ট্রাক পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন। ওই ট্রাকে করে যাতে অপহৃতদের পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে সিদ্ধিরগঞ্জে নিয়ে আসা যায়। কিন্তু মেজর আরিফ হোসেন নিজেই সাতজনকে মাইক্রোবাসে করেই নারায়ণগঞ্জের দিকে রওনা দেন। পথিমধ্যে গাড়িতেই মুখম-ল পলিথিন দিয়ে মুড়িয়ে একে একে সাতজনতে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়। হত্যার পর নূর হোসেনকে ফোন দিয়ে আরিফ হোসেন বলেন, কাঁচপুর ব্রিজের নিচে পশ্চিম পাড়ের পাথর-বালু ব্যবসা স্থল থেকে সব লোক সরিয়ে দিয়ে ফাঁকা করার জন্য। পরে নূর হোসেনের গ্রিন সিগন্যাল পাওয়ার পর লাশ নিয়ে কাঁচপুর ব্রিজের নিচে যাওয়া হয়।
উল্লেখ্য, ২৭শে এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম, তার বন্ধু মনিরুজ্জামান স্বপন, সিরাজুল ইসলাম লিটন, তাজুল ইসলাম, স্বপনের গাড়িচালক জাহাঙ্গীর আলম এবং আইনজীবী চন্দন কুমার সরকার ও তার ব্যক্তিগত গাড়িচালক ইব্রাহিম অপহৃত হন। পরদিন ২৮শে এপ্রিল ফতুল্লা মডেল থানায় নাসিক কাউন্সিলর নূর হোসেনকে প্রধান আসামি করে ৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে অপহৃত নজরুলের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম। ৩০শে এপ্রিল বিকালে নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদী থেকে ৬ জন এবং ১লা মে সকালে একজনের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।
এদিকে অপহরণের পর হত্যায় সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ স্পষ্ট হওয়ায় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ৫ই মে লে. কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, মেজর আরিফ হোসেনকে সেনাবাহিনী থেকে এবং নারায়ণগঞ্জ ক্যাম্পের সাবেক প্রধান লে. কমান্ডার এম. এম. রানাকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। পরে হাইকোর্টের নির্দেশে ১৬ই মে রাতে ক্যান্টনমেন্ট থেকে লে. কর্নেল (অব.) তারেক সাঈদ মোহাম্মদ ও মেজর (অব.) আরিফ হোসেনকে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ১৭ই মে তাদের ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। ২২শে মে তারেক সাঈদ ও আরিফ হোসেনকে প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাসহ ৫ জনকে অপহরণ ও হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করলে আদালত ৮ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। ৩০শে মে তারেক সাঈদ ও আরিফকে আদালতে হাজির করে ৭ দিনের রিমান্ড চাওয়া হয়। আদালত তাদের ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এদিকে ৪ঠা জুন আরিফ হোসেন ও এম.এম. রানা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়ার পর তাদের কারাগারে পাঠানো হয়েছে। ৫ই মে চন্দন সরকার হত্যা মামলায় তারেক সাঈদকে ৪র্থ দফায় ৫ দিনের রিমান্ডে নেয় পুলিশ। ৯ই মে নজরুল ইসলামসহ ৫ জনকে অপহরণ ও হত্যা মামলায় ৫ম দফায় তারেক সাঈদের ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। পরে ১১ই মে চন্দন সরকার হত্যা মামলায় ৬ষ্ঠ দফায় তাকে ৫ দিনের রিমান্ডে নেয় মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা।
নূর হোসেনের তথ্য চেয়েছে ভারত
বিশেষ প্রতিনিধি জানান, নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সেভেন মার্ডার মামলার প্রধান আসামি নূর হোসেনকে গ্রেপ্তারের বিষয়টি নিশ্চিত করে তার বিষয়ে আরও কিছু তথ্য চেয়েছে ভারত। এসব তথ্য জানিয়ে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, নূর হোসেন সম্পর্কে আরও কিছু তথ্য চেয়ে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক চিঠি (নোট ভারবাল) পাওয়া গেছে। এতে নূর হোসেনের গ্রেপ্তারের বিষয়টি রয়েছে। গত ১৪ই জুন নূর হোসেন গ্রেপ্তারের চার দিন পর তার সম্পর্কে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশকে জানালো ভারত। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ভারত সরকারের আনুষ্ঠানিক চিঠি পাওয়ার পর পরই কাজ শুরু করে দিয়েছে সরকার। নারায়ণগঞ্জের এসপি অফিস ও তদন্তকারী কর্মকর্তাদের কাছে নূর হোসেন সম্পর্কে আরও তথ্য জানতে চাওয়া হয়েছে। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী জানান, নূর হোসেনকে নিয়ে চাহিত তথ্য সংগ্রহে কাজ চলছে। আশা করা যায়, দুয়েক দিনের মধ্যে তাদের চিঠি’র জবাব দেয়া যাবে। নূর হোসেনকে ফেরত আনতে সরকার সচেষ্ট রয়েছে। তাকে ফিরিয়ে আনতে কোন ধরনের বিলম্ব হচ্ছে না। এর আগে গত ২৭শে এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম ও আইনজীবী চন্দন কুমার সরকারসহ সাতজন অপহৃত হওয়ার পর নূর হোসেনের দিকে অভিযোগের আঙুল উঠলে তিনি তা অস্বীকার করেন। পালিয়ে যান ভারতে। নূর হোসেন সীমান্ত অতিক্রম করেছেন বলে নিশ্চিত হওয়ার পর তাকে গ্রেপ্তারে ইন্টারপোলের সহায়তা চায় পুলিশ, সীমান্তেও জারি করা হয় সতর্কতা। এর মধ্যেই গত ১৪ই জুন পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ কলকাতার নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোস আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাছে বাগুইহাটির একটি বাড়ি থেকে নূর হোসেনকে গ্রেপ্তারের কথা জানায়। অবৈধভাবে ভারতে প্রবেশ এবং অস্ত্র বহনের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে মামলাসহ অভিযোগ দায়ের করে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ। গত ১৫ই জুন তাকে আদালতের মাধ্যমে রিমান্ডেও নেয়া হয়। এমন অবস্থার মধ্যেই বাংলাদেশ-ভারত চিঠি চালাচালি হচ্ছে।
No comments