একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের পুস্তক প্রকাশনা

দীনবন্ধু মিত্রের ঐতিহাসিক 'নীলদর্পণ' নাটক ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয়েছিল ঊনবিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকে। এর অর্থ এই নয় যে, সৃজনশীল প্রকাশনায় ঢাকার অতীত ঐতিহ্য গৌরবজ্জ্বল। বেঙ্গল লাইব্রেরি ক্যাটালগে ১৮৬৭ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ভুক্তি পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, ঢাকা থেকে সৃজনশীল বইয়ের প্রকাশনা নিতান্তই বিচ্ছিন্ন ঘটনা, এমনকী নোটবই ব্যতীত মূল পাঠ্যপুস্তকও ঢাকা থেকে তেমন একটা ছাপা হয়নি।
মূল কারণ, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবে কলকাতাই তখন ছিল প্রাণকেন্দ্র। অন্যান্য সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মতো সৃজনশীল বই প্রকাশের ক্ষেত্রেও কলকাতাই মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। পাঠক হিসেবে ঢাকার লোকজন কেমন ছিলেন তার কোনো প্রামাণিক ইতিহাস নেই, তবে মনে করা যেতে পারে যে, ঢাকায় শিক্ষা-দীক্ষায়-সমাজচিন্তায়-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে আলোকিত মানুষ হিসেবে হিন্দুরাই অগ্রগণ্য ছিলেন। বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে মুসলিম সমাজে খানিকটা আধুনিকতার ছোঁয়া লাগলেও যার ধারা ছিল অত্যন্ত ক্ষীণ। তাই বইয়ের পাঠক হিসেবে শিক্ষা-সংস্কৃতিতে পিছিয়ে থাকা ঢাকার বাঙালি মুসলমানের বিশেষ ভূমিকা থাকার কথা নয়। আর দেশ ভাগ হয়ে এখান থেকে যাঁরা চলে গেলেন, যাঁরা এলেন, সেই যোগ বিয়োগে সাংস্কৃতিক দিক থেকে ঢাকা খুব একটা লাভবান হয়নি। যেমনটি বলা হয়, ব্রিটিশ সেনারা যেখানে গিয়েছে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছে শেক্সপিয়ার মিলটনকেও, কিন্তু ঢাকায় আগমনকারী বাঙালি মুসলমান সঙ্গে করে বই ও সংস্কৃতি লক্ষণীয়ভাবে নিয়ে আসেননি।
সাতচলিস্নশ থেকে একাত্তর পর্যন্ত কালকে সাধারণভাবে বিচার করলে দেখা যায়, এখানে বইয়ের প্রকাশনা গড়ে ওঠেছে পাঠ্যপুস্তক প্রকাশনাকে ঘিরে এবং সৃজনশীল প্রকাশনা এসেছে নেহাতই ঢিলেঢালাভাবে, সামগ্রিকভাবে প্রাতিষ্ঠানিক রূপে সৃজনশীল প্রকাশনা গড়ে ওঠেনি, হাতেগোনা কয়েকজন প্রকাশক, বলতে গেলে, ষাটের দশকে এসে, খেয়ালের বশবতর্ী হয়েই যেন দু'চারটি গল্প, কবিতা, ছড়া, উপন্যাস ইত্যাদি প্রকাশ করেছেন। সৃজনশীল প্রকাশনা লাভজনক উপার্জনের পথ উন্মুক্ত করেনি। তবে তুলনামূলকভাবে মুদ্রণ শিল্পে বেশ অগ্রগতি হয়েছে।
১৯৭২ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত সময়ে সৃজনশীল পুস্তক প্রকাশনায় তুলনামূলকভাবে বেশি পুঁজির সমাবেশ ঘটেছে। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে মুক্তধারা প্রচুর বই প্রকাশ করেছে, অন্য উৎস থেকে প্রাপ্ত মূলধনের ওপর ভর করে। অনেক কিছু করা সত্ত্বেও সেই মুক্তধারা বলতে গেলে ক্রেতা পাঠকের অভাবে শুকিয়ে গেছে। অপরদিকে ওই শতকের আশির দশকের শেষের দিকে কিছু নতুন নতুন প্রকাশকের আবির্ভাব ঘটেছে। দেশ এখন কয়েকজন জনপ্রিয় লেখক সৃষ্টি করতে পেরেছে, যাদের বই প্রকাশ করে প্রকাশকরা নিশ্চিতভাবে লাভবান হতে পারেন। অন্যদিকে এই একই সময়ে প্রযুক্তির ক্ষেত্রেও বিবর্তন ঘটেছে। লেটার প্রেস উঠে গেছে, এখন সকল মুদ্রণ কাজ হয় অফসেট প্রেসে। কম্পিউটারে টাইপসেটিং এখন অনিবার্য বাস্তবতা। এতবড় রূপান্তর ঘটেছে নিতান্তই নিজের তাগিদে, এই রূপান্তরে কেউ সরকারের কাছে সাহায্যের জন্য হাত পাতেনি। অথচ কতশত লেটার প্রেস অবলুপ্ত হয়েছে। লেটার প্রেসের কত হাজার মুদ্রাক্ষরিক কর্মহীন হয়েছেন। এসবই ঘটেছে যেন সবার চোখের অজান্তে। অফসেট প্রেস ও কম্পিউটারের কল্যাণে বইয়ের বাহ্যিক চেহারা হয়েছে আগের তুলনায় অনেক মনোলোভা। পাশাপাশি বার্ষিক বই প্রকাশের সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। তবে লক্ষণীয়, বইয়ের প্রকাশনা প্রকাশকের সারা বছরের কার্যক্রম না হয়ে অনেকটাই যেন বাংলা একাডেমীর বইমেলাকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে।
একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকেও সেই ধারা অব্যাহত ছিল। কিন্তু সৃজনশীল পুস্তক প্রকাশনার সমস্যাটি ব্রিটিশ, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ আমলে একটি জায়গায় স্থির হয়ে আছে। সেটি হলো দেশে যথেষ্ট সংখ্যায় বই কেনার মতো পাঠক নেই। এই পাঠক না থাকাই বাংলাদেশের প্রকাশনার অগ্রগতির জন্য মূল বাধা। আর এই পাঠক যে আপনা আপনি গড়ে উঠবে না তা বলাই বাহুল্য। পাঠাভ্যাস হঠাৎ করে হবার বিষয় নয়, এটি একটি দীর্ঘদিনের চর্চিত অভ্যাস। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার সকল স্তরেই পাঠ্যপুস্তক বহিভর্ূত বই পাঠের কোনো সুযোগ রাখা হয়নি। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সুবাদে আপনা আপনি পাঠাভ্যাস গড়ে ওঠার সুযোগ প্রায় নেই বলে আমাদের দেশের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তিদের অতি অল্প সংখ্যক ব্যক্তিই বইয়ের পাঠক। এবং তারাও জীবন-জীবিকা-বিনোদনের কোনো ক্ষেত্রে বইকে অবলম্বন করার প্রয়োজন বোধ করেন না। পাঠক নেই বলেই ক্রেতা নেই। ক্রেতা না থাকার কারণে বই লেখা, বই প্রকাশ করা, বই বিপণন করা_কোনোটাই শক্ত জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত হতে পারছে না। বই প্রকাশ করে কাঙ্ক্ষিত লাভ না থাকার কারণে বই সম্পাদনার সঙ্গে সংশিস্নষ্ট কাজগুলো ঠিকভাবে পালিত হচ্ছে না। কোনো লেখক প্রকল্প আকারে দীর্ঘ সময় ধরে কোনো বিষয়ে পেশাদারীভাবে কোনো কাজ হাতে নিতে উৎসাহ পাচ্ছেন না, কারণ একটাই যে, প্রকাশনা ব্যবসা থেকে এর ব্যয় নির্বাহ করা সম্ভব না।
আমরা এই দুষ্টচক্রকে ভাঙবো কেমন করে? আমাদের মতে তার জন্য একটাই পথ খোলা রয়েছে। সেটি হলো, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে এমনভাবে ঢেলে সাজাতে হবে যাতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পাঠকের সৃষ্টি হয়। স্কুল-কলেজে পাঠাগার শুধু থাকবেই না, স্কুল-কলেজের পাঠ গ্রহণে ও পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে ওই পাঠাগারে পঠনপাঠনকে আবশ্যকীয় করে তুলতে হবে। কোনো বিষয়ে একটিমাত্র বই পড়ে পরীক্ষা দেবার যে রেওয়াজ চালু আছে সেটা বন্ধ করতে হবে। পাঠ্যপুস্তক ও সৃজনশীল বই থেকে অর্জিত জ্ঞান যদি পরীক্ষকের বিচার্য হয় তবেই শিক্ষাথর্ীরা সৃজনশীল বই পাঠে আগ্রহী হবে এবং তার মধ্যে সৃজনশীল বই পাঠের অভ্যাস ও আনন্দ লাভের বিষয়টি ধীরে ধীরে গড়ে উঠবে।
আমাদের নতুন শিক্ষা নীতিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠাগারের আবশ্যকতার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু পাঠদান প্রক্রিয়া ও শিক্ষাথর্ীর কমপিটেন্সি মূল্যায়নের সঙ্গে পাঠাগারের সংযোগ সাধন করা হবে কি-না তার কথা বলা নেই। শিক্ষানীতির এই দিকটি খুব স্পষ্ট নয়। শিক্ষানীতি রূপায়নের কাজে যারা যুক্ত হবেন, বিষয়টি তাঁদের স্পষ্ট করতে হবে। মানসম্মত শিক্ষার প্রসারই শিক্ষা নীতির কাজ। আর মানসম্মত শিক্ষা অবশ্যম্ভাবীরূপে সৃজনশীল মানুষ সৃষ্টি করে দেশের সৃজনশীল পুস্তক প্রকাশনারও শ্রীবৃদ্ধি করবে। দেশের গ্রন্থোন্নয়নের জন্য প্রণীত জাতীয় গ্রন্থনীতি ১৯৯৪ বাস্তবায়ন ব্যর্থ হয়েছে। এখন ভরসা জাতীয় শিক্ষানীতি। বাংলাদেশের প্রকাশক সমাজ ওই নীতির সফল বাস্তবায়নের দিকে তাকিয়ে আছে। অন্যথায় বাংলাদেশের পুস্তক প্রকাশনা যে তিমিরে আছে ভবিষ্যতে সেই তিমিরেই থেকে যাবে।
======================
গল্প- বট মানে গরুর ভুঁড়ি  গল্প- কিশলয়ের জন্মমৃত্যু  গল্প- মাকড়সা  দুর্নীতি প্রতিরোধে আশার আলো  জাগো যুববন্ধুরা, মুক্তির সংগ্রামে  ঢাকা নগর ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন প্রয়োজন  মারিও বার্গাস য়োসার নোবেল ভাষণ- পঠন ও কাহিনীর নান্দীপাঠ  লন্ডন পুলিশ জলকামানও নিল না  রাষ্ট্রের চ্যালেঞ্জ ও যুদ্ধাপরাধী বিচারের দায়বদ্ধতা  পোশাক শিল্পে অস্থিরতার উৎস-সন্ধান সূত্র  বাতাসের শব্দ  গোলাপি গল্প  বজ্র অটুঁনি অথবাঃ  উদ্ভট উটের পিঠে আইভরি কোস্ট  আনল বয়ে কোন বারতা!  ফেলানীর মৃত্যুতে পশ্চিমবঙ্গ- নিজ ভূমেই প্রশ্নবিদ্ধ ভারতের মানবিক চেহারা  বাজার চলে কার নিয়ন্ত্রণে  উঠতি বয়সের সংকট : অভিভাবকের দায়িত্ব  বিকল্প ভাবনা বিকল্প সংস্কৃতি  অন্ধত্ব ও আরোগ্য পরম্পরা  খুলে যাক সম্ভাবনার দুয়ার  কক্সবাজার সাফারি পার্কঃ প্রাণীর প্রাচুর্য আছে, নেই অর্থ, দক্ষতা  জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের গুপ্ত জীবন  ছাব্বিশটি মৃতদেহ ও একটি গ্রেপ্তার  ৩৯ বছর পরও আমরা স্বাধীনতাটাকে খুঁজছি  সাইবারযুদ্ধের দামামা  সরলতার খোঁজে  সেই আমি এই আমি  আমেরিকান অর্থনীতি ডলারের চ্যালেঞ্জ  বাংলাদেশ-ভারত যৌথ ইশতেহার- আশানুরূপ সুফল নেই এক বছরেও  ন্যায়ভিত্তিক সমাজ ও রাজনীতি  মাস্টারদা সূর্যসেন ও যুব বিদ্রোহ সাতাত্তর  রসভা নির্বাচন ২০১১: একটি পর্যালোচনা  ড. ইউনূস অর্থ আত্মসাৎ করেননি  প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির ৩৯ বছর  স্বাধীনতাযুদ্ধের 'বিস্মৃত' কূটনৈতিক মুক্তিযোদ্ধারা  আতঙ্কে শেয়ারবাজার বন্ধঃ বিক্ষোভ  আতঙ্কের রাজত্ব কায়েম হয়েছে  মানবকল্যাণ আমাদের মন্ত্র  ট্রানজিট নিয়ে সবে গবেষণা শুরু  ভারতের একতরফা সেচ প্রকল্পঃ বাংলাদেশের আপত্তিতে বিশ্বব্যাংকের সাড়া  আমলাদের যাচ্ছেতাই বিদেশ সফর


দৈনিক ইত্তেফাক এর সৌজন্যে
লেখকঃ মহিউদ্দিন আহমেদ ও বদিউদ্দিন নাজির


এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.