সিলেটে উচ্চশিক্ষা এখন হাতের নাগালে
সিলেটে
উচ্চশিক্ষার সুযোগ এখন হাতের নাগালে। প্রতিবছর কয়েক হাজার শিক্ষার্থী
বিভিন্ন বিষয়ে সিলেটে বসেই উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করছেন। এই উচ্চশিক্ষার মান
নিয়ে শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষাসচেতন মহল মোটামুটি সন্তুষ্ট বলা চলে।
অথচ তিন দশক আগেও শুধু সুযোগের অভাবে সিলেটে উচ্চশিক্ষার পাট অনেকটা
উচ্চাভিলাষের মতোই থমকে ছিল।
সিলেটে আছে পাহাড়-টিলা-হাওর আর চা-বাগানের সবুজ প্রকৃতি। উঁচুতে ওঠার সীমারেখা পাহাড়-টিলার চূড়া। শিক্ষাদীক্ষায় এগিয়ে যাওয়ার পর উচ্চশিক্ষার প্রসারকে তুলনা করা হচ্ছে সিলেটের প্রকৃতির সঙ্গে। বলা হচ্ছে, শিক্ষার চূড়ায় অবস্থান করছে এখন সিলেট। এ ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী এক দশকে সিলেটে উচ্চশিক্ষার সুফলে নতুন এক ভবিষ্যতের দেখা মিলবে বলে শিক্ষাবিদসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন। তাঁদের ভাষ্য, শিক্ষার সামগ্রিক হারের মধ্যে তখন উচ্চশিক্ষাও বিবেচিত হবে মোটা দাগে।
পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, সিলেটে উচ্চশিক্ষার সুযোগ দুয়ারে আসার প্রথম সোপান বলা হয়ে থাকে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়কে (শাবিপ্রবি)। ১৯৯১ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি সিলেটে যাত্রা শুরু করা এই প্রতিষ্ঠান সিলেট অঞ্চলের প্রথম সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। মূলত এই বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়েই সিলেটে বিস্তৃত পরিসরে উচ্চশিক্ষার দরজা উন্মুক্ত হয়। এর আগে উচ্চশিক্ষায় আগ্রহীদের গন্তব্য ছিল চট্টগ্রাম কিংবা রাজশাহী। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রায় দশককাল পর ২০০১ সালে সিলেটে প্রথমবারের মতো লিডিং ইউনিভার্সিটি নামে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় যাত্রা শুরু করে। এরপর সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, সিলেটে মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটি, নর্থ ইস্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ নামে আরও তিনটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়।
২০০৬ সালের ২ নভেম্বর প্রতিষ্ঠিত হয় সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় নামের আরেকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। দুটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং চারটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও সিলেটের জালালাবাদ ক্যান্টনমেন্টে আর্মি ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন নামে একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এখানেও উচ্চশিক্ষার সুযোগ পাচ্ছেন মেধাবী শিক্ষার্থীরা। এই ৭টি প্রতিষ্ঠানে অন্তত ২৫ হাজার শিক্ষার্থী নানা বিষয়ে পড়াশোনা করছেন। প্রতিবছরই কৃতিত্বের সঙ্গে কয়েক হাজার শিক্ষার্থী এসব প্রতিষ্ঠান থেকে পাস করে বেরোচ্ছেন। পাশাপাশি উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের অনেকেই সরকারি-বেসরকারি নানা গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে চাকরিতে কর্মরত রয়েছেন।
সিলেটের বালাগঞ্জ ডিগ্রি কলেজের বর্তমান অধ্যক্ষ লিয়াকত শাহ ফরিদী। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা বিষয়ে ১৯৮৯ সালে স্নাতকোত্তর করেছেন। লিয়াকত শাহ বলেন, ‘দুই-আড়াই যুগের ব্যবধান। আমাদের সময় আর এখনকার সময় অনেক তফাৎ। আমরা যখন পড়াশোনা করি, তখন সিলেটে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় ছিল না। চট্টগ্রাম গিয়ে পড়াশোনা করতে হয়েছে। এখন বেশ কয়েকটি পাবলিক ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে, এটি নিঃসন্দেহে উচ্চশিক্ষাকে হাতের নাগালের মধ্যে পাওয়া।’
এরপরও লিয়াকত শাহ মনে করেন, একটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন জরুরি। কারণ, শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ফোকলোর, নাট্যকলাসহ কলা বিভাগের অনেক বিষয়ে পড়াশোনার সুযোগ নেই। এ ঘাটতি কাটাতে হলে একটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় জরুরি। এর বাইরে সিলেটে একটি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনও সময়ের দাবি।
অভিজিৎ কুমার পাল সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা পদে আছেন। ১৯৯১ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতি বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘ঢাকা, রাজশাহী কিংবা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া আমাদের উচ্চশিক্ষার জন্য বিকল্প কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল না। অনেকে তখন কষ্ট করে সিলেট থেকে অন্যত্র গিয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতেন। দূরবর্তী এলাকায় গিয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে হবে, এমন কারণে উচ্চশিক্ষার আগেই অনেকের পড়াশোনা থেমে যেত। আর এখন উচ্চশিক্ষার সুযোগ বাড়ির কাছেই।
সিলেটের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা হয়। তাঁরা বলেন, শিক্ষার মান এবং পড়াশোনা নিয়ে কারও মধ্যে বড় কোনো অভিযোগ নেই। তবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীদের আবাসন-সংকট অনেক ক্ষেত্রে প্রকট। এ ছাড়া পর্যাপ্ত ও পছন্দমতো বিষয়ের অভাবও রয়েছে। দুটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে ঠিকই। কিন্তু দুটিই বিশেষায়িত। এমনকি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও বেশিসংখ্যক শিক্ষার্থীর ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিয়ে গৎবাঁধা কিছু বিষয় নির্ধারণ করছে। ফলে বৈচিত্র্যময় বিষয়ের ওপর পড়াশোনার সুযোগ সৃষ্টি হয়নি। চারুকলা, ফোকলোর, নাট্যকলা, সাংবাদিকতাসহ নানা আকর্ষণীয় বিষয় চালু করা গেলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পূর্ণাঙ্গতা পেত বলেও তাঁরা মন্তব্য করেছেন।
শিক্ষাবিদেরা বলছেন, নানা কারণে সারা দেশেই শিক্ষার মান নিম্নগামী হচ্ছে। এ থেকে সিলেটের চিত্রও ভিন্ন নয়। তবে সেটা ভিন্ন বিষয় জানিয়ে শিক্ষাবিদদের ভাষ্য, তুলনামূলকভাবে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় উচ্চশিক্ষার মান সিলেটে খুব একটা খারাপ নয়। এ কারণেই এখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষ করে অনেকেই উচ্চপদস্থ সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক থেকে শুরু করে গুরুত্বপূর্ণ নানান পদে চাকরি পাচ্ছেন।
বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে দেশে ৪৯টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এর মধ্যে দুটি সিলেটে। ১০৩টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং ৩টি আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। চারটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সিলেটে। উচ্চশিক্ষার সুযোগ নাগালের মধ্যে আসার পর সিলেটের শিক্ষার গুণগত মানের কী অবস্থা? এমন প্রশ্নের উত্তর নিয়েও তর্ক-বিতর্ক আছে। তবে এ প্রসঙ্গ উল্লেখ করে শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা ২০১০ সালে স্পেনের বৃহত্তম সরকারি গবেষণা সংস্থা সিএসআইসি (Consejo Superior de Investigaciones Cientificas)-এর বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক সারা বিশ্বে পরিচালিত একটি জরিপের উদাহরণ দিয়েছেন। এই জরিপে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ১২তম স্থানে জায়গা করে নিয়েছিল।
সিলেটের শিক্ষাবিদ, ভাষাসংগ্রামী অধ্যাপক মো. আবদুল আজিজ সিলেটের মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটির ‘ইমিরেটাস প্রফেসর’ পদে আছেন। সিলেটে থেকে তাঁর এ পদে আসীনও যেন উচ্চশিক্ষা প্রসারের আরও এক উদাহরণ। আবদুল আজিজ প্রথম আলোকে বলেন, উচ্চশিক্ষার সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে সিলেটের চিত্র অতীত আর বর্তমানের মধ্যে এখন অনেক তফাৎ। শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ তৈরিতে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার ইতিহাস সিলেটবাসীর জন্য একটি বাঁক বদলের মতোই ঘটনা। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের পর সিলেটে আরও কয়েকটি সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এটি অবশ্যই ইতিবাচক একটি বিষয়। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের এখন উচিত শিক্ষার প্রকৃত ও গুণগত উন্নয়নের দিকে নজর দেওয়া। তবেই শিক্ষার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ নিশ্চিত হবে।
শিক্ষাদীক্ষার সুযোগ-সুবিধা বাড়ায় বদলে যাচ্ছে সিলেট নগরও। হজরত শাহজালাল (রহ.) ও হজরত শাহপরান (রহ.) দরগাহ সিলেট নগরে থাকায় সিলেটকে ‘আধ্যাত্মিক নগর’ বা ‘৩৬০ আউলিয়ার শহর’ বলা হতো। যুক্তরাজ্যপ্রবাসী বেশি হওয়ায় সিলেটকে ‘বাংলাদেশের লন্ডন’ নামেও ডাকা হয়। চা-বাগান, পাহাড়-ঝরনাধারার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ‘পর্যটক নগর’ পরিচিতির মধ্যে শিক্ষাদীক্ষার প্রসার, বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর ‘শিক্ষানগর’ বলেও ডাকা হয়। ভবিষ্যতের হাতছানি ‘স্মার্টসিটি সিলেট’।
একাদশ জাতীয় নির্বাচনে সিলেট-১ (মহানগর-সদর) আসন থেকে নির্বাচিত সাংসদ পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের নির্বাচনী অঙ্গীকার ছিল সিলেটকে বাংলাদেশের প্রথম ‘ডিজিটাল সিটি’ গড়া। নির্বাচনের পর তিনি তাঁর অঙ্গীকার বাস্তবায়নে ১০০ দিনের কর্মসূচির কথাও ঘোষণা করেছেন।
সিলেটের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী জানিয়েছেন, সিলেট নগর উন্নয়নের প্রতিটি প্রকল্পে এখন শিক্ষার্থীদের কথা বিবেচনায় রাখা হয়েছে। মেয়র বলেন, তথ্যপ্রযুক্তির সব সুবিধা দিতে সিলেটকে স্মার্টসিটি হিসেবে গড়ে তোলা সময়ের দাবিতে রূপ নেওয়ার পেছনে তাগাদা হচ্ছে শিক্ষাদীক্ষায় অগ্রসর হওয়া।
শিক্ষার্থী কত
সিলেটসহ তিন জেলায় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর কোর্স চালু রয়েছে, এমন ২০টি কলেজে লক্ষাধিক শিক্ষার্থী রয়েছেন। এ ছাড়া শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, চারটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, এমসি কলেজ, মদনমোহন কলেজ, সরকারি মহিলা কলেজসহ উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৫০ হাজারের বেশি।
মেডিকেল শিক্ষায়ও উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্র সৃষ্টি হয়েছে। সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন চূড়ান্ত হওয়ার পর উপাচার্য নিয়োগের মধ্য দিয়ে দাপ্তরিক কাজও শুরু হয়েছে। হবিগঞ্জে শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজে এবার থেকে শিক্ষার্থী ভর্তির প্রক্রিয়ায় রয়েছে। সুনামগঞ্জে নতুন মেডিকেল কলেজ স্থাপনে ভূমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া চলছে।
সিলেটে এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ নামে সরকারি মেডিকেল কলেজ ছাড়াও বেসরকারি মেডিকেল কলেজ রয়েছে চারটি। এগুলো হচ্ছে, জালালাবাদ রাগীব-রাবেয়া মেডিকেল কলেজ, নর্থ ইস্ট মেডিকেল কলেজ, সিলেট উইমেন্স মেডিকেল কলেজ ও পার্কভিউ মেডিকেল কলেজ। সিলেট সেন্ট্রাল ডেন্টাল কলেজ ও ইউনানী মেডিকেল কলেজ, একটি সরকারিসহ নার্সিং কলেজ রয়েছে চারটি। মেডিকেল ও নার্সিং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১০ হাজারের বেশি। মেডিকেল কলেজে বিদেশি শিক্ষার্থীও আছেন।
সিলেটে আছে পাহাড়-টিলা-হাওর আর চা-বাগানের সবুজ প্রকৃতি। উঁচুতে ওঠার সীমারেখা পাহাড়-টিলার চূড়া। শিক্ষাদীক্ষায় এগিয়ে যাওয়ার পর উচ্চশিক্ষার প্রসারকে তুলনা করা হচ্ছে সিলেটের প্রকৃতির সঙ্গে। বলা হচ্ছে, শিক্ষার চূড়ায় অবস্থান করছে এখন সিলেট। এ ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী এক দশকে সিলেটে উচ্চশিক্ষার সুফলে নতুন এক ভবিষ্যতের দেখা মিলবে বলে শিক্ষাবিদসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন। তাঁদের ভাষ্য, শিক্ষার সামগ্রিক হারের মধ্যে তখন উচ্চশিক্ষাও বিবেচিত হবে মোটা দাগে।
পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, সিলেটে উচ্চশিক্ষার সুযোগ দুয়ারে আসার প্রথম সোপান বলা হয়ে থাকে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়কে (শাবিপ্রবি)। ১৯৯১ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি সিলেটে যাত্রা শুরু করা এই প্রতিষ্ঠান সিলেট অঞ্চলের প্রথম সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। মূলত এই বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়েই সিলেটে বিস্তৃত পরিসরে উচ্চশিক্ষার দরজা উন্মুক্ত হয়। এর আগে উচ্চশিক্ষায় আগ্রহীদের গন্তব্য ছিল চট্টগ্রাম কিংবা রাজশাহী। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রায় দশককাল পর ২০০১ সালে সিলেটে প্রথমবারের মতো লিডিং ইউনিভার্সিটি নামে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় যাত্রা শুরু করে। এরপর সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, সিলেটে মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটি, নর্থ ইস্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ নামে আরও তিনটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়।
২০০৬ সালের ২ নভেম্বর প্রতিষ্ঠিত হয় সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় নামের আরেকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। দুটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং চারটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও সিলেটের জালালাবাদ ক্যান্টনমেন্টে আর্মি ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন নামে একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এখানেও উচ্চশিক্ষার সুযোগ পাচ্ছেন মেধাবী শিক্ষার্থীরা। এই ৭টি প্রতিষ্ঠানে অন্তত ২৫ হাজার শিক্ষার্থী নানা বিষয়ে পড়াশোনা করছেন। প্রতিবছরই কৃতিত্বের সঙ্গে কয়েক হাজার শিক্ষার্থী এসব প্রতিষ্ঠান থেকে পাস করে বেরোচ্ছেন। পাশাপাশি উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের অনেকেই সরকারি-বেসরকারি নানা গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে চাকরিতে কর্মরত রয়েছেন।
সিলেটের বালাগঞ্জ ডিগ্রি কলেজের বর্তমান অধ্যক্ষ লিয়াকত শাহ ফরিদী। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা বিষয়ে ১৯৮৯ সালে স্নাতকোত্তর করেছেন। লিয়াকত শাহ বলেন, ‘দুই-আড়াই যুগের ব্যবধান। আমাদের সময় আর এখনকার সময় অনেক তফাৎ। আমরা যখন পড়াশোনা করি, তখন সিলেটে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় ছিল না। চট্টগ্রাম গিয়ে পড়াশোনা করতে হয়েছে। এখন বেশ কয়েকটি পাবলিক ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে, এটি নিঃসন্দেহে উচ্চশিক্ষাকে হাতের নাগালের মধ্যে পাওয়া।’
এরপরও লিয়াকত শাহ মনে করেন, একটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন জরুরি। কারণ, শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ফোকলোর, নাট্যকলাসহ কলা বিভাগের অনেক বিষয়ে পড়াশোনার সুযোগ নেই। এ ঘাটতি কাটাতে হলে একটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় জরুরি। এর বাইরে সিলেটে একটি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনও সময়ের দাবি।
অভিজিৎ কুমার পাল সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা পদে আছেন। ১৯৯১ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতি বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘ঢাকা, রাজশাহী কিংবা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া আমাদের উচ্চশিক্ষার জন্য বিকল্প কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল না। অনেকে তখন কষ্ট করে সিলেট থেকে অন্যত্র গিয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতেন। দূরবর্তী এলাকায় গিয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে হবে, এমন কারণে উচ্চশিক্ষার আগেই অনেকের পড়াশোনা থেমে যেত। আর এখন উচ্চশিক্ষার সুযোগ বাড়ির কাছেই।
সিলেটের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা হয়। তাঁরা বলেন, শিক্ষার মান এবং পড়াশোনা নিয়ে কারও মধ্যে বড় কোনো অভিযোগ নেই। তবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীদের আবাসন-সংকট অনেক ক্ষেত্রে প্রকট। এ ছাড়া পর্যাপ্ত ও পছন্দমতো বিষয়ের অভাবও রয়েছে। দুটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে ঠিকই। কিন্তু দুটিই বিশেষায়িত। এমনকি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও বেশিসংখ্যক শিক্ষার্থীর ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিয়ে গৎবাঁধা কিছু বিষয় নির্ধারণ করছে। ফলে বৈচিত্র্যময় বিষয়ের ওপর পড়াশোনার সুযোগ সৃষ্টি হয়নি। চারুকলা, ফোকলোর, নাট্যকলা, সাংবাদিকতাসহ নানা আকর্ষণীয় বিষয় চালু করা গেলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পূর্ণাঙ্গতা পেত বলেও তাঁরা মন্তব্য করেছেন।
শিক্ষাবিদেরা বলছেন, নানা কারণে সারা দেশেই শিক্ষার মান নিম্নগামী হচ্ছে। এ থেকে সিলেটের চিত্রও ভিন্ন নয়। তবে সেটা ভিন্ন বিষয় জানিয়ে শিক্ষাবিদদের ভাষ্য, তুলনামূলকভাবে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় উচ্চশিক্ষার মান সিলেটে খুব একটা খারাপ নয়। এ কারণেই এখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষ করে অনেকেই উচ্চপদস্থ সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক থেকে শুরু করে গুরুত্বপূর্ণ নানান পদে চাকরি পাচ্ছেন।
বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে দেশে ৪৯টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এর মধ্যে দুটি সিলেটে। ১০৩টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং ৩টি আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। চারটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সিলেটে। উচ্চশিক্ষার সুযোগ নাগালের মধ্যে আসার পর সিলেটের শিক্ষার গুণগত মানের কী অবস্থা? এমন প্রশ্নের উত্তর নিয়েও তর্ক-বিতর্ক আছে। তবে এ প্রসঙ্গ উল্লেখ করে শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা ২০১০ সালে স্পেনের বৃহত্তম সরকারি গবেষণা সংস্থা সিএসআইসি (Consejo Superior de Investigaciones Cientificas)-এর বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক সারা বিশ্বে পরিচালিত একটি জরিপের উদাহরণ দিয়েছেন। এই জরিপে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ১২তম স্থানে জায়গা করে নিয়েছিল।
সিলেটের শিক্ষাবিদ, ভাষাসংগ্রামী অধ্যাপক মো. আবদুল আজিজ সিলেটের মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটির ‘ইমিরেটাস প্রফেসর’ পদে আছেন। সিলেটে থেকে তাঁর এ পদে আসীনও যেন উচ্চশিক্ষা প্রসারের আরও এক উদাহরণ। আবদুল আজিজ প্রথম আলোকে বলেন, উচ্চশিক্ষার সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে সিলেটের চিত্র অতীত আর বর্তমানের মধ্যে এখন অনেক তফাৎ। শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ তৈরিতে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার ইতিহাস সিলেটবাসীর জন্য একটি বাঁক বদলের মতোই ঘটনা। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের পর সিলেটে আরও কয়েকটি সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এটি অবশ্যই ইতিবাচক একটি বিষয়। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের এখন উচিত শিক্ষার প্রকৃত ও গুণগত উন্নয়নের দিকে নজর দেওয়া। তবেই শিক্ষার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ নিশ্চিত হবে।
শিক্ষাদীক্ষার সুযোগ-সুবিধা বাড়ায় বদলে যাচ্ছে সিলেট নগরও। হজরত শাহজালাল (রহ.) ও হজরত শাহপরান (রহ.) দরগাহ সিলেট নগরে থাকায় সিলেটকে ‘আধ্যাত্মিক নগর’ বা ‘৩৬০ আউলিয়ার শহর’ বলা হতো। যুক্তরাজ্যপ্রবাসী বেশি হওয়ায় সিলেটকে ‘বাংলাদেশের লন্ডন’ নামেও ডাকা হয়। চা-বাগান, পাহাড়-ঝরনাধারার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ‘পর্যটক নগর’ পরিচিতির মধ্যে শিক্ষাদীক্ষার প্রসার, বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর ‘শিক্ষানগর’ বলেও ডাকা হয়। ভবিষ্যতের হাতছানি ‘স্মার্টসিটি সিলেট’।
একাদশ জাতীয় নির্বাচনে সিলেট-১ (মহানগর-সদর) আসন থেকে নির্বাচিত সাংসদ পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের নির্বাচনী অঙ্গীকার ছিল সিলেটকে বাংলাদেশের প্রথম ‘ডিজিটাল সিটি’ গড়া। নির্বাচনের পর তিনি তাঁর অঙ্গীকার বাস্তবায়নে ১০০ দিনের কর্মসূচির কথাও ঘোষণা করেছেন।
সিলেটের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী জানিয়েছেন, সিলেট নগর উন্নয়নের প্রতিটি প্রকল্পে এখন শিক্ষার্থীদের কথা বিবেচনায় রাখা হয়েছে। মেয়র বলেন, তথ্যপ্রযুক্তির সব সুবিধা দিতে সিলেটকে স্মার্টসিটি হিসেবে গড়ে তোলা সময়ের দাবিতে রূপ নেওয়ার পেছনে তাগাদা হচ্ছে শিক্ষাদীক্ষায় অগ্রসর হওয়া।
শিক্ষার্থী কত
সিলেটসহ তিন জেলায় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর কোর্স চালু রয়েছে, এমন ২০টি কলেজে লক্ষাধিক শিক্ষার্থী রয়েছেন। এ ছাড়া শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, চারটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, এমসি কলেজ, মদনমোহন কলেজ, সরকারি মহিলা কলেজসহ উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৫০ হাজারের বেশি।
মেডিকেল শিক্ষায়ও উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্র সৃষ্টি হয়েছে। সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন চূড়ান্ত হওয়ার পর উপাচার্য নিয়োগের মধ্য দিয়ে দাপ্তরিক কাজও শুরু হয়েছে। হবিগঞ্জে শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজে এবার থেকে শিক্ষার্থী ভর্তির প্রক্রিয়ায় রয়েছে। সুনামগঞ্জে নতুন মেডিকেল কলেজ স্থাপনে ভূমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া চলছে।
সিলেটে এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ নামে সরকারি মেডিকেল কলেজ ছাড়াও বেসরকারি মেডিকেল কলেজ রয়েছে চারটি। এগুলো হচ্ছে, জালালাবাদ রাগীব-রাবেয়া মেডিকেল কলেজ, নর্থ ইস্ট মেডিকেল কলেজ, সিলেট উইমেন্স মেডিকেল কলেজ ও পার্কভিউ মেডিকেল কলেজ। সিলেট সেন্ট্রাল ডেন্টাল কলেজ ও ইউনানী মেডিকেল কলেজ, একটি সরকারিসহ নার্সিং কলেজ রয়েছে চারটি। মেডিকেল ও নার্সিং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১০ হাজারের বেশি। মেডিকেল কলেজে বিদেশি শিক্ষার্থীও আছেন।
No comments