সাংবাদিকতা, গণতন্ত্র ও রাষ্ট্র
বিদেশে যখন আমি সাংবাদিকতা পড়ছিলাম, তখন আমার শিক্ষক বলেছিলেন, নিউজ স্টোরি বা সংবাদ প্রতিবেদন হওয়া উচিত স্কার্টের মতো। মানে, তা এতটা বড় হবে যাতে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে সব তথ্য দেওয়া যায়, আবার তা যেন আকর্ষণীয়ও হয়। বছরের পর বছর ধরে নিউজের স্টোরি অংশটা ফুলেফেঁপে উঠেছে, যার সঙ্গে অনিবার্যভাবেই অনেক উপাদান যুক্ত হবে। জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকেরা যখন এক এক করে মারা যাচ্ছেন, তখন আমাদের সামনে যে প্রশ্নের উদয় হয়েছে তা হলো, ভবিষ্যতে কোন ধরনের সাংবাদিকতা থাকবে। অবশ্যই ব্যাপারটা শুধু ভারতের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। সবাই একই প্রশ্ন করছেন, কোন লক্ষ্মণরেখা সাংবাদিকদের অতিক্রম করা উচিত নয়? অথবা সাংবাদিকদের জন্য কোনো লক্ষ্মণরেখা আদৌ থাকা উচিত কি না?
ব্যক্তি নাগরিকেরা ক্রমবর্ধমান হারে একটি প্রশ্ন করে যাচ্ছেন, সাংবাদিকেরা কেন তাঁদের ব্যক্তিগত বিষয়ে নাক গলাবেন। আর সাংবাদিকেরা আত্মরক্ষা করেন এ কথা বলে যে তাঁরা যদি পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করেন, তাহলে তো ঝোলা থেকে বিড়াল বেরোবে না। আর সরকার বলে সেই গৎবাঁধা কথা: কিছু কিছু জিনিস জনস্বার্থে উন্মোচন করা ঠিক নয়। এভাবে অনেক বড় বড় কেলেঙ্কারির ঘটনা ধামাচাপা দেওয়া হয়। মনে আছে, সুপ্রিম কোর্টের তিন বিচারপতিকে ডিঙিয়ে যখন অন্য একজনকে প্রধান বিচারপতি পদে নিয়োগ দেওয়া হয়, তখন আমি এর বিরুদ্ধে লিখলে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী আমার সমালোচনা করেছিলেন, বিচারপতিদের ‘অঙ্গীকার’ নিয়ে বয়ান দেওয়া সাংবাদিকদের কাজ নয়। তিনি অবশ্য বলেননি, সেই ‘অঙ্গীকার’ আসলে কী জিনিস। আমি বুঝি বিচারপতিরা সংবিধানের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ, কোনো ব্যক্তির প্রতি নয়, তা সেই ব্যক্তি যত বড়ই হোন না কেন। আসলে, ইন্দিরা গান্ধী চাইছিলেন, বিচারপতিরা যেন তাঁর কথা মেনে চলেন, অর্থাৎ তাঁর প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ থাকেন। সে কারণেই তিনি তিন জ্যেষ্ঠ বিচারপতিকে ডিঙিয়ে বিচারপতি রায়কে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন। এমনকি তিনি সেই তিনজনকে আগে থেকে তা জানানোরও সৌজন্য দেখাননি। তাঁরা সবাই অল ইন্ডিয়া রেডিওতে সে খবর শুনেছিলেন।
এ ধরনের রাজনৈতিক দাদাগিরি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। কারণ, গণতন্ত্রের কাঠামো আসলে ক্ষমতার বিভাজন ও সীমাবদ্ধতার ওপর নির্ভরশীল। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের সব অঙ্গ স্বাধীনভাবে কাজ করে, কিন্তু সেটাও এমনভাবে হওয়া উচিত যাতে সার্বভৌমত্ব জনগণের হাতেই থাকে। হ্যাঁ, শাসকেরা কর্তৃত্বপরায়ণ হয়ে যান বা নিকৃষ্টতম মোগল শাসকের মতো আচরণ করেন, সেটা ভিন্ন বিষয়। কথা হচ্ছে, গণতন্ত্র যাতে জনগণের স্বার্থে কাজ করে, সেটা নিশ্চিত করার দায়িত্ব বিচারকদের। আর বিচার বিভাগ সবার ওপরে, নাকি নির্বাহী বিভাগ—সেটা এক চলমান বিতর্ক। সাংবাদিকদের কাজ রাষ্ট্রের এই অঙ্গগুলো ঠিকঠাক কাজ করছে কি না, সেদিকে খেয়াল রাখা। এটা তাঁদের দায়িত্ব। তাঁরা যদি তা করার সাহস না দেখান, তাহলে তা খুব দুর্ভাগ্যজনক হবে। আমার মনে আছে, ৪১ বছর আগে ভারতে যখন জরুরি অবস্থা জারি করা হয়, তখন কীভাবে পুরো গণমাধ্যম ধসে পড়েছিল। শুরুতে সম্পাদকসহ সাংবাদিকেরা প্রেসক্লাবে জড়ো হয়ে প্রেস সেনসরশিপের প্রতিবাদ করেছিলেন। কিন্তু ধীরে ধীরে তাঁরা এত ভীত হয়ে পড়েন যে ইন্দিরা গান্ধীর ছেলে সঞ্জয় গান্ধীর নির্দেশও পালন করতে শুরু করেন।
প্রেস কাউন্সিল অব ইন্ডিয়ার একজন সদস্য হিসেবে আমি সংস্থাটির চেয়ারম্যান বিচারপতি আয়ারকে বলেছিলাম, কাউন্সিলের বৈঠক ডাকা হোক। আমি তখনো জানতাম না, ভয় ইতিমধ্যে তাঁকেও জি হুজুর বানিয়ে দিয়েছে। তিনি বললেন, বৈঠক ডেকে লাভ হবে না, কারণ এর খবর তো প্রচার হবে না। আমার যুক্তি ছিল, আমরা যদি প্রতিবাদ না করি তাহলে ভবিষ্যতে আর্কাইভ খুললে লোকে জানতে পারবে, প্রেস কাউন্সিল বা সাংবাদিকেরা এই লজ্জাকর জরুরি অবস্থার প্রতিবাদ করেননি। জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার করার পর শ্বেতপত্র প্রকাশিত হলে আমি জানতে পারি, তিনি তৎকালীন তথ্যমন্ত্রী ভি সি শুক্লাকে চিঠি লিখেছিলেন, কীভাবে তিনি কুলদীপ নায়ারের প্রেস কাউন্সিলের বৈঠক ডাকার চেষ্টা রহিত করেছিলেন। একইভাবে, বিভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে সাংবাদিকদের স্বাধীনতার প্রশ্নটি আমার মনে ঘুরেফিরে আসে। আমি দেখছি, আমরা সাংবাদিকেরা যথাযথ মান অর্জন করতে পারিনি। ডিজিটাল প্রযুক্তি এসেও লাভ হয়নি। ওই ছোট ছোট নিউজ স্টোরিও কাজের কিছু নয়। বস্তুত ব্যাপারটা এত খারাপ পর্যায়ে গেছে যে সংবাদ কলামও এখন কেনা যাচ্ছে। এটা তো এখন ওপেন সিক্রেট যে কিছু কিছু স্টোরি আসলে টাকা দিয়ে করানো হয়। কিছু কিছু শীর্ষ সংবাদপত্র তো পত্রিকার জায়গা যারতার কাছে বিক্রি করে। তাদের কাছে ব্যাপারটা স্রেফ রোজগারের, আর কিছুর নয়।
আমরা কত উঁচুতে উঠেছিলাম, আর সেখান থেকে কোথায় নেমেছি? একসময় আমরা মুন্ধ্রা ইনস্যুরেন্সের মতো দুর্নীতির ঘটনা জনসমক্ষে আনতে পারতাম, তখন অর্থমন্ত্রী ছিলেন টি টি কৃষ্ণাচারী। জওহরলাল নেহরু তাঁকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেছিলেন। জনগণের দুঃখ-দুর্দশার ব্যাপারে ভারত উদাসীন। যুক্তরাজ্যের গণমাধ্যম একসময় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার নিরীহ ভুক্তভোগী মানুষের জন্য দাঁড়াত। যেমন সানডে টাইমস-এর কথাই বলা যায়, আমি এ পত্রিকার স্ট্রিংগার হিসেবে কাজ করেছি। তারা থ্যালিডোমাইড ওষুধের কারণে বিকলাঙ্গ হয়ে জন্ম নেওয়া শিশুদের জন্য যা করেছিল, তার জন্য মানুষ এখনো কৃতজ্ঞচিত্তে তাদের স্মরণ করে। মানুষের চাপের কারণে ওষুধ কোম্পানি ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য হয়। আমরা কি আজ সে মানে আবার যেতে পারব? আমাদের সাংবাদিকদের সততাই তো প্রশ্নের মুখে পড়েছে, সেই উচ্চমানের কথা আর না-ই বললাম।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন।
কুলদীপ নায়ার: ভারতীয় সাংবাদিক।
ব্যক্তি নাগরিকেরা ক্রমবর্ধমান হারে একটি প্রশ্ন করে যাচ্ছেন, সাংবাদিকেরা কেন তাঁদের ব্যক্তিগত বিষয়ে নাক গলাবেন। আর সাংবাদিকেরা আত্মরক্ষা করেন এ কথা বলে যে তাঁরা যদি পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করেন, তাহলে তো ঝোলা থেকে বিড়াল বেরোবে না। আর সরকার বলে সেই গৎবাঁধা কথা: কিছু কিছু জিনিস জনস্বার্থে উন্মোচন করা ঠিক নয়। এভাবে অনেক বড় বড় কেলেঙ্কারির ঘটনা ধামাচাপা দেওয়া হয়। মনে আছে, সুপ্রিম কোর্টের তিন বিচারপতিকে ডিঙিয়ে যখন অন্য একজনকে প্রধান বিচারপতি পদে নিয়োগ দেওয়া হয়, তখন আমি এর বিরুদ্ধে লিখলে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী আমার সমালোচনা করেছিলেন, বিচারপতিদের ‘অঙ্গীকার’ নিয়ে বয়ান দেওয়া সাংবাদিকদের কাজ নয়। তিনি অবশ্য বলেননি, সেই ‘অঙ্গীকার’ আসলে কী জিনিস। আমি বুঝি বিচারপতিরা সংবিধানের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ, কোনো ব্যক্তির প্রতি নয়, তা সেই ব্যক্তি যত বড়ই হোন না কেন। আসলে, ইন্দিরা গান্ধী চাইছিলেন, বিচারপতিরা যেন তাঁর কথা মেনে চলেন, অর্থাৎ তাঁর প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ থাকেন। সে কারণেই তিনি তিন জ্যেষ্ঠ বিচারপতিকে ডিঙিয়ে বিচারপতি রায়কে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন। এমনকি তিনি সেই তিনজনকে আগে থেকে তা জানানোরও সৌজন্য দেখাননি। তাঁরা সবাই অল ইন্ডিয়া রেডিওতে সে খবর শুনেছিলেন।
এ ধরনের রাজনৈতিক দাদাগিরি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। কারণ, গণতন্ত্রের কাঠামো আসলে ক্ষমতার বিভাজন ও সীমাবদ্ধতার ওপর নির্ভরশীল। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের সব অঙ্গ স্বাধীনভাবে কাজ করে, কিন্তু সেটাও এমনভাবে হওয়া উচিত যাতে সার্বভৌমত্ব জনগণের হাতেই থাকে। হ্যাঁ, শাসকেরা কর্তৃত্বপরায়ণ হয়ে যান বা নিকৃষ্টতম মোগল শাসকের মতো আচরণ করেন, সেটা ভিন্ন বিষয়। কথা হচ্ছে, গণতন্ত্র যাতে জনগণের স্বার্থে কাজ করে, সেটা নিশ্চিত করার দায়িত্ব বিচারকদের। আর বিচার বিভাগ সবার ওপরে, নাকি নির্বাহী বিভাগ—সেটা এক চলমান বিতর্ক। সাংবাদিকদের কাজ রাষ্ট্রের এই অঙ্গগুলো ঠিকঠাক কাজ করছে কি না, সেদিকে খেয়াল রাখা। এটা তাঁদের দায়িত্ব। তাঁরা যদি তা করার সাহস না দেখান, তাহলে তা খুব দুর্ভাগ্যজনক হবে। আমার মনে আছে, ৪১ বছর আগে ভারতে যখন জরুরি অবস্থা জারি করা হয়, তখন কীভাবে পুরো গণমাধ্যম ধসে পড়েছিল। শুরুতে সম্পাদকসহ সাংবাদিকেরা প্রেসক্লাবে জড়ো হয়ে প্রেস সেনসরশিপের প্রতিবাদ করেছিলেন। কিন্তু ধীরে ধীরে তাঁরা এত ভীত হয়ে পড়েন যে ইন্দিরা গান্ধীর ছেলে সঞ্জয় গান্ধীর নির্দেশও পালন করতে শুরু করেন।
প্রেস কাউন্সিল অব ইন্ডিয়ার একজন সদস্য হিসেবে আমি সংস্থাটির চেয়ারম্যান বিচারপতি আয়ারকে বলেছিলাম, কাউন্সিলের বৈঠক ডাকা হোক। আমি তখনো জানতাম না, ভয় ইতিমধ্যে তাঁকেও জি হুজুর বানিয়ে দিয়েছে। তিনি বললেন, বৈঠক ডেকে লাভ হবে না, কারণ এর খবর তো প্রচার হবে না। আমার যুক্তি ছিল, আমরা যদি প্রতিবাদ না করি তাহলে ভবিষ্যতে আর্কাইভ খুললে লোকে জানতে পারবে, প্রেস কাউন্সিল বা সাংবাদিকেরা এই লজ্জাকর জরুরি অবস্থার প্রতিবাদ করেননি। জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার করার পর শ্বেতপত্র প্রকাশিত হলে আমি জানতে পারি, তিনি তৎকালীন তথ্যমন্ত্রী ভি সি শুক্লাকে চিঠি লিখেছিলেন, কীভাবে তিনি কুলদীপ নায়ারের প্রেস কাউন্সিলের বৈঠক ডাকার চেষ্টা রহিত করেছিলেন। একইভাবে, বিভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে সাংবাদিকদের স্বাধীনতার প্রশ্নটি আমার মনে ঘুরেফিরে আসে। আমি দেখছি, আমরা সাংবাদিকেরা যথাযথ মান অর্জন করতে পারিনি। ডিজিটাল প্রযুক্তি এসেও লাভ হয়নি। ওই ছোট ছোট নিউজ স্টোরিও কাজের কিছু নয়। বস্তুত ব্যাপারটা এত খারাপ পর্যায়ে গেছে যে সংবাদ কলামও এখন কেনা যাচ্ছে। এটা তো এখন ওপেন সিক্রেট যে কিছু কিছু স্টোরি আসলে টাকা দিয়ে করানো হয়। কিছু কিছু শীর্ষ সংবাদপত্র তো পত্রিকার জায়গা যারতার কাছে বিক্রি করে। তাদের কাছে ব্যাপারটা স্রেফ রোজগারের, আর কিছুর নয়।
আমরা কত উঁচুতে উঠেছিলাম, আর সেখান থেকে কোথায় নেমেছি? একসময় আমরা মুন্ধ্রা ইনস্যুরেন্সের মতো দুর্নীতির ঘটনা জনসমক্ষে আনতে পারতাম, তখন অর্থমন্ত্রী ছিলেন টি টি কৃষ্ণাচারী। জওহরলাল নেহরু তাঁকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেছিলেন। জনগণের দুঃখ-দুর্দশার ব্যাপারে ভারত উদাসীন। যুক্তরাজ্যের গণমাধ্যম একসময় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার নিরীহ ভুক্তভোগী মানুষের জন্য দাঁড়াত। যেমন সানডে টাইমস-এর কথাই বলা যায়, আমি এ পত্রিকার স্ট্রিংগার হিসেবে কাজ করেছি। তারা থ্যালিডোমাইড ওষুধের কারণে বিকলাঙ্গ হয়ে জন্ম নেওয়া শিশুদের জন্য যা করেছিল, তার জন্য মানুষ এখনো কৃতজ্ঞচিত্তে তাদের স্মরণ করে। মানুষের চাপের কারণে ওষুধ কোম্পানি ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য হয়। আমরা কি আজ সে মানে আবার যেতে পারব? আমাদের সাংবাদিকদের সততাই তো প্রশ্নের মুখে পড়েছে, সেই উচ্চমানের কথা আর না-ই বললাম।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন।
কুলদীপ নায়ার: ভারতীয় সাংবাদিক।
No comments