মায়ের হাতটি যখন থাকবে না... by মানসুরা হোসাইন
মা দেলেরা বেগম দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মেয়ের পোশাক ঠিক করে দিচ্ছেন। মোহাম্মদপুরের পুেরােনা থানা রোড সিগন্যাল থেকে তোলা ছবি |
‘আমি
আমার এক চোখ দিতে চাইছিলাম মেয়েরে। ভাবছিলাম আমার এক চোখ দিয়া মেয়ে দেখব।
কিন্তু কেউ নিল না। ডাক্তাররা জানাই দিছে মেয়ের চোখ আর ভালা হবে না। এখন
মেয়েরে ছাইড়া এক মিনিটও দূরে থাকি না। আমি যত দিন বাইচ্যা আছি আমার মেয়ের
শরীর তো দূরের কথা একটা পশমেও কেউ হাত দিবার পারব না।’
কথাগুলো বলছিলেন দেলেরা বেগম। রাজধানীর মোহাম্মদপুরের পুেরােনা থানা রোড সিগন্যালে দেলেরা বেগম এবং তাঁর ১৮ বছর বয়সী মেয়ে কল্পনার সংসার। রবি ও সোমবার ছাড়া সপ্তাহের বাকি দিনগুলো কাটে এই সিগন্যালে। সকাল ছয়টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সিগন্যালের পাশেই ফুটপাতে দিনের খাওয়া, ঘুম সবই চলে। বৃষ্টি-বাদলার দিনে পাশের মার্কেটে আশ্রয় নেন তাঁরা। বাথরুমও সারেন সেখানেই।
গতকাল শনিবার বিকেলে কথা হয় দেলেরা বেগম ও কল্পনার সঙ্গে। কল্পনা দুই চোখে কিছুই দেখতে পান না। তিন বছর বয়সে কল্পনার টাইফয়েড হয়। চিকিৎসার পেছনে শুধু টাকা খরচই হয়েছে, লাভ হয়নি। তারপর মা দেলেরাই কল্পনার একমাত্র আশ্রয়। মায়ের হাতটি ধরেই কাটিয়ে দিলেন ১৮ বছর।
মায়ের হাতটি যখন থাকবে না তখন কী হবে? এই প্রশ্নে মায়ের মুখ অন্ধকার। কেননা, এই প্রশ্নের উত্তর তাঁর কাছে অজানা। শুধু জানেন, এই মেয়ের জন্য সৃষ্টিকর্তাই ভরসা। এরপর যদি কেউ থাকে তা তাঁর ছোট মেয়ে। ছোট মেয়েই হয়তো এই মেয়ের দিকে হাত বাড়াবে। কিন্তু তা-ও অনিশ্চিত।
কল্পনার গায়ে জামা পরিয়ে দেওয়া, গোসল করানো, ভাত মুখে তুলে দেওয়া, টয়লেটে গেলে পানি ঢেলে দেওয়া, মাসিকের সময় পরিষ্কার করে দেওয়া, সবই করতে হয় দেলেরাকে। তিনি এসব কাজই করেন হাসিমুখে। তাঁর ভাষায় বিরক্ত হয়েই বা কী হবে?
চোখে সমস্যা হওয়ার পর থেকে কল্পনা অন্য দশটি মেয়ের মতো বেড়ে ওঠেননি। তাঁর কল্পজগতে কখন কী চলে তা মা-ও অনেক সময় বুঝতে পারেন না। রেগে গেলে মাকে গালি দেওয়া, আঘাত করা সবই করেন। মা সবকিছু সহ্য করেন মেয়ের মুখের দিকে চেয়ে। বয়স অনুযায়ী বুদ্ধির দিক থেকেও কল্পনা খানিকটা পিছিয়ে আছেন।
দেলেরা বেগমের বাড়ি নওগাঁয়। ঢাকায় আছেন দীর্ঘদিন ধরে। তাঁর দুই মেয়ে। ছোট মেয়ে চোখে দেখতে পায়। দেখতেও সুন্দর। তাকে কিছু পড়াশোনাও করিয়েছেন দেলেরা। ছোট মেয়ের যখন ছয় মাস বয়স তখন দেলেরার স্বামী আরেক বিয়ে করে তাঁদের ছেড়ে চলে যান। স্বামী মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত আর কোনো সম্পর্ক ছিল না। দেলেরা একাই দুই মেয়েকে নিয়ে পাড়ি দিয়েছেন এতগুলো বছর। একসময় পোশাকশিল্প কারখানায় কাজ করেছেন দেলেরা। সেখান থেকে টাকা জমিয়ে গ্রামে দেড় কাঠা জমি কিনে একটি ঘর তুলেছেন। খেয়ে না-খেয়ে টাকা জমিয়েছেন ছোট মেয়ের বিয়ের জন্য। ৫০ হাজার টাকা খরচ করে দুই বছর আগে ছোট মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন।
বড় মেয়ে কল্পনার বিয়ের চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলেছেন। স্বাভাবিক সুরেই বললেন, ‘ওর তো বিয়া হবে না। কে বিয়া করব? আমার একটি ঘর আছে। তা বড় মেয়ের নামেই কিনছি। এই ঘরের লোভে কেউ বিয়া করল, কিন্তু তারপর যদি আমার মেয়েরে আর না দেখে? আমার তো আর কেউ দেখার নাই।’
দেলেরা জানালেন, এত বড় মেয়েকে নিয়ে রাস্তায় ভিক্ষা করতে ভালো লাগে না। মেয়েও আর মানুষের কাছে হাত পাততে চান না। দুই-পাঁচ টাকা পেতে দুই-তিন সিগন্যাল পার করতে হয়। আবার কোনো কোনো দিন এক শ বা দেড় শ টাকাও মেলে। এই টাকা দিয়েই কল্যাণপুরে একটি ঘরের জন্য দুই হাজার টাকা ভাড়া দেন দেলেরা। মা ও মেয়ে মাংস খেয়েছিলেন গত কোরবানির ঈদে। বড় মাছ কবে খেয়েছিলেন মনে নেই। গতকাল দুপুরে মা ও মেয়ে ভাত খেয়েছেন শুধু আলুভর্তা দিয়ে। মেয়েকে সারাক্ষণ আগলে রাখতে হয় বলে এখন আর ভিক্ষা ছাড়া অন্য কোনো কাজও করতে পারেন না।
৪৫ বছর বয়সী দেলেরা বলেন, ‘খাই আর না-খাই ঘরভাড়া জমা করি না। ঘরে থেকে বাইর কইরা দিলে মেয়েরে নিয়া কই দাঁড়ামু?’
মেয়ের জন্য কী চান জানতে চাইলে দেলেরা বলেন, ‘আমি আমার কথা ভাবি না। ভিক্ষা না কইরা ঘরে বইসাই যদি মেয়ের তিনবেলা খাবার জোগাড় হইত। মেয়েরে নিয়া যদি আর পথে পথে ভিক্ষা করতে না হইত। সিগন্যালে সবাই দুই-এক টাকা কইরা দিলেই কিছু টাকা জমাইতে পারতাম। কিন্তু সবাই দেয় না। তখন খুব খারাপ লাগে।’
মুখে এক টুকরো কষ্টের হাসি এনে দেলেরা বললেন, ‘আমার মনে হয়, আমি মইরা গেলে আমার এই মেয়েও বেশি দিন বাঁচব না। খুব বেশি হইলে এক-দেড় বছর বাঁচব। তারপর মইরা যাইব।’
কথাগুলো বলছিলেন দেলেরা বেগম। রাজধানীর মোহাম্মদপুরের পুেরােনা থানা রোড সিগন্যালে দেলেরা বেগম এবং তাঁর ১৮ বছর বয়সী মেয়ে কল্পনার সংসার। রবি ও সোমবার ছাড়া সপ্তাহের বাকি দিনগুলো কাটে এই সিগন্যালে। সকাল ছয়টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সিগন্যালের পাশেই ফুটপাতে দিনের খাওয়া, ঘুম সবই চলে। বৃষ্টি-বাদলার দিনে পাশের মার্কেটে আশ্রয় নেন তাঁরা। বাথরুমও সারেন সেখানেই।
গতকাল শনিবার বিকেলে কথা হয় দেলেরা বেগম ও কল্পনার সঙ্গে। কল্পনা দুই চোখে কিছুই দেখতে পান না। তিন বছর বয়সে কল্পনার টাইফয়েড হয়। চিকিৎসার পেছনে শুধু টাকা খরচই হয়েছে, লাভ হয়নি। তারপর মা দেলেরাই কল্পনার একমাত্র আশ্রয়। মায়ের হাতটি ধরেই কাটিয়ে দিলেন ১৮ বছর।
মায়ের হাতটি যখন থাকবে না তখন কী হবে? এই প্রশ্নে মায়ের মুখ অন্ধকার। কেননা, এই প্রশ্নের উত্তর তাঁর কাছে অজানা। শুধু জানেন, এই মেয়ের জন্য সৃষ্টিকর্তাই ভরসা। এরপর যদি কেউ থাকে তা তাঁর ছোট মেয়ে। ছোট মেয়েই হয়তো এই মেয়ের দিকে হাত বাড়াবে। কিন্তু তা-ও অনিশ্চিত।
কল্পনার গায়ে জামা পরিয়ে দেওয়া, গোসল করানো, ভাত মুখে তুলে দেওয়া, টয়লেটে গেলে পানি ঢেলে দেওয়া, মাসিকের সময় পরিষ্কার করে দেওয়া, সবই করতে হয় দেলেরাকে। তিনি এসব কাজই করেন হাসিমুখে। তাঁর ভাষায় বিরক্ত হয়েই বা কী হবে?
চোখে সমস্যা হওয়ার পর থেকে কল্পনা অন্য দশটি মেয়ের মতো বেড়ে ওঠেননি। তাঁর কল্পজগতে কখন কী চলে তা মা-ও অনেক সময় বুঝতে পারেন না। রেগে গেলে মাকে গালি দেওয়া, আঘাত করা সবই করেন। মা সবকিছু সহ্য করেন মেয়ের মুখের দিকে চেয়ে। বয়স অনুযায়ী বুদ্ধির দিক থেকেও কল্পনা খানিকটা পিছিয়ে আছেন।
দেলেরা বেগমের বাড়ি নওগাঁয়। ঢাকায় আছেন দীর্ঘদিন ধরে। তাঁর দুই মেয়ে। ছোট মেয়ে চোখে দেখতে পায়। দেখতেও সুন্দর। তাকে কিছু পড়াশোনাও করিয়েছেন দেলেরা। ছোট মেয়ের যখন ছয় মাস বয়স তখন দেলেরার স্বামী আরেক বিয়ে করে তাঁদের ছেড়ে চলে যান। স্বামী মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত আর কোনো সম্পর্ক ছিল না। দেলেরা একাই দুই মেয়েকে নিয়ে পাড়ি দিয়েছেন এতগুলো বছর। একসময় পোশাকশিল্প কারখানায় কাজ করেছেন দেলেরা। সেখান থেকে টাকা জমিয়ে গ্রামে দেড় কাঠা জমি কিনে একটি ঘর তুলেছেন। খেয়ে না-খেয়ে টাকা জমিয়েছেন ছোট মেয়ের বিয়ের জন্য। ৫০ হাজার টাকা খরচ করে দুই বছর আগে ছোট মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন।
বড় মেয়ে কল্পনার বিয়ের চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলেছেন। স্বাভাবিক সুরেই বললেন, ‘ওর তো বিয়া হবে না। কে বিয়া করব? আমার একটি ঘর আছে। তা বড় মেয়ের নামেই কিনছি। এই ঘরের লোভে কেউ বিয়া করল, কিন্তু তারপর যদি আমার মেয়েরে আর না দেখে? আমার তো আর কেউ দেখার নাই।’
দেলেরা জানালেন, এত বড় মেয়েকে নিয়ে রাস্তায় ভিক্ষা করতে ভালো লাগে না। মেয়েও আর মানুষের কাছে হাত পাততে চান না। দুই-পাঁচ টাকা পেতে দুই-তিন সিগন্যাল পার করতে হয়। আবার কোনো কোনো দিন এক শ বা দেড় শ টাকাও মেলে। এই টাকা দিয়েই কল্যাণপুরে একটি ঘরের জন্য দুই হাজার টাকা ভাড়া দেন দেলেরা। মা ও মেয়ে মাংস খেয়েছিলেন গত কোরবানির ঈদে। বড় মাছ কবে খেয়েছিলেন মনে নেই। গতকাল দুপুরে মা ও মেয়ে ভাত খেয়েছেন শুধু আলুভর্তা দিয়ে। মেয়েকে সারাক্ষণ আগলে রাখতে হয় বলে এখন আর ভিক্ষা ছাড়া অন্য কোনো কাজও করতে পারেন না।
৪৫ বছর বয়সী দেলেরা বলেন, ‘খাই আর না-খাই ঘরভাড়া জমা করি না। ঘরে থেকে বাইর কইরা দিলে মেয়েরে নিয়া কই দাঁড়ামু?’
মেয়ের জন্য কী চান জানতে চাইলে দেলেরা বলেন, ‘আমি আমার কথা ভাবি না। ভিক্ষা না কইরা ঘরে বইসাই যদি মেয়ের তিনবেলা খাবার জোগাড় হইত। মেয়েরে নিয়া যদি আর পথে পথে ভিক্ষা করতে না হইত। সিগন্যালে সবাই দুই-এক টাকা কইরা দিলেই কিছু টাকা জমাইতে পারতাম। কিন্তু সবাই দেয় না। তখন খুব খারাপ লাগে।’
মুখে এক টুকরো কষ্টের হাসি এনে দেলেরা বললেন, ‘আমার মনে হয়, আমি মইরা গেলে আমার এই মেয়েও বেশি দিন বাঁচব না। খুব বেশি হইলে এক-দেড় বছর বাঁচব। তারপর মইরা যাইব।’
No comments