চালের বাজার হুমকির মুখে by হামিদ বিশ্বাস
ভারত
থেকে আসা চালে ছেয়ে গেছে দেশের বাজার। নিম্নমানের এ চালের দাম কম হওয়ায়
অতি মুনাফার লোভে ব্যবসায়ীরা এ চাল আমদানি করছেন। এতে দেশী চালের বাজার
হুমকিতে পড়েছে। ভারত থেকে অব্যাহতভাবে চাল এলে দেশের কৃষক ও কৃষিব্যবস্থা
ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে মনে করছেন বাজার বিশেষজ্ঞরা। চাল ব্যবসায়ীদের সঙ্গে
কথা বলে জানা গেছে, শূন্য শুল্কে চাল আমদানির পাশাপাশি ভারতীয় ব্যবসায়ীরা
তাদের দেশ থেকে চাল রপ্তানির উপর প্রণোদনাও পাচ্ছেন। ফলে বাংলাদেশের চালের
চেয়ে ভারতীয় চালের দাম কম পড়ছে। ভারতীয় চালের প্রতি কেজির আমদানিমূল্য ২৫
থেকে ৩০ টাকা পড়ছে। আর সরকার-নির্ধারিত দরে ধান কিনে চালকলে ভাঙলে প্রতি
কেজি চালের দাম পড়ছে ৩০ থেকে ৩২ টাকা। ফলে ব্যবসায়ীরা চাল আমদানির দিকেই
মনোযোগ বেশি দিচ্ছেন। বাজার ঘুরে নূরজাহান ব্র্যান্ডের বস্তা বস্তা চাল
দেখা গেছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, এগুলো ভারতীয় চাল। পাইকারি বিক্রেতা খোরশেদ
জানান, রত্না ভারতীয় চাল। দেশীয় আটাশ চালের মোড়কে চালটি বিক্রি হচ্ছে ৩০
টাকা কেজিতে। এলসি’র মাধ্যমে আসা ভারতীয় মোটা চাল ২৬ টাকা কেজিতে বিক্রি
হচ্ছে। মেসার্স হক রাইস এজেন্সির মালিক আবদুল হক জানান, কিছু অসাধু
ব্যবসায়ী নিজের স্বার্থে ভারতীয় চাল আমদানি করে দেশের বিপদ ডেকে এনেছেন।
তিনি বলেন, সরকারের উচিত যত দ্রুত সম্ভব ভারতীয় এ সব চাল আনা বন্ধ করা। নাম
প্রকাশে অনিচ্ছুক কাওরান বাজারের একজন চাল ব্যবসায়ী বলেন, বাজারে এখন
ভারতীয় চালই বেশি। নামে-বেনামে, সামনে-পেছনে ও ডানে-বাঁয়ে তাকালেই দেখা
যাবে-শুধু ভারতীয় চাল। ভারতীয় চালের বিষয়ে বাদামতলী ও বাবুবাজার চাল আড়ৎদার
সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. নিজাম উদ্দিন বলেন, সরকার ও আমজনতা সাময়িক
লাভবান হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পুরো দেশ। ক্ষতির স্পষ্ট ব্যাখ্যায় তিনি
বলেন, এতে করে প্রান্তিক পর্যায়ে উৎপাদক শ্রেণী তথা কৃষকরা ধান-চাল উৎপাদনে
আগ্রহ হারিয়ে ফেলবেন। বন্ধ হয়ে যাবে চাল উৎপাদনে নিয়োজিত মিল কারখানা। কম
দামে চাল খাওয়াতে পেরে হয়তো সরকার আনন্দিত। কিন্তু এর আড়ালে আছে ভয়াবহ
দুঃসংবাদ। ভারতীয় চাল যদি দেশের বাজার দখলে অব্যাহত গতিতে এগিয়ে যায় তবে
আগামীতে কৃষক কোন চাষাবাদ করবে না। কদমতলী বাজারের মেসার্স পিয়াস
ট্রেডিংয়ের স্বত্বাধিকারী মো. আবদুল কাদির বলেন, আড়ৎদারের চেয়ে বেশি
ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বেপারীরা। তার থেকেও অধিক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন কৃষক। দুই
ধরনের ক্ষতির কথা উল্লেখ করে কাদির বলেন, বেপারীা এতোদিন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে
ভারতীয় চালের কারণে। বর্তমানে হচ্ছে নতুন চাল আসায়। তবে নতুন-পুরনো সব চাল
মার খাচ্ছে কম দামে ছেড়ে দেয়া ভারতীয় চালের কাছে। ভারতী চাল বর্তমানে
নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। অবাধে প্রবেশ করছে এ সব কমদামি চাল। যা চাল
শিল্পের জন্য অশনিসংকেত বলে মনে করেন তিনি। বগুড়ার নাহিদ অ্যারোমেটিক অটো
রাইস মিলের মালিক আহমেদ আলী সরদার স্বপন বলেন, ভারতীয় চালের কারণে
ব্যবসায়ীদের কোন ক্ষতি নেই। যত ক্ষতি কৃষকের। তারা ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না।
কৃষক ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উল্লেখ করে তিনি বলেন, কৃষকের উৎপাদন খরচ
অনুযায়ী প্রতিমণ ধানের দাম হওয়ার কথা ১০০০ টাকা। কিন্তু সে ধানের দাম
বর্তমানে নেমে এসেছে ৫০০ টাকার নিচে। আমদানিকারক, রপ্তানীকারক, আড়ৎদার,
মিলার, পাইকার ও খুচরা ব্যবসায়ী সবাই ভাল আছেন। কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন
শুধুই কৃষক। তিনি আরও বলেন, চালের দাম কমলে ব্যবসায়ীদের লাভ বেশি হয়।
সুতরাং ব্যবসায়ী সমপ্রদায়ের কোন ক্ষতি নেই। এদিকে আমদানি-রপ্তানি সমান তালে
চলছে। দুয়ের মাঝখানে পিষ্ট হচ্ছেন সাধারণ কৃষক। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে
দেখা গেছে, গত কয়েক মাসে চাল আমদানি বেড়েছে কয়েক গুণ। গত অর্থবছর চাল
আমদানি হয় ৩ লাখ ৭৪ হাজার টন। অথচ চলতি অর্থবছরের ২০ এপ্রিল পর্যন্ত আমদানি
হয়েছে ১২ লাখ ৯১ হাজার ৪১০ টন চাল। অথচ ২০১০ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত
বাংলাদেশ খুব সামান্য সুগন্ধি চাল আমদানি করেছিল। সাধারণের জন্য মোটা চাল
আমদানি ওই তিন বছর বন্ধ ছিল। ফলে ওই তিন বছর বাংলাদেশের চাল আমদানি করতে না
হওয়ায় প্রতিবছর প্রায় ১০০ কোটি ডলার বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হয়। আবার
একদিকে ভারত থেকে চাল আমদানি হলেও সরকার চাল উৎপাদনে ‘দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ’ এ
যুক্তি দেখিয়ে চলতি অর্থবছরে শ্রীলঙ্কায় ৫০ হাজার টন চাল রপ্তানি করেছে।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বর্তমানে ভারতে প্রতিটন সেদ্ধ চালের
আমদানিমূল্য ৩৬৫ ডলার। জাহাজে পরিবহনসহ অন্যান্য খরচ যোগ করলে দেশের
বাজারে ওই চাল ৩১ টাকারও কম দরে বিক্রি করা সম্ভব। অন্যদিকে খাদ্য
মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে দেশের মোটা চালের প্রতি কেজির পাইকারি মূল্য ২৩
টাকা ও খুচরা ৩২ টাকা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আর আরেক সরকারি প্রতিষ্ঠান
ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) তাদের ওয়েবসাইটে দেয়া তথ্য অনুযায়ী
প্রতি কেজি চাল ৩০ থেকে ৩৬ টাকায় বিক্রি হচ্ছে বাজারে।
No comments