মা–জননীর সুখ–দুঃখ by উম্মে মুসলিমা
আজ
বিশ্ব মা দিবস। ১৯১৪ সালের ৮ মে মার্কিন কংগ্রেস মে মাসের দ্বিতীয়
রোববারকে ‘মা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করে। উইকিপিডিয়া অনুসারে মা দিবসের
তাৎপর্যের মূলে আছে তিনটি বিষয় ১. সকল মায়ের প্রতি সম্মান প্রদর্শন ২. সকল
মাতৃত্বের প্রতি সম্মান প্রদর্শন ৩. সমাজে মায়ের প্রভাবের প্রতিফলন।
প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন বলেছিলেন, ‘আমি যা কিছু পেয়েছি, যা কিছু হয়েছি
অথবা যা হতে আশা করি, তার জন্য আমি আমার মায়ের কাছে ঋণী।’
শিল্প-সাহিত্যে সবচেয়ে বড় জায়গাটি দখল করে আছেন মা। মাক্সিম গোর্কির মা দিয়ে আমরা আমাদের মায়ের স্বরূপ উদ্ঘাটনে উৎসাহী হয়েছি। মাকে নিয়ে শিশু ভোলানাথের অসাধারণ কবিতাগুলো যেন এখনো আবৃত্তির সঙ্গে সঙ্গে মায়ের গন্ধকেও ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য করে তোলে। এমন যে পৃথিবীবিখ্যাত ‘মোনালিসা’, তাকেও গবেষকেরা সন্তানবতী করে তুলেছেন। তার মানে গবেষকেরা স্বীকার করেছেন, মাতৃরূপেই নারীর সৌন্দর্য পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে।
সংস্কৃতিতে ‘পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভার্যা’ বলে যে কথা প্রচলিত ছিল, তা এখনো আমাদের অনেক স্বামীর মনেই বদ্ধমূল। শুধু স্বামীই নন, শ্বশুর, শাশুড়ি, ননদ, দেবর, ভাশুরও চান তাঁদের বাড়ির বউটার কোলজুড়ে যেন সন্তান আসে অচিরেই। ছেলেসন্তান হলে তো কথাই নেই। কিন্তু সন্তান চাই। তা না হলে বাঁজা নাম নিয়ে বউটা হয় সবার মুখ ঝামটা সহ্য করেন, নাহয় সতিনের সঙ্গে মন-কষাকষি করে সারা জীবন কাটিয়ে দেন। কেউ তালাক পান। দুঃখে-লজ্জায় কেউ আত্মঘাতী হন। এ চিত্র গ্রামাঞ্চলেই বেশি। শহরাঞ্চলের পুরুষেরাও অনেকেই এ রকম মানসিকতা লালন করেন। এখনো সন্তান জন্ম দিতে না পারার জন্য নারীকেই এক শ ভাগ দায়ী করা হয়। অথচ চিকিৎসাবিজ্ঞান বলে, সন্তান জন্মদানের বাধাসমূহের সঠিক চিকিৎসা হলে সব নারীই কমবেশি সন্তান জন্ম দিতে সক্ষম। রূপকথায় অনেক গল্পের শুরুই এভাবে—‘এক ছিল রাজা। তার ছিল ছয় রানি। কিন্তু রাজার মনে খুব দুঃখ। কারণ রাজার কোনো সন্তান ছিল না।’ তখন কারও মনে এ আশঙ্কা উদয় হতো না যে রাজাই আসলে নপুংসক। তাই একের পর এক রাজা বিয়ে করতেন। যত দোষ সব রানিদের। পরে সপ্তমবার গরিবের এক মেয়েকে বিয়ে করে স্বপ্নে পাওয়া বা কামেল কবিরাজের কাছ থেকে পাওয়া এক দুষ্প্রাপ্য গাছের শিকড় খাইয়ে ছোট রানির গর্ভে সন্তান আসত। রাজার আঁটকুড়ে নাম ঘুচত।
ফাহিমা রহমান (ছদ্মনাম) এক সরকারি কর্মকর্তার স্ত্রী। নিঃসন্তান। অনেক ডাক্তার-কবিরাজ, অনেক টেস্ট-ডায়াগনসিস, অনেক ওষুধ-পথ্যের পরও দীর্ঘ ১৫ বছরের বিবাহিত জীবনে সন্তানের মা হতে পারেননি। তবে স্বামী খুবই সহানুভূতিশীল। আত্মীয়স্বজনের চাপেও দ্বিতীয় বিয়ের কথা চিন্তা করেননি। বাসায় কোনো আত্মীয় তাঁদের ছোট বাচ্চা নিয়ে বেড়াতে এলে ফাহিমা যেন ছোঁ মেরে বাচ্চাকে নিয়ে খাওয়ানো, গোসল করানো, ঘুম পাড়ানো, ডায়াপার পাল্টানো—সব নিজের হাতে করতে মহা তৎপর হয়ে পড়তেন। পাশের বাসার এক কর্মজীবী নারী প্রতিবেশীর সন্তান হওয়ার পর চাকরি করতে পারবেন কি না সংশয় দেখা দিলে ফাহিমা নিজে থেকেই তাঁর বাচ্চার দেখভালের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। প্রায় তিন বছর বাচ্চাটাকে নিজের সন্তানের মতো আদরে-সোহাগে মানুষ করেছিলেন। বাচ্চাটা নিজের মাকে ডাকত আম্মু আর ফাহিমাকে ডাকত মাম্মু। প্রতিবেশী নারী যেদিন বদলি হয়ে অন্যত্র চলে গেলেন, সেদিন ফাহিমার অবস্থা দেখে অনেকেই চোখের জল ফেলেছিলেন। ফাহিমা বেশ কিছুদিন নাওয়া-খাওয়া প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলেন। বাচ্চাও জিদ ধরলে তার মা-বাবা মাসে-দুই মাসে একবার করে তাঁর বাচ্চাকে ফাহিমার কাছে নিয়ে আসতেন। তারপর আস্তে আস্তে সময়ে সব ঠিক হয়ে গিয়েছিল। টাইম ইজ দ্য বেস্ট হিলার।
অন্যদিকে একজন সাংবাদিকের স্ত্রীর বিয়ের চার বছরের মাথায় গর্ভধারণের পর গর্ভপাত হয়ে গেলে পরে তিনি আর গর্ভধারণ করতে পারেননি। স্বামী-স্ত্রী দুজনেরই খুব বাচ্চার শখ। ওরা এতিমখানা থেকে মা মরা এক সদ্যোজাত মেয়েশিশুকে এনে নিজের সন্তানের মতো মানুষ করছেন। এতিম সন্তানটি পরম আদরে মা-বাবার স্নেহের ছায়ায় বড় হচ্ছে। অথচ সুরাইয়া (ছদ্মনাম) ২০ বছর ধরে হাপিত্যেশ করছেন একটা সন্তানের জন্য। লাখ লাখ টাকা খরচ করেছেন চিকিৎসায়। দুবার টেস্টটিউব বেবি নিতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছেন। ইদানীং নাকি এক পীরের কাছে যাওয়া শুরু করেছেন। তাঁর স্বামী চিকিৎসা করিয়েছেন কি না জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘না, না ওর কোনো অসুবিধা নেই। ওদের বংশের কেউ এ রকম নেই। বরং আমারই এক খালা ছিলেন নিঃসন্তান। দোষটা আমারই। পুরুষ মানুষের দোষ দিয়ে কী লাভ!’
সন্তান না হলে স্বামী-স্ত্রী দুজনেরই চিকিৎসা আবশ্যক। এখনো আমাদের দেশে কোনো পুরুষকে সন্তান জন্ম না দেওয়ার জন্য দায়ী করা হয় না। পুরুষেরা তা মানেনও না। তাই নিঃসন্তান নারীরা বোন, বান্ধবী, খালা, ফুফু, ভাবিদের নিয়ে ডাক্তারের কাছে যান। যেন ধরেই নেন ত্রুটি তাঁদেরই। অনেক স্বামী পৌরুষ হারানোর ভয়ে যান না, অনেকে উল্টো এসব অনুরোধের জন্য স্ত্রীকে পীড়ন করেন। অনেকে ভাবেন বেশ তো, দ্বিতীয় বিয়ের একটা মওকা পাওয়া গেল।
কোনো কারণে সন্তান না হলে এত হাপিত্যেশের কী আছে? ‘মাতৃত্বেই নারীর পূর্ণতা’—এ একটা সেকেলে ধারণামাত্র। অনেকে তো হাড়-জ্বালানো সন্তানদের হাত থেকে রেহাই পেতে মাথার চুল ছেঁড়েন। উন্নত বিশ্বে পেশা-সচেতন নারীরা ইচ্ছে করেই অনেকে সন্তান না নেওয়ার কথা ভাবেন। এসব দেখে ওসব দেশের সরকার দেশ মানবশূন্য হয়ে যাওয়ার ভয়ে নারীদের বিভিন্নভাবে উৎসাহ দিয়ে আসছে। অনেকে আবার সন্তান জন্মের পক্ষ নিয়ে বলেন, ‘ছেলেপুলে না থাকলে ঘরবাড়ি কেমন খাঁ খাঁ করে না?’ আবার কোনো মা বলেন, ‘তিনটে ছেলেমেয়ের তিনটেই বিদেশে লেখাপড়া করতে গেছে। ওরা ওখানেই বিয়ে-থা করবে। সেই তো একাই থাকতে হবে আমাদের। সারাক্ষণ ওদের জন্য রাজ্যের দুশ্চিন্তা মাথায় নিয়ে ঘুরতে হয়।’ সন্তান জন্ম দিলেই মাতৃত্ব উথলে ওঠে, না দিলে পাষাণী—এমন তো নয়।
মাতৃত্ব মানবিক গুণ। মাদার তেরেসার নিজের কয়জন সন্তান ছিল? উন্নত দেশগুলোতে সন্তান দত্তক নেওয়া অতি স্বাভাবিক সংস্কৃতি। অনেকে নিজের সন্তান থাকলেও দত্তক নেন। বিশ্বসুন্দরী সুস্মিতা সেন বিয়ে না করেও দত্তক নিয়েছেন। গায়িকা ম্যাডোনা, নায়িকা অ্যাঞ্জেলিনা জোলি নিজেদের সন্তানের সঙ্গে দত্তক সন্তানদেরও সমান আদরে মানুষ করছেন। তাই সন্তান জন্ম দিতে না পারা যতটা না কষ্টের, তার চেয়ে দুঃখজনক হলো ‘বাৎসল্য’ না জন্মানো। বাৎসল্য যদি নিঃসন্তান নারী-পুরুষের হৃদয়ে বেদনা জাগায়, তাহলে আমাদের এতিমখানার মাতৃস্নেহ বঞ্চিতরা কেউ কেউ সে বেদনা উপশম করতে পারে, তারা নিজেরাও পারিবারিক পরিবেশে সুস্থ মানসিকতায় বড় হতে পারে, ‘মা’ ‘বাবা’ ডাক শুনে সন্তানহীন বাবা-মায়েরও চোখের কোনা চিকচিক করে উঠতে পারে পরম পাওয়ার আনন্দাশ্রুতে।
উম্মে মুসলিমা: কথাসাহিত্যিক।
শিল্প-সাহিত্যে সবচেয়ে বড় জায়গাটি দখল করে আছেন মা। মাক্সিম গোর্কির মা দিয়ে আমরা আমাদের মায়ের স্বরূপ উদ্ঘাটনে উৎসাহী হয়েছি। মাকে নিয়ে শিশু ভোলানাথের অসাধারণ কবিতাগুলো যেন এখনো আবৃত্তির সঙ্গে সঙ্গে মায়ের গন্ধকেও ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য করে তোলে। এমন যে পৃথিবীবিখ্যাত ‘মোনালিসা’, তাকেও গবেষকেরা সন্তানবতী করে তুলেছেন। তার মানে গবেষকেরা স্বীকার করেছেন, মাতৃরূপেই নারীর সৌন্দর্য পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে।
সংস্কৃতিতে ‘পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভার্যা’ বলে যে কথা প্রচলিত ছিল, তা এখনো আমাদের অনেক স্বামীর মনেই বদ্ধমূল। শুধু স্বামীই নন, শ্বশুর, শাশুড়ি, ননদ, দেবর, ভাশুরও চান তাঁদের বাড়ির বউটার কোলজুড়ে যেন সন্তান আসে অচিরেই। ছেলেসন্তান হলে তো কথাই নেই। কিন্তু সন্তান চাই। তা না হলে বাঁজা নাম নিয়ে বউটা হয় সবার মুখ ঝামটা সহ্য করেন, নাহয় সতিনের সঙ্গে মন-কষাকষি করে সারা জীবন কাটিয়ে দেন। কেউ তালাক পান। দুঃখে-লজ্জায় কেউ আত্মঘাতী হন। এ চিত্র গ্রামাঞ্চলেই বেশি। শহরাঞ্চলের পুরুষেরাও অনেকেই এ রকম মানসিকতা লালন করেন। এখনো সন্তান জন্ম দিতে না পারার জন্য নারীকেই এক শ ভাগ দায়ী করা হয়। অথচ চিকিৎসাবিজ্ঞান বলে, সন্তান জন্মদানের বাধাসমূহের সঠিক চিকিৎসা হলে সব নারীই কমবেশি সন্তান জন্ম দিতে সক্ষম। রূপকথায় অনেক গল্পের শুরুই এভাবে—‘এক ছিল রাজা। তার ছিল ছয় রানি। কিন্তু রাজার মনে খুব দুঃখ। কারণ রাজার কোনো সন্তান ছিল না।’ তখন কারও মনে এ আশঙ্কা উদয় হতো না যে রাজাই আসলে নপুংসক। তাই একের পর এক রাজা বিয়ে করতেন। যত দোষ সব রানিদের। পরে সপ্তমবার গরিবের এক মেয়েকে বিয়ে করে স্বপ্নে পাওয়া বা কামেল কবিরাজের কাছ থেকে পাওয়া এক দুষ্প্রাপ্য গাছের শিকড় খাইয়ে ছোট রানির গর্ভে সন্তান আসত। রাজার আঁটকুড়ে নাম ঘুচত।
ফাহিমা রহমান (ছদ্মনাম) এক সরকারি কর্মকর্তার স্ত্রী। নিঃসন্তান। অনেক ডাক্তার-কবিরাজ, অনেক টেস্ট-ডায়াগনসিস, অনেক ওষুধ-পথ্যের পরও দীর্ঘ ১৫ বছরের বিবাহিত জীবনে সন্তানের মা হতে পারেননি। তবে স্বামী খুবই সহানুভূতিশীল। আত্মীয়স্বজনের চাপেও দ্বিতীয় বিয়ের কথা চিন্তা করেননি। বাসায় কোনো আত্মীয় তাঁদের ছোট বাচ্চা নিয়ে বেড়াতে এলে ফাহিমা যেন ছোঁ মেরে বাচ্চাকে নিয়ে খাওয়ানো, গোসল করানো, ঘুম পাড়ানো, ডায়াপার পাল্টানো—সব নিজের হাতে করতে মহা তৎপর হয়ে পড়তেন। পাশের বাসার এক কর্মজীবী নারী প্রতিবেশীর সন্তান হওয়ার পর চাকরি করতে পারবেন কি না সংশয় দেখা দিলে ফাহিমা নিজে থেকেই তাঁর বাচ্চার দেখভালের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। প্রায় তিন বছর বাচ্চাটাকে নিজের সন্তানের মতো আদরে-সোহাগে মানুষ করেছিলেন। বাচ্চাটা নিজের মাকে ডাকত আম্মু আর ফাহিমাকে ডাকত মাম্মু। প্রতিবেশী নারী যেদিন বদলি হয়ে অন্যত্র চলে গেলেন, সেদিন ফাহিমার অবস্থা দেখে অনেকেই চোখের জল ফেলেছিলেন। ফাহিমা বেশ কিছুদিন নাওয়া-খাওয়া প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলেন। বাচ্চাও জিদ ধরলে তার মা-বাবা মাসে-দুই মাসে একবার করে তাঁর বাচ্চাকে ফাহিমার কাছে নিয়ে আসতেন। তারপর আস্তে আস্তে সময়ে সব ঠিক হয়ে গিয়েছিল। টাইম ইজ দ্য বেস্ট হিলার।
অন্যদিকে একজন সাংবাদিকের স্ত্রীর বিয়ের চার বছরের মাথায় গর্ভধারণের পর গর্ভপাত হয়ে গেলে পরে তিনি আর গর্ভধারণ করতে পারেননি। স্বামী-স্ত্রী দুজনেরই খুব বাচ্চার শখ। ওরা এতিমখানা থেকে মা মরা এক সদ্যোজাত মেয়েশিশুকে এনে নিজের সন্তানের মতো মানুষ করছেন। এতিম সন্তানটি পরম আদরে মা-বাবার স্নেহের ছায়ায় বড় হচ্ছে। অথচ সুরাইয়া (ছদ্মনাম) ২০ বছর ধরে হাপিত্যেশ করছেন একটা সন্তানের জন্য। লাখ লাখ টাকা খরচ করেছেন চিকিৎসায়। দুবার টেস্টটিউব বেবি নিতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছেন। ইদানীং নাকি এক পীরের কাছে যাওয়া শুরু করেছেন। তাঁর স্বামী চিকিৎসা করিয়েছেন কি না জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘না, না ওর কোনো অসুবিধা নেই। ওদের বংশের কেউ এ রকম নেই। বরং আমারই এক খালা ছিলেন নিঃসন্তান। দোষটা আমারই। পুরুষ মানুষের দোষ দিয়ে কী লাভ!’
সন্তান না হলে স্বামী-স্ত্রী দুজনেরই চিকিৎসা আবশ্যক। এখনো আমাদের দেশে কোনো পুরুষকে সন্তান জন্ম না দেওয়ার জন্য দায়ী করা হয় না। পুরুষেরা তা মানেনও না। তাই নিঃসন্তান নারীরা বোন, বান্ধবী, খালা, ফুফু, ভাবিদের নিয়ে ডাক্তারের কাছে যান। যেন ধরেই নেন ত্রুটি তাঁদেরই। অনেক স্বামী পৌরুষ হারানোর ভয়ে যান না, অনেকে উল্টো এসব অনুরোধের জন্য স্ত্রীকে পীড়ন করেন। অনেকে ভাবেন বেশ তো, দ্বিতীয় বিয়ের একটা মওকা পাওয়া গেল।
কোনো কারণে সন্তান না হলে এত হাপিত্যেশের কী আছে? ‘মাতৃত্বেই নারীর পূর্ণতা’—এ একটা সেকেলে ধারণামাত্র। অনেকে তো হাড়-জ্বালানো সন্তানদের হাত থেকে রেহাই পেতে মাথার চুল ছেঁড়েন। উন্নত বিশ্বে পেশা-সচেতন নারীরা ইচ্ছে করেই অনেকে সন্তান না নেওয়ার কথা ভাবেন। এসব দেখে ওসব দেশের সরকার দেশ মানবশূন্য হয়ে যাওয়ার ভয়ে নারীদের বিভিন্নভাবে উৎসাহ দিয়ে আসছে। অনেকে আবার সন্তান জন্মের পক্ষ নিয়ে বলেন, ‘ছেলেপুলে না থাকলে ঘরবাড়ি কেমন খাঁ খাঁ করে না?’ আবার কোনো মা বলেন, ‘তিনটে ছেলেমেয়ের তিনটেই বিদেশে লেখাপড়া করতে গেছে। ওরা ওখানেই বিয়ে-থা করবে। সেই তো একাই থাকতে হবে আমাদের। সারাক্ষণ ওদের জন্য রাজ্যের দুশ্চিন্তা মাথায় নিয়ে ঘুরতে হয়।’ সন্তান জন্ম দিলেই মাতৃত্ব উথলে ওঠে, না দিলে পাষাণী—এমন তো নয়।
মাতৃত্ব মানবিক গুণ। মাদার তেরেসার নিজের কয়জন সন্তান ছিল? উন্নত দেশগুলোতে সন্তান দত্তক নেওয়া অতি স্বাভাবিক সংস্কৃতি। অনেকে নিজের সন্তান থাকলেও দত্তক নেন। বিশ্বসুন্দরী সুস্মিতা সেন বিয়ে না করেও দত্তক নিয়েছেন। গায়িকা ম্যাডোনা, নায়িকা অ্যাঞ্জেলিনা জোলি নিজেদের সন্তানের সঙ্গে দত্তক সন্তানদেরও সমান আদরে মানুষ করছেন। তাই সন্তান জন্ম দিতে না পারা যতটা না কষ্টের, তার চেয়ে দুঃখজনক হলো ‘বাৎসল্য’ না জন্মানো। বাৎসল্য যদি নিঃসন্তান নারী-পুরুষের হৃদয়ে বেদনা জাগায়, তাহলে আমাদের এতিমখানার মাতৃস্নেহ বঞ্চিতরা কেউ কেউ সে বেদনা উপশম করতে পারে, তারা নিজেরাও পারিবারিক পরিবেশে সুস্থ মানসিকতায় বড় হতে পারে, ‘মা’ ‘বাবা’ ডাক শুনে সন্তানহীন বাবা-মায়েরও চোখের কোনা চিকচিক করে উঠতে পারে পরম পাওয়ার আনন্দাশ্রুতে।
উম্মে মুসলিমা: কথাসাহিত্যিক।
No comments