এই সহিংসতার জন্য আমরা লজ্জিত
সদ্যসমাপ্ত দশম সংসদ নির্বাচন নিয়ে সারা দেশে যে ধরনের আলোচনা-সমালোচনা, তর্কবিতর্ক আর চায়ের কাপে ঝড় চলছিল, অনেককে হতাশ করে দিয়ে নির্বাচনটি হয়ে যাওয়ার পর তাকে ঘিরে চলমান আলোচনায় নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোয় ফাটাফাটি কারবার চলছে। পত্রিকাগুলো নিজেদের মতো করে এই নির্বাচনের খবর প্রকাশ করেছে। কোনো কোনোটির আবার অনলাইন সংস্করণের সঙ্গে পাঠকের হাতে যাওয়া ছাপানো কপিটির মিল থাকছে না। টিভি টক শোর কোনো কোনো আলোচক তো পারলে টিভির পর্দা ফেটে বের হয়ে পড়েন। তারেক জিয়া তো সেই সুদূর লন্ডন থেকে এখন তালেবান স্টাইলে ভিডিওবার্তা পাঠাতে শুরু করেছেন। নির্বাচনের পূর্বরাতে তিনি তাঁর ‘জাতির উদ্দেশে’ ভাষণ দেওয়ার স্টাইলে দেশবাসীকে নির্বাচন বর্জন, প্রতিহত ও প্রতিরোধ করার ডাক দিলেন। তাঁর আহ্বানে সাড়া না পেয়ে তিনি পরদিন আবারও একই কায়দায় দেশবাসীর সামনে হাজির হলেন। বললেন, ‘এই নির্বাচন মানি না। একে বাতিল করতে হবে।’ তারেক রহমান তাঁর বাবার স্টাইল ভালোই রপ্ত করতে পেরেছেন। তাঁর বাবা জেনারেল জিয়াউর রহমান বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো পাকিস্তানের আইয়ুব খানের মতো টিভিতে উর্দি পরে জাতির উদ্দেশে সালাম জানিয়ে দেশবাসীকে জানিয়ে দিয়েছিলেন, তাদের উদ্ধার করতে তিনি এসে গেছেন। আমার পাড়ার চরমপন্থী রাজনৈতিক কর্মী সাবেক সরকারি কর্মচারী জামাল চাচা, যিনি কখনো ভোটের রাজনীতিতে বিশ্বাস করেন না, তাঁকে ভোটের দিন দেখি লাইনে দাঁড়ানো। সালাম দিয়ে জানতে চাই, হঠাৎ কেন তিনি ভোটের লাইনে। জামাল চাচার জবাবে আমার আক্কেলগুড়ুম।
বলেন, ‘ওই তারেক জিয়ার বক্তৃতা আমাকে ভোটের লাইনে নিয়ে এসেছে। সে ভাষণ দিয়ে দেশের মানুষকে নসিহত করার কে? হু ইজ হি?’ ছোটকাল থেকে দেখেছি, চাচা উত্তেজিত হলে ইংরেজিতে কথা বলেন। দেশের ইলেকট্রনিক মিডিয়ার এখন বাড়ন্ত অবস্থা। আওয়ামী লীগ সরকারকে যতই সমালোচনা করি না কেন, টিভির লাইসেন্স দেওয়ার ব্যাপারে তারা একেবারে দরাজ দিল। লাইসেন্স পান একজন, তা দ্রুত হাতবদল হয়ে যায় অন্যজনের হাতে। শেখ হাসিনা তাঁর প্রথম সরকারের সময় একটি টিভি চ্যানেল নিজে উদ্বোধন করেছিলেন। সেই টিভি এখন নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি হচ্ছে, তা দেখানোর জন্য রিপোর্টার লাইনে দাঁড়ানো একজন ভোটারের সামনে মাইক ধরে জানতে চান, ‘ভোটার আইডি কার্ড’ আছে কি না। ওই লোক বলেন, না, নেই। এবার রিপোর্টার বলেন, তাঁর ভোটার আইডি কার্ড নেই, অথচ তিনি ভোট দিতে লাইনে দাঁড়িয়েছেন। তিনি কি জানেন না, দেশে ভোটার আইডি কার্ড বলে কোনো জিনিসের অস্তিত্ব নেই। যেটি আছে, সেটি অনেক ক্ষেত্রে ভুলে ভরা ‘জাতীয় পরিচয়পত্র’। ভোট দিতে ভোটার আইডি কার্ড লাগে না। ভোটার নম্বর লাগে। ভোটার তালিকায় ভোটারের ছবি থাকে। ওটার সঙ্গে মিললেই হলো। বিদেশি গণমাধ্যমগুলো এই নির্বাচনের ওপর রিপোর্ট করতে গিয়ে নির্বাচন নিয়ে যত কথা বলেছে, তার চেয়ে বেশি উৎসাহী হয়েছে এই নির্বাচন ঘিরে দেশে সন্ত্রাসের মাত্রা কত ওপরে উঠেছে, তা জানাতে। পাঠকের মনে থাকতে পারে, কদিন আগে যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত ফরেন পলিসি ম্যাগাজিন আগামী এক বছরে যে ১০টি দেশ সংঘাতে ঝুঁকিপূর্ণ হবে, তার তালিকায় বাংলাদেশকে স্থান দিয়েছে।
সুতরাং, এখানে এখন যদি বলা হয়, দুটির মধ্যে একটি যোগসূত্র আছে, তখন কি মন্তব্যটি ফেলে দেওয়া যাবে? বাংলাদেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের দুর্ভাগ্য যে দেশে নির্বাচন এলেই কোনো কোনো এলাকায় তাদের ওপর সন্ত্রাসের খড়্গ নেমে আসে। কে হারল আর কে জিতল, সেটি বড় প্রশ্ন নয়, প্রশ্ন হচ্ছে তারা ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ। সুতরাং, কিছু মানুষ নামের হায়েনা সব সময় মনে করে, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলে পড়া তাদের ইমানি দায়িত্ব। যারা এই অত্যাচারের শিকার হয়, তারা বেশির ভাগই নিম্নবিত্ত অথবা নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষ। ২০০১ সালের নির্বাচনের পর দক্ষিণবঙ্গে এমন হামলায় বহু মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল, দেশছাড়া হতে হয়েছিল কয়েক লাখকে। তাদের একমাত্র অপরাধ, তারা নাকি আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছিল, অথচ কে কাকে ভোট দেয়, তা জানার উপায় নেই। তবে এটি ভ্রান্তভাবে ধারণা করা হয়, সংখ্যালঘু মানেই তারা আওয়ামী লীগের সমর্থক। সুতরাং, যেকোনো উপায়ে তাদের দেশছাড়া করতে হবে, যাতে বাংলাদেশকে আবার একটা মিনি পাকিস্তান বানানো যায় এবং নব্য মুসলিম লিগাররা সব সময় ক্ষমতায় থাকে। বাস্তবে, বর্তমানে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অনেকে ভয়েই ভোটকেন্দ্রের ধারেকাছে যান না। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের এক দিন পর জামায়াত-শিবিরের দুর্বৃত্তরা দিনাজপুরে, যশোর ও উত্তরবঙ্গের আরও অনেক জেলায় ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বাড়িঘরে, দোকানপাটে যে লুটতরাজ আর অগ্নিসংযোগ শুরু করেছে, তাতে জাতি হিসেবে আমাদের লজ্জিত হওয়ার কথা। জামায়াত-শিবির এ ধরনের হামলা করার সাহস পেয়েছে বিএনপির নির্বাচন প্রতিহত আর প্রতিরোধ করার ডাকের কারণে। এই সহিংসতা প্রতিরোধ করতে না পারা সরকারের বড় ব্যর্থতা।
সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে তো রামকৃষ্ণ মিশনের সদস্যের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলে হবে না। তাদের তো এটা মনে রাখতে হবে, এই দুর্বৃত্তদের হাতে তাদেরই সহকর্মীরা নিয়মিত বিরতি দিয়ে মারা যাচ্ছেন আর তাদের একটি অংশ এই ধরনের সহিংসতায় নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করলে তো এই দুর্বৃত্তরা এটি তাদের দুর্বলতা হিসেবে দেখবে। এমন দিন হয়তো আসবে, যখন তারাও এই দুর্বৃত্তদের হাতে আক্রান্ত হবে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা হয়েছে। নির্বাচনের আগে অনেকেই সমঝাতার কথা বলেছিলেন। চেষ্টাও করেছেন কেউ কেউ। শেষে এসেছিলেন জাতিসংঘের মহাসচিবের বিশেষ দূত। শেষ পর্যন্ত তিনি ব্যর্থ হয়ে ফিরে গেছেন। কিন্তু বাস্তবতা কেউ তেমন একটা বুঝতে চায়নি। বিএনপি তো এখন নিজের রাজনীতি বাদ দিয়ে জামায়াতের রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত। বিএনপির বর্তমান রাজনীতি দেশের সর্বোচ্চ আদালত কর্তৃক বাতিল হয়ে যাওয়া ত্রয়োদশ সংশোধনী পুনর্বহাল আর জামায়াতের রাজনীতি হচ্ছে যেকোনো উপায়ে হোক, যুদ্ধাপরাধের দায়ে যারা অভিযুক্ত ও দণ্ডপ্রাপ্ত, তাদের মুক্তি। বিএনপির ছাতার নিচে আশ্রয় নিয়ে তারা তাদের উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য আন্দোলনের নামে সারা দেশে দুই বছর ধরে তাণ্ডবে লিপ্ত। বেগম জিয়া তো প্রকাশ্যেই জামায়াতের এসব নেতার মুক্তির দাবি করেছেন এবং গত সোমবার বিবিসির সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে জানান, তিনি জামায়াতের সঙ্গ ছাড়তে পারবেন না। সুতরাং তারা তো কখনো চাইবে না বেগম জিয়া তাদের মাঝপথে ফেলে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করুন। কারণ, নির্বাচনে যে বিএনপি বিজয়ী হতে পারবে,
তার নিশ্চয়তা কে দেবে? এটি সত্য, গত কয়েক মাসে নির্বাচন নিয়ে একাধিক জরিপ পরিচালিত হয়েছে এবং এগুলোর বেশ কয়েকটি বলেছে, দশম সংসদ নির্বাচনে বিএনপি জিতবে। বাস্তবে সব সময় এসব জরিপ সঠিক অবস্থার প্রতিফলন করে না। যুক্তরাষ্ট্রে এমন জরিপ অনেক হয়েছে, যেখানে যা ঘটেছে আর জরিপের ফলাফল ছিল উল্টো। নির্বাচনে জিতবে, এমন নিশ্চয়তা পেলে বিএনপি নির্বাচনে হয়তো যেত, কিন্তু তাতেও সন্দেহ আছে। যেকোনো কারণেই হোক, বর্তমান অবস্থায় জামায়াতের খোঁয়াড়ে বিএনপি বাঁধা আছে। নির্বাচনে ভোটারের উপস্থিতি নিয়ে যাঁরা কথা বলেন, তাঁদের উদ্দেশে বলি, দুই মাস ধরে হরতাল-অবরোধের নামে সারা দেশে যে অচলাবস্থা সৃষ্টি করে রেখেছে বিএনপি-জামায়াত জোট, তার কারণে কজন ভোটার ভোট দিতে নিজ গ্রাম বা বাড়ি যেতে পেরেছেন? আমার বাসায় পাঁচজন ভোটার। এক আমি ছাড়া তো আর কেউ এবার ভোট দিতে যেতে পারেননি। কারণ, সবাইকে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে বিমানে নিয়ে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। আর নির্বাচনের আগের কয়েক দিন নির্বাচন প্রতিহত ও প্রতিরোধের নামে যে মাত্রার সহিংসতা হয়েছে, তাতে গ্রামের একজন সাধারণ মানুষ যদি নির্বাচন কেন্দ্রে যেতে ভীত হন, তাহলে নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতির গড়-হার তো কম হবেই। তবে সবচেয়ে বড় কথা হলো, এত সবের পরও অনেক কেন্দ্রে ভোটাররা নিজের জীবন হাতে নিয়ে ভোট দিতে গেছেন এবং তাঁদের অনেকেই ভোট দেওয়ার অপরাধে ৬ তারিখের ডেইলি স্টার-এর প্রথম পাতায় প্রকাশিত দুজন ভোটারের মতো পরিণতি ভোগ করেছেন। প্রধানমন্ত্রী ৬ তারিখ তাঁর সংবাদ সম্মেলনে জানান, তিনি সন্ত্রাসীদের কঠোর হাতে দমন করবেন। দেশের মানুষ তাঁর এই বক্তব্যের বাস্তব রূপ দেখতে চায়। দেখতে চায় দিনাজপুর-যশোরের মতো ঘটনা যেসব দুর্বৃত্ত ঘটিয়েছে, তাদের প্রত্যেককে গ্রেপ্তার করা হোক এবং আইন অনুযায়ী সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়া হোক। এই সহিংসতার জন্য জাতি হিসেবে আমরা লজ্জিত।
আবদুল মান্নান: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
আবদুল মান্নান: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments