সব মৌসুমে কাজের ব্যবস্থা করতে হবে by মোস্তফা কামাল মুজেরী ও মনসুর আহমেদ
গ্রামীণ বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষের জীবনযাত্রার মানের অবস্থা অনেকাংশে নির্ভর করে শ্রম মজুরির গতিধারার ওপর। তবে মজুরি ও কর্মসংস্থানের হালনাগাদ উপাত্ত একেবারেই পাওয়া যায় না। তাই গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর একটা বিরাট অংশের অর্থনৈতিক অবস্থার সাম্প্রতিক গতিপ্রকৃতি অনুধাবন করা কষ্টকর। বাংলাদেশ খানাভিত্তিক আয় ও ব্যয় জরিপ ২০০৫-এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গ্রামীণ জনপদে কৃষি পেশায় নিয়োজিত মোট শ্রমশক্তির ৩৭ শতাংশই দিনমজুর হিসেবে কাজ করে। অকৃষি পেশায় এ ধরনের শ্রমজীবীর অনুপাত ৩৫ শতাংশ। এই অনুপাত চরম দরিদ্রদের ক্ষেত্রে আরও বেশি, প্রায় অর্ধেক। এটা থেকে পরিষ্কার যে মজুরির ওঠানামা দেশের জনগণের একটা বড় অংশের জীবনযাত্রার মানকে প্রভাবিত করে। এমতাবস্থায়, সাম্প্রতিক সময়ে গ্রামীণ মজুরির গতিপ্রকৃতি থেকে গ্রামীণ জনগণ বিশেষ করে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আর্থসামাজিক অবস্থা সম্পর্কে একটি ধারণা পাওয়া যেতে পারে।
গত ডিসেম্বরে বাংলাদেশের অর্থনীতির সাম্প্রতিক অবস্থা বিশ্লেষণ করার জন্য বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) সারা দেশে একটি সমীক্ষা পরিচালনা করে। এই সমীক্ষায় অন্যান্য সূচকের পাশাপাশি শ্রমজীবী মানুষের মজুরি সম্পর্কেও তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়। এ থেকে মজুরির হারের ওঠানামার পাশাপাশি মজুরির আঞ্চলিক ভিন্নতা সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্য বেরিয়ে এসেছে। মজুরির আঞ্চলিক ভিন্নতা শ্রমিকের গতিশীলতা নিরূপণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
বিআইডিএসের সমীক্ষা থেকে দেখা যায়, বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে আর্থিক মজুরির ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ভিন্নতা রয়েছে। তা ছাড়া একই অঞ্চলে বছরের বিভিন্ন সময়ে আর্থিক মজুরির হার পরিবর্তন হয়।
সমীক্ষা অনুসারে, দেশের পূর্বাঞ্চলে জুলাই মাসের দিকে মজুরির হার উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কম থাকে। এই অঞ্চলে একজন কৃষি শ্রমিক ডিসেম্বরে (২০০৯) গড় মজুরি পেয়েছিল প্রতিদিন ২২৩ টাকা। জুলাইয়ে (২০০৯) এ মজুরি ছিল মাত্র ১৪৮ টাকা। পূর্বাঞ্চলে এই সময়ে সাধারণত কৃষি শ্রমিকের চাহিদা তেমন থাকে না। তবে দেশের অন্যান্য অঞ্চলে এ ধরনের পরিবর্তনে ভিন্নতা দেখা যায়। দেশের মধ্যাঞ্চলে কৃষিতে দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। যার ফলে জুলাই (২০০৯) মাসে কৃষি মজুরি ছিল দিনে ২৪৪ টাকা, যা কিছুটা কমে ডিসেম্বরে (২০০৯) ২১৯ টাকা হয়েছিল।
অপরদিকে দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোতে গড় মজুরি জুলাই (২০০৯) মাসে ছিল ১৭১ টাকা, যা ডিসেম্বরে (২০০৯) হয় ১৫৩ টাকা।
তবে উত্তরাঞ্চলে মৌসুমভিত্তিক কৃষি মজুরির ভিন্নতা সবচেয়ে বেশি। জুলাই (২০০৯) মাসে গড় মজুরি ছিল মাত্র ১১৬ টাকা, যা ডিসেম্বরে (২০০৯) বেড়েছিল ১৬৪ টাকায়। এ থেকে দেখা যায় দেশের মধ্যাঞ্চলে কৃষি শ্রমিকের দৈনিক মজুরি অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় বেশি। অন্যদিকে উত্তরাঞ্চলে দৈনিক মজুরির হার অনেক সময় মধ্যাঞ্চলের তুলনায় অর্ধেকেরও নিচে নেমে আসে। দক্ষিণাঞ্চলের মজুরির অবস্থা উত্তরাঞ্চলের তুলনায় ভালো হলেও পূর্ব ও মধ্যাঞ্চলের তুলনায় অনেক কম।
তবে অকৃষি পেশায় নিয়োজিত শ্রমিকের মজুরির হার কৃষি শ্রমিকের মজুরি থেকে বেশি থাকে সব অঞ্চলেই। মাসভিত্তিক মজুরির যে পরিবর্তন তাও অনেকটা কৃষি মজুরির মতোই। তবে আঞ্চলিক ভিন্নতা আরও বেশি। বিশেষ করে দেশের উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোতে মজুরির হার বিশেষ করে মধ্যাঞ্চলের তুলনায় অনেক কম। যেমন ডিসেম্বরে (২০০৯) মধ্যাঞ্চলে দৈনিক অকৃষি মজুরি ছিল প্রতিদিন গড়ে ৩১৩ টাকা, যা দক্ষিণাঞ্চলে ছিল মাত্র ১৭৩ টাকা।
এ ক্ষেত্রে একটা বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন। তা হচ্ছে, দেশের সব অঞ্চলে মজুরি হারের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা। এ প্রবণতা আবার যেসব অঞ্চলে (যেমন উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলো) মজুরির হার কম সেসব এলাকায় বেশি। যেমন ২০০৮ সালের ডিসেম্বর মাসের তুলনায় ২০০৯ সালের ডিসেম্বরে উত্তরাঞ্চলে কৃষি মজুরি বেড়েছে ৩৪ শতাংশ এবং অকৃষি মজুরি বেড়েছে ১৭ শতাংশ। এই বৃদ্ধি দক্ষিণাঞ্চলে ছিল যথাক্রমে ১৩ ও ২৫ শতাংশ।
দেখা যাচ্ছে, মজুরির যে অঞ্চলভিত্তিক ভিন্নতা তা কমে আসার প্রবণতা দেখা দিচ্ছে মূলত দুটি কারণে। প্রথমত, অতিরিক্ত কৃষি শ্রমিক কাজের সন্ধানে অকৃষি শ্রমবাজারে চলে আসছে। দ্বিতীয়ত, এক অঞ্চলের শ্রমিক অন্য অঞ্চলে বিশেষ করে যেসব এলাকায় মজুরির হার এবং কাজের সুযোগ বেশি, সেসব জায়গায় সাময়িকভাবে চলে যাচ্ছে।
শ্রমিকদের প্রকৃত মজুরির পরিবর্তন বিশ্লেষণ করার জন্য আমরা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের একজন শ্রমিক তার দৈনিক মজুরি দিয়ে গড়ে কত কেজি মোটা চাল ক্রয় করতে পারে তা বের করেছি। এ ক্ষেত্রে দেখা যায়, প্রকৃত মজুরির আঞ্চলিক ভিন্নতা ততটা প্রকট নয়, যতটা দেখা যায় আর্থিক মজুরির ক্ষেত্রে। ২০০৯ সালের ডিসেম্বর মাসে উত্তরাঞ্চলের একজন কৃষি শ্রমিক দৈনিক মজুরি দিয়ে কিনতে পারত প্রায় নয় কেজি মোটা চাল। একই সময়ে দক্ষিণাঞ্চলের একজন কৃষি শ্রমিক কিনতে পারত মাত্র সাড়ে ছয় কেজি মোটা চাল। পূর্ব ও মধ্যাঞ্চলে এই পরিমাণ ছিল যথাক্রমে সাড়ে আট কেজি এবং সাড়ে সাত কেজির কিছু বেশি। তবে একই সময়ে অকৃষি শ্রমিকের ক্ষেত্রে মধ্যাঞ্চলে একজন শ্রমিক তার দৈনিক মজুরি দিয়ে ১১ কেজি মোটা চাল কিনতে পারত, যা ছিল দক্ষিণাঞ্চলে মাত্র সাত কেজি।
বিআইডিএসের সমীক্ষা থেকে দেখা যায় যে ২০০৭ ও ২০০৮ সালের তুলনায় ২০০৯ সালে দেশের সব অঞ্চলে প্রকৃত মজুরি বেড়েছে। এর কারণ একদিকে কৃষি এবং অকৃষি উভয় খাতে আর্থিক মজুরি বৃদ্ধি, অন্যদিকে মোটা চালের দাম কিছুটা কমে যাওয়া। ফলে একজন শ্রমিক এখন তার প্রাপ্ত আর্থিক মজুরি দিয়ে আগের তুলনায় বেশি চাল কিনতে পারছে।
এই অগ্রগতিটা বেশি লক্ষ করা গেছে দেশের উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলে। উত্তরাঞ্চলে একজন কৃষি শ্রমিক ২০০৮ সালের ডিসেম্বর মাসে তার দৈনিক মজুরি দিয়ে চার কেজি চাল কিনতে পারত, সেখানে ২০০৯ সালের ডিসেম্বরে এসে সে সাড়ে আট কেজি চাল কিনতে পারছে। দক্ষিণাঞ্চলেও একজন কৃষি শ্রমিক যেখানে ডিসেম্বর ২০০৮-এ সাড়ে চার কেজি চাল ক্রয় করতে পারত, সেখানে ২০০৯ সালের ডিসেম্বরে সে ক্রয় করতে পারত সাড়ে ছয় কেজি চাল। অকৃষি শ্রমিকের ক্ষেত্রেও একই চিত্র দেখা যায়।
সুতরাং, এটা বলা যায় যেতে পারে যে বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের কৃষি ও অকৃষি শ্রমিকেরা তাদের দৈনিক মজুরি হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতির সঙ্গে নিজেদের কিছুটা মানিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছে। মূল্যস্ফীতি বিশেষ করে চালের মূল্যবৃদ্ধির প্রাথমিক শিকার যেহেতু এই গরিব জনগণ, সেহেতু তাদের প্রকৃত মজুরি বৃদ্ধি সার্বিক অর্থনীতির একটা ভালো দিক।
দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মৌসুমি মজুরির হার বেশ ওঠানামা করে। এক অঞ্চলে যখন কাজের সুযোগ থাকে না, তখন অন্য অঞ্চলে দেখা যায় অতিরিক্ত শ্রমিকের চাহিদা। তাই শ্রমিকের আঞ্চলিক গতিশীলতা লক্ষণীয়। যেমন: পূর্বাঞ্চলে সাধারণত জুলাই-অক্টোবর সময়কালে কৃষি শ্রমিকের তেমন কাজ থাকে না। তখন তারা বিভিন্ন অকৃষি পেশায় নিয়োজিত হয়। অনেকে রাজধানী বা আশপাশের শহরে কাজের সন্ধানে যায়। অন্যদিকে পূর্বাঞ্চলে যখন আমন ও বোরো মৌসুম, তখন কৃষি শ্রমিকের চাহিদা ব্যাপক ও এই সময়ে উত্তরাঞ্চলের শ্রমিকেরা পূর্বাঞ্চলে পাড়ি জমায় কাজের সন্ধানে।
দেশে মধ্যাঞ্চলে একটা দ্রুত কাঠামোগত পরিবর্তন ঘটছে। এখানকার স্থানীয় শ্রমিকেরা বেশি হারে অকৃষি পেশায় নিয়োজিত হচ্ছে, অন্যদিকে বিশেষ করে উত্তরাঞ্চল থেকে আগত শ্রমিকেরা কৃষি শ্রমিক হিসেবে কাজ করছে। দেশের উত্তরাঞ্চলের লোকজনের কর্মসংস্থানের মূল উৎস হচ্ছে কৃষি। সেখানে কৃষিতে কাজের সুযোগ রয়েছে মূলত কৃষি মৌসুমে। বছরের একটা বড় সময় কৃষিকাজ থাকে না এসব এলাকায়। তাই হয় তাদের বাধ্য হয়ে বেকার থাকতে হয় অথবা কাজের সন্ধানে রাজধানীসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলের দিকে পাড়ি জমাতে হয়। এসব শ্রমিককে সাধারণত কম মজুরিতে কাজ করতে হয়। কারণ, তাদের উপস্থিতি ওই অঞ্চলে শ্রমের জোগান বাড়িয়ে দেয়।
দেশের দক্ষিণাঞ্চলেও বছরের যে মৌসুমে কৃষিকাজ থাকে না, তখন কৃষি শ্রমিকদের অকৃষি শ্রমিকের কাজে নিয়োজিত হতে হয়। অথবা তারা রাজধানী বা বড় শহরের দিকে যাত্রা করে কাজের সন্ধানে। দেশের মধ্য ও পূর্বাঞ্চলে অকৃষি কাজের সুযোগ তুলনামূলকভাবে বেশি রয়েছে, ফলে এসব অঞ্চলে কৃষি এবং অকৃষি ক্ষেত্রে মজুরির বড় তারতম্য ঘটে না। শ্রমিকেরা তুলনামূলকভাবে কম হারে অন্য অঞ্চলে কাজের সন্ধানে যায়।
সুতরাং, বছরের সব মৌসুমে কৃষিকাজের সুযোগ না থাকা এবং অকৃষি কর্মকাণ্ডের অপ্রতুলতা মূলত দেশের দক্ষিণ ও উত্তরাঞ্চলের শ্রমিকদের রাজধানী ও অন্যান্য অঞ্চলমুখী করছে। এমতাবস্থায়, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর পাশাপাশি বছরের সব মৌসুমে চাষের ব্যবস্থা এবং অকৃষি খাতে ব্যাপক কর্মসৃজনের ব্যবস্থা করতে হবে। তা না হলে মজুরির এই আঞ্চলিক বৈষম্য থেকেই যাবে এবং আমাদের দারিদ্র্য নিরসন প্রচেষ্টা বাধাগ্রস্ত হবে।
মোস্তফা কামাল মুজেরী: মহাপরিচালক, বাংলাদেশে উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস);
মনসুর আহমেদ: গবেষণা সহযোগী, বিআইডিএস।
গত ডিসেম্বরে বাংলাদেশের অর্থনীতির সাম্প্রতিক অবস্থা বিশ্লেষণ করার জন্য বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) সারা দেশে একটি সমীক্ষা পরিচালনা করে। এই সমীক্ষায় অন্যান্য সূচকের পাশাপাশি শ্রমজীবী মানুষের মজুরি সম্পর্কেও তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়। এ থেকে মজুরির হারের ওঠানামার পাশাপাশি মজুরির আঞ্চলিক ভিন্নতা সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্য বেরিয়ে এসেছে। মজুরির আঞ্চলিক ভিন্নতা শ্রমিকের গতিশীলতা নিরূপণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
বিআইডিএসের সমীক্ষা থেকে দেখা যায়, বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে আর্থিক মজুরির ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ভিন্নতা রয়েছে। তা ছাড়া একই অঞ্চলে বছরের বিভিন্ন সময়ে আর্থিক মজুরির হার পরিবর্তন হয়।
সমীক্ষা অনুসারে, দেশের পূর্বাঞ্চলে জুলাই মাসের দিকে মজুরির হার উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কম থাকে। এই অঞ্চলে একজন কৃষি শ্রমিক ডিসেম্বরে (২০০৯) গড় মজুরি পেয়েছিল প্রতিদিন ২২৩ টাকা। জুলাইয়ে (২০০৯) এ মজুরি ছিল মাত্র ১৪৮ টাকা। পূর্বাঞ্চলে এই সময়ে সাধারণত কৃষি শ্রমিকের চাহিদা তেমন থাকে না। তবে দেশের অন্যান্য অঞ্চলে এ ধরনের পরিবর্তনে ভিন্নতা দেখা যায়। দেশের মধ্যাঞ্চলে কৃষিতে দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। যার ফলে জুলাই (২০০৯) মাসে কৃষি মজুরি ছিল দিনে ২৪৪ টাকা, যা কিছুটা কমে ডিসেম্বরে (২০০৯) ২১৯ টাকা হয়েছিল।
অপরদিকে দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোতে গড় মজুরি জুলাই (২০০৯) মাসে ছিল ১৭১ টাকা, যা ডিসেম্বরে (২০০৯) হয় ১৫৩ টাকা।
তবে উত্তরাঞ্চলে মৌসুমভিত্তিক কৃষি মজুরির ভিন্নতা সবচেয়ে বেশি। জুলাই (২০০৯) মাসে গড় মজুরি ছিল মাত্র ১১৬ টাকা, যা ডিসেম্বরে (২০০৯) বেড়েছিল ১৬৪ টাকায়। এ থেকে দেখা যায় দেশের মধ্যাঞ্চলে কৃষি শ্রমিকের দৈনিক মজুরি অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় বেশি। অন্যদিকে উত্তরাঞ্চলে দৈনিক মজুরির হার অনেক সময় মধ্যাঞ্চলের তুলনায় অর্ধেকেরও নিচে নেমে আসে। দক্ষিণাঞ্চলের মজুরির অবস্থা উত্তরাঞ্চলের তুলনায় ভালো হলেও পূর্ব ও মধ্যাঞ্চলের তুলনায় অনেক কম।
তবে অকৃষি পেশায় নিয়োজিত শ্রমিকের মজুরির হার কৃষি শ্রমিকের মজুরি থেকে বেশি থাকে সব অঞ্চলেই। মাসভিত্তিক মজুরির যে পরিবর্তন তাও অনেকটা কৃষি মজুরির মতোই। তবে আঞ্চলিক ভিন্নতা আরও বেশি। বিশেষ করে দেশের উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোতে মজুরির হার বিশেষ করে মধ্যাঞ্চলের তুলনায় অনেক কম। যেমন ডিসেম্বরে (২০০৯) মধ্যাঞ্চলে দৈনিক অকৃষি মজুরি ছিল প্রতিদিন গড়ে ৩১৩ টাকা, যা দক্ষিণাঞ্চলে ছিল মাত্র ১৭৩ টাকা।
এ ক্ষেত্রে একটা বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন। তা হচ্ছে, দেশের সব অঞ্চলে মজুরি হারের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা। এ প্রবণতা আবার যেসব অঞ্চলে (যেমন উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলো) মজুরির হার কম সেসব এলাকায় বেশি। যেমন ২০০৮ সালের ডিসেম্বর মাসের তুলনায় ২০০৯ সালের ডিসেম্বরে উত্তরাঞ্চলে কৃষি মজুরি বেড়েছে ৩৪ শতাংশ এবং অকৃষি মজুরি বেড়েছে ১৭ শতাংশ। এই বৃদ্ধি দক্ষিণাঞ্চলে ছিল যথাক্রমে ১৩ ও ২৫ শতাংশ।
দেখা যাচ্ছে, মজুরির যে অঞ্চলভিত্তিক ভিন্নতা তা কমে আসার প্রবণতা দেখা দিচ্ছে মূলত দুটি কারণে। প্রথমত, অতিরিক্ত কৃষি শ্রমিক কাজের সন্ধানে অকৃষি শ্রমবাজারে চলে আসছে। দ্বিতীয়ত, এক অঞ্চলের শ্রমিক অন্য অঞ্চলে বিশেষ করে যেসব এলাকায় মজুরির হার এবং কাজের সুযোগ বেশি, সেসব জায়গায় সাময়িকভাবে চলে যাচ্ছে।
শ্রমিকদের প্রকৃত মজুরির পরিবর্তন বিশ্লেষণ করার জন্য আমরা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের একজন শ্রমিক তার দৈনিক মজুরি দিয়ে গড়ে কত কেজি মোটা চাল ক্রয় করতে পারে তা বের করেছি। এ ক্ষেত্রে দেখা যায়, প্রকৃত মজুরির আঞ্চলিক ভিন্নতা ততটা প্রকট নয়, যতটা দেখা যায় আর্থিক মজুরির ক্ষেত্রে। ২০০৯ সালের ডিসেম্বর মাসে উত্তরাঞ্চলের একজন কৃষি শ্রমিক দৈনিক মজুরি দিয়ে কিনতে পারত প্রায় নয় কেজি মোটা চাল। একই সময়ে দক্ষিণাঞ্চলের একজন কৃষি শ্রমিক কিনতে পারত মাত্র সাড়ে ছয় কেজি মোটা চাল। পূর্ব ও মধ্যাঞ্চলে এই পরিমাণ ছিল যথাক্রমে সাড়ে আট কেজি এবং সাড়ে সাত কেজির কিছু বেশি। তবে একই সময়ে অকৃষি শ্রমিকের ক্ষেত্রে মধ্যাঞ্চলে একজন শ্রমিক তার দৈনিক মজুরি দিয়ে ১১ কেজি মোটা চাল কিনতে পারত, যা ছিল দক্ষিণাঞ্চলে মাত্র সাত কেজি।
বিআইডিএসের সমীক্ষা থেকে দেখা যায় যে ২০০৭ ও ২০০৮ সালের তুলনায় ২০০৯ সালে দেশের সব অঞ্চলে প্রকৃত মজুরি বেড়েছে। এর কারণ একদিকে কৃষি এবং অকৃষি উভয় খাতে আর্থিক মজুরি বৃদ্ধি, অন্যদিকে মোটা চালের দাম কিছুটা কমে যাওয়া। ফলে একজন শ্রমিক এখন তার প্রাপ্ত আর্থিক মজুরি দিয়ে আগের তুলনায় বেশি চাল কিনতে পারছে।
এই অগ্রগতিটা বেশি লক্ষ করা গেছে দেশের উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলে। উত্তরাঞ্চলে একজন কৃষি শ্রমিক ২০০৮ সালের ডিসেম্বর মাসে তার দৈনিক মজুরি দিয়ে চার কেজি চাল কিনতে পারত, সেখানে ২০০৯ সালের ডিসেম্বরে এসে সে সাড়ে আট কেজি চাল কিনতে পারছে। দক্ষিণাঞ্চলেও একজন কৃষি শ্রমিক যেখানে ডিসেম্বর ২০০৮-এ সাড়ে চার কেজি চাল ক্রয় করতে পারত, সেখানে ২০০৯ সালের ডিসেম্বরে সে ক্রয় করতে পারত সাড়ে ছয় কেজি চাল। অকৃষি শ্রমিকের ক্ষেত্রেও একই চিত্র দেখা যায়।
সুতরাং, এটা বলা যায় যেতে পারে যে বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের কৃষি ও অকৃষি শ্রমিকেরা তাদের দৈনিক মজুরি হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতির সঙ্গে নিজেদের কিছুটা মানিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছে। মূল্যস্ফীতি বিশেষ করে চালের মূল্যবৃদ্ধির প্রাথমিক শিকার যেহেতু এই গরিব জনগণ, সেহেতু তাদের প্রকৃত মজুরি বৃদ্ধি সার্বিক অর্থনীতির একটা ভালো দিক।
দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মৌসুমি মজুরির হার বেশ ওঠানামা করে। এক অঞ্চলে যখন কাজের সুযোগ থাকে না, তখন অন্য অঞ্চলে দেখা যায় অতিরিক্ত শ্রমিকের চাহিদা। তাই শ্রমিকের আঞ্চলিক গতিশীলতা লক্ষণীয়। যেমন: পূর্বাঞ্চলে সাধারণত জুলাই-অক্টোবর সময়কালে কৃষি শ্রমিকের তেমন কাজ থাকে না। তখন তারা বিভিন্ন অকৃষি পেশায় নিয়োজিত হয়। অনেকে রাজধানী বা আশপাশের শহরে কাজের সন্ধানে যায়। অন্যদিকে পূর্বাঞ্চলে যখন আমন ও বোরো মৌসুম, তখন কৃষি শ্রমিকের চাহিদা ব্যাপক ও এই সময়ে উত্তরাঞ্চলের শ্রমিকেরা পূর্বাঞ্চলে পাড়ি জমায় কাজের সন্ধানে।
দেশে মধ্যাঞ্চলে একটা দ্রুত কাঠামোগত পরিবর্তন ঘটছে। এখানকার স্থানীয় শ্রমিকেরা বেশি হারে অকৃষি পেশায় নিয়োজিত হচ্ছে, অন্যদিকে বিশেষ করে উত্তরাঞ্চল থেকে আগত শ্রমিকেরা কৃষি শ্রমিক হিসেবে কাজ করছে। দেশের উত্তরাঞ্চলের লোকজনের কর্মসংস্থানের মূল উৎস হচ্ছে কৃষি। সেখানে কৃষিতে কাজের সুযোগ রয়েছে মূলত কৃষি মৌসুমে। বছরের একটা বড় সময় কৃষিকাজ থাকে না এসব এলাকায়। তাই হয় তাদের বাধ্য হয়ে বেকার থাকতে হয় অথবা কাজের সন্ধানে রাজধানীসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলের দিকে পাড়ি জমাতে হয়। এসব শ্রমিককে সাধারণত কম মজুরিতে কাজ করতে হয়। কারণ, তাদের উপস্থিতি ওই অঞ্চলে শ্রমের জোগান বাড়িয়ে দেয়।
দেশের দক্ষিণাঞ্চলেও বছরের যে মৌসুমে কৃষিকাজ থাকে না, তখন কৃষি শ্রমিকদের অকৃষি শ্রমিকের কাজে নিয়োজিত হতে হয়। অথবা তারা রাজধানী বা বড় শহরের দিকে যাত্রা করে কাজের সন্ধানে। দেশের মধ্য ও পূর্বাঞ্চলে অকৃষি কাজের সুযোগ তুলনামূলকভাবে বেশি রয়েছে, ফলে এসব অঞ্চলে কৃষি এবং অকৃষি ক্ষেত্রে মজুরির বড় তারতম্য ঘটে না। শ্রমিকেরা তুলনামূলকভাবে কম হারে অন্য অঞ্চলে কাজের সন্ধানে যায়।
সুতরাং, বছরের সব মৌসুমে কৃষিকাজের সুযোগ না থাকা এবং অকৃষি কর্মকাণ্ডের অপ্রতুলতা মূলত দেশের দক্ষিণ ও উত্তরাঞ্চলের শ্রমিকদের রাজধানী ও অন্যান্য অঞ্চলমুখী করছে। এমতাবস্থায়, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর পাশাপাশি বছরের সব মৌসুমে চাষের ব্যবস্থা এবং অকৃষি খাতে ব্যাপক কর্মসৃজনের ব্যবস্থা করতে হবে। তা না হলে মজুরির এই আঞ্চলিক বৈষম্য থেকেই যাবে এবং আমাদের দারিদ্র্য নিরসন প্রচেষ্টা বাধাগ্রস্ত হবে।
মোস্তফা কামাল মুজেরী: মহাপরিচালক, বাংলাদেশে উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস);
মনসুর আহমেদ: গবেষণা সহযোগী, বিআইডিএস।
No comments