প্রতিভার স্বীকৃতি চায় শিশুরা -শিশুশিক্ষা by আমিরুল আলম খান

ছোট্ট শিশু তৌসিফ। সে তৃতীয় শ্রেণীতে ভর্তি হতে চায় সাতক্ষীরা সরকারি স্কুলে। সেখানে তৃতীয় থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ার সুযোগ আছে। নামডাক আছে স্কুলটির। কিন্তু ভর্তি পরীক্ষার আগে অসুস্থ হয়ে পড়ায় আশানুরূপ ফল করতে পারেনি। তাই ভর্তির অনুমতি মেলেনি। তার মন খারাপ। মন খারাপ গোটা পরিবারের। বাবা ছুটে এসেছেন আমার কাছে। তাঁর ধারণা, আমি সুপারিশ করলে ছেলেটা ভর্তি হতে পারবে।
কাকে বলতে হবে? ডিসি সাহেবকে।
এখন সরকারি সব স্কুলের দায়িত্ব নিয়েছেন ডিসি সাহেবেরা। প্রধান শিক্ষকদের এখন করার কিছু নেই।
কী বলব তৌসিফের বাবাকে? বললাম, সুপারিশে কাজ হবে না। সন্তুষ্ট হতে পারলেন না তৌসিফের বাবা। তিনি বললেন, ছেলেটা আসলেই মেধাবী। লেখাপড়া ছাড়া আরও অনেক গুণ আছে তার। সে ভালো কবিতা আবৃত্তি করে, ভালো ক্রিকেট খেলে, বিতর্ক প্রতিযোগিতায় উপজেলায় প্রথম স্থান পেয়েছিল। সুযোগ পেলে সে আরও ভালো করতে পারবে, স্কুলের মুখ উজ্জ্বল করবে।
আমি তার বাবাকে বোঝানোর অনেক চেষ্টা করি। বলি, সাতক্ষীরায় পল্লীমঙ্গলের মতো ভালো স্কুল আছে। সেখানে ছেলেকে ভর্তির ব্যবস্থা করতে। বাবা খুশি হলেন না। তাঁর ইচ্ছা, সরকারি স্কুলেই ভর্তি হোক তৌসিফ।
প্রতিবছর আমাকে এ ধরনের পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয়। কেউ না কেউ আসেন, তাঁর ছেলে বা মেয়েকে জেলা স্কুল বা সরকারি মাধ্যমিক স্কুল বা অন্য কোনো ভালো স্কুলে ভর্তির সুপারিশ করতে। তাঁদের ধারণা, আমার সুপারিশ রক্ষা করবে স্কুল কর্তৃপক্ষ। কিন্তু আসলেই সুপারিশে কোনো কাজ হয় না। তাদের অনেক নিয়ম মেনে চলতে হয়। সুপারিশ মানলে ভালো ছেলে বা মেয়েকে বঞ্চিত করা হয় ভর্তির সুযোগ থেকে। তারা আমার কথা রাখতে পারে না। তাতে বরং আমি খুশিই হই। কেননা, একজন ভালো ছাত্র বঞ্চিত হোক, তা আমি কখনো চাই না।
কিন্তু তৌসিফের কথা আলাদা। সে শুধু মেধাবী নয়, ভালো আবৃত্তিকার, ভালো বক্তা, ভালো ক্রিকেট খেলোয়াড়।
তৌসিফের বাবা অবস্থাসম্পন্ন মানুষ। ছেলেকে মানুষ করার জন্য তিনি সবকিছু করতে রাজি। কিন্তু এতটুকু শিশুকে দূরে পাঠিয়ে তিনি ও তৌসিফের মা নিশ্চিন্তে ঘুমাবেন কী করে? তাই তিনি ছুটে এসেছেন সাতক্ষীরা থেকে যশোরে। তদবির করাতে।
তৌসিফের ঘটনা আমাকে নানাভাবে ভাবিয়েছে। প্রথমত, এখনো সরকারি স্কুলের প্রতি মানুষের আস্থা আছে। দেশজুড়ে সরকারি ব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে এত যে বিষোদ্গার, এর সব তাহলে সত্য নয়।
দ্বিতীয়ত, তৌসিফের বাবা যে কথাটা বলেছেন, তা হলো, তৌসিফ আর দশজন ভালো ছাত্রের চেয়ে আলাদা। তৌসিফ ভালো বক্তা। ভালো কবিতা আবৃত্তি করে, ভালো ক্রিকেট খেলে। সুযোগ পেলে সে আরও ভালো করতে পারবে। কিন্তু সে জন্য সে আলাদা কোনো ক্রেডিট পায়নি। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় এসব সহশিক্ষা কার্যক্রমের আলাদা কোনো মূল্যায়ন নেই। ভালো ছাত্রের একটাই সংজ্ঞা : তার স্মৃতি হবে প্রখর, সে দ্রুত মুখস্থ করতে পারে। পরীক্ষার খাতায় সে নির্ভুল লিখতে পারে। কিন্তু সে যে লেখে মুখস্থ বিদ্যা, সেখানে যে তার নিজস্ব চিন্তার কোনো প্রকাশ নেই—তার বিরুদ্ধে আমরা সবাই নীরব।
আমরা ধরেই নিয়েছি, শিশু আবার ভাববে কী? সে আবার নিজে লিখবে কী?
একবার আমি একজন কৃতবিদ্য অধ্যাপককে দেখেছিলাম। তিনি তাঁর ছয় বছরের ছোট মেয়েকে কিছু ফুলের নাম শেখাচ্ছিলেন। তাঁর সুন্দর হস্তাক্ষরে তিনি কিছু ফুলের নাম লিখে দিচ্ছিলেন। আমি সেই অধ্যাপককে বলি, আপনি কি ওকে জিজ্ঞেস করে দেখেছেন, সে কোন কোন ফুল চেনে? তিনি বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকান।
আমি এবার সেই শিশুটিকে বললাম, তুকি কী কী ফুল চেন? সে অন্তত ১০টি ফুলের নাম বলে গেল অবলীলায়। তার চেনা ফুল। তার শিশুমন যেসব ফুলকে ভালোবাসতে শিখিয়েছে, সেসব ফুলের নাম।
অধ্যাপক মহোদয় হতোদ্যম হওয়ার পাত্র নন। তিনি বললেন, এসব বুনোফুলের নাম শিখলে সে কি পরীক্ষায় নম্বর পাবে?
আমি আরও অবাক হলাম। ওই অতটুকু শিশু, তাকে নিয়ে এখনই পরীক্ষা পাসের চিন্তা! বললাম, বেশ তো, ওকে আরও ফুল চেনার সুযোগ করে দিন। ওকেই ওর মতো করে ফুলের নাম লিখতে দিন। তাতে ওর নিজের ওপর আস্থা বাড়বে। কেবল আত্মবিশ্বাসী শিশুই বড় হতে পারে। তিনি এবার আমার ওপর রীতিমতো রুষ্ট হলেন।
দীর্ঘদিন ট্রেনিং কলেজে পড়িয়েছি। শিশু মনোবিজ্ঞান পড়িয়েছি শিক্ষকদের। মনে হয়, সে সবই শুধুই পুঁথিগত বিদ্যা। আমরা শিক্ষকেরা, অভিভাবকেরা একগাদা বই তুলে দিই শিশুদের কাঁধে। কিন্ডারগার্টেনগুলোয় পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। এত বইয়ের গাদা যে বহন করার সামর্থ্যই নেই এ বয়েসী শিশুর, তা কখনো ভাবি না। বইয়ের বোঝা টানতে টানতে বহু শিশুর মেরুদণ্ড বাঁকা হয়ে যাচ্ছে—এ কথা বলছেন চিকিত্সকেরা। কিন্তু তাতে কি? বেশি বই পড়া মানেই তো বেশি বেশি জানা, দিগ্গজ হওয়া! আমরা আমাদের সন্তানদের এরিস্টটল, আইনস্টাইন(!) বানাতে চাই। ইঁদুর দৌড়ে তাকে প্রথম হতেই হবে। নইলে সে শিকার হয় বাবা-মায়ের অশেষ লাঞ্ছনার!
২০০৮ সালে প্রায় দেড় শ শিক্ষার্থী নিজ স্কুল থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষা দিতে না পেরে নিয়মবহির্ভূতভাবে অন্য স্কুল থেকে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে বিপদগ্রস্ত হয়। এর কারণ অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে এক চাঞ্চল্যকর তথ্য। টেস্ট পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়ায় অনেকের বাবা-মা তাদের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দেন। কাউকে কাউকে বাড়ি থেকেই বের করে দেন। লিখিতভাবে এসব তথ্য তারা দিয়েছিল তদন্তকারী কর্তৃপক্ষের কাছে। শিশুদের প্রতি কী অমানবিক আচরণ! শুধু পরিবারের কাছে টিকে থাকার জন্যই তারা অবৈধভাবে পরীক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করে ধরা পড়ে।
আমাদের শিশুদের ওপর আমরা কী ধরনের মানসিক অত্যাচার করি, এটা এর একটা দৃষ্টান্ত মাত্র। আমাদের শিশুদের কোনো স্বাধীনতা নেই। শিশুর মেধা, তার ইচ্ছা-অনিচ্ছা, সামর্থ্য, রুচি—সবই আমাদের কাছে মূল্যহীন। আমরা ভালো ছাত্রের একটা সংজ্ঞাই কেবল জানি ও মানি: তাকে ক্লাসে প্রথম হতে হবে, সার্টিফিকেট পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেতে হবে। এর বাইরে তার অন্য কোনো সাফল্য পিতামাতাকে খুশি করে না। খুশি করে না শিক্ষক বা প্রশাসকদেরও।
পরীক্ষায় শুধু দেখা হয়, সে কত মুখস্থ করতে পারে, তার কতটা সে উগরে দিতে পারে পরীক্ষার খাতায়। তার অন্য কোনো গুণ তার ভর্তির নিয়ামক হতে পারে—এটা যেন কেউ ভাবতেও পারি না। সে হয়তো ছবি আঁকতে পছন্দ করে, পছন্দ করে নাচতে, গাইতে। কিংবা পছন্দ করে খোলা আকাশের নিচে দৌড়ে বেড়াতে, নদীর জলে সাঁতার কাটতে। পারে সুন্দর করে ফুল সাজাতে, ঘর গোছাতে বা রান্না করতে। না, আমাদের অতি আধুনিক মা-বাবা-শিক্ষকদের কাছে শিশুদের এসব ইচ্ছা বা গুণ কোনোই যোগ্যতা নয়। তাঁরা চান, শিশুরা খেলা করে সময় নষ্ট করবে না, সারা দিনমান শুধু বই পড়বে, নোট গিলবে, পণ্ডিত হবে। এভাবে লেখাপড়া শিশুদের কাছে আবির্ভূত হয় এক ভয়ঙ্কর যন্ত্রণাদায়ক জীবনপ্রণালী হিসেবে। রবীন্দ্রনাথ বুঝেছিলেন শিশুমনের এই যন্ত্রণা। তাঁর ডাকঘর নাটিকায় তিনি শিশুমনের এ আকুতির কথা প্রকাশ করেছেন। কিন্তু কে তার ধার ধারে! ডাকঘর তাই শিশুপাঠ্য বা অভিনয়োপযুক্ত শুধুই একটি নাটিকা! একে মান্য করা নিষ্প্রয়োজন! বার্নার্ড শ-এর একটি রচনা শিশুদের পাঠ্যতালিকাভুক্ত করার প্রস্তাব করা হলে তিনি রাজি হননি। বরং জবাব দিয়েছিলেন, ‘আমি শিশুদের ওপর অত্যাচার করার মতো কিছু লিখেছি বলে তো মনে পড়ে না।’
আমরা শিক্ষাব্যবস্থা ঢেলে সাজাতে চাই। শিশুদের প্রতি আমরা কি সদয় হতে পারব?
আমিরুল আলম খান: শিক্ষাবিদ।
Amirulkhan570@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.