শিশুরা কেমন মানুষ হচ্ছে? by সরকার আবদুল মান্নান
একজন শিশু কেন স্কুলে যাবে, কেন সে পড়াশোনা করবে—এসব প্রসঙ্গ বেশ পুরোনো, বহুল বিবেচ্য বিষয়। কিন্তু এর গুরুত্ব শেষ হয়ে যায়নি, মীমাংসা হয়ে যায়নি; বরং বিষয়টি এখন তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে, সংকটাপন্ন অবস্থায় এসে পৌঁছেছে, ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। কেন? এই প্রশ্নে শিক্ষা-বৈজ্ঞানিক (Pedagogical) বিতর্ক রয়েছে। সেই বিতর্কে না গিয়ে খোলা চোখে যেটুকু দেখা যায়, সেটুকু বিবেচনা করা যেতে পারে।
কোনো শিশুকেই রাষ্ট্র স্কুলে নিয়ে আসে না। শিশুকে স্কুলে নিয়ে আসে তার মা-বাবা, অভিভাবক। সেই মা-বাবা বা অভিভাবককে যদি জিজ্ঞাসা করেন, কেন আপনি আপনার শিশুকে স্কুলে পাঠান? তিনি বলবেন, মানুষ করার জন্য। কিন্তু মানুষ করার মানে কী, নীতি কী, তা নির্ধারণ করে দেওয়ার দায়িত্ব রাষ্ট্রের, মা-বাবা কিংবা অভিভাবকদের নয়। স্বাধীনতা লাভের পর চার দশক অতিক্রান্ত হতে যাচ্ছে। দীর্ঘ এ সময়ে শিশুদের মানুষ করে তোলার জন্য রাষ্ট্র কি সত্যিকার অর্থে সর্বজনগ্রাহ্য, সর্বজনমান্য কোনো নীতি তৈরি করেছে? যদি তৈরি করে থাকে তাহলে সেই নীতিগুলো কোথায়? কোন শিক্ষক সেই নীতিগুলোর আলোকে শিক্ষার্থীকে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলছেন, মানুষ করে তুলছেন? এর কিছুই আমরা জানি না।
আমরা জানি, পরীক্ষায় ভালো ফল করাই মানুষ হওয়ার একমাত্র মানদণ্ড। শিক্ষার্থীর কাছে, মা-বাবা ও আত্মীয়স্বজনের কাছে, শিক্ষকের কাছে, এমনকি রাষ্ট্রের কাছেও ভালো ছাত্রছাত্রীর মানেই হলো কাগজ-কলমে পরীক্ষায় ভালো ফল করা। খুব শৈশব থেকে অর্থাৎ তথাকথিত ভালো স্কুলে ভর্তি হওয়া থেকেই শুরু হয় মানুষ হওয়ার এই প্রক্রিয়া। শিশুটিকে ভর্তিযুদ্ধে জয়ী করানোর জন্য মা-বাবা এবং কোচিং সেন্টারগুলো যে পরিমাণ অত্যাচার তার ওপর করে, এর কোনো তুলনা চলে না। অস্বাভাবিক তথ্য মুখস্থ করতে বাধ্য করা হয়। অবোধ শিশুটির কিছুই করার থাকে না।
শিশুটি যখন স্কুলে ভর্তি হয়, তখন মা-বাবা ও শিক্ষকের প্রত্যাশা অনুযায়ী, ভালো ফল করার জন্য মুখস্থ, মুখস্থ আর মুখস্থ করার মধ্যেই তার মানুষ হওয়ার নিয়তি নির্ধারিত হয়ে যায় এবং শিক্ষার সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত এই নিয়তিকে কখনোই আর সে অতিক্রম করতে পারে না। ফলে ফি-বছর শিক্ষার হার বাড়ে, সার্টিফিকেট লাভ হয়, ডিগ্রি লাভ হয়; কিন্তু সুনাগরিক বাড়ে না, যোগ্য ও দক্ষ নাগরিক বাড়ে না, দেশপ্রেমিক নাগরিক বাড়ে না, অসাম্প্রদায়িক জীবনবোধে বিশ্বাসী মানুষ গড়ে ওঠে না; জাতি, ধর্ম, গোত্র, বর্ণ, ধনী-দরিদ্রনির্বিশেষে সব মানুষকে শ্রদ্ধা ও সম্মান করার মতো উদার মনোভঙ্গির মানুষ তৈরি হয় না। প্রতিষ্ঠা, প্রতিষ্ঠা ও প্রতিষ্ঠার জন্যই যেন তার শিক্ষা। নীতি-নৈতিকতার বিষয় নেই, সত্যাসত্যের বিষয় নেই, মূল্যবোধের বিষয় নেই, ন্যায়-অন্যায়ের বিষয় নেই, যুক্তি-অযুক্তির বিষয় নেই, কল্যাণ-অকল্যাণের বিষয় নেই—তার সামনে থাকে শুধুই প্রতিষ্ঠা লাভের দানবীয় আকাঙ্ক্ষা। যখন শিশুর মস্তিষ্কের গড়ন নির্ধারিত হবে; জীবনকে দেখার, বোঝার দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হবে তখন থেকে তার মধ্যে পুরে দেওয়া হয় স্বার্থপরতার এই বীভৎস একচোখা দৈত্যের পাঠ।
আমরা জাতিগতভাবেই ভুলে গিয়েছি যে ভালো ছাত্র হওয়ার প্রতিভা নিয়ে সব শিশু জন্মগ্রহণ করে না। কিন্তু বিচিত্র পথে যোগ্য মানুষ হওয়ার প্রতিভা সব শিশুর মধ্যেই আছে। যথাযথ পরিচর্যা পেলে তার অসাধারণ সম্ভাবনাগুলো বিকশিত হওয়ার সুযোগ পায়। আর সেই বিকাশের পথে প্রথম পাঠ হলো শিশুকে ভালোবাসতে শেখানো। পাঠ্যপুস্তকনির্ভর খাতা-কলমের পরীক্ষা দিয়ে শিশুকে ভালোবাসতে শেখানো যায় না। এর জন্য প্রয়োজন তার প্রতিদিনের আচরণকে পরিমার্জিত করা। শিশুটি যেন তার পোশাক-পরিচ্ছদকে ভালোবাসতে শেখে; তার বই-পুস্তক, খাতা-কলমকে ভালোবাসতে শেখে; তার আসবাবকে ভালোবাসতে শেখে; তার মা-বাবা, ভাইবোন ও আত্মীয়স্বজনকে ভালোবাসতে শেখে; শিক্ষক থেকে শুরু করে সহপাঠী সবাইকে এবং পিয়ন-দারোয়ানকে ভালোবাসতে শেখে—শিশুর মধ্যে এই পাঠদান করা সর্বাগ্রে জরুরি। প্রকৃতিকে সে যেন গভীর মমত্ব ও ভালোবাসার সঙ্গে গ্রহণ করতে পারে সেই দৃষ্টিভঙ্গিও তৈরি করে দেওয়ার দায়িত্ব মা-বাবা ও শিক্ষকের। জাতি, ধর্ম, গোত্র, বর্ণ, ধনী, দরিদ্র সব মানুষকে সে যেন শ্রদ্ধা ও সম্মান করার সামর্থ্য লাভ করতে পারে সে দায়িত্বও মা-বাবা ও শিক্ষকের। কিছু তথ্য মুখস্থ রাখার বাইরে সব ক্ষেত্রে শিশুরা যেন তাদের নিজ নিজ চিন্তা ও কল্পনা প্রতিভার স্বাক্ষর রাখতে পারে, শিক্ষককে তা নিশ্চিত করতে হবে। অন্যের লেখা নোট শিশুকে দিয়ে মুখস্থ করানো শুধু অনৈতিকই নয়, অপরাধও বটে। শিক্ষক ও অভিভাবককে এই অনৈতিক ও অপরাধের পথ থেকে সরে আসতে হবে। কোনো শিশুকে দিয়েই অন্যকে অতিক্রম করানোর চেষ্টা করা যাবে না। শিশুটি যেন প্রতিনিয়ত নিজেকে অতিক্রম করতে পারে, সেই শক্তি ও সম্ভাবনা তার মধ্যে তৈরি করতে হবে।
শিশুকে মা মায়ের মতো, বাবা বাবার মতো কিংবা শিক্ষক শিক্ষকের মতো করে গড়ে তোলার চেষ্টা করবেন না। বরং শিশুকে তার নিজের মতো করে গড়ে ওঠার পথ করে দেবেন। ভালো ছাত্র, মন্দ ছাত্র; ধনী ছাত্র, দরিদ্র ছাত্র; সুবোধ ছাত্র, দুষ্ট ছাত্র; হিন্দু ছাত্র, মুসলমান ছাত্র—এমন কোনো পরিচয় কোনো অবস্থাতেই বিবেচনায় আনা যাবে না। বরং শিখন-শিক্ষণ (Teaching-Learning) প্রক্রিয়ায় সব শিক্ষার্থীর জন্য আনন্দদায়ক ও অংশগ্রহণমূলক পরিবেশ তৈরি করতে হবে। কোনো শিক্ষার্থী যেন বঞ্চিতবোধ না করে, বঞ্চিত না হয় সেই পরিবেশ তৈরি করা জরুরি। সব শিক্ষার্থী যেন শিক্ষকের ভালোবাসা পায়, তার স্নেহের পরশ লাভ করে, সচেতনভাবেই তা নিশ্চিত করতে হবে। শাস্তি দিয়ে, গালাগাল দিয়ে, চিৎকার-চেঁচামেচি করে কখনোই শিশুদের আচরণিক পরিবর্তন করা যায় না। এর জন্য প্রয়োজন নিঃশর্ত ভালোবাসা ও অফুরন্ত স্নেহ। অধিকাংশ শিশু যেমন সহজাতভাবেই মা-বাবাকে অনিঃশেষ আশ্রয়স্থল মনে করে, তেমনি বিদ্যালয়েও যদি শিক্ষকেরা নিজেদের শিশুদের আশ্রয়স্থল হিসেবে গড়ে তুলতে পারেন, তবে শিশুরা নিঃসংকোচে নিজেদের মেলে ধরার স্বতঃস্ফূর্ততা লাভ করবে।
প্রকৃতিগতভাবেই শিশুরা কমবেশি দুরন্ত। এই দুরন্তপনাকে যেসব শিক্ষক অস্বাভাবিক ও অসহ্য মনে করেন, শিশুশিক্ষায় তাঁদের না যাওয়াই ভালো। কেননা, তাঁদের দিয়ে শিশুদের শিক্ষা হয় না—অশিক্ষা হয়, ক্ষতি হয়। শিশুদের শাসন ততক্ষণ পর্যন্ত করা যাবে না, যতক্ষণ না শিশু বুঝতে পারে যে আপনি তাকে ভালোবাসেন। শাসন করা তারই সাজে সোহাগ করে যে। এই প্রবাদ কোনো কথার কথা নয়।
শিশুকে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য; মানব-প্রেমিক, দেশপ্রেমিক ও প্রকৃতিপ্রেমিক মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য সরকারের উদ্যোগ ও ব্যবস্থা গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই। সরকার যদি সুনির্দিষ্ট নীতি নির্ধারণ করে সর্বান্তঃকরণে এগিয়ে আসে, তাহলে পাশে দাঁড়ানোর মতো ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের অভাব হবে না। শিখন-শিক্ষণ প্রক্রিয়ার মধ্যে মানদণ্ডগুলোকে দৃঢ়ভাবে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য শিক্ষকদের যে প্রশিক্ষণ ও নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা দরকার, সে দায়িত্ব তো সরকারেরই। একটি আধুনিক রাষ্ট্র গঠনের এই যে মূলগত ভিত্তি—এ নিয়ে কোনো সরকার কখনো সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে ভেবেছে? তবে সময় ফুরিয়ে যায়নি। ইতিমধ্যে অনেক অহেতুক বিষয়নিয়ে অনেক সময় পার করে দিয়েছি, যার সত্যিকার অর্থে কোনো অর্থ নেই, তাৎপর্য নেই। কেননা একটি স্বার্থান্ধ মনোগড়ন নিয়ে বেড়ে ওঠা শিশুটিকে পরিণত বয়সে এসে পরিবর্তন করা কখনোই সম্ভব নয়। ফলে আমাদের পরিবার-সংগঠন থেকে শুরু করে সমাজ-সংগঠন ও রাষ্ট্র-সংগঠনের সর্বত্রই বিরাজ করছে স্বার্থপরতাসংশ্লিষ্ট বিচিত্র সংকট। এই সংকট উত্তরণের জন্য দরকার সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে শিশুশিক্ষার খোলনলচে পালটে দেওয়া। এ ক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকা নিঃসন্দেহেই মুখ্য। কিন্তু শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবী, কবি-সাহিত্যিক-সাংবাদিক এবং অন্যান্য অংশীজনদের ভূমিকাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। সবাই মিলে আমরা যদি আমাদের শিশুদের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার অঙ্গীকার গ্রহণ করি, তাহলেই একটি আধুনিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন সফল হবে; তিরিশ লক্ষ শহীদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা যথার্থ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হবে।
সরকার আবদুল মান্নান: গবেষক, প্রাবন্ধিক।
কোনো শিশুকেই রাষ্ট্র স্কুলে নিয়ে আসে না। শিশুকে স্কুলে নিয়ে আসে তার মা-বাবা, অভিভাবক। সেই মা-বাবা বা অভিভাবককে যদি জিজ্ঞাসা করেন, কেন আপনি আপনার শিশুকে স্কুলে পাঠান? তিনি বলবেন, মানুষ করার জন্য। কিন্তু মানুষ করার মানে কী, নীতি কী, তা নির্ধারণ করে দেওয়ার দায়িত্ব রাষ্ট্রের, মা-বাবা কিংবা অভিভাবকদের নয়। স্বাধীনতা লাভের পর চার দশক অতিক্রান্ত হতে যাচ্ছে। দীর্ঘ এ সময়ে শিশুদের মানুষ করে তোলার জন্য রাষ্ট্র কি সত্যিকার অর্থে সর্বজনগ্রাহ্য, সর্বজনমান্য কোনো নীতি তৈরি করেছে? যদি তৈরি করে থাকে তাহলে সেই নীতিগুলো কোথায়? কোন শিক্ষক সেই নীতিগুলোর আলোকে শিক্ষার্থীকে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলছেন, মানুষ করে তুলছেন? এর কিছুই আমরা জানি না।
আমরা জানি, পরীক্ষায় ভালো ফল করাই মানুষ হওয়ার একমাত্র মানদণ্ড। শিক্ষার্থীর কাছে, মা-বাবা ও আত্মীয়স্বজনের কাছে, শিক্ষকের কাছে, এমনকি রাষ্ট্রের কাছেও ভালো ছাত্রছাত্রীর মানেই হলো কাগজ-কলমে পরীক্ষায় ভালো ফল করা। খুব শৈশব থেকে অর্থাৎ তথাকথিত ভালো স্কুলে ভর্তি হওয়া থেকেই শুরু হয় মানুষ হওয়ার এই প্রক্রিয়া। শিশুটিকে ভর্তিযুদ্ধে জয়ী করানোর জন্য মা-বাবা এবং কোচিং সেন্টারগুলো যে পরিমাণ অত্যাচার তার ওপর করে, এর কোনো তুলনা চলে না। অস্বাভাবিক তথ্য মুখস্থ করতে বাধ্য করা হয়। অবোধ শিশুটির কিছুই করার থাকে না।
শিশুটি যখন স্কুলে ভর্তি হয়, তখন মা-বাবা ও শিক্ষকের প্রত্যাশা অনুযায়ী, ভালো ফল করার জন্য মুখস্থ, মুখস্থ আর মুখস্থ করার মধ্যেই তার মানুষ হওয়ার নিয়তি নির্ধারিত হয়ে যায় এবং শিক্ষার সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত এই নিয়তিকে কখনোই আর সে অতিক্রম করতে পারে না। ফলে ফি-বছর শিক্ষার হার বাড়ে, সার্টিফিকেট লাভ হয়, ডিগ্রি লাভ হয়; কিন্তু সুনাগরিক বাড়ে না, যোগ্য ও দক্ষ নাগরিক বাড়ে না, দেশপ্রেমিক নাগরিক বাড়ে না, অসাম্প্রদায়িক জীবনবোধে বিশ্বাসী মানুষ গড়ে ওঠে না; জাতি, ধর্ম, গোত্র, বর্ণ, ধনী-দরিদ্রনির্বিশেষে সব মানুষকে শ্রদ্ধা ও সম্মান করার মতো উদার মনোভঙ্গির মানুষ তৈরি হয় না। প্রতিষ্ঠা, প্রতিষ্ঠা ও প্রতিষ্ঠার জন্যই যেন তার শিক্ষা। নীতি-নৈতিকতার বিষয় নেই, সত্যাসত্যের বিষয় নেই, মূল্যবোধের বিষয় নেই, ন্যায়-অন্যায়ের বিষয় নেই, যুক্তি-অযুক্তির বিষয় নেই, কল্যাণ-অকল্যাণের বিষয় নেই—তার সামনে থাকে শুধুই প্রতিষ্ঠা লাভের দানবীয় আকাঙ্ক্ষা। যখন শিশুর মস্তিষ্কের গড়ন নির্ধারিত হবে; জীবনকে দেখার, বোঝার দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হবে তখন থেকে তার মধ্যে পুরে দেওয়া হয় স্বার্থপরতার এই বীভৎস একচোখা দৈত্যের পাঠ।
আমরা জাতিগতভাবেই ভুলে গিয়েছি যে ভালো ছাত্র হওয়ার প্রতিভা নিয়ে সব শিশু জন্মগ্রহণ করে না। কিন্তু বিচিত্র পথে যোগ্য মানুষ হওয়ার প্রতিভা সব শিশুর মধ্যেই আছে। যথাযথ পরিচর্যা পেলে তার অসাধারণ সম্ভাবনাগুলো বিকশিত হওয়ার সুযোগ পায়। আর সেই বিকাশের পথে প্রথম পাঠ হলো শিশুকে ভালোবাসতে শেখানো। পাঠ্যপুস্তকনির্ভর খাতা-কলমের পরীক্ষা দিয়ে শিশুকে ভালোবাসতে শেখানো যায় না। এর জন্য প্রয়োজন তার প্রতিদিনের আচরণকে পরিমার্জিত করা। শিশুটি যেন তার পোশাক-পরিচ্ছদকে ভালোবাসতে শেখে; তার বই-পুস্তক, খাতা-কলমকে ভালোবাসতে শেখে; তার আসবাবকে ভালোবাসতে শেখে; তার মা-বাবা, ভাইবোন ও আত্মীয়স্বজনকে ভালোবাসতে শেখে; শিক্ষক থেকে শুরু করে সহপাঠী সবাইকে এবং পিয়ন-দারোয়ানকে ভালোবাসতে শেখে—শিশুর মধ্যে এই পাঠদান করা সর্বাগ্রে জরুরি। প্রকৃতিকে সে যেন গভীর মমত্ব ও ভালোবাসার সঙ্গে গ্রহণ করতে পারে সেই দৃষ্টিভঙ্গিও তৈরি করে দেওয়ার দায়িত্ব মা-বাবা ও শিক্ষকের। জাতি, ধর্ম, গোত্র, বর্ণ, ধনী, দরিদ্র সব মানুষকে সে যেন শ্রদ্ধা ও সম্মান করার সামর্থ্য লাভ করতে পারে সে দায়িত্বও মা-বাবা ও শিক্ষকের। কিছু তথ্য মুখস্থ রাখার বাইরে সব ক্ষেত্রে শিশুরা যেন তাদের নিজ নিজ চিন্তা ও কল্পনা প্রতিভার স্বাক্ষর রাখতে পারে, শিক্ষককে তা নিশ্চিত করতে হবে। অন্যের লেখা নোট শিশুকে দিয়ে মুখস্থ করানো শুধু অনৈতিকই নয়, অপরাধও বটে। শিক্ষক ও অভিভাবককে এই অনৈতিক ও অপরাধের পথ থেকে সরে আসতে হবে। কোনো শিশুকে দিয়েই অন্যকে অতিক্রম করানোর চেষ্টা করা যাবে না। শিশুটি যেন প্রতিনিয়ত নিজেকে অতিক্রম করতে পারে, সেই শক্তি ও সম্ভাবনা তার মধ্যে তৈরি করতে হবে।
শিশুকে মা মায়ের মতো, বাবা বাবার মতো কিংবা শিক্ষক শিক্ষকের মতো করে গড়ে তোলার চেষ্টা করবেন না। বরং শিশুকে তার নিজের মতো করে গড়ে ওঠার পথ করে দেবেন। ভালো ছাত্র, মন্দ ছাত্র; ধনী ছাত্র, দরিদ্র ছাত্র; সুবোধ ছাত্র, দুষ্ট ছাত্র; হিন্দু ছাত্র, মুসলমান ছাত্র—এমন কোনো পরিচয় কোনো অবস্থাতেই বিবেচনায় আনা যাবে না। বরং শিখন-শিক্ষণ (Teaching-Learning) প্রক্রিয়ায় সব শিক্ষার্থীর জন্য আনন্দদায়ক ও অংশগ্রহণমূলক পরিবেশ তৈরি করতে হবে। কোনো শিক্ষার্থী যেন বঞ্চিতবোধ না করে, বঞ্চিত না হয় সেই পরিবেশ তৈরি করা জরুরি। সব শিক্ষার্থী যেন শিক্ষকের ভালোবাসা পায়, তার স্নেহের পরশ লাভ করে, সচেতনভাবেই তা নিশ্চিত করতে হবে। শাস্তি দিয়ে, গালাগাল দিয়ে, চিৎকার-চেঁচামেচি করে কখনোই শিশুদের আচরণিক পরিবর্তন করা যায় না। এর জন্য প্রয়োজন নিঃশর্ত ভালোবাসা ও অফুরন্ত স্নেহ। অধিকাংশ শিশু যেমন সহজাতভাবেই মা-বাবাকে অনিঃশেষ আশ্রয়স্থল মনে করে, তেমনি বিদ্যালয়েও যদি শিক্ষকেরা নিজেদের শিশুদের আশ্রয়স্থল হিসেবে গড়ে তুলতে পারেন, তবে শিশুরা নিঃসংকোচে নিজেদের মেলে ধরার স্বতঃস্ফূর্ততা লাভ করবে।
প্রকৃতিগতভাবেই শিশুরা কমবেশি দুরন্ত। এই দুরন্তপনাকে যেসব শিক্ষক অস্বাভাবিক ও অসহ্য মনে করেন, শিশুশিক্ষায় তাঁদের না যাওয়াই ভালো। কেননা, তাঁদের দিয়ে শিশুদের শিক্ষা হয় না—অশিক্ষা হয়, ক্ষতি হয়। শিশুদের শাসন ততক্ষণ পর্যন্ত করা যাবে না, যতক্ষণ না শিশু বুঝতে পারে যে আপনি তাকে ভালোবাসেন। শাসন করা তারই সাজে সোহাগ করে যে। এই প্রবাদ কোনো কথার কথা নয়।
শিশুকে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য; মানব-প্রেমিক, দেশপ্রেমিক ও প্রকৃতিপ্রেমিক মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য সরকারের উদ্যোগ ও ব্যবস্থা গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই। সরকার যদি সুনির্দিষ্ট নীতি নির্ধারণ করে সর্বান্তঃকরণে এগিয়ে আসে, তাহলে পাশে দাঁড়ানোর মতো ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের অভাব হবে না। শিখন-শিক্ষণ প্রক্রিয়ার মধ্যে মানদণ্ডগুলোকে দৃঢ়ভাবে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য শিক্ষকদের যে প্রশিক্ষণ ও নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা দরকার, সে দায়িত্ব তো সরকারেরই। একটি আধুনিক রাষ্ট্র গঠনের এই যে মূলগত ভিত্তি—এ নিয়ে কোনো সরকার কখনো সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে ভেবেছে? তবে সময় ফুরিয়ে যায়নি। ইতিমধ্যে অনেক অহেতুক বিষয়নিয়ে অনেক সময় পার করে দিয়েছি, যার সত্যিকার অর্থে কোনো অর্থ নেই, তাৎপর্য নেই। কেননা একটি স্বার্থান্ধ মনোগড়ন নিয়ে বেড়ে ওঠা শিশুটিকে পরিণত বয়সে এসে পরিবর্তন করা কখনোই সম্ভব নয়। ফলে আমাদের পরিবার-সংগঠন থেকে শুরু করে সমাজ-সংগঠন ও রাষ্ট্র-সংগঠনের সর্বত্রই বিরাজ করছে স্বার্থপরতাসংশ্লিষ্ট বিচিত্র সংকট। এই সংকট উত্তরণের জন্য দরকার সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে শিশুশিক্ষার খোলনলচে পালটে দেওয়া। এ ক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকা নিঃসন্দেহেই মুখ্য। কিন্তু শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবী, কবি-সাহিত্যিক-সাংবাদিক এবং অন্যান্য অংশীজনদের ভূমিকাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। সবাই মিলে আমরা যদি আমাদের শিশুদের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার অঙ্গীকার গ্রহণ করি, তাহলেই একটি আধুনিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন সফল হবে; তিরিশ লক্ষ শহীদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা যথার্থ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হবে।
সরকার আবদুল মান্নান: গবেষক, প্রাবন্ধিক।
No comments