আবারও যেন তৈলাক্ত বাঁশে ওঠারই অভিজ্ঞতা -সুশাসন by বদিউল আলম মজুমদার
নবম জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনে পাস করা ‘গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (সংশোধিত) আইন, ২০০৯’-এ অন্তর্ভুক্ত রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন সম্পর্কিত বিধান নিয়ে আমাদের পিছু হটার অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়ে গত ৩ সেপ্টেম্বরের প্রথম আলোতে ‘এ যেন এক তৈলাক্ত বাঁশে ওঠারই অভিজ্ঞতা’ শীর্ষক একটি উপসম্পাদকীয় লিখেছিলাম। গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে রাজনৈতিক দল ও অন্যান্য স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে ব্যাপক মতবিনিময়ের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশনের অধীনে কতগুলো শর্ত সাপেক্ষে রাজনৈতিক দলের বাধ্যতামূলক নিবন্ধনের বিধান গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২-এ অধ্যাদেশের মাধ্যমে সংযোজন করা হয়। সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ শর্তগুলো হলো: কেন্দ্রীয়সহ দলের সর্বস্তরের কমিটি নির্বাচনের মাধ্যমে নির্ধারণ; দলের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন বিলুপ্তকরণ; দলের তৃণমূলের কমিটিগুলোর সুপারিশের ভিত্তিতে সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়ন প্রদান; দলের সর্বস্তরে নারীদের উল্লেখযোগ্য প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিতকরণ ইত্যাদি।
সংশোধিত গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে এসব শর্ত অমান্য করার কারণে দলের নিবন্ধন বাতিল করার ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনকে দেওয়া হয়। বর্তমান সংসদের প্রথম অধিবেশনে পাস করা ‘গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (সংশোধিত) আইন, ২০০৯’-এ নিবন্ধনের এসব শর্ত রাখা হলেও দুর্ভাগ্যবশত এগুলো না মানলে কমিশনের নিবন্ধন বাতিলের ক্ষমতা রহিত করা হয়। তাই আমরা তৈলাক্ত বাঁশে ওঠার মতো কিছুটা অগ্রসর হয়ে আবার যেন পিছু হটছি! এমন অভিজ্ঞতারই যেন আবারও পুনরাবৃত্তি ঘটেছে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রার্থীদের তথ্য দেওয়ার ক্ষেত্রে।
স্মরণ করা যেতে পারে, ২০০৫ সালের ২৪ মে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ একটি যুগান্তকারী রায় দেন। রায়ে সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রার্থীদের আটটি তথ্য হলফনামা আকারে নির্বাচন কমিশন কর্তৃক সংগ্রহ করে তা ভোটারদের মধ্যে বিতরণ করার নির্দেশ দেওয়া হয়। তথ্যগুলো হলো: ১. সার্টিফিকেটসহ প্রার্থীদের শিক্ষাগত যোগ্যতা; ২. বর্তমানে তাদের বিরুদ্ধে রুজু করা ফৌজদারি অপরাধের অভিযোগের তালিকা (যদি থাকে); ৩. অতীত ফৌজদারি মামলার তালিকা ও ফলাফল; ৪. প্রার্থীর পেশা; ৫. প্রার্থীর আয়ের উত্স ও উত্সসমূহ; ৬. অতীতে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে থাকলে জনগণের প্রতি প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি পূরণ করার ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকার বর্ণনা; ৭. প্রার্থী ও প্রার্থীর ওপর নির্ভরশীল ব্যক্তিদের সম্পদ এবং দায়দেনার বর্ণনা এবং ৮. ব্যাংক কিংবা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ব্যক্তিগতভাবে বা যৌথভাবে এবং কোম্পানি কর্তৃক—যে কোম্পানিতে প্রার্থী চেয়ারম্যান, নির্বাহী পরিচালক কিংবা পরিচালক—গৃহীত ঋণের পরিমাণ ও বর্ণনা।
আরও স্মরণ করা যেতে পারে, রায়টি দেওয়ার পর সুজন—সুশাসনের জন্য নাগরিকের পক্ষ থেকে এটি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত বিচারপতি এম এ আজিজের নেতৃত্বে গঠিত নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা পাওয়া যায়নি। এমনকি প্রার্থীদের প্রদত্ত হলফনামার কপিগুলোও আমাদের দেওয়া হয়নি। বরং কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়, রায়টি ‘ডিরেক্টরি’, ‘ম্যান্ডেটরি’ নয়। অর্থাত্ এটি মানা বাধ্যতামূলক নয়। তবুও গত জোট সরকারের আমলে অনুষ্ঠিত পাঁচটি উপনির্বাচনে প্রার্থীদের দেওয়া যতটুকু তথ্য পাওয়া গেছে, তা সুজনের সঙ্গে সম্পৃক্ত স্বেচ্ছাব্রতীরা ভোটারদের মধ্যে লিফলেট আকারে বিতরণ করে। একই সঙ্গে তিনটি নির্বাচনী এলাকায় ‘প্রার্থী-ভোটার মুখোমুখি’ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়, যা ভোটারদের মধ্যে ব্যাপক উত্সাহ-উদ্দীপনা সৃষ্টি করে।
ভোটারদের তথ্য দিয়ে ক্ষমতায়নের এ প্রচেষ্টায় একটি বড় ধরনের আঘাত আসে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আবু সাফা নামের জনৈক ব্যক্তির পক্ষ থেকে একটি লিভ টু আপিল পিটিশন দায়েরের মাধ্যমে, যা ৬ এপ্রিল সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতিসহ আপিল বিভাগের তিন বিচারপতির একটি বেঞ্চে গৃহীত হয়। কয়েকটি কারণে লিভ টু আপিল পিটিশন গ্রহণের বিষয়টি ছিল অস্বাভাবিক। প্রথমত, আবু সাফা ছিলেন একজন তৃতীয় পক্ষ। তিনি মূল মামলার সঙ্গে কোনোভাবেই জড়িত ছিলেন না। দ্বিতীয়ত, মামলাটি শুনানিকালে বাদীপক্ষ কিংবা তাদের উকিলদের কেউই উপস্থিত ছিলেন না। এ ব্যাপারে তাদের জানানোও হয়নি। তবে শুনানির সময় আবু সাফা হাইকোর্টের রায়টির ওপর স্থগিতাদেশ প্রার্থনা করেন, যদিও সংশ্লিষ্ট বেঞ্চ তা নামঞ্জুর করেন।
জনগণের তথ্যপ্রাপ্তির অধিকার ভণ্ডুল করার সবচেয়ে মারাত্মক ঘটনাটি ঘটে ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়নপত্র দাখিলের প্রাক্কালে ২০০৬ সালের ১৯ ডিসেম্বর। ওই দিন আবু সাফার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আপিল বিভাগের অবসরকালীন বেঞ্চের বিচারপতি মো. জয়নাল আবেদীন আসন্ন নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রার্থীদের হলফনামার মাধ্যমে আটটি তথ্য দেওয়ার ওপর স্থগিতাদেশ জারি করেন। এ স্থগিতাদেশটিও ছিল অস্বাভাবিক। প্রথমত, স্থগিতাদেশের শুনানিটি ছিল একতরফা এবং ‘কেভিয়েট’ দেওয়া থাকলেও মূল মামলার বাদীদের এ ব্যাপারে জানানো হয়নি এবং তাঁদের কৌঁসুলি আদালতে উপস্থিতও ছিলেন না। (কেভিয়েট দেওয়া থাকলে আইনসম্মত পদ্ধতি হলো, শুনানির সময় সংশ্লিষ্ট পক্ষের উপস্থিতি নিশ্চিত করা এবং তাদের বক্তব্য শোনা।) দ্বিতীয়ত, আবু সাফা তাঁর শিক্ষাগত যোগ্যতা প্রকাশের ব্যাপারে আপত্তি জানালেও বিজ্ঞ বিচারপতি পুরো আটটি তথ্যসংবলিত হলফনামা জমা দেওয়ার ওপরই নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। তৃতীয়ত, যদিও আবু সাফা তাঁর নিজের তথ্য দেওয়ার বিপক্ষে আদালতের শরণাপন্ন হন। বিচারপতি জয়নুল আবেদীন সব প্রার্থীর ক্ষেত্রেই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। উল্লেখ্য, অবিশ্বাস্য ধরনের ক্ষিপ্রতা দেখিয়ে নির্বাচন কমিশন একই দিনে প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে এ নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করে ভোটারদের তথ্যপ্রাপ্তির অধিকার হরণ করে।
প্রসঙ্গত, স্থগিতাদেশ প্রার্থনার আর্জিতে আবু সাফা দাবি করেন, তিনি স্বল্প শিক্ষিত কিন্তু বিত্তশালী ও সমাজকর্মে লিপ্ত স্থানীয়ভাবে একজন জনপ্রিয় রাজনীতিবিদ। তিনি নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চট্টগ্রাম জেলার সন্দ্বীপ আসন থেকে একজন মনোনয়নপ্রত্যাশী এবং হলফনামার মাধ্যমে শিক্ষাগত যোগ্যতা প্রকাশ করলে নির্বাচনে তাঁর বিরুদ্ধে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতে পারে। তাই জনস্বার্থে তিনি আপিল করেন। পরবর্তী সময়ে আমরা সুজনের পক্ষ থেকে সন্দ্বীপে খোঁজখবর নিয়ে জেনেছি, আবু সাফা একজন প্রতারক, তাঁর পক্ষে আদালতে দেওয়া বক্তব্য সম্পূর্ণ বানোয়াট এবং তিনি তাঁর জন্মস্থান সন্দ্বীপে বসবাসও করেন না। উল্লেখ্য, আবু সাফার সম্পর্কে প্রথম আলোর একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল, ‘সুপ্রিম কোর্টে আবু সাফার আবেদন: সন্দ্বীপে তাঁর স্বজনেরা শুনে হেসেই খুন’। উল্লেখ্য, পরবর্তী সময়ে আপিলের চূড়ান্ত শুনানিকালে আবু সাফার আইনজীবীরা আদালতের নির্দেশ সত্ত্বেও তাঁকে হাজির করতে ব্যর্থ হন। তাই পুরো বিষয়টিই ছিল দেশের সর্বোচ্চ আদালতের সঙ্গে একটি জঘন্য জালিয়াতি।
প্রার্থীদের সম্পর্কে ভোটারদের তথ্যপ্রাপ্তির অধিকার হরণের আরেকটি চরম ঘটনা ঘটে প্রধান বিচারপতি জে আর মোদাচ্ছের হোসেনের নেতৃত্বে গঠিত বেঞ্চের ২০০৭ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি দেওয়া একটি রায়ের মাধ্যমে। ওই দিন আদালত আবু সাফার প্রতিপক্ষের আইনজীবী ড. কামাল হোসেনের যুক্তিতর্ক না শুনেই আপিলটি গ্রহণ করেন—অর্থাত্ হাইকোর্টের রায় খারিজ করেন—রায় দেন। পরবর্তী সময়ে ড. হোসেনের প্রবল আপত্তির মুখে এবং অন্যান্য জ্যেষ্ঠ আইনজীবীর হস্তক্ষেপের ফলে আদালত কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই রায়টি নাটকীয়ভাবে প্রত্যাহার করেন।
পরবর্তী সময়ে অবশ্য প্রধান বিচারপতি এম রুহুল আমিনের নেতৃত্বে আপিল বিভাগ সর্বসম্মত রায়ে ২০০৭ সালের ১১ ডিসেম্বর আপিলটি খারিজ করে দেন। প্রতারণার কারণে এটি কোনো আপিলই হয়নি বলে রায় দেন। এ রায়ের মাধ্যমে সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশে সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রার্থীদের সম্পর্কে ভোটারদের তথ্যপ্রাপ্তির অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এরপর গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে অধ্যাদেশ জারি করে এ অধিকার গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সুজন এ ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে গঠিত ‘স্থানীয় সরকার গতিশীল ও শক্তিশালীকরণ কমিটি’—বর্তমান লেখক যার একজন সদস্য ছিল—স্থানীয় সরকারের সর্বস্তরের নির্বাচনে প্রার্থীদের সম্পর্কে ভোটারদের তথ্যপ্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিত করার পক্ষে সুপারিশ করে। কমিটি সংশ্লিষ্ট আইনগুলোর খসড়া তৈরি করে হলফনামা আকারে সাতটি তথ্য (সংসদ সদস্য হিসেবে দেওয়া প্রতিশ্রুতির কতটুকু বাস্তবায়িত হয়েছে তা ব্যতীত) দেওয়ার বিধান এগুলোতে অন্তর্ভুক্ত করে। পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক স্থানীয় সরকার সম্পর্কিত যেসব অধ্যাদেশ জারি করা হয়, সেগুলোতে এ বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
অনেকেরই স্মরণ আছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৮ সালের ৪ আগস্ট নয়টি পৌরসভা ও চারটি সিটি করপোরেশনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এসব নির্বাচনে অংশ নেওয়া সব প্রার্থীকে হলফনামার মাধ্যমে সাতটি তথ্য দিতে হয়। গত ২২ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত উপজেলা নির্বাচনেও চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীদের হলফনামা আকারে এসব তথ্য মনোনয়নপত্রের সঙ্গে দাখিল করতে হয়। সুজনের উদ্যোগে এসব তথ্যের ভিত্তিতে প্রার্থীদের প্রোফাইল তৈরি করে ভোটারদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। আমাদের স্বেচ্ছাব্রতীরা সিটি করপোরেশন ও পৌর নির্বাচনের ১৩টি স্থানেই প্রার্থী-ভোটার মুখোমুখি অনুষ্ঠান আয়োজন করে। এসব উদ্যোগে মিডিয়া পার্টনার হিসেবে প্রথম আলো, দ্য ডেইলি স্টার ও চ্যানেল আই আমাদের সহযোগী ছিল। এসব অনুষ্ঠান ছিল অত্যন্ত অনুপ্রেরণামূলক এবং এগুলো ভোটারদের জেনে-শুনে-বুঝে সত্, যোগ্য ও জনকল্যাণে নিবেদিত প্রার্থীদের পক্ষে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে সহায়তা করে।
কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত নবম জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনে পাস করা উপজেলা আইনে তথ্যপ্রাপ্তির অধিকারের বিধানটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত অধিবেশনে সংসদ সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ আইন পাস করে। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, এসব আইন থেকেও তথ্য দেওয়ার বিধানটি রহিত করা হয়। অর্থাত্ যে অধিকার ভোটাররা আগে ভোগ করেছিল, সে অধিকার তাদের থেকে হরণ করা হয়। নাগরিক হিসেবে আমরা এ ধরনের সিদ্ধান্তের কোনো যৌক্তিকতা খুঁজে পাই না।
উল্লেখ্য, ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট ২০০৩ সালে দেওয়া একটি ঐতিহাসিক রায়ে বলেন: ‘গণতন্ত্র যাতে গুণ্ডাতন্ত্র এবং উপহাস বা প্রহসনে পরিণত না হয়, তা নিশ্চিত করতে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য ভোটারদের তথ্যপ্রাপ্তি জরুরি। বিভ্রান্তিমূলক তথ্য, ভুল তথ্য, তথ্যের অনুপস্থিতি—এসবই নাগরিকের অসচেতনতার জন্য দায়ী। আর এতে গণতন্ত্র গুণ্ডাতন্ত্র ও প্রহসনে পরিণত হতে বাধ্য।’ [পিইউসিএল বনাম ইউনিয়ন অব ইন্ডিয়া (২০০৩) ৪ এসসিসি]
আরও উল্লেখ্য, পূর্ববর্তী আরেকটি রায়ে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট তথ্যপ্রাপ্তির অধিকারকে বাক্স্বাধীনতা তথা নাগরিকের মৌলিক অধিকারের অংশ হিসেবে দেখেন। আদালত ইউনিয়ন অব ইন্ডিয়া বনাম এডিআর [(২০০২) ৫ এসসিসি] মামলার রায়ে বলেন: ‘আমাদের গঠনতন্ত্র [অনুচ্ছেদ ১৯(১)(এ)] বাক ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা প্রদান করে। নির্বাচনে ভোট দেওয়া ভোটারদের বাক ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার অন্তর্ভুক্ত। অর্থাত্ ভোটার সরব হয় বা মত প্রকাশ করে ভোটের মাধ্যমে। তাই নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রার্থীদের তথ্যপ্রাপ্তি অতি আবশ্যকীয়।’ আমাদের বিজ্ঞ আদালতও একই ধরনের মতামত প্রকাশ করেন। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না, কারোরই নাগরিকদের মৌলিক অধিকার হরণ করার এখতিয়ার নেই এবং আদালতের মাধ্যমে এর প্রয়োগ নিশ্চিত করা সম্ভব।
পরিশেষে এ কথা অনস্বীকার্য যে আমাদের গণতন্ত্রের সংকটের একটি বড় কারণ আমাদের সর্বস্তরের অনেক নির্বাচিত প্রতিনিধির অযোগ্যতা ও অসততা। রাজনীতি আমাদের দেশে আজ যেন বহুলাংশে ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য আমাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের—স্থানীয় থেকে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত—গুণগত মানে পরিবর্তন আনা জরুরি। আর এ জন্য সর্বস্তরের নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রার্থীদের তথ্য দেওয়া বাধ্যতামূলক হওয়া আবশ্যক, যাতে ভোটাররা নির্বাচনী বুথে তথ্যের ভিত্তিতে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে। তাই স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে তথ্য দেওয়ার বিধানটি বাধ্যতামূলক করার জন্য আমরা জাতীয় সংসদের সদস্যদের সনির্বন্ধ অনুরোধ জানাই। আশা করি, সরকার এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেবে।
বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুজন—সুশাসনের জন্য নাগরিক।
সংশোধিত গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে এসব শর্ত অমান্য করার কারণে দলের নিবন্ধন বাতিল করার ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনকে দেওয়া হয়। বর্তমান সংসদের প্রথম অধিবেশনে পাস করা ‘গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (সংশোধিত) আইন, ২০০৯’-এ নিবন্ধনের এসব শর্ত রাখা হলেও দুর্ভাগ্যবশত এগুলো না মানলে কমিশনের নিবন্ধন বাতিলের ক্ষমতা রহিত করা হয়। তাই আমরা তৈলাক্ত বাঁশে ওঠার মতো কিছুটা অগ্রসর হয়ে আবার যেন পিছু হটছি! এমন অভিজ্ঞতারই যেন আবারও পুনরাবৃত্তি ঘটেছে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রার্থীদের তথ্য দেওয়ার ক্ষেত্রে।
স্মরণ করা যেতে পারে, ২০০৫ সালের ২৪ মে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ একটি যুগান্তকারী রায় দেন। রায়ে সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রার্থীদের আটটি তথ্য হলফনামা আকারে নির্বাচন কমিশন কর্তৃক সংগ্রহ করে তা ভোটারদের মধ্যে বিতরণ করার নির্দেশ দেওয়া হয়। তথ্যগুলো হলো: ১. সার্টিফিকেটসহ প্রার্থীদের শিক্ষাগত যোগ্যতা; ২. বর্তমানে তাদের বিরুদ্ধে রুজু করা ফৌজদারি অপরাধের অভিযোগের তালিকা (যদি থাকে); ৩. অতীত ফৌজদারি মামলার তালিকা ও ফলাফল; ৪. প্রার্থীর পেশা; ৫. প্রার্থীর আয়ের উত্স ও উত্সসমূহ; ৬. অতীতে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে থাকলে জনগণের প্রতি প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি পূরণ করার ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকার বর্ণনা; ৭. প্রার্থী ও প্রার্থীর ওপর নির্ভরশীল ব্যক্তিদের সম্পদ এবং দায়দেনার বর্ণনা এবং ৮. ব্যাংক কিংবা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ব্যক্তিগতভাবে বা যৌথভাবে এবং কোম্পানি কর্তৃক—যে কোম্পানিতে প্রার্থী চেয়ারম্যান, নির্বাহী পরিচালক কিংবা পরিচালক—গৃহীত ঋণের পরিমাণ ও বর্ণনা।
আরও স্মরণ করা যেতে পারে, রায়টি দেওয়ার পর সুজন—সুশাসনের জন্য নাগরিকের পক্ষ থেকে এটি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত বিচারপতি এম এ আজিজের নেতৃত্বে গঠিত নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা পাওয়া যায়নি। এমনকি প্রার্থীদের প্রদত্ত হলফনামার কপিগুলোও আমাদের দেওয়া হয়নি। বরং কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়, রায়টি ‘ডিরেক্টরি’, ‘ম্যান্ডেটরি’ নয়। অর্থাত্ এটি মানা বাধ্যতামূলক নয়। তবুও গত জোট সরকারের আমলে অনুষ্ঠিত পাঁচটি উপনির্বাচনে প্রার্থীদের দেওয়া যতটুকু তথ্য পাওয়া গেছে, তা সুজনের সঙ্গে সম্পৃক্ত স্বেচ্ছাব্রতীরা ভোটারদের মধ্যে লিফলেট আকারে বিতরণ করে। একই সঙ্গে তিনটি নির্বাচনী এলাকায় ‘প্রার্থী-ভোটার মুখোমুখি’ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়, যা ভোটারদের মধ্যে ব্যাপক উত্সাহ-উদ্দীপনা সৃষ্টি করে।
ভোটারদের তথ্য দিয়ে ক্ষমতায়নের এ প্রচেষ্টায় একটি বড় ধরনের আঘাত আসে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আবু সাফা নামের জনৈক ব্যক্তির পক্ষ থেকে একটি লিভ টু আপিল পিটিশন দায়েরের মাধ্যমে, যা ৬ এপ্রিল সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতিসহ আপিল বিভাগের তিন বিচারপতির একটি বেঞ্চে গৃহীত হয়। কয়েকটি কারণে লিভ টু আপিল পিটিশন গ্রহণের বিষয়টি ছিল অস্বাভাবিক। প্রথমত, আবু সাফা ছিলেন একজন তৃতীয় পক্ষ। তিনি মূল মামলার সঙ্গে কোনোভাবেই জড়িত ছিলেন না। দ্বিতীয়ত, মামলাটি শুনানিকালে বাদীপক্ষ কিংবা তাদের উকিলদের কেউই উপস্থিত ছিলেন না। এ ব্যাপারে তাদের জানানোও হয়নি। তবে শুনানির সময় আবু সাফা হাইকোর্টের রায়টির ওপর স্থগিতাদেশ প্রার্থনা করেন, যদিও সংশ্লিষ্ট বেঞ্চ তা নামঞ্জুর করেন।
জনগণের তথ্যপ্রাপ্তির অধিকার ভণ্ডুল করার সবচেয়ে মারাত্মক ঘটনাটি ঘটে ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়নপত্র দাখিলের প্রাক্কালে ২০০৬ সালের ১৯ ডিসেম্বর। ওই দিন আবু সাফার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আপিল বিভাগের অবসরকালীন বেঞ্চের বিচারপতি মো. জয়নাল আবেদীন আসন্ন নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রার্থীদের হলফনামার মাধ্যমে আটটি তথ্য দেওয়ার ওপর স্থগিতাদেশ জারি করেন। এ স্থগিতাদেশটিও ছিল অস্বাভাবিক। প্রথমত, স্থগিতাদেশের শুনানিটি ছিল একতরফা এবং ‘কেভিয়েট’ দেওয়া থাকলেও মূল মামলার বাদীদের এ ব্যাপারে জানানো হয়নি এবং তাঁদের কৌঁসুলি আদালতে উপস্থিতও ছিলেন না। (কেভিয়েট দেওয়া থাকলে আইনসম্মত পদ্ধতি হলো, শুনানির সময় সংশ্লিষ্ট পক্ষের উপস্থিতি নিশ্চিত করা এবং তাদের বক্তব্য শোনা।) দ্বিতীয়ত, আবু সাফা তাঁর শিক্ষাগত যোগ্যতা প্রকাশের ব্যাপারে আপত্তি জানালেও বিজ্ঞ বিচারপতি পুরো আটটি তথ্যসংবলিত হলফনামা জমা দেওয়ার ওপরই নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। তৃতীয়ত, যদিও আবু সাফা তাঁর নিজের তথ্য দেওয়ার বিপক্ষে আদালতের শরণাপন্ন হন। বিচারপতি জয়নুল আবেদীন সব প্রার্থীর ক্ষেত্রেই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। উল্লেখ্য, অবিশ্বাস্য ধরনের ক্ষিপ্রতা দেখিয়ে নির্বাচন কমিশন একই দিনে প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে এ নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করে ভোটারদের তথ্যপ্রাপ্তির অধিকার হরণ করে।
প্রসঙ্গত, স্থগিতাদেশ প্রার্থনার আর্জিতে আবু সাফা দাবি করেন, তিনি স্বল্প শিক্ষিত কিন্তু বিত্তশালী ও সমাজকর্মে লিপ্ত স্থানীয়ভাবে একজন জনপ্রিয় রাজনীতিবিদ। তিনি নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চট্টগ্রাম জেলার সন্দ্বীপ আসন থেকে একজন মনোনয়নপ্রত্যাশী এবং হলফনামার মাধ্যমে শিক্ষাগত যোগ্যতা প্রকাশ করলে নির্বাচনে তাঁর বিরুদ্ধে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতে পারে। তাই জনস্বার্থে তিনি আপিল করেন। পরবর্তী সময়ে আমরা সুজনের পক্ষ থেকে সন্দ্বীপে খোঁজখবর নিয়ে জেনেছি, আবু সাফা একজন প্রতারক, তাঁর পক্ষে আদালতে দেওয়া বক্তব্য সম্পূর্ণ বানোয়াট এবং তিনি তাঁর জন্মস্থান সন্দ্বীপে বসবাসও করেন না। উল্লেখ্য, আবু সাফার সম্পর্কে প্রথম আলোর একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল, ‘সুপ্রিম কোর্টে আবু সাফার আবেদন: সন্দ্বীপে তাঁর স্বজনেরা শুনে হেসেই খুন’। উল্লেখ্য, পরবর্তী সময়ে আপিলের চূড়ান্ত শুনানিকালে আবু সাফার আইনজীবীরা আদালতের নির্দেশ সত্ত্বেও তাঁকে হাজির করতে ব্যর্থ হন। তাই পুরো বিষয়টিই ছিল দেশের সর্বোচ্চ আদালতের সঙ্গে একটি জঘন্য জালিয়াতি।
প্রার্থীদের সম্পর্কে ভোটারদের তথ্যপ্রাপ্তির অধিকার হরণের আরেকটি চরম ঘটনা ঘটে প্রধান বিচারপতি জে আর মোদাচ্ছের হোসেনের নেতৃত্বে গঠিত বেঞ্চের ২০০৭ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি দেওয়া একটি রায়ের মাধ্যমে। ওই দিন আদালত আবু সাফার প্রতিপক্ষের আইনজীবী ড. কামাল হোসেনের যুক্তিতর্ক না শুনেই আপিলটি গ্রহণ করেন—অর্থাত্ হাইকোর্টের রায় খারিজ করেন—রায় দেন। পরবর্তী সময়ে ড. হোসেনের প্রবল আপত্তির মুখে এবং অন্যান্য জ্যেষ্ঠ আইনজীবীর হস্তক্ষেপের ফলে আদালত কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই রায়টি নাটকীয়ভাবে প্রত্যাহার করেন।
পরবর্তী সময়ে অবশ্য প্রধান বিচারপতি এম রুহুল আমিনের নেতৃত্বে আপিল বিভাগ সর্বসম্মত রায়ে ২০০৭ সালের ১১ ডিসেম্বর আপিলটি খারিজ করে দেন। প্রতারণার কারণে এটি কোনো আপিলই হয়নি বলে রায় দেন। এ রায়ের মাধ্যমে সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশে সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রার্থীদের সম্পর্কে ভোটারদের তথ্যপ্রাপ্তির অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এরপর গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে অধ্যাদেশ জারি করে এ অধিকার গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সুজন এ ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে গঠিত ‘স্থানীয় সরকার গতিশীল ও শক্তিশালীকরণ কমিটি’—বর্তমান লেখক যার একজন সদস্য ছিল—স্থানীয় সরকারের সর্বস্তরের নির্বাচনে প্রার্থীদের সম্পর্কে ভোটারদের তথ্যপ্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিত করার পক্ষে সুপারিশ করে। কমিটি সংশ্লিষ্ট আইনগুলোর খসড়া তৈরি করে হলফনামা আকারে সাতটি তথ্য (সংসদ সদস্য হিসেবে দেওয়া প্রতিশ্রুতির কতটুকু বাস্তবায়িত হয়েছে তা ব্যতীত) দেওয়ার বিধান এগুলোতে অন্তর্ভুক্ত করে। পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক স্থানীয় সরকার সম্পর্কিত যেসব অধ্যাদেশ জারি করা হয়, সেগুলোতে এ বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
অনেকেরই স্মরণ আছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৮ সালের ৪ আগস্ট নয়টি পৌরসভা ও চারটি সিটি করপোরেশনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এসব নির্বাচনে অংশ নেওয়া সব প্রার্থীকে হলফনামার মাধ্যমে সাতটি তথ্য দিতে হয়। গত ২২ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত উপজেলা নির্বাচনেও চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীদের হলফনামা আকারে এসব তথ্য মনোনয়নপত্রের সঙ্গে দাখিল করতে হয়। সুজনের উদ্যোগে এসব তথ্যের ভিত্তিতে প্রার্থীদের প্রোফাইল তৈরি করে ভোটারদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। আমাদের স্বেচ্ছাব্রতীরা সিটি করপোরেশন ও পৌর নির্বাচনের ১৩টি স্থানেই প্রার্থী-ভোটার মুখোমুখি অনুষ্ঠান আয়োজন করে। এসব উদ্যোগে মিডিয়া পার্টনার হিসেবে প্রথম আলো, দ্য ডেইলি স্টার ও চ্যানেল আই আমাদের সহযোগী ছিল। এসব অনুষ্ঠান ছিল অত্যন্ত অনুপ্রেরণামূলক এবং এগুলো ভোটারদের জেনে-শুনে-বুঝে সত্, যোগ্য ও জনকল্যাণে নিবেদিত প্রার্থীদের পক্ষে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে সহায়তা করে।
কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত নবম জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনে পাস করা উপজেলা আইনে তথ্যপ্রাপ্তির অধিকারের বিধানটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত অধিবেশনে সংসদ সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ আইন পাস করে। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, এসব আইন থেকেও তথ্য দেওয়ার বিধানটি রহিত করা হয়। অর্থাত্ যে অধিকার ভোটাররা আগে ভোগ করেছিল, সে অধিকার তাদের থেকে হরণ করা হয়। নাগরিক হিসেবে আমরা এ ধরনের সিদ্ধান্তের কোনো যৌক্তিকতা খুঁজে পাই না।
উল্লেখ্য, ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট ২০০৩ সালে দেওয়া একটি ঐতিহাসিক রায়ে বলেন: ‘গণতন্ত্র যাতে গুণ্ডাতন্ত্র এবং উপহাস বা প্রহসনে পরিণত না হয়, তা নিশ্চিত করতে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য ভোটারদের তথ্যপ্রাপ্তি জরুরি। বিভ্রান্তিমূলক তথ্য, ভুল তথ্য, তথ্যের অনুপস্থিতি—এসবই নাগরিকের অসচেতনতার জন্য দায়ী। আর এতে গণতন্ত্র গুণ্ডাতন্ত্র ও প্রহসনে পরিণত হতে বাধ্য।’ [পিইউসিএল বনাম ইউনিয়ন অব ইন্ডিয়া (২০০৩) ৪ এসসিসি]
আরও উল্লেখ্য, পূর্ববর্তী আরেকটি রায়ে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট তথ্যপ্রাপ্তির অধিকারকে বাক্স্বাধীনতা তথা নাগরিকের মৌলিক অধিকারের অংশ হিসেবে দেখেন। আদালত ইউনিয়ন অব ইন্ডিয়া বনাম এডিআর [(২০০২) ৫ এসসিসি] মামলার রায়ে বলেন: ‘আমাদের গঠনতন্ত্র [অনুচ্ছেদ ১৯(১)(এ)] বাক ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা প্রদান করে। নির্বাচনে ভোট দেওয়া ভোটারদের বাক ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার অন্তর্ভুক্ত। অর্থাত্ ভোটার সরব হয় বা মত প্রকাশ করে ভোটের মাধ্যমে। তাই নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রার্থীদের তথ্যপ্রাপ্তি অতি আবশ্যকীয়।’ আমাদের বিজ্ঞ আদালতও একই ধরনের মতামত প্রকাশ করেন। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না, কারোরই নাগরিকদের মৌলিক অধিকার হরণ করার এখতিয়ার নেই এবং আদালতের মাধ্যমে এর প্রয়োগ নিশ্চিত করা সম্ভব।
পরিশেষে এ কথা অনস্বীকার্য যে আমাদের গণতন্ত্রের সংকটের একটি বড় কারণ আমাদের সর্বস্তরের অনেক নির্বাচিত প্রতিনিধির অযোগ্যতা ও অসততা। রাজনীতি আমাদের দেশে আজ যেন বহুলাংশে ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য আমাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের—স্থানীয় থেকে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত—গুণগত মানে পরিবর্তন আনা জরুরি। আর এ জন্য সর্বস্তরের নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রার্থীদের তথ্য দেওয়া বাধ্যতামূলক হওয়া আবশ্যক, যাতে ভোটাররা নির্বাচনী বুথে তথ্যের ভিত্তিতে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে। তাই স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে তথ্য দেওয়ার বিধানটি বাধ্যতামূলক করার জন্য আমরা জাতীয় সংসদের সদস্যদের সনির্বন্ধ অনুরোধ জানাই। আশা করি, সরকার এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেবে।
বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুজন—সুশাসনের জন্য নাগরিক।
No comments