‘আমি তোমাকেই বলে দেব’ -স্মরণ by মাহমুদুজ্জামান বাবু

কবে প্রথম দেখা হয়েছিল? মনে নেই। শুধু মনে পড়ে, তখন আমাদের চারপাশে সকাল-দুপুর-রাতজুড়ে সামরিক স্বৈরশাসন। যখন-তখন সান্ধ্য আইন। এবং আমাদের প্রতিবাদ। মিছিল। এবং তাত্ক্ষণিকভাবে হয়ে ওঠা নতুন কোনো একটি গান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, কলা ভবন, মল চত্বর আর মধুর ক্যান্টিন তখন মুখর হয়ে থাকত স্লোগানভরা রোদবৃষ্টিতে। আর টিএসসির ভেতর-বাহির থইথই করত পথনাটক, আবৃত্তি আর গানের মহড়ায়। এসবের ফাঁকে ফাঁকে বিরতি মিললেই টিএসসির ফুটপাত ঘেঁষে অস্থায়ী চায়ের দোকানে বিরামহীন বিতর্ক; কে আপসকামী আর কে আপসহীন! কোন সংবাদটি ভুল আর কোনটি ঠিক! কে ভীরু আর কে সাহসী! মনে পড়ে। পড়ছে। সঞ্জীব চৌধুরীর গানের মতো করেই আজ এখন এই মুহূর্তে... ‘চোখটা এত পোড়ায় কেন?’ আমি এখন কোন সমুদ্রে যাব?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে পড়েছিল সঞ্জীব। তারপর শুরু করেছিল সাংবাদিকতার কাজ। অসম্ভব রকমের উদ্ভাবনী সৃজনশীলতা তাকে দিয়েছিল অস্থিরতার ডানা। সে ডানায় ভর করে উড়ত তার উড়ালপঙ্খী মন। সেই অস্থির মনটা নিয়ে আজ কত গল্প শুনি! ভুল গল্প। ঠিক গল্প।
১৯৮৭-এর ১০ নভেম্বর বুকে-পিঠে ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ লিখে নূর হোসেন প্রতিবাদের রাজপথে গিয়ে দাঁড়ালে স্বৈরাচারী এরশাদের দাঙ্গা পুলিশ যখন তাকে গুলি করে খুন করল, নতুন করে সান্ধ্য আইন জারি করল, চলমান আন্দোলনটা তখন একটু থমকাল। তখনকার স্বনামখ্যাত কবি ও আবৃত্তিকার ইস্তেকবাল হোসেন নূর হোসেনকে নিয়ে একটা কবিতা লিখলে সঞ্জীব সেটা সুরারোপ করে গেয়েছিল। হাহাকার ও কান্নায় মোড়ানো সেই ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হয় আজও কানে কানে। নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের চার দিন পর টিএসসির সামনের খোলাপথে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের বিজয়মঞ্চে গান-কবিতা-বক্তৃতার উপচে পড়া কোলাহলে হাতে হাত ধরে থাকা সময়ের গল্প-চরিত্র সঞ্জীব আজ স্মৃতির উপন্যাসের নায়ক। মনে পড়ছে।
আমরা কেউ কেউ সক্রিয় রাজনীতিতে থেকেছি তার পরও। একই রকম সমাজ বদলানোর চোখ নিয়ে সঞ্জীব জড়িয়েছিল সাংবাদিকতার পেশায়। তখন দেখা হতো খুব কম। দেখা হলে স্মৃতি তর্পণ। পানাহারে আসক্তি বেড়েছিল তার। বিষাক্ত তরল ছোঁয়া লালচে চোখ এবং আচমকা ঝলসে ওঠা দ্যুতিময় প্রশ্ন... ‘বাবু, আমাদের সেই সব দিন কোথায় গেল?’ উত্তর মেলে না। দিনগুলো কোথায় যায়? জাগরণের দিন কোথায় আসলে?
সীমানা পেরিয়ে যেতে চেয়েছিল সঞ্জীব চৌধুরী। পেরিয়ে যেতে চেয়েছিল না পাওয়ার সকাল-দুপুর-রাত। গানে লিখল সে, ‘যাই পেরিয়ে এই যে সবুজ বন, যাই পেরিয়ে সকাল দুপুর রাত, যাই পেরিয়ে নিজের ছায়া, বাড়িয়ে দেয়া হাত’। গান ছিল তার যাপিত জীবনের প্রিয়তম ছন্দ। আশির দশকে সাংবাদিকতা শুরু করলেও ‘শঙ্খচিল’ নামে একটি গানের দলে নিয়মিত সংগীতচর্চা শুরু করে সে। এখান থেকে ওখান থেকে ছুটতে ছুটতে ১৯৯৬ সালে বাপ্পা মজুমদারের সঙ্গে গড়ে তোলে ‘দলছুট’ ব্যান্ড। এবং সেখানেই সে প্রথম বাউলসম্রাট শাহ আবদুল করিমের ‘গাড়ি চলে না’ গানটি যুগলভাবে গায়।
তার কণ্ঠে জনপ্রিয়তা পায় ‘বায়োস্কোপ’, ‘রিকশা কেন আস্তে চলে না’, ‘আমাকে অন্ধ করে দিয়েছিল চাঁদ’, ‘আমি তোমাকেই বলে দেব’, ‘সাদা ময়লা রঙ্গিলা পালে’ এবং দিনাজপুরে পুলিশের হাতে ধর্ষিত ও নিহত ইয়াসমীনকে নিয়ে করা ‘আহ্ ইয়াসমীন’ গানগুলো।
টেলিভিশনের জন্য নির্মিত একটি ধারাবাহিকসহ বেশ কয়েকটি নাটকে সঞ্জীব অভিনয়ও করেছিল। লিখেছে গল্প, ছোট কাগজের জন্য কবিতা, কখনো কখনো গানের মঞ্চেই অচেনা আবেগে করেছে আবৃত্তি।
অনেক পরে, যখন আমিও গাইতে এসেছি সবটুকু, ২০০৩-এ সঞ্জীব তার প্রথম অ্যালবামে গাইল সেই গান, ‘আমি ঘুরিয়া ঘুরিয়া/সন্ধানও করিয়া/স্বপ্নেরই পাখি ধরতে চাই/ স্বপ্নেরই কথা বলতে চাই/আমি অন্তরেরই কথা বলতে চাই...’। টালমাটাল চারপাশে সঞ্জীব আমাদের বিশ্বাস করাতে চেয়ে বলল, ‘ওরা বলে, ট্রাকে করে ওরা আমাদের জন্য খাদ্য ও পানীয় নিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু বিশ্বাস করুন, বন্ধুগণ, ওই ট্রাকে কোনো খাদ্য ও পানীয় ছিল না। ছিল ৩০০টি লাশ। নিয়ে যাচ্ছিল গুম করার জন্য...।’
অনিচ্ছুক এক ঘুম যেদিন সঞ্জীব চৌধুরীর চোখ বুজিয়ে দিল, নিজেরই গানটি সঞ্জীব গুনগুন করে গেয়েছিল কি? এখনো কি গায়? ‘ঘুম ভাঙা পথ/শেষ হতে বলো কত বাকি/ ভোর হবে বলে জেগে থাকি’।

No comments

Powered by Blogger.