উন্নয়নের সূচকে এগিয়ে, রাজনীতির সূচকে পিছিয়ে

অসুস্থ রাজনীতির শিকার গীতা সেনের
পাশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা- ফাইল ছবি
একজন লেখকের যেমন কোনো বিষয়ে কিছু বলার বা মত প্রকাশের স্বাধীনতা আছে, তেমনি পাঠকেরও অধিকার আছে সেই মতের সমালোচনা করার। গত সপ্তাহে প্রকাশিত কলাম ‘যাহা জয় বাংলা, তাহাই জিন্দাবাদ!’ নিয়ে বিপুলসংখ্যক পাঠক যে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন, তাকে আমি সানন্দদৃষ্টিতে নিয়েছি। তার পরও একটি ব্যক্তিগত ব্যাখ্যা দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করছি এ কারণে যে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কবি নির্মলেন্দু গুণ লেখাটির প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। একজন অগ্রজ বন্ধু পত্রিকান্তরে লেখাটি উপলক্ষ করে একটি উপসম্পাদকীয়ই লিখে ফেলেছেন। নির্মলেন্দু গুণ আমার অত্যন্ত প্রিয় কবি ও শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তিত্ব। আমি তাঁর সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত যে বাংলাদেশে একশ্রেণির পাকিস্তানবাদী লোক ১৫ আগস্টের পর জয় বাংলার বিপরীতে জিন্দাবাদ স্লোগান ব্যবহার করেছে। বাংলাদেশ বেতারকে রেডিও বাংলাদেশ বানিয়েছিল। একশ্রেণির মতলববাজ যে জয় বাংলার বিপরীতে জিন্দাবাদ জিগির তোলে, সে কথা আমিও লিখেছি। জয় বাংলা স্লোগানের ইতিবৃত্ত তুলে ধরার অর্থ জিন্দাবাদিদের সমর্থন করা নয়। এ কলামে আমি এ কথাও বলেছি যে জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে কেউ অন্যায় করলে সেটি যেমন ভালো কাজ হয় না, তেমনি কেউ জয় বাংলা না বললেই তিনি পাকিস্তানপন্থী হয়ে যান না। ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে গড়ে ওঠা শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ জয় বাংলা স্লোগানটি দলীয় বৃত্ত থেকে বের করে এনে বৃহত্তর পরিসরে ছড়িয়ে দিয়েছিল—এ কথা দিবালোকের মতো সত্য। কিন্তু পরবর্তী সময়ে কারা সেই মঞ্চকে বিভক্ত ও প্রায় নিষ্ক্রিয় করে রেখেছে, জয় বাংলার তাৎপর্য অনুধাবনের পাশাপাশি সেই প্রশ্নের জবাবও খোঁজা জরুরি। সব দায় জিন্দাবাদপন্থীদের ওপর চাপিয়ে আত্মতৃপ্তি পাওয়া যেতে পারে, কিন্তু একটি সত্যিকার অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়া যাবে না। আমার লেখায় পুরান ঢাকায় বিশ্বজিৎ দাস হত্যাকারী কিংবা বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে সায়াদ হত্যাকারীদের মুখে জয় বাংলা স্লোগানের বিপদ সম্পর্কেই পাঠককে সতর্ক করে দেওয়ার চেষ্টা করেছি মাত্র। শফিউল আলম প্রধানরাও একসময় জয় বাংলা স্লোগান দিতেন এবং যাঁরা এই স্লোগান দিতেন না, তাঁদের শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত পর্যন্ত করেছেন।
২. গত বৃহস্পতিবার প্রকাশিত জাতিসংঘ উন্নয়ন সংস্থার (ইউএনডিপি) বার্ষিক প্রতিবেদনে মানব উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশ এক ধাপ এগিয়েছে বলে জানানো হয়। বর্তমানে (২০১৪) মানবসম্পদ উন্নয়নে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪২তম। গতবার বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৪৩তম।দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শ্রীলঙ্কার অবস্থান ৭৩তম। ভারত ও পাকিস্তান রয়েছে যথাক্রমে ১৩৫ ও ১৪৬তম অবস্থানে। বাংলাদেশ ভারতের পেছনে থাকলেও পাকিস্তানের আগে রয়েছে। নারী-পুরুষ সমতা উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ভারত ও পাকিস্তানের তুলনায় ভালো। এ সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান যেখানে ১০৭তম, ভারত ও পাকিস্তানের অবস্থান যথাক্রমে ১৩৫ ও ১৪৬তম। দেশ দুটির তুলনায় বাংলাদেশি নারীরা নিজ দেশের পুরুষের তুলনায় বেশি হারে উন্নতি করেছেন। ২০১৩ সালের সূচকে দ্রুত উন্নয়ন করেছে বিশ্বের এমন ১৮টি দেশের মধ্যে ছিল বাংলাদেশ। এবারও সেই ধারা রেখেছে। এ বছর বাংলাদেশ মানব উন্নয়ন সূচকে প্রবৃদ্ধি দশমিক ৭ শতাংশ। সার্বিক উন্নয়ন সূচকেও বাংলাদেশ পার্শ্ববর্তী ভারত, পাকিস্তান ও নেপালের চেয়ে বেশি উন্নতি করেছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। নারী-পুরুষের বৈষম্য সূচকেও বাংলাদেশ ভালো করেছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান ১১৫তম, ভারত ও পাকিস্তান উভয়েই এ সূচকে ১২৭তম অবস্থানে রয়েছে। অর্থাৎ এ দুই দেশের তুলনায় বাংলাদেশে নারীর প্রতি বৈষম্য কম। বহুমাত্রিক দারিদ্র্য সূচকেও বাংলাদেশ ভারতের তুলনায় ভালো করেছে। বাংলাদেশের মানুষের প্রত্যাশিত গড় আয়ু এখন ৬৯ দশমিক ২ বছর, শিক্ষা গ্রহণের গড় সময়কাল ৫ দশমিক ৮ বছর এবং মাথাপিছু জাতীয় আয় (জিএনআই, পিপিপি ভিত্তিতে) দুই হাজার ৭১৩ ডলার। সব মিলিয়ে মানব উন্নয়ন সূচকে এবার বাংলাদেশের স্কোর দশমিক ৫৪৪।
৩. কেবল ইউএনডিপির প্রতিবেদন নয়; নিকট অতীতে আর্থসামাজিক বিষয়ে যতগুলো আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক প্রতিবেদন হয়েছে, তার প্রায় সবটাতেই বাংলাদেশ তুলনামূলক এগিয়ে আছে। নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনও বাংলাদেশের মানবসম্পদ উন্নয়নের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন এবং ভারতকে বাংলাদেশ থেকে শিক্ষা নিতে বলেছেন। এটি কম কৃতিত্বের কথা নয়। লন্ডনের ইকোনমিস্ট বাংলাদেশের রাজনীতির গালমন্দ করলেও অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে বলেছে ধাঁ ধা বা প্যারাডক্স। এ ধাঁ ধা তৈরিতে সরকারের যতটা না ভূমিকা, তার চেয়ে বেশি ভূমিকা সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের। বাংলাদেশের মানুষ উদ্যমী ও পরিশ্রমী। দুমুঠো খাবার ও থাকার আশ্রয় পেলে দিনরাত কাজ করতে পারেন। দেশের উন্নয়নের এ চিত্র আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে নেওয়া যেত, যদি আমাদের রাজনীতি সুস্থ ও সুস্থির থাকত। স্বাধীনতার পর দেশের রাজনীতি প্রকৃত অর্থে কখনোই সুষ্ঠু ও সুস্থধারায় প্রবাহিত হয়নি। কেন হয়নি, সেই প্রশ্নের জবাব রাজনীতিকদেরই দিতে হবে। অনেক ডাকসাইটে মন্ত্রী ও নেতা আক্ষেপ করে বলেন, রাজনীতি আর রাজনীতিকদের হাতে নেই। তাহলে কাদের হাতে? বিগত সংসদে ৫২ শতাংশ আসন ছিল ব্যবসায়ীদের দখলে। এবারের সংসদের হিসাবটা তার চেয়ে খারাপ হওয়ার আশঙ্কাই বেশি। অসুস্থ রাজনীতি ও অসাধু ব্যবসার যে যুগলবন্ধন ঘটেছে, তার কারণেই হল-মার্ক কেলেঙ্কারি হয়, শেয়ারবাজার লুট হয়ে যায়,
বেসিক ব্যাংক ধ্বংস করেও এর অধিকর্তারা পার পেয়ে যান। স্বাধীনতার পর একশ্রেণির বিপ্লববাদী দেশের স্বাধীনতাকেই মেনে নেয়নি। তারা তখন জনগণকে বুঝিয়েছিল, প্রকৃত স্বাধীনতা আসেনি। প্রকৃত স্বাধীনতা পেতে হলে আওয়ামী লীগকে হটাতে হবে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাষ্ট্রপালিত কুচক্রীদের হাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হওয়ার আগ পর্যন্ত তারা থামল না। প্রায় একই পরিস্থিতি তৈরি হয় নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে স্বৈরাচারের পতনের পরও। স্বৈরাচারকে তাড়াতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এক হলেও দেশশাসনে কেউ কাউকে আস্থায় নেয়নি। বরং পরস্পরকে শত্রু ভাবছে। একজন স্বৈরাচার ও অপরজন রাজাকারের সঙ্গে হাত মিলিয়ে গণতন্ত্র ও দেশ উদ্ধারের মহড়া দিচ্ছে। বাংলাদেশ আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে যে উন্নতি-অগ্রগতি করেছে, তার সিংহভাগ কৃতিত্ব কৃষক, তৈরি পোশাক কারখানায় নিয়োজিত অপুষ্ট শরীরের ৪০ লাখ নারী শ্রমিক এবং বিদেশে অবস্থিত ৮০ লাখ প্রবাসী শ্রমিকের। কিন্তু রাজনীতি তঁাদের নিরাপত্তা ও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য নিশ্চিত করতে পারেনি বলেই এক সরকারের আমলে সারপ্রার্থী কৃষকেরা গুলি খেয়ে মরেন, আরেক সরকারের আমলে তাজরীন ও রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি ঘটে, যার শিকার হন শত শত শ্রমিক। রাজনীতির ছত্রচ্ছায়ায় যে সন্ত্রাস চলছে, তারই প্রকৃষ্ট উদাহরণ ফেনী, নারায়ণগঞ্জ ও লক্ষ্মীপুর।
৪. অসুস্থ ও বৈরী রাজনীতি দেশকে বারবার বিপর্যয়ের মধ্যে ঠেলে দেয়। এবং সাধারণ মানুষ সেই বিপর্যয় থেকে ঘুরে দাঁড়াতে চাইলেও রাজনীতি সেটি করতে দেয় না। আইলা-সিডরের পর দেশে বড় ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলেও মানুষ অহরহ রাজনীতিসৃষ্ট দুর্যোগের শিকার হচ্ছে। ৫ জানুয়ারির আগে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সারা দেশে যে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, তাতে মারা গেছে কয়েক শ মানুষ; চিরতরে পঙ্গু হয়েছে হাজার হাজার নারী, পুরুষ ও শিশু; সহায়-সম্বল হারিয়ে অনেকে নিঃস্ব, রিক্ত। ক্ষমতামত্ত রাজনীতি তাদের খোঁজ রাখে না। আমরা পুরান ঢাকার গৃহবধূ সেই গীতা সেনের কথা ভুলে যাইনি। সন্ত্রাসীদের বোমায় আহত গীতা সেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বিছানায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে কাছে পেয়ে বলেছিলেন, ‘আমরা আপনাদের তৈরি করছি, আপনারা আমাদের তৈরি করেন নাই। আমরা আমাদের স্বামীরটা খাই। আপনারা আমাদের নিয়ে ছিনিমিনি খেলছেন।...আমরা ভালো সরকার চাই...আমরা অসুস্থ সরকার চাই না।’ তিনি আরও বলেছিলেন, ‘আমরা অসুস্থভাবে আমাদের সন্তানকে বড় করতে চাই না। আমরা আর অসুস্থ থাকতে চাই না। আমরা একটা ভালো সরকার চাই। ওরা কেন আমাদের মারে? আমরা তো ওদের ক্ষতি করি নাই। আমরা তো কিচ্ছু করি নাই, আমরা তো যাচ্ছিলাম, আমরা তো ওদের চিনিও না। আমরা খালেদারেও চিনি না, হাসিনার কাছেও যাই না। আমরা যার যার সংসার নিয়ে থাকি, আমাদের কেন মারে ওরা?.. দিদি, আপনি এগুলার বিচার করেন, এগুলার বিচার করেন, আর সহ্য হয় না। কত লোক এইখানে আছে, আমরা সবাই অসুস্থ...।
(প্রথম আলো, ২ ডিসেম্বর, ২০১৩) সম্প্রতি লন্ডন সফরকালে বিবিসির সঙ্গে সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বিএনপি ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে না গিয়ে ভুল করেছে। সেই ভুলের মাশুল তাকে দিতে হবে। যুক্তির খাতিরে যদি তাঁর কথাটি মেনেও নিই, তার পরও কথা থাকে। পাঁচ বছর পর পর নির্বাচন নিয়ে এ ক্যাচাল হয় কেন? কেন সব দল মিলে একটি সিদ্ধান্তে আসতে পারে না। যখন যার সুবিধা তত্ত্বাবধায়ক সরকার চাইবে, যার অসুবিধা বাতিল করবে, এর নাম গণতন্ত্র নয়। প্রধানমন্ত্রীকে মনে রাখতে হবে যে একটি রাজনৈতিক দল ভুল করলে সেই দলকে তার খেসারত দিতে হয়। কিন্তু একটি সরকার ভুল করলে গোটা দেশ ও দেশের মানুষকেই তার খেসারত দিতে হয়। নির্বাচন বর্জন অবশ্যই খারাপ কাজ। কিন্তু একতরফা নির্বাচনও কোনো ভালো কাজ নয়। প্রধানমন্ত্রীকে দেশে দেশে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে কৈফিয়ত ও ব্যাখ্যা দিতে হলে সেটি তাঁর জন্য যেমন, তেমনি বাংলাদেশের জন্যও মহা লজ্জার বিষয়। (দ্রষ্টব্য: ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর মুখপাত্রের বক্তব্য) বিটিশ সাময়িকী ইকোনমিস্ট লিখেছে, আওয়ামী লীগ টানা দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার মাধ্যমে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা কিছুটা কেটে গেছে। বিরোধী দল বিএনপি নির্বাচন বর্জন করেছে এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়া পরিবর্তনের দাবি চালিয়ে যাবে। ফলে ২০১৪-২০১৮-এ দেশব্যাপী ধর্মঘটের আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বাংলাদেশের অর্থনীতি ও মানুষ এগিয়ে গেলেও রাজনীতি এগোচ্ছে না। ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছে। ন্যূনতম নীতিনৈতিকতা, মূল্যবোধ ও আদর্শ হারিয়ে এখন রাজনীতি হয়ে উঠেছে হিংসা ও বিদ্বেষের হাতিয়ার। এ থেকে পরিত্রাণের উপায় কী?
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrabo3@dhaka.net

No comments

Powered by Blogger.