সমুদ্রকে জাতীয় সমৃদ্ধি অর্জনে কাজে লাগাতে হবে by ড. আনু মাহমুদ
ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমাবিরোধ নিষ্পত্তির সালিশ আদালতের রায়ে সুবিচার পেয়েছে বাংলাদেশ। বঙ্গোপসাগরের পশ্চিমাঞ্চলে ২৫ হাজার ৬০২ বর্গকিলোমিটার এলাকা তার প্রাপ্য বলে দাবি করেছিল। আদালতের রায়ে প্রায় ১৯ হাজার ৪৬৭ বর্গকিলোমিটার এলাকার নিরঙ্কুশ অধিকার লাভ করেছে বাংলাদেশ। আসলে বিরোধ দেখা দিয়েছিল দুই দেশের জলসীমা শুরুর স্থান নির্ধারণ এবং ভূমিরেখার মূলবিন্দু থেকে সমুদ্রে রেখা টানার পদ্ধতি নিয়ে। ভারত সমদূরত্বের ভিত্তিতে রেখা টানার পক্ষে মত দিলে বাংলাদেশ ন্যায্যতার ভিত্তিতে রেখা টানার দাবি জানায়। বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগর ও ভূমির মূলবিন্দু থেকে সমুদ্রের দিকে ১৮০ ডিগ্রি সোজা রেখা টানার দাবি জানালে ভারত বলেছিল, সমুদ্রতট বিবেচনায় এ রেখা হবে ১৬২ ডিগ্রি থেকে। শেষ পর্যন্ত ১৯৪৭ সালের ভারত বিভাগের সময়কার র্যাডক্লিফের ম্যাপ অনুযায়ীই সীমানাবিন্দু ধরা হয়েছে। বলা বাহুল্য, সেটাই বৈধ ভিত্তি। রায় ন্যায়ভিত্তিক হওয়ায় ভারতও রায় মেনে নিয়েছে।
প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তির আলোচনা শুরু হয় ১৯৭৪ সালে। দীর্ঘ সময়ে কয়েকটি বৈঠক হলেও সমাধান না পেয়ে ২০০৯ সালের ৮ অক্টোবর আন্তর্জাতিক আদালতে যায় বাংলাদেশ। সেখানেও সমঝোতা না হওয়ায় ২০১১ সালের মে মাসে বিষয়টি দ্য হেগের আদালতে গড়ায়। ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্ব অক্ষুণœ রেখে আন্তর্জাতিক সালিশি আদালতের মাধ্যমে সমস্যাটির শান্তিপূর্ণ মীমাংসা হওয়ায় সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে। এর আগে ২০১২ সালে মিয়ানমারের সঙ্গে জাতিসংঘ সমুদ্র আইনবিষয়ক আন্তর্জাতিক আদালতে মামলার রায়ের মাধ্যমে উপকূল থেকে বঙ্গোপসাগরের ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত একচ্ছত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং ২০০ নটিক্যাল মাইলের বাইরে মহিসোপান অঞ্চলে আইনগত অধিকার লাভ করে বাংলাদেশ। এ ছাড়া মহিসোপানের বাইরের সামুদ্রিক সম্পদেও বাংলাদেশের নিরংকুশ ও সার্বভৌম অধিকার সুনিশ্চিত হয়। মিয়ানমার এ সমুদ্র অঞ্চলকে নিজের বলে দাবি করায় বাংলাদেশ দীর্ঘদিন এর সম্পদ আহরণে ব্যর্থ হয়েছে। এ নিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের বিরোধ চলে আসছিল দীর্ঘ ৩৮ বছর ধরে। দুর্ভাগ্যজনক যে, এ বিরোধ নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেয়া হয়নি দীর্ঘদিন। ২০০৮ সালের জানুয়ারিতে ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তির একটি উদ্যোগ নেয় তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার। কিন্তু সে উদ্যোগ বেশিদূর এগোয়নি। মহাজোট ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালের ৮ অক্টোবর সরকার আন্তর্জাতিক সালিশি আদালতের শরণাপন্ন হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। মিয়ানমারের সঙ্গে বিরোধ নিষ্পত্তি হওয়ায় ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধ নিরসনের দাবি জোরালো হয় সন্দেহ নেই। তবে ভারতের সঙ্গে বিরোধ মীমাংসায় বাংলাদেশ ট্রাইব্যুনালের বদলে আরবিট্রেশনে গেছে। এ পথ বেয়েই এসেছে সাফল্য।
ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নির্ধারিত হয়ে যাওয়ায় এ বিরাট জলসীমায় অবস্থিত প্রাণিজ-অপ্রাণিজ সম্পদ, খনিজ জৈবসহ সব ধরনের সম্পদের মালিকানা এখন বাংলাদেশের। এখন সরকারের দায়িত্ব হল এ সম্পদ খুঁজে বের করে আহরণ করা। সে ক্ষেত্রে বর্ধিত এ সমুদ্রসীমার নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করা জরুরি। এজন্য নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ডের বিদ্যমান সম্পদের অপ্রতুলতা দূর করতে হবে। বাড়াতে হবে জনবল।
ভারত আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী রাষ্ট্র। দেশটির সঙ্গে সমুদ্রসীমা সমস্যার নিষ্পত্তি হওয়ার বিষয়টি তাই বিশেষ গুরুত্বের দাবি রাখে। ভারতের সঙ্গে বিদ্যমান অন্যান্য অমীমাংসিত সমস্যা নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে এর একটি ইতিবাচক প্রভাব পড়বে, এটাই প্রত্যাশা। কলকাতা থেকে প্রকাশিত দৈনিক টেলিগ্রাফের শিরোনাম- একটি বড় সমুদ্র অঞ্চল ভারতের হাতছাড়া হল। আমাদের মনে আছে, বঙ্গোপসাগরের বিরোধপূর্ণ এলাকায় মৎস্যসম্পদ আহরণ বা তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের অধিকার নিয়ে দুই প্রতিবেশীর সঙ্গে মাঝে মধ্যেই অস্বস্তিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো। সর্বশেষ আন্তর্জাতিক সালিশি আদালতে ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নির্ধারণ হওয়ার পর এমন পরিস্থিতির আশংকা তিরোহিত হয়েছে বলে মনে করি। যে বিরোধপূর্ণ এলাকায় ভারতের বাধার জন্য বাংলাদেশ তেল-গ্যাস অনুসন্ধান করতে পারছিল না বা দরপত্র আহ্বানের পরও বিদেশী কোম্পানিগুলো সাড়া দিচ্ছিল না, তা এখন বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ও কৌশলগত কাজে লাগাতে পারবে। এখন অভিন্ন সমুদ্রাঞ্চলের অমিত সম্ভাবনা দুই দেশই কাজে লাগাতে পারবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।
সার্বভৌমত্ব, সমরনীতি ও সম্পদের সদ্ব্যবহারের পরিপ্রেক্ষিতেও আন্তর্জাতিক সালিশি আদালতের রায় গুরুত্বপূর্ণ।
বৈঠকে বেঠকে সাড়ে তিন দশকের বেশি সময় ব্যয় করে সমস্যা সমাধান না হওয়ায় বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক সালিশির দ্বারস্থ হতে হয়েছিল। সাহসী ও দূরদর্শী এ সিদ্ধান্তের কারণে অর্জিত এই সাফল্যের জন্য সরকার, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সাধুবাদ জানাই। একই সঙ্গে অভিনন্দন জানাই আন্তর্জাতিক আদালতে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলকে। তাদের মেধা, শ্রম ও অধ্যবসায় সম্ভাবনার নতুন দরজা খুলে দিয়েছে। বাংলাদেশের পক্ষে আদালতে সওয়াল-জওয়াবে অংশ নিয়েছেন যেসব বিদেশী আইনজীবী, তাদেরও অভিনন্দন। ভারত আদালতের কার্যক্রমে সহযোগিতার মাধ্যমে সৎ প্রতিবেশীসুলভ নীতির পরিচয় দিয়েছে। আমরা আশা করি, সমুদ্রসীমার বিরোধ নিষ্পত্তির পর ঢাকা-নয়াদিল্লি এবং ঢাকা-ইয়াঙ্গুনের বন্ধুত্ব আরও জোরদার হবে। এখন উদ্যোগী হতে হবে নিষ্পন্ন সমুদ্রসীমার সর্বোত্তম ব্যবহারের প্রতি। আমাদের জলসীমার মৎস্যসম্পদ অন্য দেশের জেলেরা আহরণ করার অভিযোগ পুরনো। বিরোধপূর্ণ এলাকার কারণে এতদিন সেখানে পূর্ণ নজরদারি সম্ভব হয়নি। এখন আর বঙ্গোপসাগরের মৎস্যসম্পদ বাংলাদেশের সমৃদ্ধিতে কাজে লাগানো কঠিন হবে না। আমাদের সমুদ্রসীমায় দেশী-বিদেশী জলদস্যু নিয়ন্ত্রণও এখন সহজ হবে। সীমানা নির্ধারণের পর বাংলাদেশের সমুদ্রবক্ষের তেল-গ্যাস উত্তোলনের দিকে এখন মনোযোগ দিতে হবে। ভারতের সঙ্গে বিরোধ নিষ্পত্তির পর পানি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত তার এক নিবন্ধে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনে রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানিকে সক্রিয় ও সক্ষম করার তাগিদ দিয়েছেন। আমরাও তার সঙ্গে একমত। পাশাপাশি আমাদের সমুদ্র এলাকার জীব ও খনিজ সম্পদের সংরক্ষণ ও টেকসই ব্যবহারও নিশ্চিত করতে হবে। অমিত সম্ভাবনাময় সমুদ্রকে জাতীয় সমৃদ্ধিতে কাজে লাগানোর এখনই সময়। পাহাড়, সমুদ্র, নদীনালা ও সমতল ভূমি মিলে বৈচিত্র্যময় এ দেশ। দক্ষিণে রয়েছে আমাদের সুবিস্তীর্ণ সমুদ্র, বঙ্গোপসাগর। এ সাগরে বিপুল সম্পদের সমাহার রয়েছে। এখান থেকে বিপুল পরিমাণ মৎস্য আহরণ করা হয়, যা আমাদের প্রোটিনের একটি বড় অংশের জোগান দিয়ে থাকে। এরই মধ্যে সাগরতলে বিপুল পরিমাণ তেল-গ্যাসের সন্ধান মিলেছে। এ ছাড়া রয়েছে জানা-অজানা আরও সম্পদের বিপুল ভাণ্ডার। সমুদ্রের সম্পদ তাই আমাদের অর্থনীতির গতিশীলতার জন্য জরুরি। কিন্তু প্রতিবেশীর সঙ্গে গত তিন দশকজুড়ে সমুদ্রবিরোধ থাকায় আমাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না সমুদ্রসম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা। এখন আদালতের রায়ে বঙ্গোপসাগরে ২০০ নটিক্যাল মাইলের একচ্ছত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল (ইইজেড) ও ২০০ নটিক্যাল মাইলের বাইরে মহিসোপান অঞ্চলে বাংলাদেশের নিরঙ্কুশ ও সর্বাভৌম অধিকার সুনিশ্চিত হয়েছে। এর ফলে সমুদ্র ব্যবহারের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত হল।
আদালতের রায়ের ফল নির্ধারিত হয়েছে ন্যায্যতার ভিত্তিতে। রায়ের পর বাংলাদেশের সমুদ্রসীমার আয়তন যেমন বেড়ে গেল, তেমনি বেড়ে গেল আমাদের দায়িত্বও। এখন আমাদের উচিত হবে জনগণের জীবনমানের উন্নয়নে সামুদ্রিক সম্পদের কার্যকর ব্যবহার। দেশের স্বার্থ সংরক্ষণ করে তেল-গ্যাসের সুবিধাপ্রাপ্তি নিশ্চিত করা। সমুদ্রের অপার সম্ভাবনা নিয়ে অনুসন্ধান ও গবেষণায় অবতীর্ণ হওয়া। এ রায়ের গুরুত্বের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা অভিন্ন নদীগুলোর বিরোধ নিষ্পত্তির বিষয়টি ভাবতে পারি কি-না- সেটিও বিবেচনাযোগ্য।
ড. আনু মাহমুদ : অর্থনীতি বিশ্লেষক
anumahmud@yahoo.com
প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তির আলোচনা শুরু হয় ১৯৭৪ সালে। দীর্ঘ সময়ে কয়েকটি বৈঠক হলেও সমাধান না পেয়ে ২০০৯ সালের ৮ অক্টোবর আন্তর্জাতিক আদালতে যায় বাংলাদেশ। সেখানেও সমঝোতা না হওয়ায় ২০১১ সালের মে মাসে বিষয়টি দ্য হেগের আদালতে গড়ায়। ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্ব অক্ষুণœ রেখে আন্তর্জাতিক সালিশি আদালতের মাধ্যমে সমস্যাটির শান্তিপূর্ণ মীমাংসা হওয়ায় সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে। এর আগে ২০১২ সালে মিয়ানমারের সঙ্গে জাতিসংঘ সমুদ্র আইনবিষয়ক আন্তর্জাতিক আদালতে মামলার রায়ের মাধ্যমে উপকূল থেকে বঙ্গোপসাগরের ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত একচ্ছত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং ২০০ নটিক্যাল মাইলের বাইরে মহিসোপান অঞ্চলে আইনগত অধিকার লাভ করে বাংলাদেশ। এ ছাড়া মহিসোপানের বাইরের সামুদ্রিক সম্পদেও বাংলাদেশের নিরংকুশ ও সার্বভৌম অধিকার সুনিশ্চিত হয়। মিয়ানমার এ সমুদ্র অঞ্চলকে নিজের বলে দাবি করায় বাংলাদেশ দীর্ঘদিন এর সম্পদ আহরণে ব্যর্থ হয়েছে। এ নিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের বিরোধ চলে আসছিল দীর্ঘ ৩৮ বছর ধরে। দুর্ভাগ্যজনক যে, এ বিরোধ নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেয়া হয়নি দীর্ঘদিন। ২০০৮ সালের জানুয়ারিতে ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তির একটি উদ্যোগ নেয় তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার। কিন্তু সে উদ্যোগ বেশিদূর এগোয়নি। মহাজোট ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালের ৮ অক্টোবর সরকার আন্তর্জাতিক সালিশি আদালতের শরণাপন্ন হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। মিয়ানমারের সঙ্গে বিরোধ নিষ্পত্তি হওয়ায় ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধ নিরসনের দাবি জোরালো হয় সন্দেহ নেই। তবে ভারতের সঙ্গে বিরোধ মীমাংসায় বাংলাদেশ ট্রাইব্যুনালের বদলে আরবিট্রেশনে গেছে। এ পথ বেয়েই এসেছে সাফল্য।
ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নির্ধারিত হয়ে যাওয়ায় এ বিরাট জলসীমায় অবস্থিত প্রাণিজ-অপ্রাণিজ সম্পদ, খনিজ জৈবসহ সব ধরনের সম্পদের মালিকানা এখন বাংলাদেশের। এখন সরকারের দায়িত্ব হল এ সম্পদ খুঁজে বের করে আহরণ করা। সে ক্ষেত্রে বর্ধিত এ সমুদ্রসীমার নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করা জরুরি। এজন্য নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ডের বিদ্যমান সম্পদের অপ্রতুলতা দূর করতে হবে। বাড়াতে হবে জনবল।
ভারত আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী রাষ্ট্র। দেশটির সঙ্গে সমুদ্রসীমা সমস্যার নিষ্পত্তি হওয়ার বিষয়টি তাই বিশেষ গুরুত্বের দাবি রাখে। ভারতের সঙ্গে বিদ্যমান অন্যান্য অমীমাংসিত সমস্যা নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে এর একটি ইতিবাচক প্রভাব পড়বে, এটাই প্রত্যাশা। কলকাতা থেকে প্রকাশিত দৈনিক টেলিগ্রাফের শিরোনাম- একটি বড় সমুদ্র অঞ্চল ভারতের হাতছাড়া হল। আমাদের মনে আছে, বঙ্গোপসাগরের বিরোধপূর্ণ এলাকায় মৎস্যসম্পদ আহরণ বা তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের অধিকার নিয়ে দুই প্রতিবেশীর সঙ্গে মাঝে মধ্যেই অস্বস্তিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো। সর্বশেষ আন্তর্জাতিক সালিশি আদালতে ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নির্ধারণ হওয়ার পর এমন পরিস্থিতির আশংকা তিরোহিত হয়েছে বলে মনে করি। যে বিরোধপূর্ণ এলাকায় ভারতের বাধার জন্য বাংলাদেশ তেল-গ্যাস অনুসন্ধান করতে পারছিল না বা দরপত্র আহ্বানের পরও বিদেশী কোম্পানিগুলো সাড়া দিচ্ছিল না, তা এখন বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ও কৌশলগত কাজে লাগাতে পারবে। এখন অভিন্ন সমুদ্রাঞ্চলের অমিত সম্ভাবনা দুই দেশই কাজে লাগাতে পারবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।
সার্বভৌমত্ব, সমরনীতি ও সম্পদের সদ্ব্যবহারের পরিপ্রেক্ষিতেও আন্তর্জাতিক সালিশি আদালতের রায় গুরুত্বপূর্ণ।
বৈঠকে বেঠকে সাড়ে তিন দশকের বেশি সময় ব্যয় করে সমস্যা সমাধান না হওয়ায় বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক সালিশির দ্বারস্থ হতে হয়েছিল। সাহসী ও দূরদর্শী এ সিদ্ধান্তের কারণে অর্জিত এই সাফল্যের জন্য সরকার, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সাধুবাদ জানাই। একই সঙ্গে অভিনন্দন জানাই আন্তর্জাতিক আদালতে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলকে। তাদের মেধা, শ্রম ও অধ্যবসায় সম্ভাবনার নতুন দরজা খুলে দিয়েছে। বাংলাদেশের পক্ষে আদালতে সওয়াল-জওয়াবে অংশ নিয়েছেন যেসব বিদেশী আইনজীবী, তাদেরও অভিনন্দন। ভারত আদালতের কার্যক্রমে সহযোগিতার মাধ্যমে সৎ প্রতিবেশীসুলভ নীতির পরিচয় দিয়েছে। আমরা আশা করি, সমুদ্রসীমার বিরোধ নিষ্পত্তির পর ঢাকা-নয়াদিল্লি এবং ঢাকা-ইয়াঙ্গুনের বন্ধুত্ব আরও জোরদার হবে। এখন উদ্যোগী হতে হবে নিষ্পন্ন সমুদ্রসীমার সর্বোত্তম ব্যবহারের প্রতি। আমাদের জলসীমার মৎস্যসম্পদ অন্য দেশের জেলেরা আহরণ করার অভিযোগ পুরনো। বিরোধপূর্ণ এলাকার কারণে এতদিন সেখানে পূর্ণ নজরদারি সম্ভব হয়নি। এখন আর বঙ্গোপসাগরের মৎস্যসম্পদ বাংলাদেশের সমৃদ্ধিতে কাজে লাগানো কঠিন হবে না। আমাদের সমুদ্রসীমায় দেশী-বিদেশী জলদস্যু নিয়ন্ত্রণও এখন সহজ হবে। সীমানা নির্ধারণের পর বাংলাদেশের সমুদ্রবক্ষের তেল-গ্যাস উত্তোলনের দিকে এখন মনোযোগ দিতে হবে। ভারতের সঙ্গে বিরোধ নিষ্পত্তির পর পানি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত তার এক নিবন্ধে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনে রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানিকে সক্রিয় ও সক্ষম করার তাগিদ দিয়েছেন। আমরাও তার সঙ্গে একমত। পাশাপাশি আমাদের সমুদ্র এলাকার জীব ও খনিজ সম্পদের সংরক্ষণ ও টেকসই ব্যবহারও নিশ্চিত করতে হবে। অমিত সম্ভাবনাময় সমুদ্রকে জাতীয় সমৃদ্ধিতে কাজে লাগানোর এখনই সময়। পাহাড়, সমুদ্র, নদীনালা ও সমতল ভূমি মিলে বৈচিত্র্যময় এ দেশ। দক্ষিণে রয়েছে আমাদের সুবিস্তীর্ণ সমুদ্র, বঙ্গোপসাগর। এ সাগরে বিপুল সম্পদের সমাহার রয়েছে। এখান থেকে বিপুল পরিমাণ মৎস্য আহরণ করা হয়, যা আমাদের প্রোটিনের একটি বড় অংশের জোগান দিয়ে থাকে। এরই মধ্যে সাগরতলে বিপুল পরিমাণ তেল-গ্যাসের সন্ধান মিলেছে। এ ছাড়া রয়েছে জানা-অজানা আরও সম্পদের বিপুল ভাণ্ডার। সমুদ্রের সম্পদ তাই আমাদের অর্থনীতির গতিশীলতার জন্য জরুরি। কিন্তু প্রতিবেশীর সঙ্গে গত তিন দশকজুড়ে সমুদ্রবিরোধ থাকায় আমাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না সমুদ্রসম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা। এখন আদালতের রায়ে বঙ্গোপসাগরে ২০০ নটিক্যাল মাইলের একচ্ছত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল (ইইজেড) ও ২০০ নটিক্যাল মাইলের বাইরে মহিসোপান অঞ্চলে বাংলাদেশের নিরঙ্কুশ ও সর্বাভৌম অধিকার সুনিশ্চিত হয়েছে। এর ফলে সমুদ্র ব্যবহারের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত হল।
আদালতের রায়ের ফল নির্ধারিত হয়েছে ন্যায্যতার ভিত্তিতে। রায়ের পর বাংলাদেশের সমুদ্রসীমার আয়তন যেমন বেড়ে গেল, তেমনি বেড়ে গেল আমাদের দায়িত্বও। এখন আমাদের উচিত হবে জনগণের জীবনমানের উন্নয়নে সামুদ্রিক সম্পদের কার্যকর ব্যবহার। দেশের স্বার্থ সংরক্ষণ করে তেল-গ্যাসের সুবিধাপ্রাপ্তি নিশ্চিত করা। সমুদ্রের অপার সম্ভাবনা নিয়ে অনুসন্ধান ও গবেষণায় অবতীর্ণ হওয়া। এ রায়ের গুরুত্বের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা অভিন্ন নদীগুলোর বিরোধ নিষ্পত্তির বিষয়টি ভাবতে পারি কি-না- সেটিও বিবেচনাযোগ্য।
ড. আনু মাহমুদ : অর্থনীতি বিশ্লেষক
anumahmud@yahoo.com
No comments