বাংলাদেশ সফরের অভিজ্ঞতা by সাইদা হামিদ
আমি ১১ বছর পর বাংলাদেশে ফিরছিলাম। ২০০৩ সালে আমি সর্বশেষ দেশে এসেছিলাম, সে সময় উইমেন্স ইনিশিয়েটিভ ফর পিস ইন সাউথ এশিয়া (ডব্লিউআইপিএসএ) কর্মসূচির আওতায় কলকাতা থেকে ৪৩ জন নারীর সঙ্গে এখানে এসেছিলাম।
এবার এমন একদল নারী-পুরুষের সঙ্গে দেশে এসেছি, যারা সারা দুনিয়ায় ক্ষুধা নিবারণের পণ নিয়ে মাঠে নেমেছে। আমি দ্য হাঙ্গার প্রজেক্টে (টিএইচপি) কাজ শুরু করি মাত্র দুই বছর আগে। কিন্তু আমার সঙ্গে এই সফরে যাঁরা এসেছেন, তাঁরা এই লক্ষ্যে কাজ করছেন ২৭ বছর ধরে।
এ গল্প অবশ্য বাংলাদেশ নিয়ে, এই দেশটি আমাদের এবারের সফরের দ্বিতীয় গন্তব্য। এই গল্পে একজন মা ও মেয়ে আছেন। আমার কাছে মনে হয়, এটাই এই গল্পের সবচেয়ে অসাধারণ ও মর্মভেদী অংশ। শেরি স্ট্রমবার্গ তাঁর মেয়ে সোফিকে নিয়ে নিউইয়র্ক থেকে এসেছেন শুধু একটি কারণে, ক্ষুধা কী জিনিস সেটা তাঁর মেয়েকে দেখাতে। এই শেরি টিএইচপির গ্লোবাল বোর্ডের সদস্য ও নিউইয়র্কের সিটি ব্যাংক সিটি শেয়ার সার্ভিসের বৈশ্বিক প্রধান। সোফি মেয়েটার চুল বেশ লম্বা, তাঁর পরনের উজ্জ্বল রঙের লেহেঙ্গা ও ফিতার মতো দোপাট্টায় তাঁকে আমাদের দলে কাদম্বরীর মতো লাগত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাদম্বরী আমি পড়েছি, কিন্তু খুলনায় গিয়ে এই চমৎকার কদম ফুলটি দেখার আগ পর্যন্ত আমার পক্ষে বোঝা সম্ভব হয়নি, এটা আসলে কী বস্তু। আমার কাছে এটা ছিল সোফি। পুরো সফরে তিনি রাতের বেলা জার্নাল লিখতেন। প্রথমে ভারত ও পরে বাংলাদেশবিষয়ক তাঁর অভিব্যক্তি তিনি রেকর্ড করে রেখেছেন। রাজস্থানের মরুভূমির শক্তিমান নারীরা তাঁদের গ্রামের পরিবর্তনের দূত হিসেবে কাজ করেন, মেয়েটি এই বিস্ময়ের কথা যেমন লিখেছেন, তেমনি খুলনার যে সাহসী নারীরা গ্রামের নেতা ও সঞ্জীবনী শক্তি হিসেবে কাজ করেন, তাঁদের কথাও তিনি লিখেছেন। মেয়েটি সফরের বিভিন্ন স্থানে নানা রকম খাদ্যের স্বাদ পেয়েছেন, মেয়েটি সে কথা উৎসাহ নিয়ে লিখেছেন। আবার রাস্তার মোড়ে গাড়ি থামলে যে শিশুরা গাড়ির জানালায় এসে ভিক্ষা চাইত, তাদের কথাও তিনি দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে বর্ণনা করেছেন। সোফি কাব্যিক ঢঙে এসব ঘটনার বিবরণ লিখেছেন।
এই মেয়েটি খুব সাধাসিধেভাবে নিজের পরিচয় দিতেন, ‘আমি সোফি, নিউইয়র্ক থেকে এসেছি, উনি আমার মা।’ এই মেয়েটি আমার কাছে ক্ষুধামুক্ত বিশ্বের প্রতীক। বিশ্বের সবচেয়ে সচ্ছল এলাকার মেয়ে ক্ষুধা দেখে কষ্ট পেলে বুঝতে হবে, আমাদের আশার কোনো কমতি নেই—দুঃখের বৈতরণি পার হতে আশাই একমাত্র ভেলা।
আমরা বিভিন্ন দেশ থেকে আগত মানুষেরা একটি বেসরকারি বাসে চেপে ছয় ঘণ্টার ভ্রমণ করে খুলনায় যাই। উদ্দেশ্য হচ্ছে, হাঙ্গার প্রজেক্ট কেমন কাজ করছে তা দেখা। বদিউল আলম মজুমদারের আতিথ্যে আমরা সেখানে যাই। নিজের কাজে তিনি নিরলস। আমাদের দলে নিউইয়র্ক, অস্ট্রেলিয়া, সুইডেন, মোজাম্বিক ও ভারতের প্রতিনিধি ছিলেন।
আমাদের দলে নানা বয়সী নারী-পুরুষ ছিলেন। ১১ বছরের সোফি থেকে ৭৪ বছর বয়সের মোহিনী গিরি—ভারতের ন্যাশনাল অব উইমেনের সাবেক সভানেত্রী। সুসজ্জিত মহাসড়ক ধরে আমাদের বাস এগিয়ে চলে। এটা ঢাকা থেকে শুরু হয়ে শ্যামল গ্রামগুলোর ভেতর দিয়ে গেছে। পথে আমাদের পদ্মা নদীও পার হয়ে যেতে হয়। এ নদীর অপর পারেই বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল। ত্রিপুরার সাব্রুম থেকে আমি বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত দেখেছি। আখাউড়া যৌথ চেকপোস্ট থেকেও আমি আগরতলা সীমান্ত দেখেছি। সীমানা ও সীমান্ত রাজনীতিতে পূত–পবিত্র ব্যাপার হলেও জনগণের কাছে তা বিস্তৃত ধানের খেত ছাড়া কিছু নয়, কোনো এক পর্যায়ে গিয়ে সেটা আরেকটি দেশ হয়ে যায়।
শেষ পর্যন্ত আমরা বটিয়াঘাটা ইউনিয়ন পরিষদে পৌঁছালাম। সেখানে বাস থেকে নেমে ছোট ভ্যানে করে গ্রামের সরু পথ ধরে আমরা এগিয়ে চললাম। বৈঠকের নির্দিষ্ট স্থান বাশুরাবাদে গিয়ে পৌঁছালাম। একটি হলে বৈঠকটি হওয়ার কথা ছিল, শতাধিক নারী-পুরুষ সেখানে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। নারীনেত্রী সুচিত্রা বসাক বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে এবং নারী শিশুর শিক্ষাবিষয়ক প্রচারণার ব্যাপারে আমাদের অবহিত করলেন। তারপর ১৬ বছর বয়সী সপ্রতিভ কিশোরী জুলি বলল, সে কীভাবে বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে তার বড়দের মতামত গঠনের চেষ্টা করেছে। সেখানকার প্রধান মনোরঞ্জন, ইউএনও শান্তময় চাকমা ও অ্যানিমেটর সুপ্রিয়া গাইন বললেন, তাঁরা জন্মনিবন্ধন, উপার্জন বৃদ্ধিবিষয়ক এবং যৌতুক ও সব ধরনের সহিংসতার বিরুদ্ধে প্রচারণা চালিয়েছেন। সেখান থেকে আমরা বেতাগী ইউনিয়ন পরিষদে গেলাম, সেখানেও এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হলো। দেখলাম, অধিকাংশ নারী সিঁদুর ও বিন্দি পরিহিত। শুধু এক বা দুজন নারী হিজাব পরিহিত। দুজন তরুণী নিরাপত্তারক্ষী আমাকে বলল, এটা মূলত হিন্দু–অধ্যুষিত একটি গ্রাম, তবে সেখানে হিন্দু ও মুসলমানেরা শান্তিতে বসবাস করে। এই মেয়ে দুটো মুসলমান।
সফরে আমরা জানতে পারলাম, বটিয়াঘাটা ইউনিয়ন পরিষদে খুলনা জেলার বটিয়াঘাটা, বাশুরাবাদ ও হেতালবুনিয়ার মানুষজন একত্র হবেন। বাগেরহাটের বেতাগী ইউনিয়ন পরিষদে নারী নেতারা, যুবনেতা ও ওয়ার্ড অ্যাকশন দলের সদস্যরা সত্যিকার অর্থেই উপস্থিত ছিলেন, তাঁরা শুধু ব্রশিওরের ছবির জন্য পোজ দিতে আসেননি। আমাদের সবার কাছে এগুলো ছিল অপরিচিত নাম, আমাদের সফরসূচিতে যে শব্দগুলো লেখা ছিল। হাঙ্গার প্রজেক্ট বাংলাদেশের তিনটি স্তম্ভ আমাদের সামনে বাস্তব হয়ে ধরা দিল। প্রথমত, আত্মনির্ভরশীলতা অর্জনের জন্য তৃণমূলে জনগণকে একত্র করা, নারীরা পরিবর্তনের দূত এবং স্থানীয় সরকারের সঙ্গে কার্যকর অংশীদারি গড়ে তোলা।
আমরা দেখলাম, কীভাবে প্রশিক্ষণ ও উদ্দীপনা জোগানোর মাধ্যমে টিএইচপি তৃণমূলে এক লাখ ৪০ হাজার মানুষকে একত্র করেছে। এই কাজে যারা অংশ নিয়েছে, তাদের ৪০ শতাংশই নারী। দ্বিতীয় স্তম্ভ, অর্থাৎ পরিবর্তনের দূত হিসেবে নারী—এই কৌশলটি পুরো দক্ষিণ এশিয়ায়ই কাজে দিয়েছে। ভারত সরকারের ১১তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় প্রথমবারের মতো ‘নারীদের কর্মকাণ্ডের’ কথা বলা হয়েছে, ১২তম পরিকল্পনায় সেটাকে আরও পোক্ত করা হয়েছে। টিএইচপি প্রায় ছয় হাজার নারীকে প্রশিক্ষণ দিয়ে তাঁদের মধ্যে নেতৃত্ব বিকশিত করেছে, তাঁরা এখন স্থানীয় সরকারের কর্মসূচিতে পরিবর্তন আনার চেষ্টা করছেন। তৃতীয় ও সবচেয়ে শক্তিশালী স্তম্ভ হচ্ছে স্থানীয় সরকারের সঙ্গে অংশীদারত্ব। বেতাগী ও বটিয়াঘাটা ইউনিয়ন পরিষদের সঙ্গে আমাদের অংশীদারি সফল হয়েছে। দুজন ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলে আমি অভিভূত।
তৃণমূলের পরিবর্তন ঘটাতে হলে অনেক আশা ও ধৈর্য প্রয়োজন। টিএইচপি বাংলাদেশের কার্যক্রম দেখে জালালউদ্দিন রুমির কয়েকটি চরণের কথা মনে পড়ে গেল:
বহমান ও ধীর পদক্ষেপে আমরা কাজ করতে শিখি
খাঁড়ির নিস্তরঙ্গ পরিষ্কার পানির মতো
এ ধারা থামে না, এ ধারা বয়ে যায় আর
পথ খুঁজে নেয়
ছোট ছোট অসংখ্য পদক্ষেপে, স্বেচ্ছায়
আর তাতেই আমরা আশার খোরাক পেয়ে যাই।
আমি বাংলাদেশে কাটানো সেই তিনটি দিনের কথা ভাবছি। ঢাকা শহরে বড় বড় বিলবোর্ডে মোবাইল ফোনের বিজ্ঞাপন আর নারী-পুরুষের বাহারি পোশাকের বিজ্ঞাপন দেখে ঢাকাকে দক্ষিণ এশিয়ার আর দশটি শহরের মতোই মনে হয়। কিন্তু খুলনার পথে আদিগন্ত বিস্তৃত সবুজের যে সমারোহ দেখলাম, তা আমি আর কোথাও দেখিনি। অন্যদিকে সুন্দরবন দেখার লোভ আমার কাছে অধরা স্বপ্নের মতোই রয়ে গেল, এ বনটির বাংলাদেশ অংশ ভারতের অংশের চেয়ে সুন্দর।
এমডিজি অর্জনে বাংলাদেশ দৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে বলেই মনে হয়। এমনকি আইএমআর এবং এমএমআর হ্রাসে প্রত্যাশার চেয়েও ভালো করেছে বাংলাদেশ। ইউনিয়ন পরিষদ ও নির্বাচিত প্রতিনিধিরা টিএইচপিতে কাজ করতে গিয়ে ইতিবাচক ফল বয়ে এনেছেন। কাজী নজরুল ইসলাম ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভালোবাসার এই দেশের ভবিষ্যৎ ভালোই বোধ হচ্ছে, দেশের সাধারণ মানুষের সচেতনতার কারণেই তা সম্ভব হয়েছে।
সারা দুনিয়ার নারী-পুরুষদের নিয়েই এই টিএইচপি গঠিত। তৃণমূলের ক্ষমতায়নে এটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। স্বেচ্ছাশ্রমভিত্তিক কাজগুলো সরকারের সঙ্গে মিলেমিশেই করা হয়, এতে উভয়ই লাভবান হয়। এটা সরকারের সমান্তরাল কিছু নয়। সারা দুনিয়ার মানুষ এ গ্রহের সবচেয়ে গরিব ও দুর্বল মানুষদের জন্য চিন্তা করছেন, এটা ভাবতেই আমার চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে—তাঁরা নিজেদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ছেড়ে এসব জায়গায় এসে কাজ করছেন, যেটা তাঁদের জন্য নতুন দুনিয়াই বটে।
সফর শেষে আমি ভারতে ফিরে গেলাম। সঙ্গে ছিল বাংলাদেশের আলো আর সোফির হাতে লেখা জার্নালের মধ্যে যে আশা প্রোথিত হয়ে আছে, সেই আশা।
ড. সাইদা হামিদ: ভারতের পরিকল্পনা কমিশনের সাবেক সদস্য।
এবার এমন একদল নারী-পুরুষের সঙ্গে দেশে এসেছি, যারা সারা দুনিয়ায় ক্ষুধা নিবারণের পণ নিয়ে মাঠে নেমেছে। আমি দ্য হাঙ্গার প্রজেক্টে (টিএইচপি) কাজ শুরু করি মাত্র দুই বছর আগে। কিন্তু আমার সঙ্গে এই সফরে যাঁরা এসেছেন, তাঁরা এই লক্ষ্যে কাজ করছেন ২৭ বছর ধরে।
এ গল্প অবশ্য বাংলাদেশ নিয়ে, এই দেশটি আমাদের এবারের সফরের দ্বিতীয় গন্তব্য। এই গল্পে একজন মা ও মেয়ে আছেন। আমার কাছে মনে হয়, এটাই এই গল্পের সবচেয়ে অসাধারণ ও মর্মভেদী অংশ। শেরি স্ট্রমবার্গ তাঁর মেয়ে সোফিকে নিয়ে নিউইয়র্ক থেকে এসেছেন শুধু একটি কারণে, ক্ষুধা কী জিনিস সেটা তাঁর মেয়েকে দেখাতে। এই শেরি টিএইচপির গ্লোবাল বোর্ডের সদস্য ও নিউইয়র্কের সিটি ব্যাংক সিটি শেয়ার সার্ভিসের বৈশ্বিক প্রধান। সোফি মেয়েটার চুল বেশ লম্বা, তাঁর পরনের উজ্জ্বল রঙের লেহেঙ্গা ও ফিতার মতো দোপাট্টায় তাঁকে আমাদের দলে কাদম্বরীর মতো লাগত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাদম্বরী আমি পড়েছি, কিন্তু খুলনায় গিয়ে এই চমৎকার কদম ফুলটি দেখার আগ পর্যন্ত আমার পক্ষে বোঝা সম্ভব হয়নি, এটা আসলে কী বস্তু। আমার কাছে এটা ছিল সোফি। পুরো সফরে তিনি রাতের বেলা জার্নাল লিখতেন। প্রথমে ভারত ও পরে বাংলাদেশবিষয়ক তাঁর অভিব্যক্তি তিনি রেকর্ড করে রেখেছেন। রাজস্থানের মরুভূমির শক্তিমান নারীরা তাঁদের গ্রামের পরিবর্তনের দূত হিসেবে কাজ করেন, মেয়েটি এই বিস্ময়ের কথা যেমন লিখেছেন, তেমনি খুলনার যে সাহসী নারীরা গ্রামের নেতা ও সঞ্জীবনী শক্তি হিসেবে কাজ করেন, তাঁদের কথাও তিনি লিখেছেন। মেয়েটি সফরের বিভিন্ন স্থানে নানা রকম খাদ্যের স্বাদ পেয়েছেন, মেয়েটি সে কথা উৎসাহ নিয়ে লিখেছেন। আবার রাস্তার মোড়ে গাড়ি থামলে যে শিশুরা গাড়ির জানালায় এসে ভিক্ষা চাইত, তাদের কথাও তিনি দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে বর্ণনা করেছেন। সোফি কাব্যিক ঢঙে এসব ঘটনার বিবরণ লিখেছেন।
এই মেয়েটি খুব সাধাসিধেভাবে নিজের পরিচয় দিতেন, ‘আমি সোফি, নিউইয়র্ক থেকে এসেছি, উনি আমার মা।’ এই মেয়েটি আমার কাছে ক্ষুধামুক্ত বিশ্বের প্রতীক। বিশ্বের সবচেয়ে সচ্ছল এলাকার মেয়ে ক্ষুধা দেখে কষ্ট পেলে বুঝতে হবে, আমাদের আশার কোনো কমতি নেই—দুঃখের বৈতরণি পার হতে আশাই একমাত্র ভেলা।
আমরা বিভিন্ন দেশ থেকে আগত মানুষেরা একটি বেসরকারি বাসে চেপে ছয় ঘণ্টার ভ্রমণ করে খুলনায় যাই। উদ্দেশ্য হচ্ছে, হাঙ্গার প্রজেক্ট কেমন কাজ করছে তা দেখা। বদিউল আলম মজুমদারের আতিথ্যে আমরা সেখানে যাই। নিজের কাজে তিনি নিরলস। আমাদের দলে নিউইয়র্ক, অস্ট্রেলিয়া, সুইডেন, মোজাম্বিক ও ভারতের প্রতিনিধি ছিলেন।
আমাদের দলে নানা বয়সী নারী-পুরুষ ছিলেন। ১১ বছরের সোফি থেকে ৭৪ বছর বয়সের মোহিনী গিরি—ভারতের ন্যাশনাল অব উইমেনের সাবেক সভানেত্রী। সুসজ্জিত মহাসড়ক ধরে আমাদের বাস এগিয়ে চলে। এটা ঢাকা থেকে শুরু হয়ে শ্যামল গ্রামগুলোর ভেতর দিয়ে গেছে। পথে আমাদের পদ্মা নদীও পার হয়ে যেতে হয়। এ নদীর অপর পারেই বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল। ত্রিপুরার সাব্রুম থেকে আমি বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত দেখেছি। আখাউড়া যৌথ চেকপোস্ট থেকেও আমি আগরতলা সীমান্ত দেখেছি। সীমানা ও সীমান্ত রাজনীতিতে পূত–পবিত্র ব্যাপার হলেও জনগণের কাছে তা বিস্তৃত ধানের খেত ছাড়া কিছু নয়, কোনো এক পর্যায়ে গিয়ে সেটা আরেকটি দেশ হয়ে যায়।
শেষ পর্যন্ত আমরা বটিয়াঘাটা ইউনিয়ন পরিষদে পৌঁছালাম। সেখানে বাস থেকে নেমে ছোট ভ্যানে করে গ্রামের সরু পথ ধরে আমরা এগিয়ে চললাম। বৈঠকের নির্দিষ্ট স্থান বাশুরাবাদে গিয়ে পৌঁছালাম। একটি হলে বৈঠকটি হওয়ার কথা ছিল, শতাধিক নারী-পুরুষ সেখানে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। নারীনেত্রী সুচিত্রা বসাক বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে এবং নারী শিশুর শিক্ষাবিষয়ক প্রচারণার ব্যাপারে আমাদের অবহিত করলেন। তারপর ১৬ বছর বয়সী সপ্রতিভ কিশোরী জুলি বলল, সে কীভাবে বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে তার বড়দের মতামত গঠনের চেষ্টা করেছে। সেখানকার প্রধান মনোরঞ্জন, ইউএনও শান্তময় চাকমা ও অ্যানিমেটর সুপ্রিয়া গাইন বললেন, তাঁরা জন্মনিবন্ধন, উপার্জন বৃদ্ধিবিষয়ক এবং যৌতুক ও সব ধরনের সহিংসতার বিরুদ্ধে প্রচারণা চালিয়েছেন। সেখান থেকে আমরা বেতাগী ইউনিয়ন পরিষদে গেলাম, সেখানেও এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হলো। দেখলাম, অধিকাংশ নারী সিঁদুর ও বিন্দি পরিহিত। শুধু এক বা দুজন নারী হিজাব পরিহিত। দুজন তরুণী নিরাপত্তারক্ষী আমাকে বলল, এটা মূলত হিন্দু–অধ্যুষিত একটি গ্রাম, তবে সেখানে হিন্দু ও মুসলমানেরা শান্তিতে বসবাস করে। এই মেয়ে দুটো মুসলমান।
সফরে আমরা জানতে পারলাম, বটিয়াঘাটা ইউনিয়ন পরিষদে খুলনা জেলার বটিয়াঘাটা, বাশুরাবাদ ও হেতালবুনিয়ার মানুষজন একত্র হবেন। বাগেরহাটের বেতাগী ইউনিয়ন পরিষদে নারী নেতারা, যুবনেতা ও ওয়ার্ড অ্যাকশন দলের সদস্যরা সত্যিকার অর্থেই উপস্থিত ছিলেন, তাঁরা শুধু ব্রশিওরের ছবির জন্য পোজ দিতে আসেননি। আমাদের সবার কাছে এগুলো ছিল অপরিচিত নাম, আমাদের সফরসূচিতে যে শব্দগুলো লেখা ছিল। হাঙ্গার প্রজেক্ট বাংলাদেশের তিনটি স্তম্ভ আমাদের সামনে বাস্তব হয়ে ধরা দিল। প্রথমত, আত্মনির্ভরশীলতা অর্জনের জন্য তৃণমূলে জনগণকে একত্র করা, নারীরা পরিবর্তনের দূত এবং স্থানীয় সরকারের সঙ্গে কার্যকর অংশীদারি গড়ে তোলা।
আমরা দেখলাম, কীভাবে প্রশিক্ষণ ও উদ্দীপনা জোগানোর মাধ্যমে টিএইচপি তৃণমূলে এক লাখ ৪০ হাজার মানুষকে একত্র করেছে। এই কাজে যারা অংশ নিয়েছে, তাদের ৪০ শতাংশই নারী। দ্বিতীয় স্তম্ভ, অর্থাৎ পরিবর্তনের দূত হিসেবে নারী—এই কৌশলটি পুরো দক্ষিণ এশিয়ায়ই কাজে দিয়েছে। ভারত সরকারের ১১তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় প্রথমবারের মতো ‘নারীদের কর্মকাণ্ডের’ কথা বলা হয়েছে, ১২তম পরিকল্পনায় সেটাকে আরও পোক্ত করা হয়েছে। টিএইচপি প্রায় ছয় হাজার নারীকে প্রশিক্ষণ দিয়ে তাঁদের মধ্যে নেতৃত্ব বিকশিত করেছে, তাঁরা এখন স্থানীয় সরকারের কর্মসূচিতে পরিবর্তন আনার চেষ্টা করছেন। তৃতীয় ও সবচেয়ে শক্তিশালী স্তম্ভ হচ্ছে স্থানীয় সরকারের সঙ্গে অংশীদারত্ব। বেতাগী ও বটিয়াঘাটা ইউনিয়ন পরিষদের সঙ্গে আমাদের অংশীদারি সফল হয়েছে। দুজন ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলে আমি অভিভূত।
তৃণমূলের পরিবর্তন ঘটাতে হলে অনেক আশা ও ধৈর্য প্রয়োজন। টিএইচপি বাংলাদেশের কার্যক্রম দেখে জালালউদ্দিন রুমির কয়েকটি চরণের কথা মনে পড়ে গেল:
বহমান ও ধীর পদক্ষেপে আমরা কাজ করতে শিখি
খাঁড়ির নিস্তরঙ্গ পরিষ্কার পানির মতো
এ ধারা থামে না, এ ধারা বয়ে যায় আর
পথ খুঁজে নেয়
ছোট ছোট অসংখ্য পদক্ষেপে, স্বেচ্ছায়
আর তাতেই আমরা আশার খোরাক পেয়ে যাই।
আমি বাংলাদেশে কাটানো সেই তিনটি দিনের কথা ভাবছি। ঢাকা শহরে বড় বড় বিলবোর্ডে মোবাইল ফোনের বিজ্ঞাপন আর নারী-পুরুষের বাহারি পোশাকের বিজ্ঞাপন দেখে ঢাকাকে দক্ষিণ এশিয়ার আর দশটি শহরের মতোই মনে হয়। কিন্তু খুলনার পথে আদিগন্ত বিস্তৃত সবুজের যে সমারোহ দেখলাম, তা আমি আর কোথাও দেখিনি। অন্যদিকে সুন্দরবন দেখার লোভ আমার কাছে অধরা স্বপ্নের মতোই রয়ে গেল, এ বনটির বাংলাদেশ অংশ ভারতের অংশের চেয়ে সুন্দর।
এমডিজি অর্জনে বাংলাদেশ দৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে বলেই মনে হয়। এমনকি আইএমআর এবং এমএমআর হ্রাসে প্রত্যাশার চেয়েও ভালো করেছে বাংলাদেশ। ইউনিয়ন পরিষদ ও নির্বাচিত প্রতিনিধিরা টিএইচপিতে কাজ করতে গিয়ে ইতিবাচক ফল বয়ে এনেছেন। কাজী নজরুল ইসলাম ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভালোবাসার এই দেশের ভবিষ্যৎ ভালোই বোধ হচ্ছে, দেশের সাধারণ মানুষের সচেতনতার কারণেই তা সম্ভব হয়েছে।
সারা দুনিয়ার নারী-পুরুষদের নিয়েই এই টিএইচপি গঠিত। তৃণমূলের ক্ষমতায়নে এটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। স্বেচ্ছাশ্রমভিত্তিক কাজগুলো সরকারের সঙ্গে মিলেমিশেই করা হয়, এতে উভয়ই লাভবান হয়। এটা সরকারের সমান্তরাল কিছু নয়। সারা দুনিয়ার মানুষ এ গ্রহের সবচেয়ে গরিব ও দুর্বল মানুষদের জন্য চিন্তা করছেন, এটা ভাবতেই আমার চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে—তাঁরা নিজেদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ছেড়ে এসব জায়গায় এসে কাজ করছেন, যেটা তাঁদের জন্য নতুন দুনিয়াই বটে।
সফর শেষে আমি ভারতে ফিরে গেলাম। সঙ্গে ছিল বাংলাদেশের আলো আর সোফির হাতে লেখা জার্নালের মধ্যে যে আশা প্রোথিত হয়ে আছে, সেই আশা।
ড. সাইদা হামিদ: ভারতের পরিকল্পনা কমিশনের সাবেক সদস্য।
No comments