ঈদ উৎসবে ৮ পরিবারের কান্না
ঈদের আর মাত্র ৩ দিন বাকি। সমগ্র
রাজধানীতে উৎসবের আনন্দ। এই উৎসবের মুহূর্তে সন্তানহারা, স্বামীহারা,
পিতাহারা কিছু মুখ গতকাল সকালে একত্রিত হয়েছিল জাতীয় প্রেসক্লাবে। তারা
দাবি জানিয়েছে গুম হওয়া প্রিয়জনকে ফিরিয়ে দেয়ার। স্বজনদের আরজি, ‘ওরা গুম,
ওরা স্বজনদের কাছে ঈদ করতে চায়। ওদের ফিরিয়ে দিন।’ জাতীয় প্রেস ক্লাবের
কনফারেন্স লাউঞ্জে সাম্প্রতিক সময়ে গুম হওয়া ৮ ব্যক্তির পরিবার শনিবার সকাল
১১টায় সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে এই আকুতি জানায়। গুম হওয়া ৮ ব্যক্তি হলেন
ঢাকা মহানগর বিএনপির ৩৮নং ওয়ার্ডের সাধারণ সম্পাদক সাজেদুল ইসলাম সুমন, তার
খালাতো ভাই জাহিদুল করিম তানভীর, তেজগাঁও কলেজ ছাত্রদলের যুগ্ম-সাধারণ
সম্পাদক তরিকুল ইসলাম জন্টু, পূর্ব নাখালপাড়ার আবদুল কাদের ভূইয়া মাসুম,
পশ্চিম নাখালপাড়ার মাজহারুল ইসলাম রাসেল, মুগদার আসাদুজ্জামান, উত্তর
বাড্ডা এলাকার আল-আমিন ও শাহীনবাগের এএম আদনান চৌধুরী। সংবাদ সম্মেলনে
সমাজের বিশিষ্ট নাগরিক ও মানবাধিকার সংগঠনের নেতারা অংশ নিয়ে সংহতি প্রকাশ
করেন। নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না শোকার্ত পরিবারগুলোর
প্রতি সমবেদনা জানিয়ে বলেন, আমাদের অসহায়ত্ব প্রকাশ করলে চলবে না।
অসহায়ত্বই আমাদের শক্তি। প্রয়োজনে ঈদের পরে গুম হওয়া ব্যক্তিদের ফিরিয়ে
দেয়ার দাবিতে অনশনসহ কঠোর কর্মসূচি পালন করা হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী
বাহিনীর সমালোচনা করে মান্না বলেন, থানায় জিডি করতে গিয়ে স্বজনরা জিডি করতে
পারেননি। জিডির ভাষা থানা থেকে নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। পুলিশ র্যাবকে
ওপর থেকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে বলেই তারা এমন করেছে। বিএনপির সমালোচনা করে
নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক বলেন, নিখোঁজ ব্যক্তিদের সন্ধান দাবিতে বিএনপি তেমন
কোন ভূমিকা রাখেনি। তাই সাধারণ জনগণকে সঙ্গে নিয়ে আমাদের আন্দোলনের মাধ্যমে
নিজেদের দাবি আদায় করতে হবে। তিনি র্যাবকে ‘কিলার বাহিনী’ আখ্যা দিয়ে
বলেন, র্যাব কোন এলিট ফোর্স নয়। এটা কিলার ফোর্স। এখানে পুলিশ, আনসারসহ সব
বাহিনীর সদস্য আছে। এলিট ফোর্স শুধুমাত্র এলিট শ্রেণীর নিরাপত্তা দিয়ে
থাকে। সাম্প্রতিক সময়ের গুমের ঘটনায় প্রধানমন্ত্রীকে দায়ী করে মান্না বলেন,
দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে সব গুমের ঘটনার জন্য প্রধানমন্ত্রী দায়ী।
তার উচিত কোন থানার কোন পুলিশ বা র্যাব এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িত তাদের
শাস্তির আওতায় নিয়ে আসা। তিনি শাস্তি না দিলেও এক সময় ঠিকই তাদের শাস্তির
আওতায় আনা হবে। প্রধানমন্ত্রী সবকিছুর ঊর্ধ্বে নন। একদিন প্রত্যেক ব্যাপারে
জবাবদিহি করতে হবে। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাকতা ডা. জাফরুল্লাহ
চৌধুরী বলেন, গাজায় ৮০০ লোককে হত্যা করার কারণে সারা বিশ্বে নিন্দার ঝড়
উঠেছে। অথচ বাংলাদেশে একটা বাহিনী ৮০০ লোক মেরে ফেলেছে। কিন্তু কোন
প্রতিবাদ হচ্ছে না। তিনি বিএনপি নেত্রীর প্রতি আহ্বান জানান, ভবিষ্যতে
ক্ষমতায় এলে র্যাব বিলুপ্ত করতে হবে এমন অঙ্গীকার করতে হবে।
প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে ডা. জাফরুল্লাহ বলেন, গুম হওয়া সদস্যদের পরিবারের
দুঃখ আপনার বোঝার কথা। ঈদের উপহার হিসেবে ৮ ব্যক্তিকে তাদের পরিবারের কাছে
ফিরিয়ে দিন। এটা আপনার নৈতিক দায়িত্ব। প্রয়োজন হলে গুম হওয়া ব্যক্তিদের
সন্ধান দাবিতে নাগরিক সমাজ ঈদের পরে কঠোর আন্দোলন করবে বলে ঘোষণা দেন তিনি।
সাংবাদিক সম্মেলনে সংহতি প্রকাশ করে সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক
বলেন, এতো কিছুর পরেও অনেকেই র্যাবের পক্ষে কথা বলছেন। আমরা আর কত
অসভ্য-বর্বর হবো। দেশে আইন থাকা সত্ত্বেও একটা বাহিনী বিনা বিচারে ৮০০
লোককে হত্যা করলো। এটা প্রমাণ করেছে আইন জিনিসটা খুব খারাপ। তারা আইনকে
বিশ্বাস করে না। তিনি র্যাবকে সৃষ্টিকর্তার চেয়েও সর্বজান্তা দাবি করে
বলেন, শেষ বিচারের দিনে আল্লাহ মানুষকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেবেন।
তাদের বিচারের মাধ্যমে শাস্তি অথবা পুরস্কৃত করবেন। অথচ র্যাব কোন প্রকার
বিচার ছাড়াই মানুষকে মেরে ফেলছে। প্রধানমন্ত্রীর সমালোচনা করে সুপ্রিম
কোর্টের এই আইনজীবী বলেন, প্রধানমন্ত্রী সব সময় বলেন আমাদের দেশকে মধ্যম
আয়ের দেশে পরিণত করবেন। এর মানে দেশে আইনের সুশাসন কায়েম হতে হবে। এখন যদি
গুম-খুনের বিচার না হয় তবে ৩০-৪০ বছর পরে এর বিচার হবে। তখন জড়িত সবার
বিচার হবে। র্যাবে কর্মরত কাউকে শান্তি মিশনের নিয়োগ না দেয়ার জন্য
বাংলাদেশে সফররত জাতিসংঘ কর্মকর্তাদের প্রতি আহ্বান জানান ড. শাহদীন মালিক।
মানবাধিকার কর্মী ও নারীনেত্রী শিরিন হক বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে
মানবাধিকার কর্মীরা অসহায়বোধ করছে। কোন ব্যাপারেই কোন প্রতিকার মিলছে না।
বর্তমানে কাউকে আশা দেয়া যাচ্ছে না যে এর প্রতিকার হবে। রাজনৈতিক দলগুলো
শুধু বিবৃতি দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কোন উদ্যোগ নিতে দেখা যাচ্ছে না। অধিকার
সম্পাদক আদিলুর রহমান খান সাংবাদ সম্মেলনে অংশ নিয়ে বলেন, ‘৭১-এর
মুক্তিযুদ্ধকালে ও পরবর্তী সময়ের ন্যায় বর্তমানে গুমের ঘটনা ঘটছে। গত
জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত মোট ২৮ ব্যক্তিকে গুম করা হয়েছে। একটি রাষ্ট্রীয়
বাহিনীর বিরুদ্ধে ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে। অবিলম্বে গুম
বন্ধে রাষ্ট্রকে পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানান তিনি। গুম হওয়া ব্যক্তিদের
পরিবারের পক্ষে সাজেদুল ইসলাম সুমনের বোন ফেরদৌসী সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে
বলেন, আমার মধ্যে আবার নতুন করে আশার সঞ্চার হয়েছে। আমার মনে হচ্ছে আমাদের
ভাইদের খুঁজে পাবো। সংবাদ সম্মেলন শেষে প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন
কর্মসূচি পালন করা হয়।
No comments