ডেডলাইন ২৫শে অক্টোবর, অনড় দু’পক্ষই by আশরাফ খান

সরকারের বিদায়ের সময় যত ঘনিয়ে আসছে, সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যেকার বিরোধ ততই তীর্যক ও গভীরতর হচ্ছে। এর মধ্যেও সমঝোতার নানা চেষ্টাও ভিতরে ভিতরে হচ্ছে।
তবে ২৫শে অক্টোবরের আগে সমাধান প্রক্রিয়া ফলবতী হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। কারণ সরকার সময়ক্ষেপণের কৌশল নিয়েছে। সঙ্কট সুরাহার কোন উদ্যোগ দৃশ্যমান না হওয়ায় মানুষের মধ্যে সংশয়-উদ্বেগ গভীরতর হচ্ছে- নির্বাচন কবে হবে, বিরোধী দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন হবে? শেষ পর্যন্ত সরকার একতরফা নির্বাচন করিয়ে নেবে, না বিরোধী দলের লাগাতার প্রশাসন অচল করে দেয়ার মতো আন্দোলনের মুখে সরকার জরুরি অবস্থা জারির শেষ অস্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে আত্মরক্ষার পথ করে নেবে- এমনি সব প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে উদ্বিগ্ন সাধারণ মানুষের মধ্যে। সরকারি দলের দুই বিশিষ্ট নেতা যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ও প্রেসিডিয়ামের অন্যতম সদস্য মোহাম্মদ নাসিম দৃঢ়তার সঙ্গেই বলেন, বিরোধী দল এখন যা-ই বলুক শেষ পর্যন্ত তারা নির্বাচনে আসবে। তাদের সম্ভাব্য প্রার্থী, নেতা-কর্মীরা মাঠে নেমে পড়েছেন। নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণায় তারা এগিয়ে রয়েছেন। অপরদিকে বিরোধী দলের নেতারা বলেন, নির্বাচনে অংশ নেয়ার প্রস্তুতি তারাও নিচ্ছেন। তবে সরকার সমঝোতায় না এলে নির্বাচন তারা করবেন না, হতেও দেবেন না। সংসদ ভেঙে দেয়া এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অন্তর্বর্তী সরকার প্রধানের দায়িত্বে না থাকা সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে বিরোধের প্রধান বিষয়। এমপিদের পদে থেকে নির্বাচন করার ব্যাপারে সরকারের অবস্থান এবং এ ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনারের বক্তব্য দ্বন্দ্ব আরও প্রকট করলো। অনির্বাচিত একজনকে প্রধান করে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে বিরোধী দল বাহ্যত অনড় অবস্থানে রয়েছে। বিএনপি’র দু’জন সিনিয়র নেতা বলেন, তাদের দাবি অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকার না হলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অন্তর্বর্তী সরকারে না থাকলে তা হবে তাদের বড় প্রাপ্তি। এদিকে প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠসূত্রে জানা যায়, তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান থাকার ব্যাপারে অনমনীয় অবস্থানে নেই। তবে সাংবিধানিক ব্যবস্থার বাইরে অনির্বাচিত কারও হাতে সরকারের দায়িত্ব ছাড়া এবং এ জন্য সাংবিধানিক সংশোধনী আনার ঘোরতর বিরোধী তিনি। আওয়ামী লীগের একজন প্রভাবশালী প্রেসিডিয়াম সদস্য জানিয়েছেন, বিরোধী দল কর্তৃক স্পিকার অথবা প্রেসিডেন্টকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে মেনে নেয়ার শর্তে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানের পদে আগ্রহী না-ও হতে পারেন। সংসদ ভেঙে দেয়ার জন্য বিরোধী দলের দাবি মেনে নেয়া হবে না। সংসদ ২৫শে অক্টোবরের পর ঘুমন্ত অবস্থায় থাকবে। সংসদ সদস্যদের নির্বাচনে এমপি’র প্রভাব, ক্ষমতা খাটানোর কোন সুযোগ থাকবে না। এ ব্যাপারে প্রয়োজনে প্রশাসনিক নির্দেশনা জারি করা হবে। সংসদ বহাল থাকলে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড হবে না বলে বিরোধী দল নির্বাচনের আগে সংসদ ভেঙে দেয়ার জোর দাবি জানিয়ে আসছে। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরির বিষয়টি নির্বাচন কমিশন আচরণবিধিতে নিশ্চিত করবে। সংসদ বহাল রাখা সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার রক্ষাকবচ হিসেবে ভূমিকা রাখবে বলে আওয়ামী লীগ দলীয় ওই নেতা মনে করেন। জাতির উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে এ বিষয়গুলো তুলে ধরা হবে। সরকারের মেয়াদে ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, সিটি করপোরেশনের প্রায় ৬ হাজার স্থানীয় সরকার সংস্থা ও সংসদের উপ-নির্বাচনগুলো প্রশ্নহীনভাবে অনুষ্ঠানের কথা উল্লেখ করে আগামী সংসদ নির্বাচন সম্পূর্ণ নিরপেক্ষতা, স্বচ্ছতার সঙ্গে অনুষ্ঠানের পূর্ণ নিশ্চয়তা দেয়া হবে। বিভিন্ন গণতান্ত্রিক দেশে কোন প্রক্রিয়ায় নির্বাচন হয়ে থাকে তা-ও উল্লেখ করা হবে। প্রধানমন্ত্রী ২৫শে অক্টোবর অথবা তার একদিন আগে জাতির উদ্দেশে ভাষণে নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করা ও সরকারি প্রভাবমুক্ত নির্বাচনের নিশ্চয়তা বিধানে কমিশনের হাতে নির্বাচনে ভূমিকা রক্ষাকারী মন্ত্রণালয়গুলোর দায়িত্ব ছেড়ে দেয়ার কথাও বলা হতে পারে। প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচটি ইমাম ও ড. মশিউর রহমান এনিয়ে কাজ করছেন। সরকারের কিছু ছাড় দেয়ার প্রস্তাবে বিরোধী দল সম্মত না হলে সরকার একতরফা নির্বাচনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে যাবে। বিএনপি’র নেতৃত্বাধীন বিরোধী দল এতে বড় বাধা সৃষ্টি করতে পারবে না বলেই সরকারি দলের নেতৃবৃন্দ মনে করেন। আওয়ামী লীগ প্রেসিডিয়ামের সদস্য কাজী জাফরুল্লাহ জানিয়েছেন, ঢাকা শহরে ৮ শতাধিক কমিটি করা হয়েছে। বিরোধী দলের নৈরাজ্যকর আন্দোলন মোকাবিলায় প্রশাসনের পাশাপাশি তারাও মাঠে থাকবেন। বিএনপি’র কয়েকজন নেতা জানান, প্রধানমন্ত্রীর অন্তর্বর্তী সরকার প্রধানের দায়িত্বে না থাকা, সংসদ ভেঙে দেয়াসহ অন্যান্য দাবির প্রশ্নে কোন আপস করবে না বিরোধী দল। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলের আশঙ্কা দু’পক্ষের মুখোমুখি অবস্থান অনিবার্য সংঘাত ডেকে আনবে। একতরফা নির্বাচন, তা সম্ভব না হলে সংবিধানের ধারা প্রয়োগ করে জরুরি অবস্থা জারির পথ খোলা থাকবে সরকারের হাতে। ১৪ দলের কয়েকটি বাদে অন্য সব নামসর্বস্ব দল দিয়ে নির্বাচন করা হলেও জাতীয়ভাবেই তা গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। এদিকে এইচএম এরশাদ রাজনৈতিক অস্তিত্বের তাগিদেই মহাজোটে থাকছেন না। বিভিন্ন জনসভায় এ ব্যাপারে তিনি ম্যান্ডেট নিচ্ছেন। সমপ্রতি প্রতিবেশী একটি দেশের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বৈঠকে এরশাদ মহাজোটে না থাকার কথা জানিয়ে দিয়েছেন। জাতীয় পার্টি নেতৃবৃন্দ মনে করেন, আওয়ামী লীগ আগামীতে কোন অবস্থাতেই ক্ষমতায় আসবে না। জীবনের শেষ প্রান্তে এরশাদ কলঙ্কিত হতে চান না। অপরদিকে এরশাদের হয়ে তার প্রতিনিধি বিএনপি’র সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন।
সরকারি মহল মনে করে সরকার কিছুটা ছাড় দিলেই আন্দোলনের ময়দান ছেড়ে বিএনপি হুট করে নির্বাচনে চলে আসার ঘোষণা দেবে। নির্বাচনে সরকারের ভরাডুবি এবং তাদের বিজয়ের ব্যাপারে তারা আস্থাশীল বলেই বিএনপি সুযোগ হাতছাড়া না-ও করতে পারে। নির্বাচনে গেলে যাতে কোন সাংগঠনিক প্রতিকূলতার মধ্যে পড়তে না হয় সে জন্য নির্বাচনের প্রস্তুতিমূলক কাজগুলোও তারা ভেতরে ভেতরে গুছিয়ে নিচ্ছেন।

No comments

Powered by Blogger.