সিলেটে লোপাট হয়ে গেল হাজার হাজার কোটি টাকার পাথর
সিলেটের প্রশাসনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন- তিনটি কোয়ারিতে ৩০ থেকে ৩৫টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। কয়েকশ’ ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হলেও পাথর লুট বন্ধ হচ্ছে না। সিলেটের জাফলংকে বলা হয় পাথর রাজ্য। ৫ই আগস্ট থেকে এখন পর্যন্ত জাফলংয়ে পাথর লুট চলছে। প্রথম দিকে মাটির উপরে থাকা পাথর লুট করা হয়। গত দু’মাস ধরে চলছে বোমা মেশিন দিয়ে পাথর লুট। কয়েকশ’ বোমা মেশিন প্রতিদিন জাফলংয়ের ভূগর্ভ থেকে পাথর লুট করছে। বোমা মেশিনের তাণ্ডবে জাফলং এখন ছিন্নভিন্ন। কত টাকার পাথর লুট হয়েছে জাফলংয়ে? এ প্রশ্ন এখন সবার। আগস্টে মাত্র ১০ দিন লুটের পরিসংখ্যান জানিয়েছিল উপজেলা প্রশাসন। তারা বলেছিল এই ১০-১২ দিনে ১২৫ কোটি টাকার পাথর লুট হয়েছে। এই লুটেই থেমে থাকেনি পাথরখোকারা। এরপর থেকে তারা প্রশাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে লুট করেই চলেছে। স্থানীয়দের মতে- গত ৭ মাসে জাফলং থেকে অন্তত দুই হাজার কোটি টাকার পাথর লুট করা হয়েছে। এই পাথর লুটের নেতৃত্বে রয়েছেন জেলা বিএনপি’র পদ স্থগিতকারী নেতা রফিকুল ইসলাম শাহ্পরাণ ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান শাহ আলম স্বপন। তাদের নেতৃত্বে সর্বদলীয় পাথরখেকো চক্র এই কোয়ারিতে লুটপাট চালাচ্ছে। সম্প্রতি এসে এতে যোগ দিয়েছেন যুবদল ও ছাত্রদলের নেতারা।
পরিবেশ অধিদপ্তরে যেক’টি মামলা দায়ের করা হয়েছে প্রায় সব মামলায়ই তাদের আসামি করা হয়েছে। কোয়ারিতে চাঁদাবাজি ও পুলিশের লাইনম্যান হিসেবে তাদের সিন্ডিকেটরা কাজ করছে। জাফলংয়ে পাথর লুট বন্ধ রাখতে ইতিমধ্যে পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে ২০ থেকে ২৫ দিন অভিযান চালানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন সিলেট পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মো. বদরুল ইসলাম। তিনি মানবজমিনকে জানিয়েছেন- অভিযান, মামলা সবই হচ্ছে। সিলেটের এসপিকে আসামিদের তালিকা দেয়া হয়েছে। সেনাবাহিনীর সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে। এভাবে চলতে দেয়া যায় না। এ নিয়ে সিলেটের জেলা প্রশাসক সহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে যৌথভাবে উদ্যোগ নেয়া যায় কি না এ ব্যাপারে কাজ করা হচ্ছে। সিলেটের কোম্পানীগঞ্জের ভোলাগঞ্জ হচ্ছে দেশের বৃহত্তম পাথর কোয়ারি। এ কোয়ারির পাথর লুট বন্ধ রাখতে গিয়ে বিগত সরকারের এমপি ইমরান আহমদ বার বার বিতর্কিত হয়েছিলেন। তবুও তিনি হাল ছাড়েননি। কিন্তু হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার দিন থেকে এই কোয়ারিতে অবাধে লুট করা হচ্ছে। ভোলাগঞ্জে রয়েছে রেলওয়ের রূপওয়ের বাংকার। এই বাংকার পাহারায় ছিল রেলওয়ে নিরাপত্তাকর্মীরা। প্রথমেই তাদের ওপর হামলা চালানো হলে তারা সরে যায়। এরপর থেকে চলে লুটপাট। এই লুটের নেতৃত্বে রয়েছেন স্থানীয় যুবদল নেতা রজন আহমদ, রুবেল আহমদ বাহার ও জেলা যুবদল নেতা মোস্তাকিম ফরহাদ। তাদের নেতৃত্বে বিএনপি, আওয়ামী লীগ, ব্যবসায়ীদের যৌথ সিন্ডিকেট ৭ মাসে সাদাপাথর, বাংকার সহ গোটা কোয়ারি লুট করেছে। এখন চলছে কয়েকশ’ বোমা মেশিন বসিয়ে পাথর লুট।
ভোলাগঞ্জে আগস্টের প্রথম ১০ দিনে ১২৫ কোটি টাকার পাথর লুট করা হয়েছে। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন- ভোলাগঞ্জ কোয়ারি থেকে গত ৭ মাসে অন্তত আড়াই হাজার কোটি টাকার পাথর লুট করা হয়েছে। আর এই লুটে বিজিবি ও পুলিশের স্থানীয় সদস্য জড়িত ছিল। তারা প্রকাশ্যেই উত্তোলিত পাথর থেকে চাঁদাবাজি করা হয়। কয়েকশ’ বোমা মেশিনের তাণ্ডবে ভোলাগঞ্জও ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। ভোলাগঞ্জের অদূরে শারপিন টিলা। এই টিলাকে এবার মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়া হয়েছে। স্থানীয় বাবুল আহমদ, রাশা, সুহান, আকদ্দস আলী মিলে এবার শারপিন টিলা লুট করে। এই টিলা থেকে অন্তত ২০০ কোটি টাকার পাথর লুট করা হয়েছে। এই টিলা থেকে উত্তোলিত পাথরে চাঁদাবাজি করতে গিয়ে বিতর্কিত হন কোম্পানীগঞ্জ থানার সাব-ইন্সপেক্টর সহ ১৩ পুলিশ সদস্য। এ ঘটনায় তাদের কোম্পানীগঞ্জ থেকে প্রত্যাহার করে নেয়া হলেও মূলত পুলিশের শেল্টারেই শারপিন টিলায় অবাধে লুট করা হচ্ছে পাথর। দেশের অন্যতম বড় পাথর কোয়ারি বিছনাকান্দি এখন পাথরশূন্য। দুই মাসে বিছনাকান্দি কোয়ারির উপরের অংশে থাকা অন্তত ৩০০ কোটি টাকার পাথর লোপাট করা হয়েছে। এই কোয়ারির লুটের পাথর জব্দ করতে গিয়ে গোয়াইনঘাটের পুলিশও বিতর্কিত হয়। পরিবেশবিদরা জানিয়েছেন- যেভাবে সিন্ডিকেট করে পাথর লুট করা হচ্ছে সেটি পুলিশ দিয়ে দমানো সম্ভব নয়। আর পুলিশ, বিজিবি ও পাথরখেকো সিন্ডিকেট এক হয়ে গেছে। এখন প্রয়োজন যৌথ অভিযান। সেনাবাহিনীর সদস্যরা যেভাবে চোরাই রাজ্য হরিপুরকে ধ্বংস করেছে সেভাবে যৌথবাহিনীর সদস্যরা জাফলং, ভোলাগঞ্জ ও বিছনাকান্দিতে নামলে পাথর লুট বন্ধ করা সম্ভব হবে। জাফলং থেকে ভোলাগঞ্জ পর্যন্ত ভূমিকম্পের ডেঞ্জার জোন অবস্থিত। পাথর লুট বন্ধ না হলে ভূমিকম্পের আশঙ্কা আরও তীব্র হবে বলে জানান তারা।
No comments