প্রধান বিচারপতির সঙ্গে একমত, তবে

প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা আবারও সংবিধানের বর্তমান ১১৬ অনুচ্ছেদকে সংশোধন করে বাহাত্তরের মূল সংবিধানে ফিরিয়ে নিতে বলেছেন। এই অনুচ্ছেদটিই অধস্তন আদালত পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণে দ্বৈত শাসন তৈরি করেছে। কোনো বিচারককে বদলি বা তাঁর বিষয়ে শৃঙ্খলামূলক কোনো ব্যবস্থা নিতে হলে সেটা সরকার আগে একটা প্রস্তাব দেবে, এরপর সুপ্রিম কোর্ট যে পরামর্শ দেবেন, সেটা কার্যকর হবে। কিন্তু ওই আগে প্রস্তাব দেওয়াটাই গোলমেলে। কারণ এ ধরনের প্রস্তাবই বিচারকের ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। আমরা দেখেছি যে প্রতি কার্যদিবসে সরকার গড়ে পাঁচজনকে বদলির প্রস্তাব দেয় আর সুপ্রিম কোর্ট তাঁর চারটিতেই রাজি হন।
গণতন্ত্রে ক্ষমতা বা এখতিয়ার কখনো একতরফা ও অস্বচ্ছ কোনো প্রক্রিয়া সমর্থন করে না, সেটা জনগণের পক্ষে যে বা যাঁরাই প্রয়োগ করুন না কেন। বাংলাদেশের সংকট স্বচ্ছতার ঘাটতির। সেটা কী করে দূর করা যায়, সেটাই আজ ভাবতে হবে। বিষয়টি শুধুই সরকার মুছে সুপ্রিম কোর্ট লিখে দেওয়ার মধ্যেই সীমিত নয়। রাষ্ট্রের যে অঙ্গই ক্ষমতা অনুশীলন করুন, সেটা হতে হবে উন্মুক্ত ও স্বচ্ছ। এই দুটো দিতে অপারগ থাকলে শুধু শাসনের জায়গা বদলিয়ে খুব প্রতিকার পাওয়া যাবে না। বৈশ্বক প্রবণতা হলো, অধস্তন আদালতের বিচারক নিয়োগ ও নিয়ন্ত্রণ জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের কাছেই ন্যস্ত রাখা। প্রধান বিচারপতির মনোনীত আপিল বিভাগের বিচারপতির নেতৃত্বে বর্তমানে আমাদের একটি ভালো কমিশন রয়েছে। কিন্তু তাকে শুধু বিচারক নিয়োগের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। আমাদের মনে হয়, এটা ভাবার সময় এসেছে যে বিচারক নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতাও ওই কমিশনকেই দেওয়া যায় কি না। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে চতুর্থ সংশোধনী পাস পর্যন্ত বিচারক নিয়ন্ত্রণ যখন শুধু সুপ্রিম কোর্টের কাছেই ন্যস্ত ছিল, তখন সেটা যথাযথভাবে অনুসৃত হয়নি। কারণ, ১১৬ অনুচ্ছেদে বিচারক নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা সুপ্রিম কোর্টকে দেওয়া হলেও ১৫০ অনুচ্ছেদে ক্রান্তিকালীন বিধানাবলিতে আরেকটি বাধা সৃষ্টি করা হয়েছিল। ২০১১ সালের আগ পর্যন্ত সংবিধানে এই বিধান টিকে ছিল যে, বিচার বিভাগ পৃথক্করণ ‘যথাশীঘ্র’ বাস্তবায়ন করা হবে, যা এক-এগারোর আগে কখনো বাস্তবায়িত হয়নি। প্রধান বিচারপতি প্রবীণ আইনজীবী আবদুল বাছেত মজুমদারের আইন পেশায় ৫০ বছরের অনুষ্ঠানে ১১৬ক অনুচ্ছেদ বিষয়েও কথা বলেছেন।
তবে কেউ কেউ বলতে পারেন ১১৬ক থাকলে ক্ষতি কী। কারণ, সেখানে শুধু বিচারকার্যে বিচারকদের স্বাধীনতার কথাই বলা আছে। আমরা ১০ বছরের বেশি সময় ধরে জোরেশোরে বলে আসছি, ১১৬ অনুচ্ছেদকে মূল সংবিধানে, মানে বিচারক নিয়ন্ত্রণ কেবল সুপ্রিম কোর্টের কাছেই ন্যস্ত থাকবে। আমরা কখনো ১১৬ক নিয়ে আলাদাভাবে ভাবিনি। প্রধান বিচারপতি কেন ১১৬ক অনুচ্ছেদটিকেও অপসারণ করতে বলেছেন, তার উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছি। আমরা জানি যে মাসদার হোসেনসহ অনেক মামলাতেই আমাদের বিচারব্যবস্থা এতকাল এই অনুচ্ছেদটিকে বিচার বিভাগের স্বাধীনতাবান্ধব মনে করেছেন। কিন্তু এখন আমরা দেখলাম, চতুর্থ সংশোধনীতে ১১৫ ও ১১৬ অনুচ্ছেদ কর্তন ও ১১৬ক সংযোজন একত্রে করা হয়েছিল। এর উদ্দেশ্য (জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে) এই হতে পারে যে বিচারক নিয়ন্ত্রণে নির্বাহী বিভাগ তাঁর ভূমিকাকে ‘সংবিধানসম্মত’ করতে চেয়েছে। তাঁরা দ্বৈত বাঁধ সৃষ্টি করেছিলেন। আজকে আমরা যে ১১৬ অনুচ্ছেদ দেখি সেখানে জেনারেল জিয়ার অপেক্ষাকৃত ভালো ভূমিকা আছে। কারণ, বিচারক নিয়ন্ত্রণ পঞ্চম সংশোধনীতে রাষ্ট্রপতির কাছে ন্যস্ত রাখা ধরে রাখলেও বলা হয়েছে, সেটা সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শ করেই প্রযুক্ত হবে। কিন্তু ১১৬ক বলেছে, সংবিধানের বিধানাবলি সাপেক্ষে বিচারকেরা স্বাধীনতা ভোগ করবেন। তার মানে বিচারকেরা বিচারকার্য সম্পাদনকালে বিবেক ও ন্যায়পরায়ণতার সর্বজনীন নীতি নয়; বরং ‘সংবিধানের বিধানাবলির’ দিকে খেয়াল রাখবেন,
যা তাদের সর্বক্ষণ স্মরণ করায় যে, তাদের নিয়ন্ত্রক ক্ষমতাসীন দলের প্রধানমন্ত্রী। তাই আমরা প্রধান বিচারপতির সঙ্গে একমত যে ১১৬ ও ১১৬ক দুটোই সংবিধানের মৌলিক কাঠামোকে আঘাত করে। আমরা ১৯৭৫ সাল থেকে একটা ধাঁধায় ছিলাম, কী করে চতুর্থ সংশোধনীতে সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদে ‘সুপ্রিম কোর্ট’ মুছে দিয়ে ‘রাষ্ট্রপতি’ শব্দ প্রতিস্থাপন করা হয়েছিল। এ নিবন্ধ লিখতে গিয়ে সেই ধাঁধার একটি ব্যাখ্যা পেলাম। তানজানিয়ার জাতির জনক জুলিয়াস নায়ারে ১৯৬৪ সালে একদলীয় শাসন চালু করেছিলেন। চতুর্থ সংশোধনীতে অনেক কিছুই সেখান থেকে আমদানি করা। তবে ক্ষতিকরভাবে আনা হয়েছে। কারণ, সেখানে ১৯৬১ সালের সংবিধানেই কমিশন ছিল। এবং এই কমিশন বিচারক নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা দেখত। তানজানিয়ার বর্তমান সংবিধানের ১১৩ অনুচ্ছেদের ১ দফার (ক) উপদফায় বিচারকদের নিয়োগ প্রেসিডেন্টের কাছে ন্যস্ত রয়েছে। আবার (খ) উপদফায় বলা আছে, বিচারিক কর্মে নিয়োজিত কর্মকর্তাদের শৃঙ্খলা বিধানের অনুশীলন এবং তাঁদের অপসারণ জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের ওপর ন্যস্ত থাকবে।
কেনিয়ার সংবিধানের ১৭১ অনুচ্ছেদে নিয়োগ ও শৃঙ্খলা–সংক্রান্ত কমিশন গঠনের কথা আছে। আমরা মনে রাখব, বিচারক নিয়ন্ত্রণ ‘সুপ্রিম কোর্টের’ কাছে ন্যস্ত থাকার মানে কী, সেটা কিন্তু বাংলাদেশ সংবিধানে পরিষ্কার নেই। প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন জিএ (জেনারেল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন) কমিটি বদলি, হাইকোর্ট পদোন্নতি ও অপসারণ দেখেন। কোনো কোনো দেশে এই প্রক্রিয়ায় সংসদকেও যুক্ত করেছে। গাম্বিয়ায় প্রেসিডেন্ট প্রধান বিচারপতির পরামর্শে এবং সংসদের কনফারমেশন সাপেক্ষে কমিশনের সদস্য নিয়োগ দেন। প্রধান বিচারপতিই নেতা। সেখানে অ্যাটর্নি জেনারেলের মনোনয়নে একজন আইনজীবী এবং সংসদের মনোনয়নে একজন ও রাষ্ট্রপতি নিজ বিবেচনায় নিয়োগ দিতে পারেন একজনকে। আফ্রিকার আরেক দেশ মালাওয়ির সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদেও আমরা প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে এমন একটা জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশন দেখতে পাচ্ছি, যার কাজ শুধু বাংলাদেশের সার্ভিস কমিশনের মতো শুধুই বিচারক নিয়োগ নয়, বিচারকদের শৃঙ্খলা বিধানের বিষয়টিও তাদের কাজের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। সেখানে সদস্যদের মধ্যে সিভিল সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যানকেও রাখা হয়েছে। আমরা ২০০৭ সালের আগে পিএসসির মাধ্যমেই বিচারক পেতাম। অধস্তন আদালতের বিচারকদের স্বাধীনতার জন্য তাঁদের বিরুদ্ধে নেওয়া ব্যবস্থার বিষয়ে প্রতিকারের পথ সহজ থাকতে হবে। আমাদের দেশে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন জিএ কমিটি বা ফুলকোর্টের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে রিট দায়েরের উদহারণ রয়েছে। কিন্তু এই ব্যবস্থার মাধ্যমে দ্রুত প্রতিকারের পথ অনিশ্চিত। মালাওয়ির সংবিধানে আরও দেখতে পাচ্ছি, নিম্ন আদালতের বিচারকদের অপসারণেও জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের পরামর্শসাপেক্ষ
একধরনের অভিশংসন ব্যবস্থা চালু আছে। মালয়েশিয়ার প্রধান বিচারপতি সম্প্রতি আমাদের সুপ্রিম কোর্ট ঘুরে গেছেন। তাঁদের দেশের সংবিধানের ১৩৮ অনুচ্ছেদে জুডিশিয়াল অ্যান্ড লিগ্যাল সার্ভিস কমিশনের কথা বলা আছে। সেখানে সার্ভিস কমিশনের ‘সম্মতি’ ব্যতিরেকে বিচারকদের বিরুদ্ধে কোনো শৃঙ্খলামূলক পদক্ষেপ নেওয়া যায় না। ১৩৫ অনুচ্ছেদের ৩ উপদফা বলেছে, বিচারকার্য করতে গিয়ে তাঁদের কোনো অসদাচরণ বা ভুলের দায়ে সরকার কোনো ব্যবস্থা নিতে পারবে না। কিন্তু সরকারের যে কোনো বক্তব্য থাকতে পারে, সেটা প্রকারান্তরে স্বীকার করা হয়েছে। সরকারের বক্তব্য থাকলে সেটা দেখবেন অ্যাটর্নি জেনারেল। এখানে লক্ষণীয় যে তাদের লিগ্যাল সার্ভিস কমিশনটি কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের কোনো বিচারকের নেতৃত্বে করা হয়নি। কমিশনের দুজন সদস্য সংবিধান নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। বাকিদের প্রধান বিচারপতির সঙ্গে পরামর্শক্রমে মালয়েশিয়ার রাজা হাইকোর্টের কর্মরত, অবসরপ্রাপ্ত বা বিচারক হওয়ার যোগ্যতা থাকাদের মধ্য থেকে নিতে পারেন। আমরা এতকাল এটাই জেনে আসছি যে হাইকোর্টের রুলস মানে হাইকোর্ট কী করে চলবেন, সেটা শুধুই সুপ্রিম কোর্টের নিরঙ্কুশ এখতিয়ারের বিষয়। কিন্তু সলোমন আইল্যান্ডস সংবিধানে দেখলাম প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন রুলস কমিটিতে গভর্নর জেনারেল প্রধান বিচারপতির পরামর্শক্রমে উপযুক্ত যোগ্যতাসম্পন্ন নাগরিকদের নিয়ে থাকেন। ক্ষুদ্ররাষ্ট্র বলে চক্ষু চড়কগাছ করবেন না। কারণ, এরা বড় গণতন্ত্রের কলোনি ছিল। আর অন্তত সংবিধান লিখতে গিয়ে এরা সাধারণত বড় বড় আইনবিদের পরামর্শ মানেন। আধুনিক সংবিধানের আরেকটি প্রবণতা হচ্ছে, নিয়োগ ও অপসারণের ক্ষমতাসম্পন্ন সার্ভিস কমিশনগুলোকে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা। আমাদের জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনটি একটি মামুলি প্রজ্ঞাপনে টিকে আছে। এটির জায়গা সংবিধানের ভেতরে হতে হবে। আমরা যদি বলি ১৯৭৫ সালে তানজানিয়াকে কপি করেছি, তাহলে তানজানিয়াকে খাটো করা হবে।
কারণ, তানজানিয়া ১৯৬১ সালেই তার সংবিধানের ১১২ অনুচ্ছেদে বলেছে, ম্যাজিস্ট্রেট এবং অন্যান্য বিচারিক কর্মকর্তাদের নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশন থাকবে। আমরা মনে করি নিয়োগ ও অপসারণ একই সংস্থার কাছে থাকতে পারে। বর্তমান সংবিধানের আওতায় যদি সার্ভিস কমিশন নিয়োগ দিতে পারে। তাহলে তারা কেন শৃঙ্খলা ইত্যাদি দেখতে পারবে না। তানজানিয়ার সংবিধানে বিচারকদের শৃঙ্খলাবিধান প্রসঙ্গে ‘ডিভিশন অব পাওয়ার’ শব্দের উল্লেখ দেখলাম। কিন্তু আমাদের সংবিধান এই নীতির বিষয়ে নিশ্চুপ। আমরা প্রধান বিচারপতির সঙ্গে একমত। শুধু ভিন্নমত এতটুকু যে এটাই যথেষ্ট নয়। দুটো অনুচ্ছেদই নয়, অধস্তন আদালত নিয়ে থাকা ১১৪ থেকে ১১৬ক পুরোটাই ঢেলে সাজাতে হবে। সুপ্রিম কোর্ট যেভাবে সংবিধানের সৃষ্টি, সেভাবে অধস্তন আদালত নয়, তারা প্রধানত আইনের দ্বারা সৃষ্টি। বাহাত্তরের সংবিধানে ১১৫ অনুচ্ছেদে ‘জেলা জজ’ কথাটি ছিল। অথচ চতুর্থ সংশোধনীতে তা মুছে ফেলা হয়। বিচারকদের স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রণ করাটাই বর্তমান সংবিধানের লক্ষ্য। সংবিধানগতভাবেই তাঁরা এখন সরকার ও সংসদের মর্জির ওপর নির্ভরশীল। তবে দ্বৈত শাসন অবসানের উদ্দেশ্য যদি অধিকতর স্বচ্ছতা, অধিকতর স্বাধীনতা ও অধিকতর স্বাধীনতা প্রদানের নিশ্চয়তা হয়, তাহলে শুধু আর বাহাত্তরে ফেরাই যথেষ্ট নয়। তানজানিয়া, মালয়েশিয়া ও কেনিয়ার অভিজ্ঞতার আলোকে বিদ্যমান জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনে কিছুটা পরিবর্তন এনে (যেমন এর প্রধান হবেন প্রধান বিচারপতি) একে সংবিধানে জায়গা করে দিতে হবে বলে প্রতীয়মান হয়। তবে আমরা পুনশ্চ বলব, আমরা কিন্তু প্রধানত প্রধান বিচারপতির সঙ্গেই একমত।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷
mrkhanbd@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.