স্বস্তিটা স্থায়ী হোক by হাসান শফি
সব
জল্পনা-কল্পনা ও সন্দেহ-সংশয়ের অবসান ঘটিয়ে বিএনপি দলীয় প্রার্থীরা অবশেষে
ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন।
নির্বাচনে কারা জিতবে বা হারবে, ভোট গ্রহণ ও ফলাফল ঘোষণা সঠিক বা
সুষ্ঠুভাবে হতে পারবে কি না, বিরোধী দলীয় প্রার্থীরা শেষাবধি লড়াইয়ে টিকে
থাকবেন কি না এবং তাঁরা লড়াইটা উপভোগ করতে পারবেন কি না, এসব জরুরি
প্রশ্নকে পাশে ঠেলে, আপাতত দেশের প্রধান বিরোধী দলের প্রার্থীদের এই
নির্বাচনে আসার সংবাদটিই সবার জন্য অপার স্বস্তি বয়ে এনেছে। স্বস্তির কারণ
মানুষের এই আশাবাদ, দেশের প্রধান দুই মহানগরীর নির্বাচনী উত্তেজনা যদি
দেশবাসীকে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সহিংসতা থেকে সাময়িকভাবে হলেও মুক্তি
দেয়। বিরোধী দল ও সরকার উভয়ের জন্যই এটি সংকট থেকে পরিত্রাণের একটি সহজ
উপায় হতে পারে। যদি তাঁরা বিষয়টিকে সেভাবে ও ততটা গুরুত্ব দিয়ে বোঝেন এবং
গ্রহণ করেন। এ ব্যাপারে তাঁদের কোনো এক তরফের যে-কোনো অবিমৃষ্যকারী পদক্ষেপ
শুধু সংকটকেই গভীরতর করবে না, দেশ ও দেশবাসীর জন্য এক ভয়াবহ ভবিষ্যৎকে
ডেকে আনবে। পেট্রলবোমা-ককটেল, গুম-খুন ইত্যাদি সন্ত্রাস-সহিংসতার মধ্য দিয়ে
দেশ ইতিমধ্যেই যে ভবিষ্যতের দিকে পা বাড়িয়েছে। সরকার তাদের দিক থেকে
নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে সম্পন্ন হতে দিয়ে, বিরোধী দলের প্রার্থী ও
তাঁদের সমর্থকদের জন্য নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় সমান অংশগ্রহণের সুযোগ
উন্মুক্ত করে এবং নির্বাচনের ফলাফল যাই হোক, তাকে সহজভাবে মেনে নিয়ে তাদের
প্রজ্ঞা, দেশপ্রেম ও গণতন্ত্রের প্রতি আস্থার প্রমাণ দিতে পারে। যেভাবে
তারা কিছুদিন আগে অন্য সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনগুলোর ক্ষেত্রে দিয়েছে।
দিয়েছে বিরোধী দলও, অতীতে তারা যখন সরকারে ছিল তখন অনুষ্ঠিত একই ধরনের
স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোর বেলায়। বিরোধী দলেরও উচিত হবে তাদের সামপ্রতিক
সরকার পতনের অসফল আন্দোলনের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে, আসন্ন দুটি সিটি
কর্পোরেশন নির্বাচনকেই নিজেদের জনপ্রিয়তা যাচাই ও প্রমাণের উপায় হিসেবে
গ্রহণ করা। বর্তমান নির্বাচন কমিশনের জন্যও এটা হবে তাদের ভাবমূর্তি
পুনরুদ্ধার ও প্রতিষ্ঠার এক মহাসুযোগ। যা হয়তো আগামীতে তাদের পরিচালনায়
জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে বিরোধী দলের মধ্যে আস্থার মনোভাব
সৃষ্টিতে সহায়ক হবে।
সিটি বা মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন, উপজেলা পরিষদ ও ইউনিয়ন কাউন্সিলের মতো স্থানীয় সরকারগুলোর নির্বাচন অবশ্য আমাদের দেশে দলীয় ভিত্তিতে বা পরিচয়ে হয় না। তবে এ হলো নিয়ম বা আইনের কথা। আর কথাটা এই অর্থে ঠিক যে, প্রার্থীরা এসব নির্বাচনে দলীয় প্রতীক ব্যবহার করতে পারেন না। কিন্তু বাস্তবতা হলো, প্রায় সব ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থন নিয়েই প্রার্থীরা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার আগেই দল, বিশেষ করে বড় দলগুলোর, মনোনয়ন বা সমর্থন লাভের জন্য প্রার্থীদের একদফা প্রচার-প্রচারণা বা লড়াই-সংগ্রামে নামতে হয়। নির্বাচনের পর বিজয়ী প্রার্থীর সাফল্যকে রাজনৈতিক দলগুলো সব সময় নিজেদের দলীয় রাজনীতির সঠিকতা ও জনপ্রিয়তার প্রমাণ হিসেবে বিবেচনা ও জাহির করে। উল্টোদিকে আবার যে-দলের প্রার্থী হেরে যায়, তারা এ নির্বাচন যে নির্দলীয়, সে-কথা ভেবে ও বলে আত্মতৃপ্তি খুঁজতে চেষ্টা করে। নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন লাভে ব্যর্থ হয়ে কেউ কেউ অবশ্য স্বতন্ত্রভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এবং হয়তো জিতেও যান। সেক্ষেত্রে নির্বাচনের পর তাঁরা আবার দলের আশ্রয়েই ফিরে যান এবং দলও তাঁদেরকে সাদরে গ্রহণ করে। কোনো দলের সমর্থন ছাড়া সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তার বলে যদি কেউ কখনো নির্বাচনে জেতেন, তাঁকেও কিন্তু পরে সাধারণত দলে, বিশেষ করে ক্ষমতাসীন বা অন্য বড় দলে যোগ দিতে হয়। কারণ তিনি জানেন, এছাড়া তাঁর পক্ষে নির্বাচনমন্ডলী বা এলাকার স্বার্থে তেমন কিছু করা সম্ভব হবে না। আমাদের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা ও তার নির্বাচনের এই বাস্তবতার দিকটি সম্পর্কে আমরা সবাই কমবেশি অবহিত। উপরন্তু খোদ সরকার প্রধান যখন (নির্বাচন কমিশন কর্তৃক নির্বাচনী তফসিল ঘোষণারও আগে) মন্ত্রিসভার বৈঠকে সিটি কর্পোরেশনের মেয়র পদে দলের পক্ষে কাউকে মনোনীত করার কথা বলেন, এবং তা খবর হয়ে সংবাদপত্রে আসে, কিংবা পরেও যখন গণভবন থেকে সরকার দলীয় প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করা হয়, কাউকে কাউকে নির্দেশ দিয়ে বসিয়ে দেওয়া হয়, এমন কি দল চায় না বলে মেয়র পদে প্রার্থী হতে ইচ্ছুক কোনো সাংসদের সদস্যপদে ইস্তফাপত্র ছিঁড়ে ফেলাও হয়, তখন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনকে আর যাই হোক 'নির্দলীয়' বলার যৌক্তিকতা কোথায়? শুধু সরকারি দলই নয়, 'শত নাগরিক কমিটি' বা 'সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদ' এর ব্যানারে নির্বাচন করছে তো আসলে বিএনপি বা বিশদলীয় জোটের প্রার্থীরাই। তাদেরও প্রার্থী চূড়ান্ত করবেন বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়াই। একই কথা প্রযোজ্য অন্যান্য ছোট ছোট দলের প্রার্থীদের সম্পর্কেও।
অন্তত সিটি কর্পোরেশনের মতো বড় স্থানীয় সরকার নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রার্থীর ব্যক্তিগত যোগ্যতা ও জনপ্রিয়তা ছাড়াও, জাতীয় রাজনীতিও ইতিবাচক কিংবা নেতিবাচকভাবে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ প্রসঙ্গে একটি সাম্প্রতিক উদাহরণ দিই। রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের বিগত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থী তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি বা বিশদলীয় জোট প্রার্থীর কাছে বিপুল ভোটে পরাজিত হয়েছেন। যদিও আগেও শুনেছি, কদিন আগে রাজশাহীতে গিয়ে নানাজনের মত-মন্তব্য থেকেও ধারণা হল, আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থী খায়রুজ্জামান লিটু মেয়র হিসেবে তাঁর কর্মকালীন রাজশাহী নগরীর উন্নয়ন ও সেখানকার নাগরিক স্বাচ্ছন্দ্য বৃদ্ধিতে যে ভূমিকা রেখেছেন তার জন্য এবং তাঁর ব্যক্তিগত পরিচিতি ও জনপ্রিয়তার কারণেও, তাঁর ওভাবে হারবার কথা নয়। বস্তুত তাঁর দলীয় বা রাজনৈতিক পরিচয়ই তাঁর বিপক্ষে গেছে। তাঁর রাজনৈতিক বিরোধীরাও এমনটাই মনে করেন। এই যে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে জাতীয় রাজনীতির প্রভাব, একে কি আমরা ইতিবাচকভাবে দেখব? বিশেষ করে নাগরিক স্বার্থের দৃষ্টিকোণ থেকে?
এবার ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিএনপির প্রতিদ্বন্দ্বিতার সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে থেকেই, কিংবা বলা যায় নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের ঘোষণা দেওয়ার পরপরই, বিরোধী দল ও অন্যান্য মহল থেকে নির্বাচনের জন্য 'লেভেল প্লেইং ফিল্ড' অর্থাৎ সবার জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টির দাবিটি উঠে আসে। বোধহয় একমাত্র সরকারি দল ছাড়া দলমত নির্বিশেষে সমগ্র দেশবাসীর দাবি ও প্রত্যাশাও এই মুহূর্তে সেটাই। বলা বাহুল্য, নির্বাচনী মাঠে সবার জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি ছাড়া নির্বাচন তার গ্রহণযোগ্যতা হারাতে বাধ্য। অথচ আজকের পরিস্থিতিটা কী? নির্বাচনে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রীয় নেতাসহ অনেক নেতা-কর্মীই আজ জেলে। জামিনযোগ্য অভিযোগেই তাঁদের অনেকে বন্দি। অনেকেই আবার গ্রেফতার এড়াতে বা গুম-খুন থেকে বাঁচতে পলাতক বা আত্মগোপন অবস্থায় রয়েছেন। সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, এখনও জেলের বাইরে আছেন বা অভিযুক্ত নন, এমন অনেক নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধেও মামলা দেওয়ার প্রস্তুতি চলছে। এ অবস্থাটাকে যদি বিরোধী দলীয় প্রার্থী ও তাঁদের সমর্থকরা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার অনুকূল মনে না করেন, আর সে অজুহাতে যদি তাঁরা শেষ মুহূর্তেও নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান, তা হলে ব্যাপারটা কী দাঁড়াবে? তেমন ইঙ্গিত যে বিরোধী দল এমন কি তাদের শীর্ষনেত্রীর তরফ থেকে ইতিমধ্যে দেওয়া হয় নি তা নয়। সরকারও কি আসলে তেমন কিছুই চাইছে? ২০১৪ এর ৫ জানুয়ারির সাধারণ নির্বাচনের মতো সে রকম খালি মাঠে একতরফা জয়লাভের মধ্য দিয়ে সরকারি দল যা হয়তো লাভ করবে, হারাবে তার চেয়ে অনেকগুণ বেশি। এই সত্যটা উপলব্ধি করার ক্ষমতা দলটির নেতৃত্বের নেই, একথা বিশ্বাস করা শক্ত। আমরা তা বিশ্বাস করতেও চাই না। তারপরও নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী দলীয় নেতা ও কর্মীদের কারো কারো এমন অনায়াস জয়লাভের ব্যাপারে আগ্রহ থাকতেই পারে। আর তার জন্য তাঁদের চেষ্টাও হয়তো থাকবে। সেক্ষেত্রে নেতৃত্বের দায়িত্ব হবে তাঁদের নিয়ন্ত্রণ ও নিবৃত্ত করা। এ ব্যাপারে বড় ভূমিকাটা অবশ্য নিতে পারে নির্বাচন কমিশন। আর তাঁদের সেটা কর্তব্যও। তবে রাজনৈতিক সরকারের সদিচ্ছার অভাবে তাঁরা কতোটা কী করতে পারবেন, তা নিয়ে সব মহলেই কমবেশি সন্দেহ ও অবিশ্বাস রয়েছে। সে সন্দেহকে অমূলক প্রমাণ করার সুযোগ তাঁরা অতীতে কাজে লাগাতে পারেন নি।
এবার সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপি ও বিশদলীয় জোটের পক্ষে তাঁদের সমর্থক বুদ্ধিজীবীদের একটি গ্রুপ 'শত নাগরিক কমিটি'র প্রতিনিধিরা প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে দেখা করেন। সাক্ষাৎকালে তাঁরা কমিশনের কাছে নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও পক্ষপাতহীন করার স্বার্থে কিছু দাবি পেশ করেন। যার অধিকাংশই যে-কোনো নির্বাচনের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য বলে আমরা মনে করি। সাক্ষাৎ শেষে বেরিয়ে এসে প্রতিনিধি দল সাংবাদিকদের বলেছিলেন, প্রধান নির্বাচন কমিশনার তাঁদের দাবি বা সুপারিশগুলো বিবেচনার আশ্বাস দিয়েছেন। এ ব্যাপারে কমিশনের সক্রিয়তার দৃশ্যযোগ্য কোনো প্রমাণ অবশ্য এখনও পাওয়া যায় নি। তবু আমরা আশা রাখতে চাই। আশা করতে চাই, আমাদের সংবিধান নির্বাচন কমিশনকে যতোটা ক্ষমতা ও স্বাধীনতা দিয়েছে, তার পুরো সদ্ব্যবহার তারা এই নির্বাচনে করে দেখাবেন। যা হয়তো আগামী দিনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনসহ অন্যান্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারেও নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতায় আমাদের আস্থা জোগাবে। বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের নতুন কোনো উপায় বা বিকল্পের ইঙ্গিত দেবে। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং সে উদ্দেশ্যে প্রতিদ্বন্দ্বী সব দল ও প্রার্থীদের জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করতে, নির্বাচন কমিশন অন্তত নির্বাচনকালীন সময়টিতে বিরোধী দলের বিরুদ্ধে হামলা-মামলা বন্ধ করার জন্য প্রশাসনকে বলতে পারেন। সরকারকে পরামর্শ দিতে পারেন জামিনযোগ্য এমন বিচারাধীন মামলার আসামি রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীদের মুক্তি দিয়ে তাঁদেরকে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশগ্রহণ ও তাঁদের ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ দিতে, নতুন ধরপাকড় বন্ধ রাখতে। সরকার যদি তাঁদের কথায় কর্ণপাত না করে সেটা নির্বাচকমন্ডলী ও দেশবাসী দেখবে। কিন্তু তাঁরা অন্তত তাঁদের কর্তব্যটুকু করে দেখান।
আমাদের সংবিধান স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলোকে যে-ক্ষমতা বা স্বাধীনতা দিয়েছে, কার্যক্ষেত্রে তার সামান্যই তারা অনুশীলন করতে পারে। প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ আমাদের সব দলেরই রাজনৈতিক অঙ্গীকার হলেও, দলীয় ঘোষণাপত্র ও নির্বাচনী ইস্তাহারের বাইরে তার তেমন প্রয়োগযোগ্যতা নেই। কারণ আমাদের রাজনৈতিক অভ্যাস বা প্রবণতা হল ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করার দিকে। রাজনৈতিক দলগুলোর নিজেদের বেলায় যেমন, সরকার বা প্রশাসনের ক্ষেত্রেও কথাটা তেমনই সত্য। অথচ ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের শর্ত পূরণ না করে গণতন্ত্রের চর্চা অসম্ভব। তাই হয়তো আমাদের দেশে গণতন্ত্র আজও খুঁড়িয়ে হাঁটছে। সংসদ সদস্যদের ভূমিকা আইন প্রণেতার, অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় নীতি নির্ধারণ প্রক্রিয়ায় তাঁরা অংশগ্রহণ করবেন। আর সেটি কেন্দ্রীয় বা জাতীয় পর্যায়ের কাজ। অবশ্য জনপ্রতিনিধি হিসেবে স্থানীয় সমস্যা, উন্নয়ন, জনস্বার্থ ও কল্যাণ বিষয়ে তাঁদের কোনোরকম ভূমিকা বা সংশ্লিষ্টতা থাকবে না, তা বলা মোটেও আমাদের উদ্দেশ্য নয়। তবে তা হবে পরামর্শ বা তদারকি পর্যায়ে। কিন্তু উপজেলা পরিষদের মতো একটি স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা চালু থাকার পরও, তাঁরা উপজেলার উন্নয়ন কাজ থেকে ত্রাণ বিতরণ সব ব্যাপারেই নিয়ন্ত্রক ভূমিকা নিতে চান। এ নিয়ে উপজেলা চেয়ারম্যানদের সঙ্গে তাঁদের একটা দ্বন্দ্ব লেগেই আছে। কখনো কখনো তা বিশ্রিরকম চেহারাও নেয়। আর উপজেলা চেয়ারম্যান ও স্থানীয় সাংসদ দুজন যদি হন ভিন্ন রাজনৈতিক দলের অনুসারী তবে তো কথাই নেই! সংবিধান স্থানীয় সরকারকে যেটুকু ক্ষমতা দিয়েছে, তাও কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে অনেক সময় সহ্য করা কঠিন হয়ে পড়ে। ফলে যখন যারা সরকারে থাকে তাদের দিক থেকে স্থানীয় সরকার নির্বাচনকে প্রভাবিত করার, স্থানীয় সরকারের কাজে হস্তক্ষেপ, এমনকি তাদের জনকল্যাণমূলক কাজেও বাধা সৃষ্টির চেষ্টা চলে। অনেক সময় রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থেকে স্থানীয় সরকার প্রধানের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের, হয়রানি এমন কি তাঁকে বরখাস্ত করে সরকারি প্রশাসক কিংবা নিজ দলীয় প্যানেল চেয়ারম্যানকে তাঁর স্থলাভিষিক্ত করা হয়। এ সবই আসলে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি অনুশীলনের ব্যাপারে আমাদের অনাগ্রহ বা আন্তরিকতার অভাবকে তুলে ধরে। কোনো জনপ্রতিনিধিও যদি ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্ত হন, আইন অনুযায়ী মামলা চলাকালীন তাঁকে সাময়িক বরখাস্ত করা যেতেই পারে। কিন্তু এই আইনটিও তো দলীয় পরিচয় নির্বিশেষে সবার বেলায় সমানভাবে প্রযোজ্য হওয়া উচিত। কিন্তু তাই কি হচ্ছে? সরকার দলীয়দের ক্ষেত্রে মামলা প্রত্যাহার ও বিরোধী দলীয়দের বেলায় তা জিইয়ে রেখে প্রয়োজনে অর্থাৎ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সময়মতো তার ব্যবহার হচ্ছে নাকি? এ অবস্থায় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নূ্যনতম পারস্পরিক আস্থার মনোভাব তৈরি হওয়া কি সম্ভব? আর ওই আস্থাটুকু ছাড়া গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি দেওয়ার কথা কি আগামী দিনেও স্রেফ বাত-কি-বাত হয়েই থাকবে না? তা যে-পক্ষ থেকেই বলা হোক না কেন।
হাসান শফি : লেখক ও চিন্তক
সিটি বা মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন, উপজেলা পরিষদ ও ইউনিয়ন কাউন্সিলের মতো স্থানীয় সরকারগুলোর নির্বাচন অবশ্য আমাদের দেশে দলীয় ভিত্তিতে বা পরিচয়ে হয় না। তবে এ হলো নিয়ম বা আইনের কথা। আর কথাটা এই অর্থে ঠিক যে, প্রার্থীরা এসব নির্বাচনে দলীয় প্রতীক ব্যবহার করতে পারেন না। কিন্তু বাস্তবতা হলো, প্রায় সব ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থন নিয়েই প্রার্থীরা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার আগেই দল, বিশেষ করে বড় দলগুলোর, মনোনয়ন বা সমর্থন লাভের জন্য প্রার্থীদের একদফা প্রচার-প্রচারণা বা লড়াই-সংগ্রামে নামতে হয়। নির্বাচনের পর বিজয়ী প্রার্থীর সাফল্যকে রাজনৈতিক দলগুলো সব সময় নিজেদের দলীয় রাজনীতির সঠিকতা ও জনপ্রিয়তার প্রমাণ হিসেবে বিবেচনা ও জাহির করে। উল্টোদিকে আবার যে-দলের প্রার্থী হেরে যায়, তারা এ নির্বাচন যে নির্দলীয়, সে-কথা ভেবে ও বলে আত্মতৃপ্তি খুঁজতে চেষ্টা করে। নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন লাভে ব্যর্থ হয়ে কেউ কেউ অবশ্য স্বতন্ত্রভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এবং হয়তো জিতেও যান। সেক্ষেত্রে নির্বাচনের পর তাঁরা আবার দলের আশ্রয়েই ফিরে যান এবং দলও তাঁদেরকে সাদরে গ্রহণ করে। কোনো দলের সমর্থন ছাড়া সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তার বলে যদি কেউ কখনো নির্বাচনে জেতেন, তাঁকেও কিন্তু পরে সাধারণত দলে, বিশেষ করে ক্ষমতাসীন বা অন্য বড় দলে যোগ দিতে হয়। কারণ তিনি জানেন, এছাড়া তাঁর পক্ষে নির্বাচনমন্ডলী বা এলাকার স্বার্থে তেমন কিছু করা সম্ভব হবে না। আমাদের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা ও তার নির্বাচনের এই বাস্তবতার দিকটি সম্পর্কে আমরা সবাই কমবেশি অবহিত। উপরন্তু খোদ সরকার প্রধান যখন (নির্বাচন কমিশন কর্তৃক নির্বাচনী তফসিল ঘোষণারও আগে) মন্ত্রিসভার বৈঠকে সিটি কর্পোরেশনের মেয়র পদে দলের পক্ষে কাউকে মনোনীত করার কথা বলেন, এবং তা খবর হয়ে সংবাদপত্রে আসে, কিংবা পরেও যখন গণভবন থেকে সরকার দলীয় প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করা হয়, কাউকে কাউকে নির্দেশ দিয়ে বসিয়ে দেওয়া হয়, এমন কি দল চায় না বলে মেয়র পদে প্রার্থী হতে ইচ্ছুক কোনো সাংসদের সদস্যপদে ইস্তফাপত্র ছিঁড়ে ফেলাও হয়, তখন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনকে আর যাই হোক 'নির্দলীয়' বলার যৌক্তিকতা কোথায়? শুধু সরকারি দলই নয়, 'শত নাগরিক কমিটি' বা 'সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদ' এর ব্যানারে নির্বাচন করছে তো আসলে বিএনপি বা বিশদলীয় জোটের প্রার্থীরাই। তাদেরও প্রার্থী চূড়ান্ত করবেন বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়াই। একই কথা প্রযোজ্য অন্যান্য ছোট ছোট দলের প্রার্থীদের সম্পর্কেও।
অন্তত সিটি কর্পোরেশনের মতো বড় স্থানীয় সরকার নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রার্থীর ব্যক্তিগত যোগ্যতা ও জনপ্রিয়তা ছাড়াও, জাতীয় রাজনীতিও ইতিবাচক কিংবা নেতিবাচকভাবে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ প্রসঙ্গে একটি সাম্প্রতিক উদাহরণ দিই। রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের বিগত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থী তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি বা বিশদলীয় জোট প্রার্থীর কাছে বিপুল ভোটে পরাজিত হয়েছেন। যদিও আগেও শুনেছি, কদিন আগে রাজশাহীতে গিয়ে নানাজনের মত-মন্তব্য থেকেও ধারণা হল, আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থী খায়রুজ্জামান লিটু মেয়র হিসেবে তাঁর কর্মকালীন রাজশাহী নগরীর উন্নয়ন ও সেখানকার নাগরিক স্বাচ্ছন্দ্য বৃদ্ধিতে যে ভূমিকা রেখেছেন তার জন্য এবং তাঁর ব্যক্তিগত পরিচিতি ও জনপ্রিয়তার কারণেও, তাঁর ওভাবে হারবার কথা নয়। বস্তুত তাঁর দলীয় বা রাজনৈতিক পরিচয়ই তাঁর বিপক্ষে গেছে। তাঁর রাজনৈতিক বিরোধীরাও এমনটাই মনে করেন। এই যে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে জাতীয় রাজনীতির প্রভাব, একে কি আমরা ইতিবাচকভাবে দেখব? বিশেষ করে নাগরিক স্বার্থের দৃষ্টিকোণ থেকে?
এবার ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিএনপির প্রতিদ্বন্দ্বিতার সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে থেকেই, কিংবা বলা যায় নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের ঘোষণা দেওয়ার পরপরই, বিরোধী দল ও অন্যান্য মহল থেকে নির্বাচনের জন্য 'লেভেল প্লেইং ফিল্ড' অর্থাৎ সবার জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টির দাবিটি উঠে আসে। বোধহয় একমাত্র সরকারি দল ছাড়া দলমত নির্বিশেষে সমগ্র দেশবাসীর দাবি ও প্রত্যাশাও এই মুহূর্তে সেটাই। বলা বাহুল্য, নির্বাচনী মাঠে সবার জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি ছাড়া নির্বাচন তার গ্রহণযোগ্যতা হারাতে বাধ্য। অথচ আজকের পরিস্থিতিটা কী? নির্বাচনে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রীয় নেতাসহ অনেক নেতা-কর্মীই আজ জেলে। জামিনযোগ্য অভিযোগেই তাঁদের অনেকে বন্দি। অনেকেই আবার গ্রেফতার এড়াতে বা গুম-খুন থেকে বাঁচতে পলাতক বা আত্মগোপন অবস্থায় রয়েছেন। সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, এখনও জেলের বাইরে আছেন বা অভিযুক্ত নন, এমন অনেক নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধেও মামলা দেওয়ার প্রস্তুতি চলছে। এ অবস্থাটাকে যদি বিরোধী দলীয় প্রার্থী ও তাঁদের সমর্থকরা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার অনুকূল মনে না করেন, আর সে অজুহাতে যদি তাঁরা শেষ মুহূর্তেও নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান, তা হলে ব্যাপারটা কী দাঁড়াবে? তেমন ইঙ্গিত যে বিরোধী দল এমন কি তাদের শীর্ষনেত্রীর তরফ থেকে ইতিমধ্যে দেওয়া হয় নি তা নয়। সরকারও কি আসলে তেমন কিছুই চাইছে? ২০১৪ এর ৫ জানুয়ারির সাধারণ নির্বাচনের মতো সে রকম খালি মাঠে একতরফা জয়লাভের মধ্য দিয়ে সরকারি দল যা হয়তো লাভ করবে, হারাবে তার চেয়ে অনেকগুণ বেশি। এই সত্যটা উপলব্ধি করার ক্ষমতা দলটির নেতৃত্বের নেই, একথা বিশ্বাস করা শক্ত। আমরা তা বিশ্বাস করতেও চাই না। তারপরও নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী দলীয় নেতা ও কর্মীদের কারো কারো এমন অনায়াস জয়লাভের ব্যাপারে আগ্রহ থাকতেই পারে। আর তার জন্য তাঁদের চেষ্টাও হয়তো থাকবে। সেক্ষেত্রে নেতৃত্বের দায়িত্ব হবে তাঁদের নিয়ন্ত্রণ ও নিবৃত্ত করা। এ ব্যাপারে বড় ভূমিকাটা অবশ্য নিতে পারে নির্বাচন কমিশন। আর তাঁদের সেটা কর্তব্যও। তবে রাজনৈতিক সরকারের সদিচ্ছার অভাবে তাঁরা কতোটা কী করতে পারবেন, তা নিয়ে সব মহলেই কমবেশি সন্দেহ ও অবিশ্বাস রয়েছে। সে সন্দেহকে অমূলক প্রমাণ করার সুযোগ তাঁরা অতীতে কাজে লাগাতে পারেন নি।
এবার সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপি ও বিশদলীয় জোটের পক্ষে তাঁদের সমর্থক বুদ্ধিজীবীদের একটি গ্রুপ 'শত নাগরিক কমিটি'র প্রতিনিধিরা প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে দেখা করেন। সাক্ষাৎকালে তাঁরা কমিশনের কাছে নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও পক্ষপাতহীন করার স্বার্থে কিছু দাবি পেশ করেন। যার অধিকাংশই যে-কোনো নির্বাচনের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য বলে আমরা মনে করি। সাক্ষাৎ শেষে বেরিয়ে এসে প্রতিনিধি দল সাংবাদিকদের বলেছিলেন, প্রধান নির্বাচন কমিশনার তাঁদের দাবি বা সুপারিশগুলো বিবেচনার আশ্বাস দিয়েছেন। এ ব্যাপারে কমিশনের সক্রিয়তার দৃশ্যযোগ্য কোনো প্রমাণ অবশ্য এখনও পাওয়া যায় নি। তবু আমরা আশা রাখতে চাই। আশা করতে চাই, আমাদের সংবিধান নির্বাচন কমিশনকে যতোটা ক্ষমতা ও স্বাধীনতা দিয়েছে, তার পুরো সদ্ব্যবহার তারা এই নির্বাচনে করে দেখাবেন। যা হয়তো আগামী দিনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনসহ অন্যান্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারেও নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতায় আমাদের আস্থা জোগাবে। বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের নতুন কোনো উপায় বা বিকল্পের ইঙ্গিত দেবে। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং সে উদ্দেশ্যে প্রতিদ্বন্দ্বী সব দল ও প্রার্থীদের জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করতে, নির্বাচন কমিশন অন্তত নির্বাচনকালীন সময়টিতে বিরোধী দলের বিরুদ্ধে হামলা-মামলা বন্ধ করার জন্য প্রশাসনকে বলতে পারেন। সরকারকে পরামর্শ দিতে পারেন জামিনযোগ্য এমন বিচারাধীন মামলার আসামি রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীদের মুক্তি দিয়ে তাঁদেরকে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশগ্রহণ ও তাঁদের ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ দিতে, নতুন ধরপাকড় বন্ধ রাখতে। সরকার যদি তাঁদের কথায় কর্ণপাত না করে সেটা নির্বাচকমন্ডলী ও দেশবাসী দেখবে। কিন্তু তাঁরা অন্তত তাঁদের কর্তব্যটুকু করে দেখান।
আমাদের সংবিধান স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলোকে যে-ক্ষমতা বা স্বাধীনতা দিয়েছে, কার্যক্ষেত্রে তার সামান্যই তারা অনুশীলন করতে পারে। প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ আমাদের সব দলেরই রাজনৈতিক অঙ্গীকার হলেও, দলীয় ঘোষণাপত্র ও নির্বাচনী ইস্তাহারের বাইরে তার তেমন প্রয়োগযোগ্যতা নেই। কারণ আমাদের রাজনৈতিক অভ্যাস বা প্রবণতা হল ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করার দিকে। রাজনৈতিক দলগুলোর নিজেদের বেলায় যেমন, সরকার বা প্রশাসনের ক্ষেত্রেও কথাটা তেমনই সত্য। অথচ ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের শর্ত পূরণ না করে গণতন্ত্রের চর্চা অসম্ভব। তাই হয়তো আমাদের দেশে গণতন্ত্র আজও খুঁড়িয়ে হাঁটছে। সংসদ সদস্যদের ভূমিকা আইন প্রণেতার, অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় নীতি নির্ধারণ প্রক্রিয়ায় তাঁরা অংশগ্রহণ করবেন। আর সেটি কেন্দ্রীয় বা জাতীয় পর্যায়ের কাজ। অবশ্য জনপ্রতিনিধি হিসেবে স্থানীয় সমস্যা, উন্নয়ন, জনস্বার্থ ও কল্যাণ বিষয়ে তাঁদের কোনোরকম ভূমিকা বা সংশ্লিষ্টতা থাকবে না, তা বলা মোটেও আমাদের উদ্দেশ্য নয়। তবে তা হবে পরামর্শ বা তদারকি পর্যায়ে। কিন্তু উপজেলা পরিষদের মতো একটি স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা চালু থাকার পরও, তাঁরা উপজেলার উন্নয়ন কাজ থেকে ত্রাণ বিতরণ সব ব্যাপারেই নিয়ন্ত্রক ভূমিকা নিতে চান। এ নিয়ে উপজেলা চেয়ারম্যানদের সঙ্গে তাঁদের একটা দ্বন্দ্ব লেগেই আছে। কখনো কখনো তা বিশ্রিরকম চেহারাও নেয়। আর উপজেলা চেয়ারম্যান ও স্থানীয় সাংসদ দুজন যদি হন ভিন্ন রাজনৈতিক দলের অনুসারী তবে তো কথাই নেই! সংবিধান স্থানীয় সরকারকে যেটুকু ক্ষমতা দিয়েছে, তাও কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে অনেক সময় সহ্য করা কঠিন হয়ে পড়ে। ফলে যখন যারা সরকারে থাকে তাদের দিক থেকে স্থানীয় সরকার নির্বাচনকে প্রভাবিত করার, স্থানীয় সরকারের কাজে হস্তক্ষেপ, এমনকি তাদের জনকল্যাণমূলক কাজেও বাধা সৃষ্টির চেষ্টা চলে। অনেক সময় রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থেকে স্থানীয় সরকার প্রধানের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের, হয়রানি এমন কি তাঁকে বরখাস্ত করে সরকারি প্রশাসক কিংবা নিজ দলীয় প্যানেল চেয়ারম্যানকে তাঁর স্থলাভিষিক্ত করা হয়। এ সবই আসলে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি অনুশীলনের ব্যাপারে আমাদের অনাগ্রহ বা আন্তরিকতার অভাবকে তুলে ধরে। কোনো জনপ্রতিনিধিও যদি ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্ত হন, আইন অনুযায়ী মামলা চলাকালীন তাঁকে সাময়িক বরখাস্ত করা যেতেই পারে। কিন্তু এই আইনটিও তো দলীয় পরিচয় নির্বিশেষে সবার বেলায় সমানভাবে প্রযোজ্য হওয়া উচিত। কিন্তু তাই কি হচ্ছে? সরকার দলীয়দের ক্ষেত্রে মামলা প্রত্যাহার ও বিরোধী দলীয়দের বেলায় তা জিইয়ে রেখে প্রয়োজনে অর্থাৎ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সময়মতো তার ব্যবহার হচ্ছে নাকি? এ অবস্থায় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নূ্যনতম পারস্পরিক আস্থার মনোভাব তৈরি হওয়া কি সম্ভব? আর ওই আস্থাটুকু ছাড়া গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি দেওয়ার কথা কি আগামী দিনেও স্রেফ বাত-কি-বাত হয়েই থাকবে না? তা যে-পক্ষ থেকেই বলা হোক না কেন।
হাসান শফি : লেখক ও চিন্তক
No comments