হুমায়ূন আহমেদ সুপ্রভা, এবং... by সাজেদুল হক
স্বামীর
অপেক্ষায় স্ত্রী। বাবার অপেক্ষায় সন্তান। ছেলের অপেক্ষায় মা। প্রয়াত
ঔপন্যাসিক হুমায়ূন আহমেদের অপেক্ষা উপন্যাসে এভাবেই অপেক্ষায় থাকে একটি
পরিবার। হঠাৎ একদিন ঘর থেকে বের হয়ে মানুষটি আর ফিরে আসেন না। রাত দিন
অপেক্ষা করতে থাকেন পরিবারের সদস্যরা। কখন বুঝি বাসার কলিংবেল বেজে উঠবে,
কখন বুঝি ফিরে আসবেন পরিবারের প্রিয় মানুষটি। বাংলাদেশের অনেক পরিবারই
এখন এমন অপেক্ষায় রয়েছে। হঠাৎ হঠাৎ তারা হারিয়ে ফেলছেন তাদের পরিবারের
প্রিয় মানুষটিকে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে তুলে নিয়ে
যাওয়া হচ্ছে তাদের। সৌভাগ্যবান দু-একজন ফিরে আসছেন। কারও লাশ মিলছে। আর
কারও খোঁজ মিলছে না। ছাত্রদলের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক আনিসুর রহমান
তালুকদার খোকনের কথাই ধরুন না কেন? ফুটফুটে দুটি কন্যা সন্তান তার। পালিয়ে
থাকলেও একদিন এদের টানেই ফিরে এসেছিলেন বাড়িতে। আর সে রাতেই তুলে নিয়ে
যাওয়া হয় তাকে। এরপর থেকে দুই কন্যা অপেক্ষায় আছে তাদের বাবার জন্য। তারা
খুঁজে বেড়ান তাদের প্রিয় বাবাকে। কিন্তু কোথাও পান না। যদিও বড় কন্যাটির
দৃঢ়বিশ্বাস তাদের পিতা একদিন অবশ্যই ফিরে আসবে। শাহ ইসরাত আজমেরী খুঁজে
বেড়াচ্ছেন স্বামীকে। খুঁজে তো পাচ্ছেনই না, উল্টো তার সঙ্গে নিষ্ঠুর রসিকতা
করছেন কেউ কেউ। হঠাৎ হঠাৎ তার ফোন বেজে ওঠে। অজ্ঞাত ব্যক্তিরা ফোন করে
বলেন, আপনার স্বামীর লাশ ভেসে উঠেছে অমুক জায়গায়।
এই হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলোর পরিবারের জীবনের মর্মন্তুদ অভিজ্ঞতার বয়ান উঠে এসেছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া বিষয়ক পরিচালক মীনাক্ষী গাঙ্গুলির এক লেখায়। তিনি লিখেছেন, ‘সরকারের অস্বীকার করাই হচ্ছে বলপূর্বক গুমের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি। প্রিয়জন হয়তো বহু বছর ধরে এক অনিশ্চয়তা নিয়ে বাঁচে, আশা আর নিরাশার দোলাচলে। মায়েরা চিন্তিত থাকেন, তাদের সন্তান যদি কখনও ফেরেও, তাহলে তাকে চেনা যাবে কিনা। ভারতের জম্মু ও কাশ্মীরে যেসব নারী তাদের হারিয়ে যাওয়া স্বামীর খোঁজে এখনও অপেক্ষায় আছেন তাদের বলা হয় ‘অর্ধ-বিধবা’। গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবার জানিয়েছে, তারা শোকও প্রকাশ করতে পারেন না ঠিকঠাকভাবে। তারা অস্থির থাকেন এই ভেবে যে, তাদের প্রিয়জন কি এখন নির্যাতন ভোগ করছে, নাকি তাকে মেরে ফেলা হয়েছে, কবরে শায়িত হওয়ার মর্যাদা কি সে পেয়েছে? আজকের বাংলাদেশে, বহু পরিবার এমন প্রশ্ন নিয়ে বেঁচে রয়েছে।’
কত জনের কথাইবা বলবেন? গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশে গুমের শিকার হয়েছেন শতাধিক মানুষ। মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে গুমের শিকার হয়েছেন ২১ জন। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের এক বিবৃতিতেও গুমের প্রায় একই সংখ্যার কথা বলা হয়েছে। বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ও মুখপাত্র সালাহউদ্দিন আহমেদকে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর ২১ দিন হতে চললো আজও তার হদিস মিলেনি। তার পরিবার বারবারই বলছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাই তুলে নিয়ে গেছেন তাকে। একাধিক প্রত্যক্ষদর্শীও এমনটাই জানায় সংবাদ মাধ্যমকে। শীর্ষ পর্যায় থেকে নিম্ন পর্যায়ের বিরোধী রাজনীতিবিদ কেউই এখন গুম আতঙ্কের বাইরে নন। এমনকি রংপুর থেকে এক নারীকেও গুম করা হয়েছে।
কেমন আছেন গুম হয়ে যাওয়া, হারিয়ে যাওয়াদের পরিবারের সদস্যরা। ক’মাস আগে গুম আর বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক আলোচনার আয়োজন করা হয়েছিল। সেখানে বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার এক ব্যক্তির কন্যা বলেছিলেন, আমরা সৌভাগ্যবান। আমরা তো অন্তত আমাদের পিতার লাশ পেয়েছি। কিন্তু গুম হয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যরা তো তাও পাননি।
অপেক্ষা উপন্যাসেরই একটি চরিত্র সুপ্রভা। অভিমান করে যে আত্মহত্যা করে। তাকে নিয়ে হুমায়ূন লিখেছেন, ‘ছোট্ট সুপ্রভা। তোমার প্রসঙ্গ অপেক্ষা উপন্যাসে আর আসবে না। কারণ, তোমার জন্য কেউ অপেক্ষা করে থাকবে না। মৃত মানুষদের জন্য আমরা অপেক্ষা করি না। আমাদের সমস্ত অপেক্ষা জীবিতদের জন্য। এই চরম সত্যটি না জেনেই তুমি হারিয়ে গেলে।’
হুমায়ূনের বয়ান সত্য হলে জীবিতদের জন্যই আমাদের অপেক্ষা এ সত্য অনিবার্য। কিন্তু যারা জীবিত নয়, আবার মৃতও নয় তাদের জন্য আমরা কি করি? যে সন্তান জানে না তার পিতা বেঁচে আছেন, না মারা গেছেন, তিনি কি করবেন? যে স্ত্রী জানে না তার স্বামী মৃত না জীবিত, তিনি কি করবেন? যে পিতামাতা জানেন না তাদের সন্তানের খোঁজ, তারা কি করবেন? অর্ধএতিম, অর্ধবিধবা এবং অর্ধ মা-বাবাদের প্রশ্নের জবাব দেয়ার কেউ নেই বাংলাদেশে।
লিখেছেন: সাজেদুল হক
এই হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলোর পরিবারের জীবনের মর্মন্তুদ অভিজ্ঞতার বয়ান উঠে এসেছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া বিষয়ক পরিচালক মীনাক্ষী গাঙ্গুলির এক লেখায়। তিনি লিখেছেন, ‘সরকারের অস্বীকার করাই হচ্ছে বলপূর্বক গুমের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি। প্রিয়জন হয়তো বহু বছর ধরে এক অনিশ্চয়তা নিয়ে বাঁচে, আশা আর নিরাশার দোলাচলে। মায়েরা চিন্তিত থাকেন, তাদের সন্তান যদি কখনও ফেরেও, তাহলে তাকে চেনা যাবে কিনা। ভারতের জম্মু ও কাশ্মীরে যেসব নারী তাদের হারিয়ে যাওয়া স্বামীর খোঁজে এখনও অপেক্ষায় আছেন তাদের বলা হয় ‘অর্ধ-বিধবা’। গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবার জানিয়েছে, তারা শোকও প্রকাশ করতে পারেন না ঠিকঠাকভাবে। তারা অস্থির থাকেন এই ভেবে যে, তাদের প্রিয়জন কি এখন নির্যাতন ভোগ করছে, নাকি তাকে মেরে ফেলা হয়েছে, কবরে শায়িত হওয়ার মর্যাদা কি সে পেয়েছে? আজকের বাংলাদেশে, বহু পরিবার এমন প্রশ্ন নিয়ে বেঁচে রয়েছে।’
কত জনের কথাইবা বলবেন? গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশে গুমের শিকার হয়েছেন শতাধিক মানুষ। মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে গুমের শিকার হয়েছেন ২১ জন। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের এক বিবৃতিতেও গুমের প্রায় একই সংখ্যার কথা বলা হয়েছে। বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ও মুখপাত্র সালাহউদ্দিন আহমেদকে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর ২১ দিন হতে চললো আজও তার হদিস মিলেনি। তার পরিবার বারবারই বলছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাই তুলে নিয়ে গেছেন তাকে। একাধিক প্রত্যক্ষদর্শীও এমনটাই জানায় সংবাদ মাধ্যমকে। শীর্ষ পর্যায় থেকে নিম্ন পর্যায়ের বিরোধী রাজনীতিবিদ কেউই এখন গুম আতঙ্কের বাইরে নন। এমনকি রংপুর থেকে এক নারীকেও গুম করা হয়েছে।
কেমন আছেন গুম হয়ে যাওয়া, হারিয়ে যাওয়াদের পরিবারের সদস্যরা। ক’মাস আগে গুম আর বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক আলোচনার আয়োজন করা হয়েছিল। সেখানে বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার এক ব্যক্তির কন্যা বলেছিলেন, আমরা সৌভাগ্যবান। আমরা তো অন্তত আমাদের পিতার লাশ পেয়েছি। কিন্তু গুম হয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যরা তো তাও পাননি।
অপেক্ষা উপন্যাসেরই একটি চরিত্র সুপ্রভা। অভিমান করে যে আত্মহত্যা করে। তাকে নিয়ে হুমায়ূন লিখেছেন, ‘ছোট্ট সুপ্রভা। তোমার প্রসঙ্গ অপেক্ষা উপন্যাসে আর আসবে না। কারণ, তোমার জন্য কেউ অপেক্ষা করে থাকবে না। মৃত মানুষদের জন্য আমরা অপেক্ষা করি না। আমাদের সমস্ত অপেক্ষা জীবিতদের জন্য। এই চরম সত্যটি না জেনেই তুমি হারিয়ে গেলে।’
হুমায়ূনের বয়ান সত্য হলে জীবিতদের জন্যই আমাদের অপেক্ষা এ সত্য অনিবার্য। কিন্তু যারা জীবিত নয়, আবার মৃতও নয় তাদের জন্য আমরা কি করি? যে সন্তান জানে না তার পিতা বেঁচে আছেন, না মারা গেছেন, তিনি কি করবেন? যে স্ত্রী জানে না তার স্বামী মৃত না জীবিত, তিনি কি করবেন? যে পিতামাতা জানেন না তাদের সন্তানের খোঁজ, তারা কি করবেন? অর্ধএতিম, অর্ধবিধবা এবং অর্ধ মা-বাবাদের প্রশ্নের জবাব দেয়ার কেউ নেই বাংলাদেশে।
লিখেছেন: সাজেদুল হক
No comments