ভবিষ্যতের ইশারা by বাহারউদ্দিন
লেখাটি
দিন কয়েক আগে লিখতে পারলে ভাল হত, হয়ে উঠল না, কীভাবে লিখব, লেখা উচিত
কিনা, এসব সংশয় আর বাইরে ছুটে যাওয়ার ব্যস্ততায় তাৎক্ষণিক ইচ্ছে থমকে যায়৷
তবু আজ লেখার টেবিলে বসে আশা জাগছে, যে-সৌহার্দ্য আর জাগ্রত প্রত্যাশা
উদ্বুদ্ধ করছে, তার প্রাসঙ্গিকতা আরও কয়েক দশক জুড়ে আমাদের ভাবাতে থাকবে৷
আমরা বারবার স্মরণ করব, প্রশ্নও তুলব রাষ্ট্রবিধাতার অভিপ্রায়ের সামনে নত
বা অনত হয়েও ইহজাগতিক স্মৃতি, হত-অপহূত গৌরবকে জড়িয়ে কি কেবল পেছনে তাকাব?
না ভবিষ্যতের ইঙ্গিতে খতিয়ে দেখব সম্প্রীতির অভিযাত্রা? অবিভক্ত পথ হারিয়ে
বিভক্তির হতাশা ও প্রাপ্তিকে ঘিরে কি শুধু বলতে থাকব জাতির ওই অংশে, এই
অংশে, ওই ছিল, এই আছে, বা দিনগুলি আজ আর নেই! এরকম হ্যাঁ বোধক কিংবা নঞর্থক
সীমানার মাঝখানে দাঁড়িয়ে, অনেকটা নৈর্ব্যক্তিক হয়েও, একসময় মনে হল ভেতরের
প্রত্যয় আরও সুদৃঢ় হয়ে উঠেছে৷ কারণ আগামী দিনের স্বপ্ন নিয়ে, মঙ্গলবোধের
অভিমুখকে গুরুত্ব দিয়ে, স্বপ্নের সুঅঙ্কিত রেখাচিত্র-সহ ২৬ থেকে ২৮
ডিসেম্বর ২০১৪ কলকাতার যোধপুর বয়েজ স্কুলের প্রাঙ্গণে সাংস্কৃতিক মিলন
উৎসবে জড়ো হয়েছিলেন ভারত-বাংলাদেশের এবং বিদেশে বসবাসরত দুই প্রজন্মের কয়েক
হাজার সিলেটি৷ উৎসবটির উদ্যোক্তা বাংলাদেশের তরফে জালালাবাদ অ্যাসোসিয়েশন
আর ভারতের দক্ষিণ কলকাতা শ্রীহট্ট সম্মেলন৷ ইংরেজি গত বর্ষের শেষ পর্ব৷ শীত
ছোঁওয়া আবহাওয়া৷ আকাশ কখনও মেঘলা, কখনও শিশুদের হাসি হাসি লুকোচুরির মতো
মেঘ জড়ানো সূর্যোদয়৷ মনোহর, মনোরম পরিবেশ৷ অতি উজ্জ্বল, আবার এই লেখকের মতো
অনুজ্জ্বল মুখেরও আসা যাওয়া চলছে৷ কে নেই? লেখক, কবি, সাংবাদিক,
সমাজবিজ্ঞানী, অর্থনীতিবিদ, সফল ব্যবসায়ী, অধ্যাপক, সংগীতশিল্পী, চিত্রকর,
নাট্যজন, রাজনীতিবিদ ও আমলা৷ দেশভাগের বেদনায়, স্মৃতিকাতরতায় কেউই আক্রাম্ত
নন, এ যেন পুরনো প্রতিবেশীকে, নিকটস্হ জ্ঞাতিকে নতুন করে ফিরে পাওয়ার বা
পুনরাবিষ্কারের অমল আনন্দে গুণিজন ও শ্রীভূমির উত্তরাধিকারীদের সমবেত মেতে
ওঠা৷ এক সুর, এক স্বর, এক ঐক্যের দিকে সবার লক্ষ্য৷ এই সময়ের সাফল্য ও
ব্যর্থতার মূল্যায়নে আর ঐতিহ্যকে জড়িয়ে থাকার নিখাদ চেতনায়, স্বপ্নে
প্রত্যেকেই অঙ্গীকারবদ্ধ৷ সিলেটি বিরাদরির (ভ্রাতৃত্ববোধের) বিস্তর সুনাম
আছে৷ একে ক্ষুদ্রতা বা সংকীর্ণতা বলে সংজ্ঞায়িত করা ঠিক নয়৷ অতীত ও
ভবিষ্যৎদ্রষ্টা সৈয়দ মুজতবা আলী তাঁর স্বভাবজাত ভঙ্গিতে সম্ভবত এই
পারস্পরিক টান অনুভব করেই বলেছিলেন, চেনা-অচেনার বালাই নেই, দেশের ভাই
শুক্কুর মামুদকে পেলেই হল, দুনিয়ার যে-কোনও প্রান্তে তারা পরমাত্মীয় হয়ে
ওঠে৷ আলী সাহেবের ওই মম্তব্য যেমন রসধারায় সিক্ত, সত্য, তেমনি আজও একশো
শতাংশ প্রাসঙ্গিক৷ বঙ্গীয় সমতটের অবিচ্ছেদ্য অংশ শ্রীহট্ট বা রবীন্দ্রনাথের
‘শ্রীভূমি’ ইতিহাস আর ভূগোলের করুণ খেলায় বারবার এক রাষ্ট্র থেকে আরেক
রাষ্ট্রে, এক প্রদেশ থেকে ভিন্নতর প্রদেশের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে, কিন্তু কখনও
একই উপভাষা ও বিচিত্র সংস্কৃতিকে হারায়নি, হারাতে দেয়নি৷ স্বতঃস্ফূর্ত
আবেগে বহুজাতি, উপজাতিকে সঙ্গে অক্ষুন্ন রেখেছে তার ধর্ম ও মর্মের বহুত্বের
প্রার্থনাকে৷ অনেকানেক বিভাজিত ঘটনায় ‘নির্বাসিত’ হয়েও আপন পুণ্য হাতে,
বাঙালির হৃদয়ের সাথে বাণী মাল্য দিয়ে গেঁথে রেখেছে সে তার হিয়াকে৷ এই বাঁধন
চিরদিনের, এই সম্পর্ক শাশ্বত, জাতির আশীর্বাদে গাঁথা৷ রবীন্দ্রনাথ নিবিড়
বন্ধনের এই সত্যতাকে যেভাবে বুঝেছিলেন, ঠিক ততটাই যুগ যুগ ধরে অনুভব করে
আসছে বৃহত্তর সিলেটের লোকসত্তা, নির্মিত ও নির্মীয়মাণ প্রজ্ঞা৷ এমনকি তার
রাষ্ট্রদর্শন ও সমাজতত্ত্ব এখানে ব্যতিক্রম নয়৷ গ্রাম-শহরের কৃষক,
চাকরিজীবী ও ব্যবসায়ীদের শ্রেণী বিভাজনের বাস্তবতা এবং দেশভাগের বেদনাকেও
সে বরণ করেছে ইতিবাচক অর্থে৷ অর্থাৎ সে হয়ে উঠেছে আরও সৃজনশীল, আরও জেদি
এবং বিচ্ছিন্নতাবাদের অতন্দ্র ঘাতক৷ আহত আবেগ থেকে, ক্ষোভ থেকে যে
আত্মদর্শন ও শুভবুদ্ধির জন্ম হয়েছে, তার নাম প্রতিভা, আর এরই সঙঘবদ্ধ
প্রয়াসের পরিচয় জুড়ে রয়েছে সৃজন ও মিলন কামনার নিরম্তর প্রচেষ্টা৷ সম্ভবত
একারণেই সিলেটি লোকসাহিত্য আর লোকগান এত বেশি সমৃদ্ধ ও বহুমুখী, আর বাংলার এ
ভূখণ্ডে মরমি সাধনার বিকাশের ইতিহাসও এত বেশি তত্ত্ব-তল্লাশি৷
শ্রীচৈতন্যদেব ও শাহজালালের আমল থেকে এ পর্যন্ত যে সিলেটি প্রজ্ঞাকে আমরা
দেখি, তার নির্মাণ ও সৃষ্টির আয়তন, তার গৌরবময়তা যে-কোনও অঞ্চলের
সমাজপড়ুয়াকে বিস্মিত করে দেওয়ার পক্ষে পর্যাপ্ত দৃষ্টাম্ত৷ এবার কলকাতা
উৎসব উপলক্ষে, সৈয়দ জগনুল পাশা সম্পাদিত, স্মারক সঙ্কলনে আধুনিককালের
(নবকিশোর সেন থেকে) ১৪০ বরণীয় স্মরণীয় প্রতিভার নাম উল্লেখিত হয়েছে৷ ৪৭-এর
স্বাধীনতা-উত্তরপর্বে বরাক উপত্যকায় যে বিশাল মনীষা ও বহুমুখী প্রতিভার
বিকাশ ঘটেছে, তাঁদের নাম যোগ করলে, এই তালিকা দীর্ঘতর হয়ে উঠবে৷
ভারত-বাংলাদেশের বাঙালির বৌদ্ধিক ইতিহাস নিয়ে যাঁরা চর্চা করছেন, তাঁরা
অখণ্ড সিলেট মানসকে খতিয়ে দেখবেন, এই আশা রইল৷ এটাই সমাজের দাবি৷ এখানেই
অব্যক্ত, পরিত্যক্ত সোনালি নির্দেশও ছড়িয়ে আছে, তা আমাদের বুঝতে হবে, এ
নিয়ে ভাবতেও হবে৷ এই লেখকও সিলেটি বংশোদ্ভূত৷ বাংলার শেষ পূর্ব সীমার
উপভাষায় ঘুমের ভেতর স্বপ্ন দেখে, কথা বলতেও আরামবোধ করে৷ তবে তার
স্মৃতিকাতরতা নেই৷ নস্টালজিয়া কেন জানি ভর করে না৷ শৈশব, বালক বয়স– এরকম যা
কিছু পেরিয়ে এসেছি, তা অতীতেই পড়ে আছে৷ তবে বিস্মরণও ঘটে না, ছবির মতো
ভেসে আসে ওই ঘরবাড়ি, ওই নদী, ওই হাওর আর চা-বাগিচা৷ তার মানে স্মৃতিময়তা
নেই বললেও পালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়৷ পারিপার্শ্বিকতা, বন্ধু সংসর্গ,
জন্মাঞ্চলের সঙ্গে কুটুম্বিতা কখনও দুর্বল, কখনও সবল মুহূর্তে অনুভব করতে
থাকি৷ গত দু’বছর থেকে সিলেট উৎসবে হাজির থাকতে বাধ্য হচ্ছি৷ একি শুধু
সামাজিকতার খাতিরে? না অবদমিত আকর্ষণে? এবার অংশগ্রহণের পরিধি একটু বেশি৷
উৎসবের দ্বিতীয় দিন, ‘কীসের টানে’ শীর্ষক আলোচনাসভায় বলার জন্য ডাক পড়ল৷
হাতে সময় নেই৷ ছুটতে হবে, বড়োল্যান্ডে গণহত্যা ঘটে গেছে৷ লিখিত ভাষণ তৈরি
করার অবকাশ মেলেনি৷ ২৭ ডিসেম্বর, সকাল সাড়ে ১১টায় উৎসব প্রাঙ্গণে ঢুকেই
দেখি চকচক করছে অসংখ্য উজ্জ্বল মুখ৷ মঞ্চে বসে আছেন দিল্লিতে নিযুক্ত
বাংলাদেশের মাননীয় রাষ্ট্রদূত সৈয়দ মুয়াজ্জেম আলি, ড. অনুরাধা চন্দ, কে পি
সি হাসপাতালের পরিচালক কৃষ্ণা দাস এবং চোখের সামনে অর্থনীতিবিদ ড. মোহাম্মদ
ফরাস উদ্দিন, অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম৷ ভাবলাম, এঁদের সামনে তত্ত্বকথা
বলার যোগ্যতা নেই, বলতে হবে কয়েকটা জরুরি কথা, যা না বলা অন্যায়, চেপে রাখা
আরও ঘোর অপরাধ৷ তাই দার্শনিক কোঁৎ-এর উপযোগিতাবাদের আশ্রয় নিয়ে সরাসরি
কয়েকটি সময়োপযোগী প্রস্তাব বা দাবি পেশ করতে হল৷ এক, কলকাতায় ৫ পার্ল রোডে
আবু সয়ীদ আইয়ুবের সঙ্গে একই বাড়িতে নিকটতম বন্ধু আর ঘনিষ্ঠতম আত্মীয়ের মতো
প্রায় সারাজীবন কাটিয়ে গেছেন সৈয়দ মুজতবা আলী৷ জন্ম করিমগঞ্জ শহরে,
প্রাথমিক লেখাপড়া সিলেটে, পরে শান্তিনিকেতন, জার্মানি ও কায়রোতে৷ কিন্তু
কলকাতা তাঁর প্রাণের শহর৷ ঢাকা বার্ধক্যের আশ্রয়৷ অথচ এই দুই শহরেও তাঁর
নামে রাস্তা নেই, স্মৃতি প্রতিষ্ঠান নেই৷ জন্মের শহর ও করিমগঞ্জ এ বিষয়ে
খেয়াল করেনি৷ অতএব তাঁর নামে কলকাতা ও ঢাকায় দুটি রাস্তা এবং স্মারক
প্রতিষ্ঠান গড়তে হবে৷ দুই, মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় ঢাকা ও বরাক উপত্যকায়
অম্তত ১৮ জন শহিদ হয়েছেন৷ তাঁদের আত্মত্যাগের স্মৃতিতে দুই দেশের বঙ্গ
জমিনে যৌথ প্রয়াসের শহিদ মিনার গড়া যায় না? তিন, সাম্প্রদায়িকতা আর
সন্ত্রাসবাদ দুনিয়া জুড়ে সঙ্কট ডেকে আনছে৷ যে জাতি এর কবলে পড়ে, তার
বিপর্যয় অনিবার্য৷ বাংলা ভাষার বৃহত্তম উপভাষী জনগোষ্ঠী সিলেটিদের
সাম্প্রদায়িকতা ও সন্ত্রাস রোখার দায়িত্ব অনেক বেশি৷ কারণ তাঁরা দুনিয়া
জুড়ে ছড়িয়ে আছেন, বিশ্বনাগরিক বলেও সুপরিচিত৷ এসব বলে দ্রুত মঞ্চ ছেড়ে উধাও
হয়ে যাওয়ার পর, সেদিন রাতে, পরদিন ভোরে, সন্ধ্যায়, এরকম দিনকয়েক জুড়ে
ফোনের পর ফোন পেয়ে বুঝতে পারলাম, মুজতবা আলীর নামে রাস্তা, প্রতিষ্ঠান গড়ার
দাবিটি আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে৷ কলকাতার বহু লেখক, কবি, চিত্রকর,
নাট্যকর্মী, সাংবাদিক ও স্বেচ্ছাসেবী কথা দিয়েছেন, সমাজের এই দাবি জানিয়ে
বাংলার মাননীয় মুখ্যমন্ত্রীর কাছে যৌথ আবেদনপত্র তাঁরা পেশ করবেন৷
মুখ্যমন্ত্রীকে দূর থেকে যতটা জানি, আশা করি, তাঁর আপত্তি থাকার কথা নয়৷
রসরাজ আর কালোত্তীর্ণ কথাসাহিত্যিককে অবশ্যই তিনি যোগ্য সম্মান জানাবেন৷
মমতার হৃদয়ে এই ধন আছে৷ বাক্যালাপের আবেগেও রয়েছে হৃদ্যতা আর হাস্যরসের
ভাণ্ডার৷ যতদূর জানি, ১৯ ফেব্রুয়ারি ভাষা শহিদদের মিনার দর্শনে ঢাকা
যাচ্ছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমন্ত্রণে৷ তার আগেই যদি সম্মিলিত
আবেদন তাঁর হাতে পড়ে, আশা করি অবশ্যই সুখবর শোনাবেন, কারণ এটাও সোনালি
ভবিষ্যৎ ও সৌহার্দ্যের সহজিয়া ইঙ্গিত৷ বাহারউদ্দিন : কলকাতার আজকাল
পত্রিকার সিনিয়র সাংবাদিক
No comments