নয়া জামায়াতের আওয়াজ by সাজেদুল হক ও জাকারিয়া পলাশ
বিপর্যস্ত জামায়াত। আক্রমণের পর আক্রমণে
ছিন্নভিন্ন। নির্বাচনী রাজনীতিতে নিষিদ্ধ। কিন্তু এরপর কি? মঞ্চে হেফাজতে
ইসলামের আবির্ভাব। আবার ফ্ল্যাশআউট।
বিপদের মুখে
পলিটিক্যাল ইসলাম। শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা দুনিয়াতেই। কেমন হবে ভবিষ্যতের
পলিটিক্যাল ইসলাম? জামায়াত আর ইসলামী রাজনীতি নিয়ে আমাদের গবেষণা আর
অনুসন্ধানের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের প্রথম পর্ব আজ। চোখ রাখুন নিয়মিত-
সাজেদুল হক, জাকারিয়া পলাশ: ভেতর থেকেই কি বদলে যাচ্ছে জামায়াত? বাইরের আক্রমণে ছিন্নভিন্ন দলটির জন্য কি অপেক্ষা করছে ভবিষ্যতে? নির্বাচনী রাজনীতিতে নিষিদ্ধ হওয়ার পর কাশিমপুর আর পলাতক জীবনে থাকা দলটির নেতারা কি ভাবছেন? এই সময়ে জামায়াতের অন্যতম নীতিনির্ধারক ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের অবশ্য দলে বড় ধরনের সংস্কারের সম্ভাবনা নাকচ করেছেন। তবে জামায়াতের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, ভেতরে ভেতরে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে এগুচ্ছে দলটি। নতুন অথবা পুরাতন যে নামেই জামায়াত রাজনীতি করুক না কেন, কার্যত নেতৃত্বে বড় ধরনের রদবদল এরই মধ্যে ঘটে গেছে। জামায়াতের যেসব নেতার বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ রয়েছে তাদের প্রায় সবাই এখন কারাগারে। দলের নীতিনির্ধারণে তাদের তেমন কোন ভূমিকা নেই। দ্বিতীয় সারির নেতারাও রয়েছেন কারাগারে। দলকে এখন নেতৃত্বে দিচ্ছেন তৃতীয় সারির নেতারা। যাদের কারও বিরুদ্ধেই যুদ্ধাপরাধের কোন অভিযোগ নেই। এদের প্রত্যেকেই এক সময় ইসলামী ছাত্রশিবিরের শীর্ষ পর্যায়ে দায়িত্ব পালন করেছেন। মূলত সাবেক শিবির নেতারাই এখন জামায়াতের নীতিনির্ধারক।
তবে গত প্রায় ৫ বছর বৈরী পরিবেশে রাজনীতির পর জামায়াত ইসলামী এখন বেশ কিছু বিকল্প চিন্তা করছে। যার মধ্যে রয়েছে- ১. নিবন্ধন নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে শেষ পর্যন্ত আইনি লড়াই পরিচালনা করা। ২. নতুন নামে আত্মপ্রকাশ করা। ৩. সমআদর্শিক কোন দলের মাঝে বিলীন হওয়া। ৪. স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে আগামী নির্বাচনে অংশ নেয়া। ৫. যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত নেতাদের দল থেকে বাদ দেয়া।
বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম আন্দোলন শুরু করলে জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধের বিষয়টি নতুন করে সামনে আসে। যদিও জামায়াতেরই কেউ কেউ যুদ্ধাপরাধের বিচারের পক্ষে দলের অভ্যন্তরে মত প্রকাশ করেছিলেন। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পরপরই সে সময়কার ইসলামী ছাত্রশিবিরের সেক্রেটারি জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের উপস্থিতিতে মত প্রকাশ করেন যে, ইতিহাসের একটি অধ্যায় শেষ করতেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হওয়া প্রয়োজন। সাধারণত শিবির সেক্রেটারিরা পরবর্তী ধাপে সংগঠনটির সভাপতি হলেও ওই সেক্রেটারি আর তা হতে পারেননি। এর কিছুদিন পরই দলটিতে চরম বিপর্যয় নেমে আসে। তখন থেকে কার্যত জামায়াত এবং শিবিরকে নিষিদ্ধ সংগঠন হিসেবেই ট্রিট করে সরকার। দলটির প্রায় সব কেন্দ্রীয় নেতাকেই গ্রেপ্তার করা হয়। বাকিরা কার্যক্রম পরিচালনা করছেন আন্ডারগ্রাউন্ডে থেকে। দলটির ওপর সর্বশেষ আঘাত আসে গত মাসে। জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্ট। জামায়াতের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভীর আলোচনার কথা শোনা গেলেও তাদের রাজনীতি নিষিদ্ধ এখন সময়ের ব্যাপার বলেই মনে হচ্ছে। যদিও পশ্চিমা কূটনীতিকদের একটি বড় অংশ জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধের বিপক্ষে। তারা প্রকাশ্যেই রাজনীতি দিয়ে রাজনীতিকে মোকাবিলা করার আহবান জানিয়েছেন। বিদেশী কূটনীতিকদের সঙ্গে এখনও যোগাযোগ রক্ষা করে চলছেন জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক।
জামায়াতের নির্বাহী পরিষদের সদস্য মীর কাসেম আলীসহ দলের একটি অংশ অনেক আগ থেকেই দলে পরিবর্তনে বিশ্বাসী ছিলেন। পরিবর্তনের পক্ষে থাকা অংশটি দলে সংস্কারের জন্য ৫ দফা প্রস্তাব দিয়েছিল। চার বছরের কিছু সময় আগে দেয়া ওই প্রস্তাবে প্রচলিত ইসলামী ধারার রাজনীতির পরিবর্তে সমাজকল্যাণমূলক কাজ, সুশাসন এবং ন্যায় বিচারের ভিত্তিতে রাজনীতির কথা বলা হয়েছিল। ২০১১ সালে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক পত্রিকায় লেখা এক কলামে নিজের রাজনৈতিক ভাবনা প্রকাশ করেছিলেন। ওই লেখায় তিনি লিখেছিলেন, ভারতে ৬০ বছরের জামায়াত তার নাম পরিবর্তন করে ওয়েলফেয়ার পার্টি অব ইন্ডিয়া নামে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেছে পুরনো জামায়াতের ব্যর্থতার কারণে। ভারতের নতুন দলটিতে ১৬ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটিতে ক্যাথলিক খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের একজন ফাদারসহ ৫ জন অমুসলিমকে রাখা হয়েছে। জামায়াতের আরেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামান কারাগার থেকে লেখা এক চিঠিতে দলে সংস্কারের পরামর্শ দেন। ওই চিঠিতে তিনি নতুন নামে দল গঠনের পরামর্শ দিয়েছিলেন। চিঠিতে গণতান্ত্রিক ধারায় রাজনীতি অব্যাহত রাখতে বর্তমানে কার্যকর নেতাদের পরামর্শ দেয়া হয়।
জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ প্রসঙ্গে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্রফেসর দিলারা চৌধুরী মানবজমিনকে বলেন, ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীগুলোকে ম্যানেজ করার একমাত্র উপায় সুসংহত গণতন্ত্র। আমাদের দেশে জামায়াত, হেফাজতে ইসলাম এবং অন্যান্য সাম্প্রদায়িক দলকে মত প্রকাশের সুযোগ দিতে হবে। জোর করে তাদের বিরুদ্ধে কিছু করলে তারা আরও জনপ্রিয় হয়ে উঠবে। চলমান বিপর্যয়কর পরিস্থিতি উত্তরণের ব্যাপারে জামায়াতের নির্বাহী পরিষদের সদস্য ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের মানবজমিনকে বলেন, জামায়াত দলের অভ্যন্তরে সব সময়ই গণতন্ত্র চর্চা করে আসছে। গঠনতন্ত্র অনুসারে মজলিসে শূরার অধিবেশনে দলের নেতা নির্বাচনের জন্য ৩ জনের একটি প্যানেল নির্বাচন করার নিয়ম রয়েছে। ওই প্যানেলের মধ্য থেকে দলের সব রুকনের ভোটে এক জনকে ৩ বছরের জন্য আমির নির্বাচন করা হয়। ২০০৯ সালে মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীকে দলের আমির হিসেবে সর্বশেষ নির্বাচন করা হয়। গঠনতন্ত্র অনুসারে তার ৩ বছর মেয়াদ শেষ হয়েছে। কিন্তু এখন তো আমরা মজলিসে শূরার মিটিং করতে পারছি না। এই জরুরি পরিস্থিতিতে বিদ্যমান সাংগঠনিক কাঠামোই পরবর্তী নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করবে- এমন একটি সংশোধনী এনেছি গঠনতন্ত্রে। সুতরাং নেতৃত্বে পরিবর্তনের কোন অবস্থা এ মুহূর্তে নেই। তিনি বলেন, আমরা মৌলিক বিশ্বাসে কোন কম্প্রোমাইজ করবো না। করার সুযোগ নেই। নির্বাচন কমিশনের চাহিদা অনুসারে মৌলিক বিশ্বাসের বাইরে কিছু সংশোধন করার চিন্তা আমরা করছি। কিন্তু সেটা মৌলিকত্বকে কাটছাঁট করে নয়।
জামায়াতে ইসলামীর জন্ম ১৯৪১ সালের ২৬শে আগস্ট বৃটিশ ভারতে। শুরুতে সংগঠনটির নাম ছিল জামায়াতে ইসলামী হিন্দ। মাওলানা সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদী দলটির প্রতিষ্ঠাতা। নিষিদ্ধ হওয়াও জামায়াতের জন্য নতুন কিছু নয়। ১৯৫৯ এবং ’৬৪ সালে পাকিস্তানে জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ হয়। জামায়াত প্রকাশ্যেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করে। মুক্তিযুদ্ধকালীন ভূমিকার জন্য ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে দলটির রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। এছাড়া মুজিবনগর সরকার কর্তৃক জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধের কথাও জানা যায়। ১৯৭৬ সালে ইসলামী ডেমোক্রেটিক লীগ নামে বাংলাদেশের রাজনীতিতে আত্মপ্রকাশ করেছিল জামায়াত। পরে অবশ্য ১৯৭৯ সালে আবার জামায়াত প্রতিষ্ঠা হয়। এরপর দলটিকে নানা ঝড়ঝাপ্টা মোকাবিলা করতে হলেও কখনও নিষিদ্ধ ঘোষিত হতে হয়নি। ইসলামী ডেমোক্রেটিক লীগ বিলুপ্ত করে জামায়াত প্রতিষ্ঠা করাই জামায়াত নেতাদের সবচেয়ে বড় ভুল মনে করেন দলটির পরামর্শকদের কেউ কেউ। যদিও তখনই গোলাম আযম ও মাওলানা আবদুর রহিমের মধ্যে বিরোধ দেখা দিয়েছিল। যে বিরোধের জেরে জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছিলেন মাওলানা আবদুর রহিম।
No comments