নতুন ধারার রাজনীতি যেন জনহিতকর হয় by মোঃ মাহমুদুর রহমান
বর্তমান
রাজনীতি নিয়ে শুধু সাধারণ মানুষ নয়, আমাদের রাজনীতিকরাও সন্তুষ্ট নন।
রাজনীতিকদের অসন্তোষের কারণে তারা বিভিন্ন সময় রাজনীতিতে পরিবর্তনের কথা
বলেন। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বিগত সরকারের সময়ের দুর্নীতি, অন্যায়-অত্যাচার
ও অব্যবস্থাপনার অভিযোগ এনে দিনবদলের রাজনীতির প্রতিশ্র“তি দিয়েছিলেন।
জনগণ বিশ্বাস করে বিপুল ভোটে তার দলকে বিজয়ী করেছিল ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ
নির্বাচনে। এখন বিরোধীদলীয় নেতা বর্তমান সরকারের দুর্নীতি, গুম, খুন ও
প্রতিহিংসার রাজনীতি পরিহারের আহ্বান জানান প্রায়ই। বিরোধীদলীয় নেতা
সম্প্রতি প্রতিশ্র“তি দিয়েছেন আগামীতে ক্ষমতায় গেলে নতুন ধারার রাজনীতি
শুরু করবেন। অতীতে প্রতিশ্র“তি কতটুকু বাস্তবায়িত হয়েছে তা আমরা দেখতে
পাচ্ছি বলেই বর্তমান প্রতিশ্র“তিতে ভরসা করা কঠিন হয়ে পড়ছে। এ ছাড়া দিনবদল
আর নতুন ধারার মধ্যে শব্দ চয়নে ভিন্নতা থাকলেও মর্মার্থ অভিন্নই বলা যায়।
তাই দল দুটি ভিন্ন হলেও প্রতিশ্র“তি একই ধরনের। ফলাফল কতটুকু ভিন্ন হবে তা
নিয়ে চিন্তিত সাধারণ মানুষ। তবে আশার কথা হচ্ছে, সরকারি দল, বিরোধী দল ও
সাধারণ মানুষ সবাই যে যার অবস্থান থেকে বর্তমান ধারার রাজনীতির অবসান
চাচ্ছেন। এই সম্মিলিত চাওয়া ব্যবধানে বর্তমান প্রতিহিংসাপরায়ণ রাজনীতির
পরিবর্তে একটি জনহিতকর রাজনীতি উপহার দিতে বাধ্য করবে রাজনীতিকদের। অন্যথায়
নতুন শক্তির উদ্ভব হবে প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে।
সাম্প্রতিক সিটি কর্পোরেশনগুলোর নির্বাচনী ফলাফল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিপক্ষে যাওয়ায় ব্যাপকভাবে মনে করা হচ্ছে পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনে এর প্রভাব পড়বে এবং বর্তমান বিরোধী দল বিএনপি বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করবে, যদি নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়। এ জন্য বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা দেশ ও জনগণের জন্য বিশেষ গুরুত্ব¡ বহন করে। কিন্তু বিরোধীদলীয় নেতার নতুন ধারার রাজনীতির কোনো ব্যাখ্যা তার বক্তব্যে ছিল না। পরে লন্ডনে জনাব তারেক রহমানের বক্তব্য ও মিডিয়ার অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে কিছু ইতিবাচক পরিবর্তনের আভাস পাওয়া গেছে। একটি জাতীয় দৈনিকে নতুন ধারার বিস্তারিত বর্ণনা দেয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, পরবর্তী সরকার হবে দলীয় নয়, জাতীয় সরকার। নির্বাচনী রাজনীতিতে সুবিধা করতে না পারা বিভিন্ন ছোট ছোট দলের গুরুত্বপূর্ণ রাজনীতিকসহ দেশের বিভিন্ন মত ও পথের বুদ্ধিজীবীদের এক্ষেত্রে কাজে লাগানো হবে। একই দিনে অপর একটি জাতীয় দৈনিকে নতুন ধারা সম্পর্কে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির কয়েকজন সদস্যের মতামত তুলে ধরা হয়েছে। স্থায়ী কমিটির সদস্যরা এ ব্যাপারে তাদের অজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। কারণ দলীয় কোনো ফোরামে নতুন ধারা সম্পর্কে আলোচনা হয়নি। কেউ কেউ অনুমাননির্ভর কিছু বক্তব্য দিয়েছেন। এসব বক্তব্য থেকে বোঝা যায় যে, বিএনপি আগামীতে সরকার গঠন করলে দলীয়প্রধান ও সরকারপ্রধান একই ব্যক্তি হবেন না। আমরা ধারণা করতে পারি বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান দুজন এ দুটি পদ অলংকৃত করবেন। নতুন ধারা সম্পর্কে সুস্পষ্ট দলীয় কোনো বক্তব্য না থাকায় জনমনে অনেক শংকাও রয়েছে।
বিগত বিএনপি সরকার আমলে তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগের দলীয় কর্মসূচি পালনে বাধা প্রদান করা হতো। তাদের কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে দলীয় কার্যালয়ের সামনে অবরুদ্ধ করে রাখা হতো। পুলিশি বেষ্টনী ভেদ করে বাইরে মিছিল-মিটিং করা প্রায় অসম্ভব ছিল। তখনকার বিরোধীদলীয় নেতার দিনবদলের কথা শুনে মানুষ ধরে নিয়েছিল ভবিষ্যতে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে হয়তো এরকম অনৈতিক বাধা প্রদানের ঘটনা ঘটবে না। কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখতে পেলাম দলীয় অফিসের সামনে নয়, আওয়ামী লীগ সরকারের পুরো সময় বিএনপিকে দলীয় অফিসের ভেতরে বন্দি থাকতে হয়েছে। এতেও সরকারের ক্রোধ প্রশমিত না হওয়ায় সর্বশেষ দলীয় অফিসে ঢুকে দরজা ভেঙে দাগি অপরাধীদের মতো জাতীয় নেতাদের গ্রেফতার করা হয়েছে। ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সুবাদে দেশবাসী এ নির্লজ্জ কর্মকাণ্ড প্রত্যক্ষ করল। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বর্তমান বিরোধীদলীয় নেতার নতুন ধারা কেমন হবে? তিনি কি এসব বাদ দিয়ে ইতিবাচক ধারায় ফিরে আসবেন, না বিরোধী দল দমনের নতুন ধারা সৃষ্টি করবেন? হতে পারে তিনি অফিসের দরজা ভেঙে গ্রেফতার না করে বুলডোজার দিয়ে পুরো অফিস গুঁড়িয়ে দিয়ে নতুন ধারা সৃষ্টি করবেন!
২০০১ সালের চারদলীয় জোট তথা বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে আরেকটি অভিযোগ ছিল, সরকারি চাকরিতে নিয়োগে দুর্নীতি ও দলীয়করণ। সেই অভিযোগকারী তৎকালীন বিরোধী দল শাসকদলে পরিণত হয়ে যা করছে তা বিশ্বাস করা কঠিন। দলীয়করণ এখন আর অনৈতিক বিষয় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে না। কোনো কোনো মন্ত্রী প্রকাশ্যে বলে দিচ্ছেন ছাত্রলীগ ছাড়া কারও চাকরি হবে না। দিনবদলের রাজনীতির ধারাবাহিকতায় পরবর্তী নতুন ধারার সরকার যদি ঘোষণা করে যে, বিএনপি ব্যতীত অন্য কারও আর কষ্ট করে সরকারি চাকরিতে নিয়োগের আবেদন করারই দরকার নেই, তাহলে এটাও হবে একটি নতুন ধারা!
একইভাবে বিগত বিএনপি সরকারের সময় বহুল আলোচিত ও নিন্দিত কাজ ছিল ক্রসফায়ারের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। দেশ-বিদেশের সব মানবাধিকার কর্মী ও আমাদের তৎকালীন বিরোধী দল সর্বদা সরব ছিল এ অন্যায়ের বিরুদ্ধে। জনগণ আশা করেছিল আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে দিনবদলের প্রতিশ্র“তির কারণে ক্রসফায়ারের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যাযজ্ঞ বন্ধ হবে। কিন্তু জনগণের আশা হতাশায় পরিণত হল। আমরা দেখলাম ক্রসফায়ার বন্ধ হওয়া দূরে থাক, এর সঙ্গে যুক্ত হল গুম আতংক। ইসিয়াস আলীর মতো জাতীয় পর্যায়ের বিরোধীদলীয় নেতাকে গুম হতে হল। সরকার নির্বিকার! দিনবদল হয়েছে ঠিকই, কিন্তু ভয়ংকরভাবে! যা কারও কাছে কাম্য ছিল না। এখন বর্তমান বিরোধীদলীয় নেতা নতুন ধারার নামে আরও ভয়ংকর নতুন কিছু আবিষ্কার করতে পারেন, যা এ মুহূর্তে আমরা কল্পনা করতে পারছি না।
এভাবে বললে আরও অনেক কিছু বলা যাবে। আসলে বলতে চাচ্ছি, নতুন ধারার রাজনীতি জনহিতকর না হলে এরকম জঘন্যও হতে পারে। এ জন্য প্রয়োজন বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়ার কাছে যথাযথ ব্যাখ্যা চাওয়া, কারণ বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে দিনবদলের ব্যাখ্যা না নিয়ে জনগণ প্রতারিত হয়েছে। ভবিষ্যৎ প্রতারণার হাত থেকে জনগণকে রক্ষার জন্য বুদ্ধিজীবী ও মিডিয়া কর্মীদের উচিত বেগম জিয়ার কাছ থেকে নতুন ধারার রাজনীতির পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা দেশের মানুষের কাছে প্রকাশ করা। নতুন ধারার রাজনীতির প্রবক্তা বিরোধীদলীয় নেতার কাছ থেকে আমরা জানতে চাই- ক্ষমতায় গেলে তিনি কি প্রতিশোধপরায়ণ হবেন? বর্তমান শাসকদল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা নির্যাতনের শিকার হবেন কিনা? তাদের বিরুদ্ধে মামলার খক্ষ নেমে আসবে কিনা? সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তায় কী ব্যবস্থা নেবেন? মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার আসামিদের ছেড়ে দেবেন, না রায় রিভিউ করবেন? ট্রাইব্যুনাল ভেঙে দেবেন না পুনর্গঠন করবেন? না বর্তমান ট্রাইব্যুনাল তার নিজস্ব গতিতে চলবে? দলীয় নেতাকর্মীদের চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজি যথারীতি চলবে, না বন্ধ করবেন? সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে দলীয়করণ বন্ধ করে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগদানে কী ব্যবস্থা নেবেন? ভিন্নমতের সাংবাদিকরা নির্যাতিত হবেন কিনা? জঙ্গিবাদ দমনে কী ব্যবস্থা নেবেন? প্রতিবেশী রাষ্ট্রসহ বহির্বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে কী ব্যবস্থা নেবেন? এভাবে আমাদের অভিজ্ঞতায় যেসব ভবিষ্যৎ নিয়ে যেসব শংকা আছে তার সবগুলোর সুনির্দিষ্ট জবাব নিতে হবে। আশা করি সত্যিকারভাবে জনহিতকর নতুন ধারার রাজনীতি শুরু করার অভিপ্রায় থাকলে জনগণকে এগুলো জানাতে আপত্তি থাকার কথা নয়।
এগুলো জানালে জনগণের অবগতির সঙ্গে সঙ্গে দলীয় নেতাকর্মীরাও জানতে পারবে। তারাও মানসিকভাবে নিজেদের তৈরি করতে পারবে নতুন ধারার রাজনীতির জন্য। দলীয় কর্মীদের প্রচলিত প্রতিহিংসাপরায়ণ সন্ত্রাসনির্ভর লুটপাটের রাজনীতির আবহ থেকে ভিন্ন উন্নত নতুন ধারার দিকে নিয়ে যেতে হলে শুধু বিরোধীদলীয় নেতা একা চিন্তা করলে হবে না, তার চিন্তার সঙ্গে দলীয় সর্বস্তরের নেতাকর্মীকে অংশীদার হতে হবে। নতুবা নতুন ধারার প্রবক্তা বেগম জিয়ার অবস্থা হবে ওই দ্রুতগামী উন্নত রেল ইঞ্জিনের মতো, যার দ্রুততার সঙ্গে পুরনো লক্কড়-ঝক্কড় মার্কা বগিগুলো তাল সামলাতে না পেরে এক এক করে ছিটকে পড়বে। অবশেষে গন্তব্যে যাত্রীবাহী বগি ছাড়া শুধু ইঞ্জিনই পৌঁছবে। বিরোধীদলীয় নেতার সময়োপযোগী সুচিন্তা এভাবে ব্যর্থ হোক আমরা তা চাই না। বর্তমান নোংরা রাজনীতির কবল থেকে জনগণ মুক্তি চায়। আর এই মুক্তির জন্য সত্যিকার জনহিতকর নতুন ধারার রাজনীতি এখন সময়ের দাবি।
মোঃ মাহমুদুর রহমান : ব্যাংকার ও কলামিস্ট
সাম্প্রতিক সিটি কর্পোরেশনগুলোর নির্বাচনী ফলাফল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিপক্ষে যাওয়ায় ব্যাপকভাবে মনে করা হচ্ছে পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনে এর প্রভাব পড়বে এবং বর্তমান বিরোধী দল বিএনপি বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করবে, যদি নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়। এ জন্য বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা দেশ ও জনগণের জন্য বিশেষ গুরুত্ব¡ বহন করে। কিন্তু বিরোধীদলীয় নেতার নতুন ধারার রাজনীতির কোনো ব্যাখ্যা তার বক্তব্যে ছিল না। পরে লন্ডনে জনাব তারেক রহমানের বক্তব্য ও মিডিয়ার অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে কিছু ইতিবাচক পরিবর্তনের আভাস পাওয়া গেছে। একটি জাতীয় দৈনিকে নতুন ধারার বিস্তারিত বর্ণনা দেয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, পরবর্তী সরকার হবে দলীয় নয়, জাতীয় সরকার। নির্বাচনী রাজনীতিতে সুবিধা করতে না পারা বিভিন্ন ছোট ছোট দলের গুরুত্বপূর্ণ রাজনীতিকসহ দেশের বিভিন্ন মত ও পথের বুদ্ধিজীবীদের এক্ষেত্রে কাজে লাগানো হবে। একই দিনে অপর একটি জাতীয় দৈনিকে নতুন ধারা সম্পর্কে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির কয়েকজন সদস্যের মতামত তুলে ধরা হয়েছে। স্থায়ী কমিটির সদস্যরা এ ব্যাপারে তাদের অজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। কারণ দলীয় কোনো ফোরামে নতুন ধারা সম্পর্কে আলোচনা হয়নি। কেউ কেউ অনুমাননির্ভর কিছু বক্তব্য দিয়েছেন। এসব বক্তব্য থেকে বোঝা যায় যে, বিএনপি আগামীতে সরকার গঠন করলে দলীয়প্রধান ও সরকারপ্রধান একই ব্যক্তি হবেন না। আমরা ধারণা করতে পারি বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান দুজন এ দুটি পদ অলংকৃত করবেন। নতুন ধারা সম্পর্কে সুস্পষ্ট দলীয় কোনো বক্তব্য না থাকায় জনমনে অনেক শংকাও রয়েছে।
বিগত বিএনপি সরকার আমলে তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগের দলীয় কর্মসূচি পালনে বাধা প্রদান করা হতো। তাদের কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে দলীয় কার্যালয়ের সামনে অবরুদ্ধ করে রাখা হতো। পুলিশি বেষ্টনী ভেদ করে বাইরে মিছিল-মিটিং করা প্রায় অসম্ভব ছিল। তখনকার বিরোধীদলীয় নেতার দিনবদলের কথা শুনে মানুষ ধরে নিয়েছিল ভবিষ্যতে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে হয়তো এরকম অনৈতিক বাধা প্রদানের ঘটনা ঘটবে না। কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখতে পেলাম দলীয় অফিসের সামনে নয়, আওয়ামী লীগ সরকারের পুরো সময় বিএনপিকে দলীয় অফিসের ভেতরে বন্দি থাকতে হয়েছে। এতেও সরকারের ক্রোধ প্রশমিত না হওয়ায় সর্বশেষ দলীয় অফিসে ঢুকে দরজা ভেঙে দাগি অপরাধীদের মতো জাতীয় নেতাদের গ্রেফতার করা হয়েছে। ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সুবাদে দেশবাসী এ নির্লজ্জ কর্মকাণ্ড প্রত্যক্ষ করল। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বর্তমান বিরোধীদলীয় নেতার নতুন ধারা কেমন হবে? তিনি কি এসব বাদ দিয়ে ইতিবাচক ধারায় ফিরে আসবেন, না বিরোধী দল দমনের নতুন ধারা সৃষ্টি করবেন? হতে পারে তিনি অফিসের দরজা ভেঙে গ্রেফতার না করে বুলডোজার দিয়ে পুরো অফিস গুঁড়িয়ে দিয়ে নতুন ধারা সৃষ্টি করবেন!
২০০১ সালের চারদলীয় জোট তথা বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে আরেকটি অভিযোগ ছিল, সরকারি চাকরিতে নিয়োগে দুর্নীতি ও দলীয়করণ। সেই অভিযোগকারী তৎকালীন বিরোধী দল শাসকদলে পরিণত হয়ে যা করছে তা বিশ্বাস করা কঠিন। দলীয়করণ এখন আর অনৈতিক বিষয় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে না। কোনো কোনো মন্ত্রী প্রকাশ্যে বলে দিচ্ছেন ছাত্রলীগ ছাড়া কারও চাকরি হবে না। দিনবদলের রাজনীতির ধারাবাহিকতায় পরবর্তী নতুন ধারার সরকার যদি ঘোষণা করে যে, বিএনপি ব্যতীত অন্য কারও আর কষ্ট করে সরকারি চাকরিতে নিয়োগের আবেদন করারই দরকার নেই, তাহলে এটাও হবে একটি নতুন ধারা!
একইভাবে বিগত বিএনপি সরকারের সময় বহুল আলোচিত ও নিন্দিত কাজ ছিল ক্রসফায়ারের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। দেশ-বিদেশের সব মানবাধিকার কর্মী ও আমাদের তৎকালীন বিরোধী দল সর্বদা সরব ছিল এ অন্যায়ের বিরুদ্ধে। জনগণ আশা করেছিল আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে দিনবদলের প্রতিশ্র“তির কারণে ক্রসফায়ারের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যাযজ্ঞ বন্ধ হবে। কিন্তু জনগণের আশা হতাশায় পরিণত হল। আমরা দেখলাম ক্রসফায়ার বন্ধ হওয়া দূরে থাক, এর সঙ্গে যুক্ত হল গুম আতংক। ইসিয়াস আলীর মতো জাতীয় পর্যায়ের বিরোধীদলীয় নেতাকে গুম হতে হল। সরকার নির্বিকার! দিনবদল হয়েছে ঠিকই, কিন্তু ভয়ংকরভাবে! যা কারও কাছে কাম্য ছিল না। এখন বর্তমান বিরোধীদলীয় নেতা নতুন ধারার নামে আরও ভয়ংকর নতুন কিছু আবিষ্কার করতে পারেন, যা এ মুহূর্তে আমরা কল্পনা করতে পারছি না।
এভাবে বললে আরও অনেক কিছু বলা যাবে। আসলে বলতে চাচ্ছি, নতুন ধারার রাজনীতি জনহিতকর না হলে এরকম জঘন্যও হতে পারে। এ জন্য প্রয়োজন বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়ার কাছে যথাযথ ব্যাখ্যা চাওয়া, কারণ বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে দিনবদলের ব্যাখ্যা না নিয়ে জনগণ প্রতারিত হয়েছে। ভবিষ্যৎ প্রতারণার হাত থেকে জনগণকে রক্ষার জন্য বুদ্ধিজীবী ও মিডিয়া কর্মীদের উচিত বেগম জিয়ার কাছ থেকে নতুন ধারার রাজনীতির পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা দেশের মানুষের কাছে প্রকাশ করা। নতুন ধারার রাজনীতির প্রবক্তা বিরোধীদলীয় নেতার কাছ থেকে আমরা জানতে চাই- ক্ষমতায় গেলে তিনি কি প্রতিশোধপরায়ণ হবেন? বর্তমান শাসকদল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা নির্যাতনের শিকার হবেন কিনা? তাদের বিরুদ্ধে মামলার খক্ষ নেমে আসবে কিনা? সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তায় কী ব্যবস্থা নেবেন? মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার আসামিদের ছেড়ে দেবেন, না রায় রিভিউ করবেন? ট্রাইব্যুনাল ভেঙে দেবেন না পুনর্গঠন করবেন? না বর্তমান ট্রাইব্যুনাল তার নিজস্ব গতিতে চলবে? দলীয় নেতাকর্মীদের চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজি যথারীতি চলবে, না বন্ধ করবেন? সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে দলীয়করণ বন্ধ করে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগদানে কী ব্যবস্থা নেবেন? ভিন্নমতের সাংবাদিকরা নির্যাতিত হবেন কিনা? জঙ্গিবাদ দমনে কী ব্যবস্থা নেবেন? প্রতিবেশী রাষ্ট্রসহ বহির্বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে কী ব্যবস্থা নেবেন? এভাবে আমাদের অভিজ্ঞতায় যেসব ভবিষ্যৎ নিয়ে যেসব শংকা আছে তার সবগুলোর সুনির্দিষ্ট জবাব নিতে হবে। আশা করি সত্যিকারভাবে জনহিতকর নতুন ধারার রাজনীতি শুরু করার অভিপ্রায় থাকলে জনগণকে এগুলো জানাতে আপত্তি থাকার কথা নয়।
এগুলো জানালে জনগণের অবগতির সঙ্গে সঙ্গে দলীয় নেতাকর্মীরাও জানতে পারবে। তারাও মানসিকভাবে নিজেদের তৈরি করতে পারবে নতুন ধারার রাজনীতির জন্য। দলীয় কর্মীদের প্রচলিত প্রতিহিংসাপরায়ণ সন্ত্রাসনির্ভর লুটপাটের রাজনীতির আবহ থেকে ভিন্ন উন্নত নতুন ধারার দিকে নিয়ে যেতে হলে শুধু বিরোধীদলীয় নেতা একা চিন্তা করলে হবে না, তার চিন্তার সঙ্গে দলীয় সর্বস্তরের নেতাকর্মীকে অংশীদার হতে হবে। নতুবা নতুন ধারার প্রবক্তা বেগম জিয়ার অবস্থা হবে ওই দ্রুতগামী উন্নত রেল ইঞ্জিনের মতো, যার দ্রুততার সঙ্গে পুরনো লক্কড়-ঝক্কড় মার্কা বগিগুলো তাল সামলাতে না পেরে এক এক করে ছিটকে পড়বে। অবশেষে গন্তব্যে যাত্রীবাহী বগি ছাড়া শুধু ইঞ্জিনই পৌঁছবে। বিরোধীদলীয় নেতার সময়োপযোগী সুচিন্তা এভাবে ব্যর্থ হোক আমরা তা চাই না। বর্তমান নোংরা রাজনীতির কবল থেকে জনগণ মুক্তি চায়। আর এই মুক্তির জন্য সত্যিকার জনহিতকর নতুন ধারার রাজনীতি এখন সময়ের দাবি।
মোঃ মাহমুদুর রহমান : ব্যাংকার ও কলামিস্ট
No comments