যা দেখেছি তা লিখেছি by কাজল ঘোষ
আমি
যা দেখেছি, যা বিশ্বাস করি তার বাইরে একটি কথাও লিখিনি। বঙ্গবন্ধু আমাকে
স্নেহ করতেন। আমিও বঙ্গবন্ধুকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করতাম। তিনি আমার অত্যন্ত
প্রিয় এক ব্যক্তিত্ব। মুক্তিযুদ্ধকালীন উপ-অধিনায়ক এ কে খন্দকার এভাবেই
বলেন তার মনের কথা। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ নিয়ে তার একটি
মন্তব্য দেশজুড়ে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়।
আলোচনা-সমালোচনার ঝড় ওঠে। সাবেক মন্ত্রী এ কে খন্দকার তার লেখা ‘১৯৭১: ভেতর-বাইরে’ বইয়ে উল্লেখ করেন ৭ই মার্চের ভাষণের শেষ শব্দগুলো ছিল ‘জয় বাংলা, জয় পাকিস্তান, আর এ নিয়েই জমে উঠে বিতর্ক। ২০১৪ সালের আগস্টে প্রথমা থেকে বইটি প্রকাশিত হয়। এরপরই কোণঠাসা হয়ে পড়েন সাবেক এই বিমান বাহিনীর প্রধান। তার এই বই প্রকাশের পর পেরিয়েছে প্রায় তিন বছর। ইতিমধ্যে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ জায়গা করে নিয়েছে পৃথিবীর অন্যতম সেরা ভাষণ হিসেবে। এ কে খন্দকার রেসকোর্স ময়দানে মিত্রবাহিনীর কাছে পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণকালে তিনি বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্বও করেন। শেষ মুহূর্তে দিল্লি থেকে যখন থিয়েটার রোডে খবর পৌঁছায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী মুক্তিযোদ্ধা নয় মিত্র বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করবে। তখন হতাশা নেমে আসে থিয়েটার রোডে অস্থায়ী প্রবাসী সরকারের দপ্তরে। জেনারেল এমএজি ওসমানীর প্রস্তুতি তখন ভণ্ডুল হয়ে যায়। রেসকোর্সে তিনি না এসে প্রতিনিধিত্ব করতে পাঠান তাঁর ডেপুটি চিফ অব স্টাফ এ কে খন্দকারকে। এক ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাক্ষী হওয়ার বিরল সৌভাগ্য লাভ করেন তিনি। পরে স্বাধীনতার পর ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত ছিলেন বিমান বাহিনীর প্রধান। ছিলেন আওয়ামী লীগ সরকারের পরিকল্পনা মন্ত্রীও। কিন্তু তার বই ১৯৭১: ভেতরে বাইরে প্রকাশিত হওয়ার পর ব্যাপক সমালোচনায় ধীরে ধীরে নিজেকে গুটিয়ে নেন। এমনকি বাসার টেলিফোন এবং ব্যক্তিগত মুঠোফোন ধরা থেকেও বিরত থাকেন। সকল সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগ দেয়া থেকে বিরত থাকেন। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, মাসের পর মাস তিনি বাসার বাইরে বের হন না। তার পেছনে শারীরিক সক্ষমতা যেমন বাধা তেমনি বাধা এই বিতর্কের চাপও। বাসায় বর্তমানে সময় কাটছে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে। পছন্দের বই পড়া আর বিকালে হাঁটাহাঁটি করে সময় কাটে। সাতাশি বছরের এ কে খন্দকার ভুগছেন বয়স্কজনিত নানা শারীরিক জটিলতায়। খানিকটা স্মৃতি বিধূরতাও পেয়ে বসেছে মুক্তিযুদ্ধের এই উপ-অধিনায়ককে। বিদায়ী এই ডিসেম্বরে একটি জাতীয় দৈনিকের দেয়া সম্মাননা ছাড়া আর কোনো অনুষ্ঠানে যোগ দেননি। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কথা বলেননি কোনো সংবাদ মাধ্যমেও। কেমন আছেন জানতে চাইলে এ কে খন্দকার বললেন, খুব একটা ভালো নেই। থেকে থেকে কথা বলেন মুক্তিযুদ্ধকালীন নানা প্রসঙ্গ নিয়ে। কোনো অনুষ্ঠানাদিতে যোগ দিচ্ছেন না কেন- এমন প্রশ্নে বললেন, যা দেখেছি তাতো বইতে লিখেছি। বইতে লিখিত বক্তব্যের ঢেউ আছড়ে পড়েছিল সংসদ পর্যন্ত; ঝড় তুলেছিল সব মহলেই। কিন্তু যে প্রসঙ্গে বিতর্ক তিনি কি সেই অবস্থান থেকে সরে এসেছেন, না যা লিখেছেন তাতেই অনড়। স্পষ্ট করে বললেন, আমি আমার বইতে যা দেখেছি, যা জানি, যা বিশ্বাস করি তার বাইরে একটি কথাও লিখিনি। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসর্মপণ মুহূর্তটি স্মৃতিকে এখনো উজ্জ্বল উল্লেখ করে তিনি বলেন, ১৬ই ডিসেম্বর সকালে ডাক পড়ে প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের। আমাকে নির্দেশ দিলেন, তোমাকে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করতে হবে। বিমান প্রস্তুত আছে। যেভাবে আছো সেভাবেই যাও। কোনোরকম প্রস্তুতি ছাড়াই ছুটে যাই বিমানবন্দরে। পৌঁছে দেখি সকলেই অপেক্ষায় আছে। উঠতে যাবো দেখি জেনারেল অরোরা ও তাঁর স্ত্রী। আমি সরে ওনাদের আগে পথ দেখাতেই তিনি বললেন, ‘ইউ আর ফ্রিডম ফাইটার। ইউ উইল গো ফার্স্ট।’ দমদম বিমানবন্দর থেকে কপ্টারে করে আগরতলা হয়ে ঢাকায় পৌঁছে দেখি বিস্ময়কর দৃশ্য। রাস্তার দু’ধারে মানুষের ঢল। একটি টেবিল আর দুটো চেয়ারে অল্প সময়ের মধ্যেই আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলো।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকালীন সেই দিনগুলোর কথা মনে করে এ কে খন্দকার বলেন, সামরিক বাহিনীর সেকেন্ড ইন কমান্ড ছিলাম। আর পাকিস্তান আমলে বিমান বাহিনীর ক্যাপ্টেন ছিলাম। যা ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যাওয়া বাংলাদেশের কোনো ব্যক্তির সর্বোচ্চ পদ। আমার দায়িত্ব ছিল অনেক বেশি। কাজের ফাঁকে ফাঁকে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে বুঝতে পারছিলাম কিছু একটা হয়েছে। ১৯৭১ সালে প্রায় প্রতিদিনই বিমানে করে তাদের লোক আসছিল তেজগাঁও বিমানবন্দরে। বেসামরিক প্রশাসনের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ করা একেবারেই নিষেধ ছিল। কিন্তু নানান মাধ্যমে আমরা খবরগুলো পৌঁছাতাম। আমার সহধর্মিণীর বড় ভাইয়ের মাধ্যমে আমি তখন কিছু কিছু খবর আওয়ামী লীগের উচ্চ পর্যায়ের নীতিনির্ধারকদের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করেছি।
যখন পঁচিশে মার্চের ক্র্যাকডাউন হয় তখন লুকিয়ে ভারতে চলে যাই। তবে তাও পেরেছিলাম তিন দফা চেষ্টার পর। রাজশাহীসহ বিভিন্ন পথে যাওয়ার চেষ্টাকালে পাকিস্তানিদের নজরদারির কারণে বারবার পথ বদলাতে হয়। পরে এপ্রিলের ১০/১২ তারিখের দিকে দলবলসহ ভারত পৌঁছতে পারি। নয় মাস যে যেখানে ছিল সেখান থেকেই ঐক্যবদ্ধভাবে পরিশ্রম করেছে; দেশের জন্য কাজ করেছে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আমি ছিলাম ডেপুটি চিফ অব স্টাফ। নিয়মিত তদারকির বাইরেও আমাকে মাঝেমধ্যেই যেতে হতো রণাঙ্গনে। সেখানে ছিল ছোট্ট একটি রানওয়ে। মাত্র তিনটি যুদ্ধ বিমান ছিল। সেটা নিয়েই একটি পাহাড়ের পাশে আমরা প্রশিক্ষণ দিয়েছি মুক্তিযোদ্ধাদের। আর বেশিরভাগ সময়ই রাতের দিকে আক্রমণ চালানো হতো।
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করে এ কে খন্দকার বলেন, মুক্তিযুদ্ধের আগে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ সম্ভব ছিল না। তবে দেশ স্বাধীন হলে নানাভাবে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কাজের সুযোগ হয়েছে। তিনি আমাকে স্নেহ করতেন। আমি বঙ্গবন্ধুকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করি। তিনি আমার অত্যন্ত প্রিয় এক ব্যক্তিত্ব। যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশের সেনাবাহিনী তখন খুবই ছোট আকারের। কাজেই তিনি যখনই কোথাও যেতেন সঙ্গে সঙ্গে যেতাম। কারণ ওনার যদি কোনো বিষয়ে জানার থাকে তা সঙ্গে সঙ্গে অবগত করতে হবে।
প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ সম্পর্কে এ কে খন্দকার উল্লেখ করেন, সকল প্রতিকূলতা সত্ত্বেও এই মানুষটি ধৈর্য সহকারে সকল পরিস্থিতির মোকাবিলা করেছেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে নয়মাস কঠোর পরিশ্রম করেছেন। তিনি উদ্যোগ নিয়ে ভারত সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে প্রবাসী সরকারের কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন। একটি ছোট কামরায় দিনের পর দিন এই মানুষটি বাস করেছেন। নিজের কাপড়-চোপড় নিজেই পরিষ্কার করতেন। যুদ্ধ চলাকালে তিনি তার স্ত্রীর সঙ্গে মাত্র একবার দেখা করেছিলেন আধাঘণ্টার জন্য। তাজউদ্দীন আহমদের অবদানকে নানাভাবে খাটো করে দেখার চেষ্টা হচ্ছে। তাঁর অবদানের কারণে বাঙালির কৃতজ্ঞ থাকা উচিত।
কেমন দেশ চেয়েছিলেন এ প্রশ্নে তিনি বলেন, দেশের অনেক কিছু ভালো হয়েছে। আরো ভালো হওয়া উচিত ছিল। যতোটা ভালো চেয়েছিলাম ততটা হয়নি। স্বপ্ন ছিল দেশের মানুষ গণতন্ত্র, সুশাসন, মানবাধিকার, মুক্তভাবে কথা বলার অধিকার পাবে। তার পুরোপুরি এখনো আমরা দেখতে পাচ্ছি না। অনেক খারাপ কিছু আছে যা থেকে আমাদের বের হতে হবে। যতটুকু হয়েছে তার আরো ভালোভাবে হওয়া দরকার ছিল। আমার বিশ্বাস আগামীতে দেশ আরো ভালো হবে।
আলোচনা-সমালোচনার ঝড় ওঠে। সাবেক মন্ত্রী এ কে খন্দকার তার লেখা ‘১৯৭১: ভেতর-বাইরে’ বইয়ে উল্লেখ করেন ৭ই মার্চের ভাষণের শেষ শব্দগুলো ছিল ‘জয় বাংলা, জয় পাকিস্তান, আর এ নিয়েই জমে উঠে বিতর্ক। ২০১৪ সালের আগস্টে প্রথমা থেকে বইটি প্রকাশিত হয়। এরপরই কোণঠাসা হয়ে পড়েন সাবেক এই বিমান বাহিনীর প্রধান। তার এই বই প্রকাশের পর পেরিয়েছে প্রায় তিন বছর। ইতিমধ্যে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ জায়গা করে নিয়েছে পৃথিবীর অন্যতম সেরা ভাষণ হিসেবে। এ কে খন্দকার রেসকোর্স ময়দানে মিত্রবাহিনীর কাছে পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণকালে তিনি বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্বও করেন। শেষ মুহূর্তে দিল্লি থেকে যখন থিয়েটার রোডে খবর পৌঁছায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী মুক্তিযোদ্ধা নয় মিত্র বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করবে। তখন হতাশা নেমে আসে থিয়েটার রোডে অস্থায়ী প্রবাসী সরকারের দপ্তরে। জেনারেল এমএজি ওসমানীর প্রস্তুতি তখন ভণ্ডুল হয়ে যায়। রেসকোর্সে তিনি না এসে প্রতিনিধিত্ব করতে পাঠান তাঁর ডেপুটি চিফ অব স্টাফ এ কে খন্দকারকে। এক ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাক্ষী হওয়ার বিরল সৌভাগ্য লাভ করেন তিনি। পরে স্বাধীনতার পর ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত ছিলেন বিমান বাহিনীর প্রধান। ছিলেন আওয়ামী লীগ সরকারের পরিকল্পনা মন্ত্রীও। কিন্তু তার বই ১৯৭১: ভেতরে বাইরে প্রকাশিত হওয়ার পর ব্যাপক সমালোচনায় ধীরে ধীরে নিজেকে গুটিয়ে নেন। এমনকি বাসার টেলিফোন এবং ব্যক্তিগত মুঠোফোন ধরা থেকেও বিরত থাকেন। সকল সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগ দেয়া থেকে বিরত থাকেন। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, মাসের পর মাস তিনি বাসার বাইরে বের হন না। তার পেছনে শারীরিক সক্ষমতা যেমন বাধা তেমনি বাধা এই বিতর্কের চাপও। বাসায় বর্তমানে সময় কাটছে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে। পছন্দের বই পড়া আর বিকালে হাঁটাহাঁটি করে সময় কাটে। সাতাশি বছরের এ কে খন্দকার ভুগছেন বয়স্কজনিত নানা শারীরিক জটিলতায়। খানিকটা স্মৃতি বিধূরতাও পেয়ে বসেছে মুক্তিযুদ্ধের এই উপ-অধিনায়ককে। বিদায়ী এই ডিসেম্বরে একটি জাতীয় দৈনিকের দেয়া সম্মাননা ছাড়া আর কোনো অনুষ্ঠানে যোগ দেননি। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কথা বলেননি কোনো সংবাদ মাধ্যমেও। কেমন আছেন জানতে চাইলে এ কে খন্দকার বললেন, খুব একটা ভালো নেই। থেকে থেকে কথা বলেন মুক্তিযুদ্ধকালীন নানা প্রসঙ্গ নিয়ে। কোনো অনুষ্ঠানাদিতে যোগ দিচ্ছেন না কেন- এমন প্রশ্নে বললেন, যা দেখেছি তাতো বইতে লিখেছি। বইতে লিখিত বক্তব্যের ঢেউ আছড়ে পড়েছিল সংসদ পর্যন্ত; ঝড় তুলেছিল সব মহলেই। কিন্তু যে প্রসঙ্গে বিতর্ক তিনি কি সেই অবস্থান থেকে সরে এসেছেন, না যা লিখেছেন তাতেই অনড়। স্পষ্ট করে বললেন, আমি আমার বইতে যা দেখেছি, যা জানি, যা বিশ্বাস করি তার বাইরে একটি কথাও লিখিনি। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসর্মপণ মুহূর্তটি স্মৃতিকে এখনো উজ্জ্বল উল্লেখ করে তিনি বলেন, ১৬ই ডিসেম্বর সকালে ডাক পড়ে প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের। আমাকে নির্দেশ দিলেন, তোমাকে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করতে হবে। বিমান প্রস্তুত আছে। যেভাবে আছো সেভাবেই যাও। কোনোরকম প্রস্তুতি ছাড়াই ছুটে যাই বিমানবন্দরে। পৌঁছে দেখি সকলেই অপেক্ষায় আছে। উঠতে যাবো দেখি জেনারেল অরোরা ও তাঁর স্ত্রী। আমি সরে ওনাদের আগে পথ দেখাতেই তিনি বললেন, ‘ইউ আর ফ্রিডম ফাইটার। ইউ উইল গো ফার্স্ট।’ দমদম বিমানবন্দর থেকে কপ্টারে করে আগরতলা হয়ে ঢাকায় পৌঁছে দেখি বিস্ময়কর দৃশ্য। রাস্তার দু’ধারে মানুষের ঢল। একটি টেবিল আর দুটো চেয়ারে অল্প সময়ের মধ্যেই আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলো।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকালীন সেই দিনগুলোর কথা মনে করে এ কে খন্দকার বলেন, সামরিক বাহিনীর সেকেন্ড ইন কমান্ড ছিলাম। আর পাকিস্তান আমলে বিমান বাহিনীর ক্যাপ্টেন ছিলাম। যা ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যাওয়া বাংলাদেশের কোনো ব্যক্তির সর্বোচ্চ পদ। আমার দায়িত্ব ছিল অনেক বেশি। কাজের ফাঁকে ফাঁকে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে বুঝতে পারছিলাম কিছু একটা হয়েছে। ১৯৭১ সালে প্রায় প্রতিদিনই বিমানে করে তাদের লোক আসছিল তেজগাঁও বিমানবন্দরে। বেসামরিক প্রশাসনের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ করা একেবারেই নিষেধ ছিল। কিন্তু নানান মাধ্যমে আমরা খবরগুলো পৌঁছাতাম। আমার সহধর্মিণীর বড় ভাইয়ের মাধ্যমে আমি তখন কিছু কিছু খবর আওয়ামী লীগের উচ্চ পর্যায়ের নীতিনির্ধারকদের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করেছি।
যখন পঁচিশে মার্চের ক্র্যাকডাউন হয় তখন লুকিয়ে ভারতে চলে যাই। তবে তাও পেরেছিলাম তিন দফা চেষ্টার পর। রাজশাহীসহ বিভিন্ন পথে যাওয়ার চেষ্টাকালে পাকিস্তানিদের নজরদারির কারণে বারবার পথ বদলাতে হয়। পরে এপ্রিলের ১০/১২ তারিখের দিকে দলবলসহ ভারত পৌঁছতে পারি। নয় মাস যে যেখানে ছিল সেখান থেকেই ঐক্যবদ্ধভাবে পরিশ্রম করেছে; দেশের জন্য কাজ করেছে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আমি ছিলাম ডেপুটি চিফ অব স্টাফ। নিয়মিত তদারকির বাইরেও আমাকে মাঝেমধ্যেই যেতে হতো রণাঙ্গনে। সেখানে ছিল ছোট্ট একটি রানওয়ে। মাত্র তিনটি যুদ্ধ বিমান ছিল। সেটা নিয়েই একটি পাহাড়ের পাশে আমরা প্রশিক্ষণ দিয়েছি মুক্তিযোদ্ধাদের। আর বেশিরভাগ সময়ই রাতের দিকে আক্রমণ চালানো হতো।
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করে এ কে খন্দকার বলেন, মুক্তিযুদ্ধের আগে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ সম্ভব ছিল না। তবে দেশ স্বাধীন হলে নানাভাবে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কাজের সুযোগ হয়েছে। তিনি আমাকে স্নেহ করতেন। আমি বঙ্গবন্ধুকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করি। তিনি আমার অত্যন্ত প্রিয় এক ব্যক্তিত্ব। যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশের সেনাবাহিনী তখন খুবই ছোট আকারের। কাজেই তিনি যখনই কোথাও যেতেন সঙ্গে সঙ্গে যেতাম। কারণ ওনার যদি কোনো বিষয়ে জানার থাকে তা সঙ্গে সঙ্গে অবগত করতে হবে।
প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ সম্পর্কে এ কে খন্দকার উল্লেখ করেন, সকল প্রতিকূলতা সত্ত্বেও এই মানুষটি ধৈর্য সহকারে সকল পরিস্থিতির মোকাবিলা করেছেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে নয়মাস কঠোর পরিশ্রম করেছেন। তিনি উদ্যোগ নিয়ে ভারত সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে প্রবাসী সরকারের কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন। একটি ছোট কামরায় দিনের পর দিন এই মানুষটি বাস করেছেন। নিজের কাপড়-চোপড় নিজেই পরিষ্কার করতেন। যুদ্ধ চলাকালে তিনি তার স্ত্রীর সঙ্গে মাত্র একবার দেখা করেছিলেন আধাঘণ্টার জন্য। তাজউদ্দীন আহমদের অবদানকে নানাভাবে খাটো করে দেখার চেষ্টা হচ্ছে। তাঁর অবদানের কারণে বাঙালির কৃতজ্ঞ থাকা উচিত।
কেমন দেশ চেয়েছিলেন এ প্রশ্নে তিনি বলেন, দেশের অনেক কিছু ভালো হয়েছে। আরো ভালো হওয়া উচিত ছিল। যতোটা ভালো চেয়েছিলাম ততটা হয়নি। স্বপ্ন ছিল দেশের মানুষ গণতন্ত্র, সুশাসন, মানবাধিকার, মুক্তভাবে কথা বলার অধিকার পাবে। তার পুরোপুরি এখনো আমরা দেখতে পাচ্ছি না। অনেক খারাপ কিছু আছে যা থেকে আমাদের বের হতে হবে। যতটুকু হয়েছে তার আরো ভালোভাবে হওয়া দরকার ছিল। আমার বিশ্বাস আগামীতে দেশ আরো ভালো হবে।
No comments