মেধা আছে, নেই এর প্রয়োগ
সমাজে কখনও কখনও এমনসব চাঞ্চল্যকর ঘটনা সংঘটিত হয়, নানা কারণে সাধারণ দৃষ্টি বা প্রচলিত আইনকানুন দ্বারা এর প্রকৃত স্বরূপ ও রহস্য উদ্ঘাটন এবং সে অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা সহজ কিংবা সম্ভব হয় না। ঘটনাগুলো যত স্পর্শকাতর ও অবাঞ্ছিত, অনভিপ্রেত ও দুঃখজনকই হোক না কেন, সংঘটিত হওয়ার পর এ নিয়ে প্রথম প্রথম বেশ হৈচৈ, কৌতূহল ও আলোড়ন সৃষ্টি হয়। কিন্তু কর্তৃপক্ষের অবহেলা, খামখেয়ালিপনা, স্বার্থপরতা, অজ্ঞতা বা সদিচ্ছার অভাবে অপরাধীরা সহজে পার পেয়ে যায়। ফলে আসল রহস্য সাধারণের কাছে অনুদ্ঘাটিতই থেকে যায়। আমাদের চারপাশে এমন অসংখ্য দৃষ্টান্ত রয়েছে। অথচ প্রচলিত বিধিবিধানের বাইরে অন্তর্দৃষ্টি বা দূরদৃষ্টি প্রয়োগ করেও এমনসব আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনার সুবিচার নিশ্চিত করা সম্ভব হতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে প্রজ্ঞার পাশাপাশি ব্যক্তির উপস্থিত বুদ্ধি ও সদিচ্ছাটি থাকতেই হবে। দেশে নানা ধরনের আপাত জটিল সংকটের মুখোমুখি হই আমরা। এসব সংকটের সমাধান কঠিন মনে হলেও যথোপযুক্ত প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতা থাকলে সেগুলোর সহজ সমাধান সম্ভব। সমস্যা হচ্ছে, আমরা আমাদের মেধা ও ধীশক্তির প্রয়োগ ঘটাতে চাই না। কখনও কখনও উদাসীন থেকে যাই। তাতে সমস্যা আরও জটিলতর হয়। সমাজের সবাই যদি সুবিবেচনা ও বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিতে সক্ষম হয় তাহলে এ সমাজকে অনেকটাই সমস্যামুক্ত রাখা যেতে পারে। বিচক্ষণতা ও তাৎক্ষণিক বুদ্ধি প্রয়োগ করে যে সত্য উদ্ঘাটন করা যায় তা নিয়ে দুটি গল্প তুলে ধরা যেতে পারে। মা ও সন্তানের বহুল প্রচলিত গল্পটি বোধকরি সবারই জানা।
হাকিমের সামনে এমন এক বিচার এনে উপস্থাপন করা হল যেখানে একটিমাত্র শিশুসন্তানের একই সঙ্গে দাবিদার দু’জন নারী। তারা উভয়ে যার যার গর্ভজাত সন্তান বলে দাবি করছে শিশুটিকে। বিচারক নানাভাবে চেষ্টা করে বুঝে উঠতে না পেরে শেষ পর্যন্ত রায় দিলেন, সন্তানটিকে সমানভাবে মাঝখানে কেটে তাদের দু’জনকেই ভাগ করে দেয়া হবে। রায় শুনে একজন তো মহাখুশি। কখন শিশুটির দেহের অর্ধেক কাটা অংশ তার হাতে আসবে। আর রায় শোনার সঙ্গে সঙ্গে সন্তানের দাবিদার দ্বিতীয়জনের অস্থিরতা বেড়ে গেল- তারা কি সত্যি সত্যিই শিশুটিকে কেটে ফেলবে? ছটফট করতে করতে ওই নারী বলে উঠল, ‘দোহাই ধর্মাবতার, দয়া করে আমার কথা শুনুন। আমি এ শিশুর মা হতে চাই না। ও-ই (অপর নারী) আসলে শিশুটির মা। আমি এতক্ষণ অভিনয় করেছিলাম। দোহাই আপনাদের, শিশুটিকে কাটবেন না।’ স্বনামখ্যাত সাহিত্যিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপস্থিত বুদ্ধি নিয়ে শোনা একটি গল্পের কথা আমার প্রায়ই মনে পড়ে। স্বাধীনতা লাভের অব্যবহিত পর নবম শ্রেণীর ক্লাসে আমাদের মূরারী স্যার (মূরারী মোহন শীল) গল্পটি বলেছিলেন। গল্পটি অনেকটা এ রকম- বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তখন দ্বিতীয় শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে কলকাতার আশপাশের কোনো মফস্বল শহরে কর্মরত। একদিন তার এজলাসে চুরির এমন একটি নালিশ এলো যাতে বাদী ও বিবাদী উভয়েই পরস্পরের বিরুদ্ধে একই অভিযোগ করেছেন। তাদের একজন হলেন গ্রামের কর্তব্যরত চৌকিদার এবং অন্যজন আগন্তুক; ঘটনাসংশ্লিষ্ট বাড়ির একরাতের অতিথি। এমন অদ্ভুত একটি মামলা হাতে পেয়ে বিচারক বঙ্কিমচন্দ্র অনেকটা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন।
তিনি আরও হতবিহ্বল হয়ে পড়েন মামলার একমাত্র সাক্ষী একজন বিধবা মহিলার মুখ থেকে ঘটনার আদ্যোপান্ত বিবরণ শুনে। ওই বিধবার বাড়িতে সংঘটিত ঘটনাকে ঘিরেই এ মামলার সূত্রপাত। সংসারে মহিলার কেউ নেই। রাতে তিনি প্রতিদিনের মতো একাই ঘরে ঘুমানোর প্রস্তুতি নেন। এমন সময় জনৈক আগন্তুক এসে অতিথি হিসেবে রাতটি কাটানোর জন্য তার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করেন। মহিলা বিপদগ্রস্ত লোকটিকে রাতের খাবার খাওয়ানোর পর ঘরের বারান্দায় শোবার ব্যবস্থা করে দিয়ে নিজে ভেতরে গিয়ে ঘুমান। গভীর রাতে লোকজনের চিৎকার শুনে বিধবার ঘুম ভাঙে। বাইরে এসে দেখেন এক তেলেসমাতি কাণ্ড। অতিথি এবং গ্রামের চৌকিদারের মধ্যে রীতিমতো মল্লযুদ্ধ বেধে গেছে। অতিথি বলছেন, চৌকিদার ব্যাটাকে ঘরের মালপত্র চুরি করার সময় তিনি হাতেনাতে ধরে ফেলেছেন। আর চৌকিদার পাল্টা অতিথিকে ধরেই ‘চোর ধরেছেন’ বলে চিৎকার শুরু করে দিয়েছেন। এ ঘটনায় মহিলা তো হতভম্ব। তার বিশ্বাস, অতিথি মানে ‘সাক্ষাৎ নারায়ণ’। তার পক্ষে এ বাড়িতে চুরি করা একেবারেই সম্ভব নয়। এ ছাড়া চৌকিদারকে নিয়ে চুরির কথা ভাবা যায় কীভাবে? গ্রামবাসীর সুবিধা-অসুবিধা ও নিরাপত্তা বিধানে তিনি তো সদা-সক্রিয়। মামলাটি তার এজলাস পর্যন্ত গড়ালে হাকিম হিসেবে বঙ্কিমচন্দ্র নিজেও এ নিয়ে পড়ে যান এক মহাবিড়ম্বনায়। আসলে কে দোষী? শেষ পর্যন্ত তার মাথায় এক বুদ্ধি এলো। সে সময় কলকাতা শহরে সুবিখ্যাত একটি সার্কাস দল ছিল। বঙ্কিমচন্দ্রের সঙ্গে সার্কাস দলের ম্যানেজারের খুবই ভাব। ওই সার্কাস দলে এমন একজন অভিনেতা ছিল, যে কিনা মরার ভান ধরে পড়ে থাকলে সাধারণ কারও পক্ষে তাকে জীবিত ভাবার কোনো অবকাশ থাকত না। বঙ্কিমচন্দ্র যোগাযোগ করলেন ম্যানেজারের সঙ্গে। লোকটি এলে পরিকল্পনা অনুযায়ী মরার ভান করে বেশ দূরের একটি গো-পাটে গিয়ে শুয়ে পড়ে থাকে সে। অভিযুক্ত অতিথি ও চৌকিদারের কাছে হাকিম এ মামলা নিয়ে তার বিড়ম্বনার কথা ব্যক্ত করেন এবং অভিনব শাস্তি হিসেবে দূরের গো-পাট থেকে উভয়কে ‘মরা লাশটি’ বহন করে আনার নির্দেশ দেন।
অনন্যোপায় হয়ে চৌকিদার ও অতিথি তাকে বহন করে এজলাসের দিকে রওনা দেন। এহেন দুর্ভোগ-বিড়ম্বনা ও দুর্গতি-দুর্দশায় তারা খুবই মর্মাহত। রাগ, ক্ষোভ আর অপমানবোধ তাদের একেবারে বোবা বানিয়ে ফেলেছে। কিছুক্ষণ চলার পর চৌকিদারই প্রথম নীরবতা ভেঙে বলতে শুরু করেন, ‘আমি চৌকিদার। গ্রামের সবাই আমাকে বিশ্বাস করে। সুযোগ বুঝে মাঝে-মধ্যে আমি এটা-ওটা চুরি করেই থাকি। আমাকে কেউ কখনও সন্দেহ করে না। আপনি মশাই ভদ্রলোক, একটি রাতের জন্য এসেছেন। আমাকে ধরে অযথা কেন এ ফ্যাসাদে জড়াতে গেলেন? এবার বুঝুন মজা!’ চৌকিদারের মুখে এসব কথা শুনে বেচারা অতিথির অন্তর্জ্বালা যেন আরও বেড়ে গেল। তিনি বলতে থাকেন, ‘মশাই, এ দেশে যে এমন বিচার তা কি আর আমার জানা ছিল? ভাবলাম, বিপদকালে মাতৃসম মহিলা করুণা ও স্নেহপরবশ হয়ে আশ্রয় দিয়েছেন। ক্ষুধার্ত পেটে রাতে তার ঘরে অন্ন গ্রহণ করেছি। এমন পরোপকারীর ঘরে চুরি হবে আর আমি চুপ করে বসে থাকব- ঈশ্বর আর যাই হোক এমন অধর্ম সহ্য করবেন না। আর এ কারণেই তো আপনাকে চুরি করতে দেখে এভাবে জড়িয়ে ধরে চিৎকার শুরু করি।’ এসব কথা বলতে বলতে অতিথি ও চৌকিদার একসময় এজলাসে গিয়ে উপস্থিত হলেন। হাকিমের আসনে উপবিষ্ট বঙ্কিমচন্দ্র স্বয়ং। তার সামনে ঘর থেকে বোঝাটি নামিয়ে মাটিতে রাখতে না রাখতেই ‘মরদেহটি’ সজীব হয়ে ওঠে এবং খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই সোজা হয়ে দাঁড়ায়। সঙ্গে সঙ্গে অভিযুক্ত দু’জনই প্রমাদ গুনেন। তারা উভয়ে স্তম্ভিত হয়ে পড়েন- ব্যাপারটা আসলে কী, এ কী করে সম্ভব! অতঃপর সার্কাস দলের সুদক্ষ অভিনেতার দেয়া স্টেটমেন্ট অনুযায়ী প্রত্যুৎপন্নমতি বিচারকের পক্ষে মামলাটির রায় ঘোষণা করতে আর কোনো ইতস্তত করতে হয়নি।
বিমল সরকার : সহকারী অধ্যাপক
বিমল সরকার : সহকারী অধ্যাপক
No comments