গুচ্ছ পদ্ধতির জন্য আন্তরিকতা দরকার

সমন্বিত বা গুচ্ছভিত্তিক ভর্তি পরীক্ষার বিষয়ে ২০০৮ সালে যে আলোচনা শুরু হয় তার ধারাবাহিকতায় ২০১৩ সালের ৭ জুলাই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে উপাচার্যদের সভায় বেশির ভাগ উপাচার্য সমন্বিত বা গুচ্ছভিত্তিক ভর্তি পরীক্ষার বিষয়ে নীতিগতভাবে একমত পোষণ করেছিলেন। এরপর এ নিয়ে আরও কয়েক দফা আলোচনাও হয়। কিন্তু ফলাফল এখন পর্যন্ত শূন্য। গত বছর যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় গুচ্ছ ভিত্তিতে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও শেষ পর্যন্ত তা কার্যকর হয়নি। ফলে বিগত বছরগুলোর মতো এবারও দুর্ভোগ পোহাতে হবে ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থী ও তাঁদের অভিভাবকদের। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদও ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থীদের দুর্ভোগের কথা স্বীকার করেছেন। চলতি বছর এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন ৮ লাখ ৯৯ হাজার ১৫০ জন এবং জিপিএ-৫ পেয়েছেন ৫৮ হাজার ২৭৬ জন শিক্ষার্থী। উচ্চশিক্ষার ভুবনে প্রবেশের ছাড়পত্র পাওয়া লক্ষাধিক শিক্ষার্থীকে এখন ভর্তি পরীক্ষা নামক বিরাট যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার লক্ষ্যে আরামের ঘুম হারাম করে, খেলাধুলা বন্ধ করে, প্রচণ্ড মানসিক চাপ নিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছুটে বেড়াতে হবে। অভিভাবকদেরও ভোগান্তি পোহাতে হবে, করতে হবে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কর্তৃপক্ষ ও শিক্ষকদের কাছেও যেন লক্ষাধিক ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থী আর তাঁদের অভিভাবকদের কষ্ট, অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় ও দুর্ভোগের চেয়ে ভর্তি ফরম বিক্রি থেকে পাওয়া আয়ের বিষয়টিই বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। মূলত এ কারণেই তাঁরা এর বিপক্ষে।
আগে দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা কম থাকায় পৃথক পরীক্ষা হলেও তেমন একটা সমস্যা হতো না। কিন্তু এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়ার পাশাপাশি ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থীর সংখ্যাও বেড়েছে। বর্তমানে দেশে ৩৮টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। ইতিমধ্যে চলতি শিক্ষাবর্ষে স্নাতক (সম্মান) প্রথম বর্ষে ভর্তি পরীক্ষার সম্ভাব্য তারিখও ঘোষণা করেছে সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্যদের সংগঠন বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় পরিষদ। এখানে আগের মতোই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, দেশের সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলো যদি শিক্ষার্থী ভর্তির জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে পরীক্ষা নিয়ে ফলাফলের ভিত্তিতে কে কোন মেডিকেলে পড়বেন, তা ঠিক করে দিতে পারে, তাহলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কেন তা পারে না? সমস্যা কোথায়? ইউজিসির একাধিক বার্ষিক প্রতিবেদনে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বর্তমান ভর্তি পরীক্ষার পদ্ধতিকে ত্রুটিপূর্ণ, ব্যয়বহুল ও কোচিং-নির্ভর বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ইউজিসির উচ্চশিক্ষা মানোন্নয়ন প্রকল্পের এক গবেষণায় সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনটি গুচ্ছ করে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়। সরকার যদি একযোগে মাসব্যাপী আট-নয় লাখ শিক্ষার্থীর মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা সফলভাবে সম্পন্ন করতে পারে, তাহলে বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কেন মাত্র দুই লক্ষাধিক ছাত্রছাত্রীর ভর্তি পরীক্ষা একযোগে নিতে পারবে না? এ ক্ষেত্রে ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থীরা ভর্তি ফরম পূরণ করার সময় ক্রমান্বয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ও পছন্দের বিষয়ের তালিকা দিতে পারে। তবে এ জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন হবে দক্ষ টেকনিক্যাল জনবল।
এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত হবে বুয়েট, রুয়েট, কুয়েট, চুয়েট ও অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষ শিক্ষক, গবেষকসহ শিক্ষাবিদদের সঙ্গে দ্রুত আলোচনায় বসে করণীয় নির্ধারণ করা। যদিও ‘স্বাতন্ত্র্য’ বজায় রাখার দোহাই দিয়ে অনেক বিশ্ববিদ্যালয় গুচ্ছ ভিত্তিতে ভর্তি পরীক্ষায় রাজি হয় না এবং অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা একমত পোষণ করেন না; কিন্তু এই রাজি না হওয়া কিংবা একমত পোষণ না করার পেছনের প্রকৃত কারণ যে কী, তা আর কারও বুঝতে বাকি থাকে না। প্রকৃত কারণ এই যে উদ্বৃত্ত ভর্তি ফি থেকে বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষকদের কিছু বাড়তি আয় বন্ধ হবে। বাস্তবতা এই যে আবেদন ফরম, খাতা ও পরিদর্শন ফি বাবদ যত টাকা খরচ হয়, তার কয়েক গুণ বেশি টাকা ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আদায় করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। ইউজিসির নির্দেশনা অনুযায়ী, ভর্তি পরীক্ষার আয়ের ৪০ শতাংশ টাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিলে জমা রেখে তা উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে ব্যয় করার কথা। কিন্তু অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় তা করে না বলে অভিযোগ রয়েছে। প্রথম আলোতে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, গত শিক্ষাবর্ষে (২০১৫-১৬) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি ফরম বাবদ আয় করে প্রায় ৮ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় গত শিক্ষাবর্ষে ভর্তি পরীক্ষার ফরম বিক্রি করে আয় করে প্রায় ৭ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। একইভাবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও মোটা অঙ্কের টাকা আয় করে। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন, বিনা মূল্যে পাঠ্যবই বিতরণ, জেএসসি প্রবর্তন এবং মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের পাসের হার বাড়ানোসহ বেশ কিছু ইতিবাচক অর্জন রয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের। গুচ্ছ পদ্ধতি প্রয়োগ করে শিক্ষা মন্ত্রণালয় আরও প্রশংসা ও সাধুবাদ পাবে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কর্তৃপক্ষ এবং শিক্ষকেরা যদি ভর্তি ফরম বিক্রি থেকে পাওয়া আয়ের বিষয়টি বাদ দিতে পারেন এবং ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থী ও তাঁদের অভিভাবকদের সীমাহীন দুর্ভোগের কথা বিবেচনা করেন, তাহলেই কেবল গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব। এতে সামগ্রিকভাবে দেশ ও জাতি উপকৃত হবে। তবে এ জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সার্বিক সহযোগিতা ও আন্তরিকতা।
ড. কুদরাত-ই-খুদা: বিভাগীয় প্রধান, আইন বিভাগ, সিটি ইউনিভার্সিটি।
kekbabu@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.