সমতা, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার by সৈয়দ আবুল মকসুদ
অন্যান্য
বছরের মতো এবারও কয়েকটি টিভি চ্যানেলের সাংবাদিকেরা এসেছেন। প্রায় সবারই
একই ধরনের প্রশ্ন: স্বাধীনতার ৪৪ বছর হলো। একাত্তরে প্রত্যাশা কী ছিল এবং
এই সময়ে প্রাপ্তি কতটা?
প্রথাগত প্রশ্নের প্রথাগত জবাব দিলেই ল্যাঠা চুকে যায়। বলেছি, ৪৪ বছরে বাংলাদেশের জনগণ ও সরকারের অর্জন তো অবশ্যই আছে। ব্যর্থতার কথা শুনতে ভালো লাগে না, তা না বলাই ভালো। আর প্রত্যাশা কী ছিল—সেসব পুরোনো বিষয় নিয়ে কথা বলা আরও বিরক্তিকর। প্রত্যাশা ব্যক্তির মনের ভেতরের ব্যাপার। আমার প্রত্যাশা এক রকম ছিল তো আরেকজনের প্রত্যাশা ছিল আরেক রকম। এমনও হতে পারে, একাত্তরে একজনের যা প্রত্যাশা ছিল, স্বাধীন বাংলাদেশ থেকে তার প্রাপ্তি ঘটেছে হাজার গুণ বেশি। একাত্তরে অনেকের স্বপ্ন ছিল, দেশ একদিন স্বাধীন হবে, বেতনও একটু বাড়বে, চাল-ডাল, মাছ-তরকারির দাম একটু কমবে এবং মাসে ২৫ থেকে ৩০ টাকা ব্যাংকে জমাবেন। এখন তাঁর কাছে ব্যাংকগুলোর আড়াই থেকে তিন হাজার কোটি টাকা পাওনা বকেয়া আছে। আমি কয়েকজন সংবাদকর্মীকে বলেছি, আমাদের মতো অক্ষম ও অসন্তুষ্ট মানুষের মতামত না নিয়ে সেই ধরনের মানুষদের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির কথা জিজ্ঞেস করুন। তাঁরা দেবেন সবচেয়ে শ্রুতিমধুর উত্তর। ওই ধরনের মানুষের অনেককেই আপনি চিনতে পারবেন তাঁদের পোশাক থেকে। কয়েক বছর যাবৎ তাঁদের জামা-কাপড়ের রঙে লাল ও সবুজ কিছুটা থাকবেই। তাঁদের স্ত্রীদের আনুষ্ঠানিক পোশাক শাড়ি হলে থাকবে জমিন সবুজ এবং পাড়টা লাল, ব্লাউজেও লাল-সবুজ থাকবেই এবং সালোয়ার-কামিজ হলে একটা যদি লাল হয় তো অন্যটা সবুজ। ওড়নাটা দুই রঙের যেকোনো একটির শেড। এখন পোশাকেই দেশপ্রেমের প্রকাশ পায়। চিরকাল যা ছিল বুকের গহনতম ভেতরের জিনিস, আজ তা শরীরের ওপরে সাঁটানো।
একাত্তরের ১৭ এপ্রিল বৈদ্যনাথতলা গ্রামে যে ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ পঠিত হয়, তাতে ‘বাংলাদেশের জনগণের জন্য সমতা, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে... সার্বভৌম জনগণের প্রজাতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার প্রতিজ্ঞা ও অঙ্গীকার প্রকাশ করা হয়। বলতে গেলে সেদিন প্রায় সবার প্রত্যাশা ওইটুকুই ছিল। তবে তার পরেও কারও কারও ব্যক্তিগত স্বপ্ন থাকলেও থাকতে পারে। যেমন আথালে গরু আছে তিনটি, তা দিয়ে সাত বিঘা জমিতে হাল দেওয়া কঠিন, স্বাধীনতার পরে আর এক জোড়া ষাঁড় যদি কেনা যায়! শ্রমিক এলাকার কোনো শ্রমিক মুক্তিযোদ্ধা ভেবে থাকতে পারেন স্বাধীনতার পরে বেতন কুড়ি টাকা বাড়তে পারে। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন এমন কোনো কেরানি বা লোয়ার ডিভিশন ক্লার্ক (এলডিসি) স্বপ্ন দেখলেও দেখতে পারেন দেশ স্বাধীন হলে একটা প্রমোশন পেয়ে হেডক্লার্ক বা আপার ডিভিশন ক্লার্ক (ইউডিসি) হতে পারেন, কারণ একই পদে চাকরি হলো ১১ বছর। একজন ইউডিসি সেকশন অফিসার হওয়ার প্রত্যাশা করতেই পারেন।
তবে স্বাধীনতার চেতনা একটি সম্মিলিত একক চেতনা, স্বাধীনতার স্বপ্ন একটি ঐক্যবদ্ধ স্বপ্ন। তার সঙ্গে ব্যক্তিগত আশা-আকাঙ্ক্ষা, প্রত্যাশা, লাভ-লোকসানের কোনো সম্পর্ক নেই। তা থাকলে স্বাধীনতার জন্য মানুষ অকাতরে জীবন দিতে পারে না। স্বাধীনতার জন্য যিনি নিজের জীবন উৎসর্গ করতে প্রস্তুত, তিনি খুব ভালোই জানেন, তাঁর মৃত্যুর পরে তিনি সব চাওয়া-পাওয়ার ঊর্ধ্বে উঠে যাবেন। বেতনও বাড়বে না, প্রমোশনও হবে না, ব্যাংক থেকে ঋণও নেওয়া যাবে না ভুয়া কাগজপত্র দেখিয়ে, সুতরাং তা ফেরত না দেওয়ার প্রশ্নই আসে না।
ষাটের দশকে আমরা যারা সরাসরি কোনো দলীয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম না, তবে স্বৈরশাসন ও পশ্চিমাদের দখলদারত্ব অপছন্দ করতাম, অত্যাচার ও প্রতিক্রিয়াশীলতার বিরোধিতা করতাম, ধর্ম থেকে রাষ্ট্রকে আলাদা দেখতে চাইতাম, তাদের কাছে ওই অবস্থার বিকল্প ছিল উদারতাবাদ ও মার্ক্সীয় বামপন্থা। যে দল পূর্ব বাংলার পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে কথা বলত, তাকে সমর্থন দিতাম তার একজন কর্মী না হয়েও। যে দল সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করত, তাকে সমর্থন ও সহযোগিতা দিতাম ওই দলের একজন ক্যাডারের মতোই। ষাটের দশকে আমাদের স্বপ্ন ছিল ডানপন্থী প্রতিক্রিয়াশীলদের পরাস্ত করে উদার গণতান্ত্রিক ও অসামরিক ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার। সেই স্বপ্নেরই প্রতিফলন ঘটে বৈদ্যনাথতলার ঘোষণায়।
বৈদ্যনাথতলার ঘোষণার পক্ষকাল আগে থেকেই আমাদের মতো তরুণেরা যার যার মতো এবং ‘যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে’ যা করণীয় তা-ই করছিল। কিন্তু ১৭ এপ্রিলের ঘোষণায় যখন বলা হলো আমাদের জন্মভূমিতে ‘এটি জনগণের প্রজাতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠিত হবে, তখন সব অনিশ্চয়তা ও সন্দেহ দূর হয়ে যায়। বৈদ্যনাথতলার ঘোষণায় কিছুমাত্র ফাঁকি ছিল, অস্পষ্টতা ছিল—তা সেদিনও রেডিওতে শুনে মনে করিনি, আজও করি না। তবে এইটুকু শুধু লক্ষ করি যে ওই ঘোষণার প্রতিজ্ঞার সঙ্গে আজকের বাংলাদেশের বাস্তবতার আসমান-জমিন ফারাক।
১৯৭০-এর ডিসেম্বর থেকে ’৭১-এর ডিসেম্বর পর্যন্ত ১২টি মাস আমি স্বাধীনতা বলতে বুঝেছি, রাষ্ট্রের অন্যায় হস্তক্ষেপ থেকে দেশের প্রত্যেক নাগরিক মুক্ত থাকবে। সেটাই আমার বিবেচনায় ছিল মুক্তি ও স্বাধীনতা। সেই মুক্তির সংগ্রামের শেষ অধ্যায়টির সূচনা ১৯৭১-এর মার্চ মাসে। রাষ্ট্রের অন্যায্য ও অমানবিক হস্তক্ষেপ যেন ব্যক্তির স্বাধীন বিকাশকে ব্যাহত না করে। রাষ্ট্র হবে উদারতাবাদী বা লিবারেল।
রাষ্ট্রের সেই উদারতা অবশ্য আমরা চাই না, যেখানে একজন ব্যক্তিস্বাধীনতার দোহাই দিয়ে বলবে আমাকে ডাকাতি করার অধিকার দাও, সরকারি জমি ও নদীর তীর দখল করার অধিকার দাও বা একটি মেয়েকে রাস্তায় উত্ত্যক্ত করার অধিকার দাও। আমি সেই ব্যক্তিস্বাধীনতার পক্ষে, যা প্রত্যেক ব্যক্তির স্বাধীনভাবে তার ইতিবাচক বিকাশের পথ উন্মুক্ত করে। আমি চাইব সরকারের নীতির ঘোর বিরোধী একটি মেয়ে বা ছেলে তার প্রতিভা বিকাশের জন্য, তার বৈজ্ঞানিক গবেষণা চালানোর জন্য রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আনুকূল্য পাবে। কারণ, ভিন্নমত পোষণের জন্মগত অধিকার তার যেমন রয়েছে, তেমনি তার মেধার স্বাধীন বিকাশ ও দক্ষতা প্রয়োগের পূর্ণ সুযোগ পাওয়ার অধিকারও রয়েছে। একটি উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য হলো এই বিষয়গুলোকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া।
মানবিক মর্যাদা সমুন্নত রেখে উদার ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা স্বাধীনতার প্রধান শর্ত। বড় বড় দালান ও সেতু বানানোর চেয়ে মানবিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা, ন্যায়বিচার ও আইনের শাসন নিশ্চিত করা আগে জরুরি। উদারতাবাদের শ্রেষ্ঠত্ব কোথায়? উদারতাবাদী রাজনৈতিক সংস্কৃতি অন্ধ মতাদর্শী ও গোঁড়াদেরও জায়গা করে দেয়। কিন্তু অনুদার স্বৈরশাসন তাদের মতের বিপরীত—তা উদারই হোক বা প্রতিক্রিয়াশীলই হোক—কাউকেই সহ্য করে না। একটি বিরক্তিকর প্রবণতা আমাদের একশ্রেণির কথিত প্রগতিশীলদের মধ্যে লক্ষ করা যায়। রক্ষণশীল ও প্রতিক্রিয়াশীলদের ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে এবং আরও বহু ব্যাপারে তাঁরা কঠোর সমালোচনার অধিকার চান। কিন্তু চিন্তার স্বাধীনতা নিয়ে রক্ষণশীলদের চিন্তার অধিকারকে হরণ করতে দ্বিধা করেন না। অনেক প্রগতিশীল চান সব মানুষ তাঁদের প্রতি সম্মান দেখাবে, কিন্তু তাঁরা ভিন্নমতাবলম্বীদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে কথা বলবেন না। তাঁরা প্রতিপক্ষকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করবেন। ভিন্নমতের মানুষের সঙ্গে একসঙ্গে বসবাসের পরিবেশ যে সমাজে ও রাষ্ট্রে নেই, সে সমাজ উদার ও আধুনিক নয়, সে সমাজ মধ্যযুগীয়। সে সমাজে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের কোনো মূল্য নেই।
সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার ও দাবি ছিল বাংলাদেশের মানুষের। কিন্তু আশির দশক থেকে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অনুকূল অবস্থাটা আর রইল না। তা ছাড়া, ষাটের দশকে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার যে বৈপ্লবিক অবস্থা সৃষ্টি হয়, তা ’৭০ ও ’৮০-র দশকে ধরে রাখার মতো সমাজবাদী নেতা বাংলাদেশে ছিলেন না। বাংলাদেশে কমিউনিস্ট বলে যারা পরিচিত, তারা বহুকাল মহাত্মা মার্ক্সের নামটিও মুখে নেয় না, সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথাও বলে না, প্রতিদিন ‘সাম্প্রদায়িকতা’ ‘সাম্প্রদায়িকতা’ বলে রাজনীতিতে অস্তিত্ব রক্ষা করে চলেছে। মার্ক্সবাদী দর্শনের প্রয়োগ ছাড়া সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যায় না। সাম্প্রদায়িকতা রোগ নয়, উপসর্গ।
সোভিয়েত ইউনিয়ন খণ্ডবিখণ্ড হওয়ার পর উপযুক্ত নেতৃত্ব থাকলে উদারতাবাদী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা আমাদের জন্য সহজ ছিল। কারণ, শাশ্বত বাঙালি সংস্কৃতির মধ্যেই উদারতাবাদ রয়েছে। ধর্মীয় সহিষ্ণুতা রয়েছে। সহাবস্থানের স্বভাব বাঙালির মধ্যে রয়েছে। পর্যায়ক্রমে অসাংবিধানিক সামরিক শাসন ও সাংবিধানিক স্বৈরশাসন বিশেষ করে সামরিক-আধা সামরিক অপশাসন বাংলাদেশে একটি উদারতাবাদী গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি নির্মাণের পথ রোধ করে দেয়। যে মানবিক মর্যাদার অঙ্গীকার করা হয়েছিল একাত্তরে বৈদ্যনাথতলায়, তা থেকে বাংলাদেশ সরে আসে। রাষ্ট্রে সবাই সমান নয়, আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। কারও কারও ক্ষেত্রে যতটা প্রাপ্য, তার চেয়ে বেশি প্রযোজ্য।
উপযুক্ত ভাতাপ্রাপ্ত দলীয় পাবলিসিটি অফিসারের মতো অনেক স্বনামধন্য বিদ্বান প্রচার করছেন, অর্থনীতিই সব। গোলটেবিল ও মহাসমাবেশে প্রদত্ত তাঁদের বক্তৃতা থেকে শোনা যায় দেশের অর্থনীতি (এবং তাঁদের নিজেদের অর্থনৈতিক অবস্থা) ভালো হলে সব সামাজিক-রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। তাঁদের তত্ত্ব—মুক্তবাজার অর্থনীতি দারিদ্র্য কমায়, কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে, সামাজিক বৈষম্য কমায় প্রভৃতি। আমাদের মতো অল্প জ্ঞানগম্য যাদের, তারা এই ধারণার সমর্থক নই। বাজার অর্থনীতি কিছু মানুষকে অবশ্যই অতি দ্রুত বিত্তবান বানাতে পারে। বাজার অর্থনীতি দুর্নীতি বাড়ায় এবং প্রতিযোগিতা দিয়ে স্বার্থপর হতে শেখায়। বাজার অর্থনীতিতে বিত্তবান শ্রেণিটি তাদের স্বার্থের অনুকূল হলে স্বৈরশাসন টিকিয়ে রাখতে, ভিন্নমত দমন করতে সরকারকে বুদ্ধি–পরামর্শ দেয় ও সহযোগিতা করে। নীতি-আদর্শ বিসর্জন দিয়ে অতি দ্রুত মধ্যম আয়ের দেশ হতে গিয়ে যদি খুনখারাবি, অপহরণ, গুম প্রভৃতি অপরাধে সমাজ অস্থির হয়ে ওঠে, মানুষের মানবিক মর্যাদা বলে কিছু না থাকে, তাতে জনগণের লাভটা কী?
বাংলার মাটি আজ অগণিত কৃতী ব্যক্তির ছবিসংবলিত সুশোভিত বিলবোর্ড ও ডিজিটাল ব্যানারে পরিপূর্ণ। ভারত, চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার মানুষও অত ডিজিটাল ব্যানার দেখেনি। আমার যদি অর্থবিত্ত ও সংগতি থাকত, আমিও সারা দেশে রাস্তায় রাস্তায় টাঙিয়ে দিতাম ডিজিটাল ব্যানার। তাতে লেখা থাকত বৈদ্যনাথতলায় উচ্চারিত ‘বাংলাদেশের জনগণের জন্য সমতা, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত’ করার অঙ্গীকার বাস্তবায়নের দাবি।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
প্রথাগত প্রশ্নের প্রথাগত জবাব দিলেই ল্যাঠা চুকে যায়। বলেছি, ৪৪ বছরে বাংলাদেশের জনগণ ও সরকারের অর্জন তো অবশ্যই আছে। ব্যর্থতার কথা শুনতে ভালো লাগে না, তা না বলাই ভালো। আর প্রত্যাশা কী ছিল—সেসব পুরোনো বিষয় নিয়ে কথা বলা আরও বিরক্তিকর। প্রত্যাশা ব্যক্তির মনের ভেতরের ব্যাপার। আমার প্রত্যাশা এক রকম ছিল তো আরেকজনের প্রত্যাশা ছিল আরেক রকম। এমনও হতে পারে, একাত্তরে একজনের যা প্রত্যাশা ছিল, স্বাধীন বাংলাদেশ থেকে তার প্রাপ্তি ঘটেছে হাজার গুণ বেশি। একাত্তরে অনেকের স্বপ্ন ছিল, দেশ একদিন স্বাধীন হবে, বেতনও একটু বাড়বে, চাল-ডাল, মাছ-তরকারির দাম একটু কমবে এবং মাসে ২৫ থেকে ৩০ টাকা ব্যাংকে জমাবেন। এখন তাঁর কাছে ব্যাংকগুলোর আড়াই থেকে তিন হাজার কোটি টাকা পাওনা বকেয়া আছে। আমি কয়েকজন সংবাদকর্মীকে বলেছি, আমাদের মতো অক্ষম ও অসন্তুষ্ট মানুষের মতামত না নিয়ে সেই ধরনের মানুষদের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির কথা জিজ্ঞেস করুন। তাঁরা দেবেন সবচেয়ে শ্রুতিমধুর উত্তর। ওই ধরনের মানুষের অনেককেই আপনি চিনতে পারবেন তাঁদের পোশাক থেকে। কয়েক বছর যাবৎ তাঁদের জামা-কাপড়ের রঙে লাল ও সবুজ কিছুটা থাকবেই। তাঁদের স্ত্রীদের আনুষ্ঠানিক পোশাক শাড়ি হলে থাকবে জমিন সবুজ এবং পাড়টা লাল, ব্লাউজেও লাল-সবুজ থাকবেই এবং সালোয়ার-কামিজ হলে একটা যদি লাল হয় তো অন্যটা সবুজ। ওড়নাটা দুই রঙের যেকোনো একটির শেড। এখন পোশাকেই দেশপ্রেমের প্রকাশ পায়। চিরকাল যা ছিল বুকের গহনতম ভেতরের জিনিস, আজ তা শরীরের ওপরে সাঁটানো।
একাত্তরের ১৭ এপ্রিল বৈদ্যনাথতলা গ্রামে যে ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ পঠিত হয়, তাতে ‘বাংলাদেশের জনগণের জন্য সমতা, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে... সার্বভৌম জনগণের প্রজাতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার প্রতিজ্ঞা ও অঙ্গীকার প্রকাশ করা হয়। বলতে গেলে সেদিন প্রায় সবার প্রত্যাশা ওইটুকুই ছিল। তবে তার পরেও কারও কারও ব্যক্তিগত স্বপ্ন থাকলেও থাকতে পারে। যেমন আথালে গরু আছে তিনটি, তা দিয়ে সাত বিঘা জমিতে হাল দেওয়া কঠিন, স্বাধীনতার পরে আর এক জোড়া ষাঁড় যদি কেনা যায়! শ্রমিক এলাকার কোনো শ্রমিক মুক্তিযোদ্ধা ভেবে থাকতে পারেন স্বাধীনতার পরে বেতন কুড়ি টাকা বাড়তে পারে। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন এমন কোনো কেরানি বা লোয়ার ডিভিশন ক্লার্ক (এলডিসি) স্বপ্ন দেখলেও দেখতে পারেন দেশ স্বাধীন হলে একটা প্রমোশন পেয়ে হেডক্লার্ক বা আপার ডিভিশন ক্লার্ক (ইউডিসি) হতে পারেন, কারণ একই পদে চাকরি হলো ১১ বছর। একজন ইউডিসি সেকশন অফিসার হওয়ার প্রত্যাশা করতেই পারেন।
তবে স্বাধীনতার চেতনা একটি সম্মিলিত একক চেতনা, স্বাধীনতার স্বপ্ন একটি ঐক্যবদ্ধ স্বপ্ন। তার সঙ্গে ব্যক্তিগত আশা-আকাঙ্ক্ষা, প্রত্যাশা, লাভ-লোকসানের কোনো সম্পর্ক নেই। তা থাকলে স্বাধীনতার জন্য মানুষ অকাতরে জীবন দিতে পারে না। স্বাধীনতার জন্য যিনি নিজের জীবন উৎসর্গ করতে প্রস্তুত, তিনি খুব ভালোই জানেন, তাঁর মৃত্যুর পরে তিনি সব চাওয়া-পাওয়ার ঊর্ধ্বে উঠে যাবেন। বেতনও বাড়বে না, প্রমোশনও হবে না, ব্যাংক থেকে ঋণও নেওয়া যাবে না ভুয়া কাগজপত্র দেখিয়ে, সুতরাং তা ফেরত না দেওয়ার প্রশ্নই আসে না।
ষাটের দশকে আমরা যারা সরাসরি কোনো দলীয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম না, তবে স্বৈরশাসন ও পশ্চিমাদের দখলদারত্ব অপছন্দ করতাম, অত্যাচার ও প্রতিক্রিয়াশীলতার বিরোধিতা করতাম, ধর্ম থেকে রাষ্ট্রকে আলাদা দেখতে চাইতাম, তাদের কাছে ওই অবস্থার বিকল্প ছিল উদারতাবাদ ও মার্ক্সীয় বামপন্থা। যে দল পূর্ব বাংলার পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে কথা বলত, তাকে সমর্থন দিতাম তার একজন কর্মী না হয়েও। যে দল সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করত, তাকে সমর্থন ও সহযোগিতা দিতাম ওই দলের একজন ক্যাডারের মতোই। ষাটের দশকে আমাদের স্বপ্ন ছিল ডানপন্থী প্রতিক্রিয়াশীলদের পরাস্ত করে উদার গণতান্ত্রিক ও অসামরিক ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার। সেই স্বপ্নেরই প্রতিফলন ঘটে বৈদ্যনাথতলার ঘোষণায়।
বৈদ্যনাথতলার ঘোষণার পক্ষকাল আগে থেকেই আমাদের মতো তরুণেরা যার যার মতো এবং ‘যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে’ যা করণীয় তা-ই করছিল। কিন্তু ১৭ এপ্রিলের ঘোষণায় যখন বলা হলো আমাদের জন্মভূমিতে ‘এটি জনগণের প্রজাতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠিত হবে, তখন সব অনিশ্চয়তা ও সন্দেহ দূর হয়ে যায়। বৈদ্যনাথতলার ঘোষণায় কিছুমাত্র ফাঁকি ছিল, অস্পষ্টতা ছিল—তা সেদিনও রেডিওতে শুনে মনে করিনি, আজও করি না। তবে এইটুকু শুধু লক্ষ করি যে ওই ঘোষণার প্রতিজ্ঞার সঙ্গে আজকের বাংলাদেশের বাস্তবতার আসমান-জমিন ফারাক।
১৯৭০-এর ডিসেম্বর থেকে ’৭১-এর ডিসেম্বর পর্যন্ত ১২টি মাস আমি স্বাধীনতা বলতে বুঝেছি, রাষ্ট্রের অন্যায় হস্তক্ষেপ থেকে দেশের প্রত্যেক নাগরিক মুক্ত থাকবে। সেটাই আমার বিবেচনায় ছিল মুক্তি ও স্বাধীনতা। সেই মুক্তির সংগ্রামের শেষ অধ্যায়টির সূচনা ১৯৭১-এর মার্চ মাসে। রাষ্ট্রের অন্যায্য ও অমানবিক হস্তক্ষেপ যেন ব্যক্তির স্বাধীন বিকাশকে ব্যাহত না করে। রাষ্ট্র হবে উদারতাবাদী বা লিবারেল।
রাষ্ট্রের সেই উদারতা অবশ্য আমরা চাই না, যেখানে একজন ব্যক্তিস্বাধীনতার দোহাই দিয়ে বলবে আমাকে ডাকাতি করার অধিকার দাও, সরকারি জমি ও নদীর তীর দখল করার অধিকার দাও বা একটি মেয়েকে রাস্তায় উত্ত্যক্ত করার অধিকার দাও। আমি সেই ব্যক্তিস্বাধীনতার পক্ষে, যা প্রত্যেক ব্যক্তির স্বাধীনভাবে তার ইতিবাচক বিকাশের পথ উন্মুক্ত করে। আমি চাইব সরকারের নীতির ঘোর বিরোধী একটি মেয়ে বা ছেলে তার প্রতিভা বিকাশের জন্য, তার বৈজ্ঞানিক গবেষণা চালানোর জন্য রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আনুকূল্য পাবে। কারণ, ভিন্নমত পোষণের জন্মগত অধিকার তার যেমন রয়েছে, তেমনি তার মেধার স্বাধীন বিকাশ ও দক্ষতা প্রয়োগের পূর্ণ সুযোগ পাওয়ার অধিকারও রয়েছে। একটি উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য হলো এই বিষয়গুলোকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া।
মানবিক মর্যাদা সমুন্নত রেখে উদার ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা স্বাধীনতার প্রধান শর্ত। বড় বড় দালান ও সেতু বানানোর চেয়ে মানবিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা, ন্যায়বিচার ও আইনের শাসন নিশ্চিত করা আগে জরুরি। উদারতাবাদের শ্রেষ্ঠত্ব কোথায়? উদারতাবাদী রাজনৈতিক সংস্কৃতি অন্ধ মতাদর্শী ও গোঁড়াদেরও জায়গা করে দেয়। কিন্তু অনুদার স্বৈরশাসন তাদের মতের বিপরীত—তা উদারই হোক বা প্রতিক্রিয়াশীলই হোক—কাউকেই সহ্য করে না। একটি বিরক্তিকর প্রবণতা আমাদের একশ্রেণির কথিত প্রগতিশীলদের মধ্যে লক্ষ করা যায়। রক্ষণশীল ও প্রতিক্রিয়াশীলদের ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে এবং আরও বহু ব্যাপারে তাঁরা কঠোর সমালোচনার অধিকার চান। কিন্তু চিন্তার স্বাধীনতা নিয়ে রক্ষণশীলদের চিন্তার অধিকারকে হরণ করতে দ্বিধা করেন না। অনেক প্রগতিশীল চান সব মানুষ তাঁদের প্রতি সম্মান দেখাবে, কিন্তু তাঁরা ভিন্নমতাবলম্বীদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে কথা বলবেন না। তাঁরা প্রতিপক্ষকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করবেন। ভিন্নমতের মানুষের সঙ্গে একসঙ্গে বসবাসের পরিবেশ যে সমাজে ও রাষ্ট্রে নেই, সে সমাজ উদার ও আধুনিক নয়, সে সমাজ মধ্যযুগীয়। সে সমাজে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের কোনো মূল্য নেই।
সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার ও দাবি ছিল বাংলাদেশের মানুষের। কিন্তু আশির দশক থেকে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অনুকূল অবস্থাটা আর রইল না। তা ছাড়া, ষাটের দশকে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার যে বৈপ্লবিক অবস্থা সৃষ্টি হয়, তা ’৭০ ও ’৮০-র দশকে ধরে রাখার মতো সমাজবাদী নেতা বাংলাদেশে ছিলেন না। বাংলাদেশে কমিউনিস্ট বলে যারা পরিচিত, তারা বহুকাল মহাত্মা মার্ক্সের নামটিও মুখে নেয় না, সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথাও বলে না, প্রতিদিন ‘সাম্প্রদায়িকতা’ ‘সাম্প্রদায়িকতা’ বলে রাজনীতিতে অস্তিত্ব রক্ষা করে চলেছে। মার্ক্সবাদী দর্শনের প্রয়োগ ছাড়া সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যায় না। সাম্প্রদায়িকতা রোগ নয়, উপসর্গ।
সোভিয়েত ইউনিয়ন খণ্ডবিখণ্ড হওয়ার পর উপযুক্ত নেতৃত্ব থাকলে উদারতাবাদী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা আমাদের জন্য সহজ ছিল। কারণ, শাশ্বত বাঙালি সংস্কৃতির মধ্যেই উদারতাবাদ রয়েছে। ধর্মীয় সহিষ্ণুতা রয়েছে। সহাবস্থানের স্বভাব বাঙালির মধ্যে রয়েছে। পর্যায়ক্রমে অসাংবিধানিক সামরিক শাসন ও সাংবিধানিক স্বৈরশাসন বিশেষ করে সামরিক-আধা সামরিক অপশাসন বাংলাদেশে একটি উদারতাবাদী গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি নির্মাণের পথ রোধ করে দেয়। যে মানবিক মর্যাদার অঙ্গীকার করা হয়েছিল একাত্তরে বৈদ্যনাথতলায়, তা থেকে বাংলাদেশ সরে আসে। রাষ্ট্রে সবাই সমান নয়, আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। কারও কারও ক্ষেত্রে যতটা প্রাপ্য, তার চেয়ে বেশি প্রযোজ্য।
উপযুক্ত ভাতাপ্রাপ্ত দলীয় পাবলিসিটি অফিসারের মতো অনেক স্বনামধন্য বিদ্বান প্রচার করছেন, অর্থনীতিই সব। গোলটেবিল ও মহাসমাবেশে প্রদত্ত তাঁদের বক্তৃতা থেকে শোনা যায় দেশের অর্থনীতি (এবং তাঁদের নিজেদের অর্থনৈতিক অবস্থা) ভালো হলে সব সামাজিক-রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। তাঁদের তত্ত্ব—মুক্তবাজার অর্থনীতি দারিদ্র্য কমায়, কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে, সামাজিক বৈষম্য কমায় প্রভৃতি। আমাদের মতো অল্প জ্ঞানগম্য যাদের, তারা এই ধারণার সমর্থক নই। বাজার অর্থনীতি কিছু মানুষকে অবশ্যই অতি দ্রুত বিত্তবান বানাতে পারে। বাজার অর্থনীতি দুর্নীতি বাড়ায় এবং প্রতিযোগিতা দিয়ে স্বার্থপর হতে শেখায়। বাজার অর্থনীতিতে বিত্তবান শ্রেণিটি তাদের স্বার্থের অনুকূল হলে স্বৈরশাসন টিকিয়ে রাখতে, ভিন্নমত দমন করতে সরকারকে বুদ্ধি–পরামর্শ দেয় ও সহযোগিতা করে। নীতি-আদর্শ বিসর্জন দিয়ে অতি দ্রুত মধ্যম আয়ের দেশ হতে গিয়ে যদি খুনখারাবি, অপহরণ, গুম প্রভৃতি অপরাধে সমাজ অস্থির হয়ে ওঠে, মানুষের মানবিক মর্যাদা বলে কিছু না থাকে, তাতে জনগণের লাভটা কী?
বাংলার মাটি আজ অগণিত কৃতী ব্যক্তির ছবিসংবলিত সুশোভিত বিলবোর্ড ও ডিজিটাল ব্যানারে পরিপূর্ণ। ভারত, চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার মানুষও অত ডিজিটাল ব্যানার দেখেনি। আমার যদি অর্থবিত্ত ও সংগতি থাকত, আমিও সারা দেশে রাস্তায় রাস্তায় টাঙিয়ে দিতাম ডিজিটাল ব্যানার। তাতে লেখা থাকত বৈদ্যনাথতলায় উচ্চারিত ‘বাংলাদেশের জনগণের জন্য সমতা, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত’ করার অঙ্গীকার বাস্তবায়নের দাবি।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
No comments