সাইবার মাধ্যমে জঙ্গিরা: রাষ্ট্র এখনো ঘুমিয়ে by মিজানুর রহমান খান
এক
মাসের ব্যবধানে অভিজিৎ রায় ও ওয়াশিকুর হত্যাকাণ্ডের পর প্রশ্ন ওঠা
স্বাভাবিক, এরপর কে? মত প্রকাশের জন্য হুমায়ুন আজাদ হত্যাকাণ্ডের পর এক
দশকের বিরতিতে ঘটে ব্লগার রাজীব হত্যাকাণ্ড। কিন্তু রাজীব থেকে অভিজিতে
আসতে দুই বছর, আর অভিজিৎ থেকে ওয়াশিকুরে পৌঁছাতে সময় লেগেছে এক মাস। আমরা
অল্প সময়ের ব্যবধানে তিনজন ব্লগারকে হারালাম। এই তিনটি আলোচিত হত্যাকাণ্ডই
কেবল নয়, ব্লগারদের ওপর পরিচালিত আরও কয়েকটি হামলার ঘটনা বিশ্লেষণ করে
দেখা গেছে, জঙ্গিরা অনলাইনকে মাধ্যম হিসেবে অপব্যবহার করে ঘটনাগুলো
ঘটিয়েছে।
‘আনসারুল্লাহ বাংলা টিম’ নামের একটি সংগঠনের কথা গণমাধ্যমে খুব আসছে। ধারণা করা হচ্ছে, এই আনসারুল্লাহর অস্তিত্ব ও কার্যক্রমের মূল ভিত্তি হলো অনলাইন। অভিজিৎ ও ওয়াশিকুর—এই দুই খুনের সঙ্গেই তাদের ‘স্লিপার সেল’-এর যোগসূত্র রয়েছে বলে জানিয়েছেন তদন্তকারীরা। ওয়াশিকুরের খুনের বিচার হবে ফৌজদারি আইনে। কিন্তু তাঁকে খুন করতে গিয়ে যদি সাইবার স্পেসের অপব্যবহার ঘটে, তাহলে তার বিচার হবে সাইবার ট্রাইব্যুনালে। কিন্তু সাইবার আইনে জঙ্গিদের বিচার ও দণ্ড ও তাদের মোকাবিলা করতে চাইলে একটি অনুকূল অবকাঠামো, যথাযথ সাজসরঞ্জাম ও দক্ষ জনবল থাকতে হবে।
আমরা একটা চকিত অনুসন্ধান চালিয়েছি গত বুধবার। খুবই দুর্ভাগ্য যে ২০০৬ সালে পাস হওয়া তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ব্যবহার কার্যকর ক্ষেত্রে হচ্ছে না। বিতর্কিত তথ্যপ্রযুক্তি আইন, যা সাইবার অপরাধীদের দমন করবে, তার চেয়ে অনেক বেশি আলোচিত হচ্ছে সরকারবিরোধী ভিন্নমতকে দমন করার কাজে ব্যবহারের জন্য। ২০০৬ সালের তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা নিয়ে গত সপ্তাহে এই কলামে আলোচনা করেছি। তাতে দেখা গেছে, রাষ্ট্রযন্ত্র এই আইনকে সরকারবিরোধী মত দমনে ব্যবহারে বেশি উৎসাহী।
অনেক দেরি হয়ে যাওয়ার আগেই সাইবার স্পেসে জঙ্গি প্রতিরোধের জায়গা থেকেও দেখার অভ্যাসটা গড়ে তুলতে হবে। মনে রাখতে হবে, অনগ্রসর গণতান্ত্রিক দেশগুলো সাইবার আইন করতে গিয়ে সরকারের সমালোচকদের শায়েস্তা করার দিকটি মাথায় রেখেছে। বাংলাদেশ তার ব্যতিক্রম নয়। ফিলিপাইন ২০১২ সালে সাইবার আইন করল, কিন্তু তার কার্যকারিতা সুপ্রিম কোর্ট স্থগিত করলেন, কারণ সরকারের সমালোচকদের শায়েস্তা করার বিধান সেখানে ছিল। ফিলিপাইনের মতো দেশ যা পারে বা পারবে, তা বাংলাদেশ করতে গেলে কতগুলো ভয়ানক বিপদ ঘটতে পারে। আর সেটা হলো ধর্মের প্রশ্ন। এখানে খুব সাবধানে পা ফেলতে হবে।
উগ্রপন্থীদের দমন করা আর সমালোচকদের একই অস্ত্রে ঘায়েল করতে গেলে তা বুমেরাং হতে পারে। কিন্তু রাষ্ট্র কী ধরনের অস্ত্রপাতি নিয়ে ধেয়ে আসা সাইবার সুনামি মোকাবিলায় বসে আছে, সেটা জানতে গিয়ে যে প্রাথমিক ধারণা পাওয়া গেল, তা বিস্মিত হওয়ার মতো। কান ঝালাপালা করা রাজনৈতিক বাগাড়ম্বর, হুমকি-ধমকি ও স্তুতিবাদ প্রচারণার তুলনায় সাইবার মাধ্যম ব্যবহার করে জঙ্গিদের তৎপরতা বা অপরাধ দমনে প্রশাসনিক ও অবকাঠামোগত প্রস্তুতি এখনো যে প্রায় শূন্যের কোঠায়, সেটা মানতে কষ্ট হচ্ছে। যে বিড়াল ইঁদুর মারে, তার গোঁফ দেখে নাকি চেনা যায়। তাই সারা বিশ্বে সাইবার অপরাধ, বিশেষ করে জঙ্গিগোষ্ঠীর যোগাযোগ, অর্থায়ন ও মানি লন্ডারিং নিয়ে এত হইচই, তা নিয়ে আমাদের আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকবলটা কী রকম, তার খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করেছি। কারণ, সাইবার অপরাধ ঠিক আর দশটা অপরাধের খুনখারাবির মতো প্রশিক্ষণহীন পুলিশি জনবলের মামুলি কাজ হওয়ার নয়। তাই কতজন লোককে এই রাষ্ট্র বিশেষভাবে সাইবার অপরাধ দমনে ২৪ ঘণ্টা নিয়োজিত রেখেছে, তা জানাটাকেই বড় কর্তব্য মনে করলাম।
র্যা ব ও ডিবি—উভয় সংস্থাই অবশ্য মনে করে যে সাইবার অপরাধ ও এই মাধ্যমকে কাজে লাগিয়ে নানা অপরাধ তৎপরতার ওপর নজরদারি ও তা দমন করা বাংলাদেশের জন্য একটি বিরাট গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এ পর্যন্ত তাদের প্রস্তুতি শোচনীয় বললেও কম বলা হবে। আমরা আশা করব, র্যা ব ও ডিবির বক্তব্যকে নীতিনির্ধারকেরা যথাযথ গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করবেন। প্রথমে যোগাযোগ করি সাইবার বিষয়ে তদারকের দায়িত্বে থাকা ডিবির জয়েন্ট কমিশনার মনিরুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি আমাকে খুদে বার্তায় লেখেন: ‘ঢাকা মহানগর পুলিশের কোনো সাইবার ক্রাইম সেল ছিল না। আমি বিদ্যমান জনবল থেকে পাঁচজনকে দিয়ে একটি ক্ষুদ্র সেল গঠনের চেষ্টা করছি। কিন্তু তার জন্য কোনো আলাদা প্রশিক্ষণ কিংবা যন্ত্রপাতি নেই। যারা কাজ করছে, তারা ব্যক্তিগত উদ্যোগ ও যোগ্যতাবলে কিছু কিছু কাজ করছে। পুলিশের শুধু সিআইডিতে ১০ থেকে ১২ জনের একটি ইউনিট আছে, আর র্যা বের একটি শক্তিশালী সাইবার ইউনিট রয়েছে।’
এরপর যোগাযোগ করি র্যা বের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়াউল আহসানের সঙ্গে। তিনি সাইবার বিষয়ে একটি কাজে দিল্লিতে ছিলেন। তিনি টেলিফোনে যা বললেন, তাতে র্যা বের শক্তিশালী সাইবার ইউনিট থাকার ধারণা টেকে না। কারণ, অনধিক ১০ জনের সমন্বয়ে তাঁদের যে সেলটি সক্রিয়, তার নামকরণেই সেটা স্পষ্ট। এর নাম সাইবার প্রোপাগান্ডা সেল। অবশ্য কর্নেল জিয়া বলেন যে সাইবার অপরাধ বিষয়ে র্যা বকে শক্তিশালী করার চিন্তাভাবনা চলছে। ডিবি কমিশনারও জানালেন, সিআইডির ইউনিটকে ৪০ সদস্যের এবং ঢাকা মহানগর পুলিশে ২০ সদস্যের একটি ইউনিট গঠনের প্রস্তাব বিবেচনাধীন রয়েছে। সীমান্তহীন সাইবার অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হওয়া রাষ্ট্রের এই প্রস্তুতিও অত্যন্ত অপ্রতুল। প্রতিবেশীসহ অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতার আলোকে করণীয় নির্ধারণে অবিলম্বে একটি বিশেষ কমিটি হওয়া উচিত।
এই রাষ্ট্র ২০০৬ সালে সাইবার অপরাধ দমনে ট্রাইব্যুনাল গঠনের বিধান করে। এর সাত বছর পরে ২০১৩ সালে প্রথম সাইবার ট্রাইব্যুনাল গঠন করল দৃশ্যত রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে শাস্তি দিতে। এই রাষ্ট্র সাইবার জঙ্গিদের কাছে এই বার্তা দিতে এখনো বেশ দূরে যে সাইবার ক্রাইমস ট্রাইব্যুনাল এসেছে সাইবার অপরাধ দমনে। ওয়াশিকুরের যে ঘাতকেরা ধরা পড়েছে, তারা মগজ ধোলাইয়ের শিকার। কিন্তু এর মূল পরিকল্পনাকারীরাই হতে পারে সাইবার অপরাধী, যাঁদের কথায় ধরা পড়া দুই মাদ্রাসাছাত্র ঢাকায় এসেছিল। নেপথ্যে থাকা এই কুশীলবেরা হলো সাইবার স্বাধীনতার নতুন শত্রু। আর বাংলাদেশের এই নতুন শত্রুদের নতুন রণক্ষেত্র হলো ইন্টারনেটের জগৎ।
আইএসের মতো শক্তির সঙ্গে বাংলাদেশি উগ্রপন্থীদের যোগাযোগটা ক্রমেই দৃশ্যমান বা প্রকৃত হলেও হতে পারে, এটা ধরে নিয়েই বাংলাদেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে প্রস্তুতি নিতে হবে। উগ্রপন্থীদের বর্তমানে দৃশ্যত নির্জীব থাকা বা ঘুম পাড়িয়ে রাখতে সক্ষম হওয়া দেখে আশ্বস্ত হওয়ার তেমন কোনো কারণ নেই। কারণ, গ্রেপ্তার হওয়া দুই অনুশোচনাহীন, এমনকি কৃতকর্মের জন্য গর্বিত দুই জঙ্গি জানান দিচ্ছে, তাদের মতো লোক দিয়ে যেকোনো সময় সহজেই অনর্থ ঘটানো সম্ভব। জঙ্গিরা ও তাদের আন্তর্জাতিক মুরব্বিরা বুঝে গিয়েছে বাংলাদেশের সমাজে জঙ্গিবাদের প্রতি জনসমর্থন যতই ন্যূনতম হোক না কেন, তারা চাইলে যা নয় তার চেয়ে বহুগুণ বেশি ভয় পাইয়ে দিতে পারে।
ইন্টারনেট নতুন ক্ষেত্র তৈরি করে দিয়েছে। মত প্রকাশের জন্য হত্যাকাণ্ডকে সবচেয়ে বেশি সংবেদনশীল বলে মনে করা হচ্ছে। কারণ, আইএসের প্রতি বাংলাদেশি বংশোদ্ভূতসহ পশ্চিমা সমাজের বিপথগামী তরুণ-তরুণীদের আকৃষ্ট ও তাদের বাস্তব অংশগ্রহণ নিশ্চিত হওয়ার পেছনে অনলাইন মাধ্যমে সাইবার জঙ্গিরাই মূল ভূমিকা রাখছে। অভিজিৎ রায়কে হত্যা করার মতো
ফেসবুক স্ট্যাটাস দিয়ে ফারাবী জামিন নিয়ে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন। এই ফারাবী নিজে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত কি না, তার চেয়ে বড় কথা হত্যাকাণ্ড সংঘটনের আগ পর্যন্ত রাষ্ট্র তাঁকে নিয়ে তেমন উদ্বিগ্ন ছিল না।
সাইবার মাধ্যম ব্যবহার করে জঙ্গি তৎপরতার সঙ্গে জড়িতদের বিচারের কোনো অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন আমরা করতে পারিনি। যদিও কয়েকজন ‘জঙ্গি’ ব্লগারের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। আগেই বলেছি, ‘আনসারুল্লাহ বাংলা টিম’ এখন পর্যন্ত এমন একটি সাইবার নেটওয়ার্ক, যার বিস্তারিত জানা ও বোঝা অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে। এটা স্পষ্ট যে অন্যান্য সাইবার অপরাধ ক্রমেই বৃদ্ধি পাওয়ার পাশাপাশি সাইবার জঙ্গিরা বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তাকে এক ভয়ানক চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। তাই তাদের পরবর্তী নিশানা কে বা কারা, তার সুলুক সন্ধানে আমাদের দক্ষ সাইবার গোয়েন্দা ও প্রশাসন তৈরি করতে হবে। অথচ এখনো গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সাইবার নজরদারির ব্যবস্থা ভীষণ দুর্বল কিংবা অনুপস্থিত। অভিজিৎ রায়কে খুনের ঘটনায় দেওয়া তদন্ত প্রতিবেদনে পুলিশের দায়মুক্তি আমাদের অবাক করেছে।
মার্কিন সমীক্ষা সংস্থা পিউর জরিপমতে, বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১২ শতাংশের নিচে, তবে এটা ক্রমবর্ধমান। সুতরাং নীতিনির্ধারকদের সামনে মুখ্য বিবেচনার বিষয় হলো, সাইবার মাধ্যম ব্যবহার করে জঙ্গি তৎপরতাসহ নানা অপরাধ সুনামিতে রূপ নেওয়ার আগে উপযুক্ত রক্ষাকবচ সৃষ্টি করতে হবে। সাইবার ট্রাইব্যুনালে যেসব ব্লগার আসামি হয়েছেন, তাঁদের গায়ে কথিতমতে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের গন্ধ লেগে আছে। প্রধানমন্ত্রীকে অবমাননা করার ঘটনায় সাইবার আদালত দণ্ড দিয়েছেন। সাইবার-কাণ্ডের হদিস পেতে র্যা ব দামি যন্ত্র কিনছে। সাইবার জঙ্গি ধরার কাজে তা ব্যবহার করা হলে বিষয়টি স্বস্তির, কিন্তু সরকারের প্রতিপক্ষ দমনে ব্যবহৃত হলে তা উদ্বেগের। মত প্রকাশের জন্য সরকারযন্ত্র যদি মানুষ খুন করে, তাহলে সেই সরকারযন্ত্র মত প্রকাশের জন্য খুনের দায়ে সাইবার জঙ্গিদের বিচার করার নৈতিক সাহস হারাতে পারে।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷
mrkhanbd@gmail.com
‘আনসারুল্লাহ বাংলা টিম’ নামের একটি সংগঠনের কথা গণমাধ্যমে খুব আসছে। ধারণা করা হচ্ছে, এই আনসারুল্লাহর অস্তিত্ব ও কার্যক্রমের মূল ভিত্তি হলো অনলাইন। অভিজিৎ ও ওয়াশিকুর—এই দুই খুনের সঙ্গেই তাদের ‘স্লিপার সেল’-এর যোগসূত্র রয়েছে বলে জানিয়েছেন তদন্তকারীরা। ওয়াশিকুরের খুনের বিচার হবে ফৌজদারি আইনে। কিন্তু তাঁকে খুন করতে গিয়ে যদি সাইবার স্পেসের অপব্যবহার ঘটে, তাহলে তার বিচার হবে সাইবার ট্রাইব্যুনালে। কিন্তু সাইবার আইনে জঙ্গিদের বিচার ও দণ্ড ও তাদের মোকাবিলা করতে চাইলে একটি অনুকূল অবকাঠামো, যথাযথ সাজসরঞ্জাম ও দক্ষ জনবল থাকতে হবে।
আমরা একটা চকিত অনুসন্ধান চালিয়েছি গত বুধবার। খুবই দুর্ভাগ্য যে ২০০৬ সালে পাস হওয়া তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ব্যবহার কার্যকর ক্ষেত্রে হচ্ছে না। বিতর্কিত তথ্যপ্রযুক্তি আইন, যা সাইবার অপরাধীদের দমন করবে, তার চেয়ে অনেক বেশি আলোচিত হচ্ছে সরকারবিরোধী ভিন্নমতকে দমন করার কাজে ব্যবহারের জন্য। ২০০৬ সালের তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা নিয়ে গত সপ্তাহে এই কলামে আলোচনা করেছি। তাতে দেখা গেছে, রাষ্ট্রযন্ত্র এই আইনকে সরকারবিরোধী মত দমনে ব্যবহারে বেশি উৎসাহী।
অনেক দেরি হয়ে যাওয়ার আগেই সাইবার স্পেসে জঙ্গি প্রতিরোধের জায়গা থেকেও দেখার অভ্যাসটা গড়ে তুলতে হবে। মনে রাখতে হবে, অনগ্রসর গণতান্ত্রিক দেশগুলো সাইবার আইন করতে গিয়ে সরকারের সমালোচকদের শায়েস্তা করার দিকটি মাথায় রেখেছে। বাংলাদেশ তার ব্যতিক্রম নয়। ফিলিপাইন ২০১২ সালে সাইবার আইন করল, কিন্তু তার কার্যকারিতা সুপ্রিম কোর্ট স্থগিত করলেন, কারণ সরকারের সমালোচকদের শায়েস্তা করার বিধান সেখানে ছিল। ফিলিপাইনের মতো দেশ যা পারে বা পারবে, তা বাংলাদেশ করতে গেলে কতগুলো ভয়ানক বিপদ ঘটতে পারে। আর সেটা হলো ধর্মের প্রশ্ন। এখানে খুব সাবধানে পা ফেলতে হবে।
উগ্রপন্থীদের দমন করা আর সমালোচকদের একই অস্ত্রে ঘায়েল করতে গেলে তা বুমেরাং হতে পারে। কিন্তু রাষ্ট্র কী ধরনের অস্ত্রপাতি নিয়ে ধেয়ে আসা সাইবার সুনামি মোকাবিলায় বসে আছে, সেটা জানতে গিয়ে যে প্রাথমিক ধারণা পাওয়া গেল, তা বিস্মিত হওয়ার মতো। কান ঝালাপালা করা রাজনৈতিক বাগাড়ম্বর, হুমকি-ধমকি ও স্তুতিবাদ প্রচারণার তুলনায় সাইবার মাধ্যম ব্যবহার করে জঙ্গিদের তৎপরতা বা অপরাধ দমনে প্রশাসনিক ও অবকাঠামোগত প্রস্তুতি এখনো যে প্রায় শূন্যের কোঠায়, সেটা মানতে কষ্ট হচ্ছে। যে বিড়াল ইঁদুর মারে, তার গোঁফ দেখে নাকি চেনা যায়। তাই সারা বিশ্বে সাইবার অপরাধ, বিশেষ করে জঙ্গিগোষ্ঠীর যোগাযোগ, অর্থায়ন ও মানি লন্ডারিং নিয়ে এত হইচই, তা নিয়ে আমাদের আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকবলটা কী রকম, তার খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করেছি। কারণ, সাইবার অপরাধ ঠিক আর দশটা অপরাধের খুনখারাবির মতো প্রশিক্ষণহীন পুলিশি জনবলের মামুলি কাজ হওয়ার নয়। তাই কতজন লোককে এই রাষ্ট্র বিশেষভাবে সাইবার অপরাধ দমনে ২৪ ঘণ্টা নিয়োজিত রেখেছে, তা জানাটাকেই বড় কর্তব্য মনে করলাম।
র্যা ব ও ডিবি—উভয় সংস্থাই অবশ্য মনে করে যে সাইবার অপরাধ ও এই মাধ্যমকে কাজে লাগিয়ে নানা অপরাধ তৎপরতার ওপর নজরদারি ও তা দমন করা বাংলাদেশের জন্য একটি বিরাট গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এ পর্যন্ত তাদের প্রস্তুতি শোচনীয় বললেও কম বলা হবে। আমরা আশা করব, র্যা ব ও ডিবির বক্তব্যকে নীতিনির্ধারকেরা যথাযথ গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করবেন। প্রথমে যোগাযোগ করি সাইবার বিষয়ে তদারকের দায়িত্বে থাকা ডিবির জয়েন্ট কমিশনার মনিরুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি আমাকে খুদে বার্তায় লেখেন: ‘ঢাকা মহানগর পুলিশের কোনো সাইবার ক্রাইম সেল ছিল না। আমি বিদ্যমান জনবল থেকে পাঁচজনকে দিয়ে একটি ক্ষুদ্র সেল গঠনের চেষ্টা করছি। কিন্তু তার জন্য কোনো আলাদা প্রশিক্ষণ কিংবা যন্ত্রপাতি নেই। যারা কাজ করছে, তারা ব্যক্তিগত উদ্যোগ ও যোগ্যতাবলে কিছু কিছু কাজ করছে। পুলিশের শুধু সিআইডিতে ১০ থেকে ১২ জনের একটি ইউনিট আছে, আর র্যা বের একটি শক্তিশালী সাইবার ইউনিট রয়েছে।’
এরপর যোগাযোগ করি র্যা বের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়াউল আহসানের সঙ্গে। তিনি সাইবার বিষয়ে একটি কাজে দিল্লিতে ছিলেন। তিনি টেলিফোনে যা বললেন, তাতে র্যা বের শক্তিশালী সাইবার ইউনিট থাকার ধারণা টেকে না। কারণ, অনধিক ১০ জনের সমন্বয়ে তাঁদের যে সেলটি সক্রিয়, তার নামকরণেই সেটা স্পষ্ট। এর নাম সাইবার প্রোপাগান্ডা সেল। অবশ্য কর্নেল জিয়া বলেন যে সাইবার অপরাধ বিষয়ে র্যা বকে শক্তিশালী করার চিন্তাভাবনা চলছে। ডিবি কমিশনারও জানালেন, সিআইডির ইউনিটকে ৪০ সদস্যের এবং ঢাকা মহানগর পুলিশে ২০ সদস্যের একটি ইউনিট গঠনের প্রস্তাব বিবেচনাধীন রয়েছে। সীমান্তহীন সাইবার অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হওয়া রাষ্ট্রের এই প্রস্তুতিও অত্যন্ত অপ্রতুল। প্রতিবেশীসহ অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতার আলোকে করণীয় নির্ধারণে অবিলম্বে একটি বিশেষ কমিটি হওয়া উচিত।
এই রাষ্ট্র ২০০৬ সালে সাইবার অপরাধ দমনে ট্রাইব্যুনাল গঠনের বিধান করে। এর সাত বছর পরে ২০১৩ সালে প্রথম সাইবার ট্রাইব্যুনাল গঠন করল দৃশ্যত রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে শাস্তি দিতে। এই রাষ্ট্র সাইবার জঙ্গিদের কাছে এই বার্তা দিতে এখনো বেশ দূরে যে সাইবার ক্রাইমস ট্রাইব্যুনাল এসেছে সাইবার অপরাধ দমনে। ওয়াশিকুরের যে ঘাতকেরা ধরা পড়েছে, তারা মগজ ধোলাইয়ের শিকার। কিন্তু এর মূল পরিকল্পনাকারীরাই হতে পারে সাইবার অপরাধী, যাঁদের কথায় ধরা পড়া দুই মাদ্রাসাছাত্র ঢাকায় এসেছিল। নেপথ্যে থাকা এই কুশীলবেরা হলো সাইবার স্বাধীনতার নতুন শত্রু। আর বাংলাদেশের এই নতুন শত্রুদের নতুন রণক্ষেত্র হলো ইন্টারনেটের জগৎ।
আইএসের মতো শক্তির সঙ্গে বাংলাদেশি উগ্রপন্থীদের যোগাযোগটা ক্রমেই দৃশ্যমান বা প্রকৃত হলেও হতে পারে, এটা ধরে নিয়েই বাংলাদেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে প্রস্তুতি নিতে হবে। উগ্রপন্থীদের বর্তমানে দৃশ্যত নির্জীব থাকা বা ঘুম পাড়িয়ে রাখতে সক্ষম হওয়া দেখে আশ্বস্ত হওয়ার তেমন কোনো কারণ নেই। কারণ, গ্রেপ্তার হওয়া দুই অনুশোচনাহীন, এমনকি কৃতকর্মের জন্য গর্বিত দুই জঙ্গি জানান দিচ্ছে, তাদের মতো লোক দিয়ে যেকোনো সময় সহজেই অনর্থ ঘটানো সম্ভব। জঙ্গিরা ও তাদের আন্তর্জাতিক মুরব্বিরা বুঝে গিয়েছে বাংলাদেশের সমাজে জঙ্গিবাদের প্রতি জনসমর্থন যতই ন্যূনতম হোক না কেন, তারা চাইলে যা নয় তার চেয়ে বহুগুণ বেশি ভয় পাইয়ে দিতে পারে।
ইন্টারনেট নতুন ক্ষেত্র তৈরি করে দিয়েছে। মত প্রকাশের জন্য হত্যাকাণ্ডকে সবচেয়ে বেশি সংবেদনশীল বলে মনে করা হচ্ছে। কারণ, আইএসের প্রতি বাংলাদেশি বংশোদ্ভূতসহ পশ্চিমা সমাজের বিপথগামী তরুণ-তরুণীদের আকৃষ্ট ও তাদের বাস্তব অংশগ্রহণ নিশ্চিত হওয়ার পেছনে অনলাইন মাধ্যমে সাইবার জঙ্গিরাই মূল ভূমিকা রাখছে। অভিজিৎ রায়কে হত্যা করার মতো
ফেসবুক স্ট্যাটাস দিয়ে ফারাবী জামিন নিয়ে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন। এই ফারাবী নিজে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত কি না, তার চেয়ে বড় কথা হত্যাকাণ্ড সংঘটনের আগ পর্যন্ত রাষ্ট্র তাঁকে নিয়ে তেমন উদ্বিগ্ন ছিল না।
সাইবার মাধ্যম ব্যবহার করে জঙ্গি তৎপরতার সঙ্গে জড়িতদের বিচারের কোনো অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন আমরা করতে পারিনি। যদিও কয়েকজন ‘জঙ্গি’ ব্লগারের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। আগেই বলেছি, ‘আনসারুল্লাহ বাংলা টিম’ এখন পর্যন্ত এমন একটি সাইবার নেটওয়ার্ক, যার বিস্তারিত জানা ও বোঝা অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে। এটা স্পষ্ট যে অন্যান্য সাইবার অপরাধ ক্রমেই বৃদ্ধি পাওয়ার পাশাপাশি সাইবার জঙ্গিরা বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তাকে এক ভয়ানক চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। তাই তাদের পরবর্তী নিশানা কে বা কারা, তার সুলুক সন্ধানে আমাদের দক্ষ সাইবার গোয়েন্দা ও প্রশাসন তৈরি করতে হবে। অথচ এখনো গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সাইবার নজরদারির ব্যবস্থা ভীষণ দুর্বল কিংবা অনুপস্থিত। অভিজিৎ রায়কে খুনের ঘটনায় দেওয়া তদন্ত প্রতিবেদনে পুলিশের দায়মুক্তি আমাদের অবাক করেছে।
মার্কিন সমীক্ষা সংস্থা পিউর জরিপমতে, বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১২ শতাংশের নিচে, তবে এটা ক্রমবর্ধমান। সুতরাং নীতিনির্ধারকদের সামনে মুখ্য বিবেচনার বিষয় হলো, সাইবার মাধ্যম ব্যবহার করে জঙ্গি তৎপরতাসহ নানা অপরাধ সুনামিতে রূপ নেওয়ার আগে উপযুক্ত রক্ষাকবচ সৃষ্টি করতে হবে। সাইবার ট্রাইব্যুনালে যেসব ব্লগার আসামি হয়েছেন, তাঁদের গায়ে কথিতমতে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের গন্ধ লেগে আছে। প্রধানমন্ত্রীকে অবমাননা করার ঘটনায় সাইবার আদালত দণ্ড দিয়েছেন। সাইবার-কাণ্ডের হদিস পেতে র্যা ব দামি যন্ত্র কিনছে। সাইবার জঙ্গি ধরার কাজে তা ব্যবহার করা হলে বিষয়টি স্বস্তির, কিন্তু সরকারের প্রতিপক্ষ দমনে ব্যবহৃত হলে তা উদ্বেগের। মত প্রকাশের জন্য সরকারযন্ত্র যদি মানুষ খুন করে, তাহলে সেই সরকারযন্ত্র মত প্রকাশের জন্য খুনের দায়ে সাইবার জঙ্গিদের বিচার করার নৈতিক সাহস হারাতে পারে।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷
mrkhanbd@gmail.com
No comments