আওয়ামী লীগ কি ভয় পেয়েছে? by সোহরাব হাসান
যাঁরা
সরকারের অন্ধ সমালোচক—তার ভালো কাজও বাঁকা চোখে দেখেন—তাঁরা
ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, বিএনপি এলে তিন সিটি করপোরেশন (ঢাকা উত্তর-দক্ষিণ ও
চট্টগ্রাম) নির্বাচনই হবে না। ক্ষমতাসীনেরা যেকোনো অজুহাতে সেটি বানচাল
করে দেবেন। অন্যদিকে বিএনপির কট্টর বিরোধিতাকারীরা এ ধারণা দিয়েছিলেন যে
দলটি শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে আসবে না। নির্বাচনে যদি আসেও, কোনো না কোনো
বাহানায় সরে দাঁড়াবে। কিন্তু আশার কথা, এই দলবাজ নৈরাশ্যবাদী
বুদ্ধিজীবীদের চেয়ে রাজনীতিকেরা বেশি বাস্তববাদী। দুই পক্ষের পরম
‘শুভানুধ্যায়ীদের’ চরম মতকে অসার প্রমাণ করে দিয়ে সরকার তিন সিটি করপোরেশন
নির্বাচনের বাধাটি সরিয়ে নিয়েছে এবং বিএনপিও ৫ জানুয়ারির মতো নির্বাচন
বর্জন না করে ‘আন্দোলনের অংশ’ হিসেবে হলেও ভোটযুদ্ধে নেমে পড়েছে। দুই
পক্ষ জাতীয় রাজনীতির সব ক্ষেত্রে এই মনোভাব দেখালে দেশ অনেক অঘটন থেকেই
রেহাই পেত।
নির্বাচন করার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের (ইসি) হলেও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের ‘ছাড়পত্র’ ছাড়া তারা স্থানীয় সরকার সংস্থার নির্বাচন করতে পারে না। এ কারণেই ঢাকা সিটি করপোরেশনের নির্বাচনটি এত দিন আটকে ছিল। ইতিমধ্যে ইসি তিন সিটির মেয়র ও কাউন্সিলর পদে প্রার্থিতা চূড়ান্ত করেছে এবং প্রার্থীরা অনানুষ্ঠানিক প্রচারও চালাচ্ছেন। ৭ এপ্রিল থেকে শুরু হবে আনুষ্ঠানিক প্রচার।
ঢাকা উত্তরে ব্যবসায়ী নেতা আবদুল আউয়াল মিন্টুর প্রার্থিতা বাতিল হওয়ায় বিএনপি বেশ বেকায়দায় পড়েছে। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী আরেক ব্যবসায়ী নেতা আনিসুল হক, যিনি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সমর্থন নিয়ে লড়ছেন। দক্ষিণে বিএনপির প্রার্থী মির্জা আব্বাসের বিরুদ্ধে বহু মামলা। শেষ পর্যন্ত তিনি প্রকাশ্য প্রচারে আসতে পারবেন কি না বলা কঠিন। সেখানে আওয়ামী লীগের প্রার্থী সাঈদ খোকন। মান-অভিমান ভুলে শেষ পর্যন্ত তাঁকে সমর্থন জানানোর ঘোষণা দিয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতা ও স্বতন্ত্র সাংসদ হাজি সেলিম, পদত্যাগপত্র ছিঁড়ে ফেলায় যিনি জাতীয় সংসদেই আক্ষেপ করেছিলেন। আবদুল আউয়াল মিন্টুর বিকল্প প্রার্থী কে হবেন—মাহী বি চৌধুরী, না আবদুল আউয়াল মিন্টুর ছেলে তাবিথ আউয়াল—বিএনপি হাইকমান্ড এখনো সেই সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি। তা সত্ত্বেও আওয়ামী শিবিরে উদ্বেগ লক্ষণীয়। ঢাকার তুলনায় চট্টগ্রামে দুই দলের অবস্থান সংহত। প্রার্থী ধার করে আনতে হয়নি। সেখানে আওয়ামী লীগের পুরো নেতৃত্ব আ জ ম নাছিরের পক্ষে এবং মনজুর আলমের পক্ষে অনানুষ্ঠানিক প্রচারণা চালাচ্ছে বিএনপি।
কিছুদিন আগেও দেশে পেট্রলবোমা, ককটেল, বাসে, অফিসে আগুন দিয়ে মানুষ হত্যা এবং তার বিপরীতে পাইকারি মামলা, গণগ্রেপ্তার ও ক্রসফায়ারের যে মহড়া চলছিল, সেটি পুরোপুরি বন্ধ না হলেও স্তিমিত হয়ে আসছে। তখন রাজনীতিটা হয়ে পড়েছিল সন্ত্রাসনির্ভর। একদিকে বোমাসন্ত্রাস আরেক দিকে দমন-পীড়ন। মানুষ বড় অসহায় বোধ করেছিল।
এই প্রেক্ষাপটে সিটি নির্বাচন দেশবাসীর জন্য অনেকটা স্বস্তি নিয়ে এসেছে। কিন্তু এই স্বস্তি কত দিন স্থায়ী হবে, তা নির্ভর করছে নির্বাচনটি কেমন হবে, তার ওপর। যদি নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ হয়, মানুষ যদি নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারেন এবং ফলাফলে তার প্রতিফলন ঘটে, তাহলে মানুুষ খুশি হবেন। পাঁচ বছর পর চট্টগ্রাম সিটি এবং ১৩ বছর পর ঢাকা সিটি নির্বাচিত প্রতিনিধি পাবে।
চরম বৈরী ও বিদ্বেষমূলক রাজনৈতিক পরিবেশে যে সিটি নির্বাচন হতে যাচ্ছে, তাতে প্রার্থীর চেয়ে ভোটাররা বেশি বিবেচনায় নেবেন দল তথা শীর্ষ নেতৃত্বকে। অনেকের মতে, এই নির্বাচনে আরও একবার শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার জনপ্রিয়তা যাচাই হবে।
নির্বাচন করে নির্বাচন কমিশন। কিন্তু প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী, তাঁদের সমর্থক দলগুলোর সহায়তা ছাড়া তাদের পক্ষে এই গুরুদায়িত্ব পালন করা সম্ভব নয়। নির্বাচনের তিনটি প্রক্রিয়া আছে। প্রথমত, ভোটারদের কাছে প্রার্থীর বক্তব্য তুলে ধরা অর্থাৎ প্রচারণা। দ্বিতীয়ত, ভোটারদের নির্বিঘ্নে ভোটাধিকার প্রয়োগ এবং তৃতীয়ত, ফলাফলে জনরায়ের প্রতিফলন। এর যেকোনো একটিতে ব্যত্যয় ঘটলে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হতে বাধ্য।
কয়েক দিন আগে বিএনপির একটি প্রতিনিধিদল সিইসির সঙ্গে দেখা করে নির্বাচনে সবার সমান সুযোগ সৃষ্টি করতে কিছু দাবি পেশ করেছে; যার মধ্যে আছে প্রার্থী ও নেতা-কর্মীদের ওপর থেকে ‘মিথ্যা মামলা’ প্রত্যাহার, নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয় খুলে দেওয়া ও বিরোধী দলকে সভা-সমাবেশ করতে দেওয়া। দাবিগুলো যৌক্তিক। নির্বাচন কমিশনের উচিত অবিলম্বে বিএনপি অফিসের তালা খোলার ব্যবস্থা করা। এর বিনিময়ে বিএনপিকেও হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি প্রত্যাহার করতে হবে। আর প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্তব্য ইসিকে সর্বতোভাবে সহায়তা করা। ইসিকে কথা নয়, কাজ দিয়েই প্রমাণ করতে হবে তারা দক্ষ, যোগ্য এবং নিরপেক্ষ। নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও এই কমিশনই অনেকগুলো সিটি করপোরেশন নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করতে পেরেছে। এখন কাজী রকিবউদ্দীন আহমদকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে তিনি এ টি এম শামসুল হুদা কিংবা মোহাম্মদ আবু হেনা হবেন, নাকি এম এ সাদেক ও এম এ আজিজ হবেন? এ টি এম শামসুল হুদা ২০০৮ সালে প্রতিকূল পরিবেশে একটি সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করেছিলেন। আবু হেনা শেখ হাসিনার প্রথম সরকারের আমলে কারচুপির অভিযোগ থাকায় ঘাটাইল উপনির্বাচনের ফলাফল গেজেট বিজ্ঞপ্তি করেননি। তাঁর পদত্যাগের পরই সেটি হয়েছিল। এম এ সাদেক ১৫ ফেব্রুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচন করে ব্যাপকভাবে নিন্দিত হয়েছিলেন। এম এ আজিজের আত্মম্ভরিতার কারণে ২০০৭ সালে নির্বাচনটিই করা সম্ভব হয়নি।
এবার কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ যদি সিটি নির্বাচনটি অবাধ ও সুষ্ঠু করতে পারেন, তাহলে তাঁর অতীতের অনেক ব্যর্থতা মানুষ ভুলে যাবে। তিনি সফল হলে রাজনীতিতেই কেবল সুস্থতা ফিরে আসবে না, পরবর্তী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে যে জট তৈরি হয়েছে, তা খোলার পথও সুগম হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আস্থার সম্পর্ক গড়ে উঠবে। একে অপরের বুকে ছুরি মারতে আস্তিনের ভেতরে ছুরি নিয়ে ঘুরবে না। সিটি নির্বাচন সুষ্ঠু হলে বিরোধী দল সরকারকে যতই চাপে রাখুক না কেন, হরতাল-অবরোধ চালিয়ে যেতে পারবে না।
কিন্তু নির্বাচনটি যদি সুষ্ঠু না হয়, তাহলে কী হবে কেউ বলতে পারে না। সরকারি দলের নেতারা যতই তারস্বরে বিরোধী পক্ষকে জঙ্গি বোমাবাজ হিসেবে চিহ্নিত করুন না কেন, মানুষ শুনবে না। দেশ আরও দীর্ঘস্থায়ী হরতাল-অবরোধের কবলে চলে যাবে। সরকারকে মনে রাখতে হবে, এটাই বাংলাদেশের শেষ নির্বাচন নয়।
নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ হলে বিরোধী দলের ধ্বংসাত্মক হরতাল-অবরোধের অবসান ঘটবে এবং সরকারের দমন-পীড়ন বন্ধ হবে আশা করা যায়। এমনকি আগামী নির্বাচনের সময় ও নির্বাচনকালীন সরকারের কাঠামো নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে আলোচনা শুরু হওয়াও অসম্ভব নয়। নির্বাচনের বিষয়ে উভয় পক্ষ কিছুটা নমনীয় মনোভাব দেখাচ্ছে বলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দায়িত্ব পালনকারী একজন সাবেক রাষ্ট্রদূত দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। সম্প্রতি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন, এই নির্বাচনের পর আরেকটি নির্বাচনও হতে পারে। তিনি কি সত্যি সত্যি জাতীয় নির্বাচনের ইঙ্গিত দিয়েছেন?
অন্যদিকে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া সর্বশেষ প্রস্তাবে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই নির্বাচন হতে হবে বলে জেদ ধরেননি। তিনি নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে আলোচনার কথা বলেছেন। তাই উভয়ে যদি দলীয় সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে দেশের ও জনগণের বৃহত্তর স্বার্থের কথা বিবেচনা করে, তাহলে একটি সমঝোতায় আসা সম্ভব বলেই মনে করি। নিকট বা সুদূর অতীতে
যা-ই ঘটুক না কেন, রাজনীতিকদের সামনেই তাকাতে হবে।
নির্বাচনে কে জয়ী হবে, সেটি ঠিক করবেন ভোটাররা। স্থানীয় সরকার সংস্থার এই নির্বাচনে সরকারি দল হেরে গেলেও সরকারের ক্ষতি নেই। ক্ষমতারও পরিবর্তন হবে না; বরং সরকার বলতে পারবে, তাদের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে। কিন্তু নির্বাচনে যদি জনগণ নির্বিঘ্নে ভোট দিতে না পারে এবং জনরায়ের প্রতিফলন না ঘটে, তখন বিরোধী দলের অভিযোগই সত্য প্রমাণিত হবে যে এই সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনই সুষ্ঠু হতে পারে না।
সিটি নির্বাচন নিয়ে ইতিমধ্যে দুই পক্ষই নানা কৌশলের আশ্রয় নিয়েছে। বিরোধী দল যেমন হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি খণ্ডিতভাবে হলেও জারি রেখে সরকারের ওপর চাপ অব্যাহত রাখতে চায়, তেমনি সরকারও বিরোধী দলকে ছাড় না দেওয়ার কথা বলে আসছে। প্রকৃতপক্ষে নির্বাচন ছাড় দেওয়া না–দেওয়ার বিষয় নয়। বিষয়টি ভোটারদের হাতে ছেড়ে দিতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত বৃহস্পতিবার আওয়ামী লীগের সংসদীয় কমিটির বৈঠকে বলেছেন, স্বচ্ছতাই শক্তি। ফল যা হোক, নির্বাচন স্বচ্ছ হতে হবে। এটি সাধু উপলব্ধি। কিন্তু নির্বাচনপ্রক্রিয়ায় তার প্রতিফলন ঘটবে কি না, সেটাই বড় প্রশ্ন। কোনো কোনো মন্ত্রী ইতিমধ্যে বলেছেন, যে করেই হোক তিন সিটিতেই জিততে হবে। আওয়ামী লীগের নেতা-মন্ত্রীরা একদিকে বলছেন, বিএনপির জনপ্রিয়তা শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে, দল নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। অন্যদিকে যে করেই হোক জেতার জন্য মন্ত্রীরা নির্দেশ দিচ্ছেন। এটি কি ভয়ের লক্ষণ নয়?
যদি আওয়ামী লীগ নেতারা নিজেদের জনপ্রিয়তা সম্পর্কে এতটাই আস্থাশীল হন, তাহলে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে নিয়ত বিষোদ্গার কেন? বাস্তবতা হলো, হরতাল-অবরোধের নামে নিরীহ মানুষকে পুড়িয়ে মারার কারণে জনগণ বিএনপির কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে এবং সেই ফিরিয়ে নেওয়া মুখ আওয়ামী লীগের দিকে ঝুঁকে পড়েছে—এমন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab০3@dhaka.net
নির্বাচন করার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের (ইসি) হলেও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের ‘ছাড়পত্র’ ছাড়া তারা স্থানীয় সরকার সংস্থার নির্বাচন করতে পারে না। এ কারণেই ঢাকা সিটি করপোরেশনের নির্বাচনটি এত দিন আটকে ছিল। ইতিমধ্যে ইসি তিন সিটির মেয়র ও কাউন্সিলর পদে প্রার্থিতা চূড়ান্ত করেছে এবং প্রার্থীরা অনানুষ্ঠানিক প্রচারও চালাচ্ছেন। ৭ এপ্রিল থেকে শুরু হবে আনুষ্ঠানিক প্রচার।
ঢাকা উত্তরে ব্যবসায়ী নেতা আবদুল আউয়াল মিন্টুর প্রার্থিতা বাতিল হওয়ায় বিএনপি বেশ বেকায়দায় পড়েছে। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী আরেক ব্যবসায়ী নেতা আনিসুল হক, যিনি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সমর্থন নিয়ে লড়ছেন। দক্ষিণে বিএনপির প্রার্থী মির্জা আব্বাসের বিরুদ্ধে বহু মামলা। শেষ পর্যন্ত তিনি প্রকাশ্য প্রচারে আসতে পারবেন কি না বলা কঠিন। সেখানে আওয়ামী লীগের প্রার্থী সাঈদ খোকন। মান-অভিমান ভুলে শেষ পর্যন্ত তাঁকে সমর্থন জানানোর ঘোষণা দিয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতা ও স্বতন্ত্র সাংসদ হাজি সেলিম, পদত্যাগপত্র ছিঁড়ে ফেলায় যিনি জাতীয় সংসদেই আক্ষেপ করেছিলেন। আবদুল আউয়াল মিন্টুর বিকল্প প্রার্থী কে হবেন—মাহী বি চৌধুরী, না আবদুল আউয়াল মিন্টুর ছেলে তাবিথ আউয়াল—বিএনপি হাইকমান্ড এখনো সেই সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি। তা সত্ত্বেও আওয়ামী শিবিরে উদ্বেগ লক্ষণীয়। ঢাকার তুলনায় চট্টগ্রামে দুই দলের অবস্থান সংহত। প্রার্থী ধার করে আনতে হয়নি। সেখানে আওয়ামী লীগের পুরো নেতৃত্ব আ জ ম নাছিরের পক্ষে এবং মনজুর আলমের পক্ষে অনানুষ্ঠানিক প্রচারণা চালাচ্ছে বিএনপি।
কিছুদিন আগেও দেশে পেট্রলবোমা, ককটেল, বাসে, অফিসে আগুন দিয়ে মানুষ হত্যা এবং তার বিপরীতে পাইকারি মামলা, গণগ্রেপ্তার ও ক্রসফায়ারের যে মহড়া চলছিল, সেটি পুরোপুরি বন্ধ না হলেও স্তিমিত হয়ে আসছে। তখন রাজনীতিটা হয়ে পড়েছিল সন্ত্রাসনির্ভর। একদিকে বোমাসন্ত্রাস আরেক দিকে দমন-পীড়ন। মানুষ বড় অসহায় বোধ করেছিল।
এই প্রেক্ষাপটে সিটি নির্বাচন দেশবাসীর জন্য অনেকটা স্বস্তি নিয়ে এসেছে। কিন্তু এই স্বস্তি কত দিন স্থায়ী হবে, তা নির্ভর করছে নির্বাচনটি কেমন হবে, তার ওপর। যদি নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ হয়, মানুষ যদি নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারেন এবং ফলাফলে তার প্রতিফলন ঘটে, তাহলে মানুুষ খুশি হবেন। পাঁচ বছর পর চট্টগ্রাম সিটি এবং ১৩ বছর পর ঢাকা সিটি নির্বাচিত প্রতিনিধি পাবে।
চরম বৈরী ও বিদ্বেষমূলক রাজনৈতিক পরিবেশে যে সিটি নির্বাচন হতে যাচ্ছে, তাতে প্রার্থীর চেয়ে ভোটাররা বেশি বিবেচনায় নেবেন দল তথা শীর্ষ নেতৃত্বকে। অনেকের মতে, এই নির্বাচনে আরও একবার শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার জনপ্রিয়তা যাচাই হবে।
নির্বাচন করে নির্বাচন কমিশন। কিন্তু প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী, তাঁদের সমর্থক দলগুলোর সহায়তা ছাড়া তাদের পক্ষে এই গুরুদায়িত্ব পালন করা সম্ভব নয়। নির্বাচনের তিনটি প্রক্রিয়া আছে। প্রথমত, ভোটারদের কাছে প্রার্থীর বক্তব্য তুলে ধরা অর্থাৎ প্রচারণা। দ্বিতীয়ত, ভোটারদের নির্বিঘ্নে ভোটাধিকার প্রয়োগ এবং তৃতীয়ত, ফলাফলে জনরায়ের প্রতিফলন। এর যেকোনো একটিতে ব্যত্যয় ঘটলে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হতে বাধ্য।
কয়েক দিন আগে বিএনপির একটি প্রতিনিধিদল সিইসির সঙ্গে দেখা করে নির্বাচনে সবার সমান সুযোগ সৃষ্টি করতে কিছু দাবি পেশ করেছে; যার মধ্যে আছে প্রার্থী ও নেতা-কর্মীদের ওপর থেকে ‘মিথ্যা মামলা’ প্রত্যাহার, নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয় খুলে দেওয়া ও বিরোধী দলকে সভা-সমাবেশ করতে দেওয়া। দাবিগুলো যৌক্তিক। নির্বাচন কমিশনের উচিত অবিলম্বে বিএনপি অফিসের তালা খোলার ব্যবস্থা করা। এর বিনিময়ে বিএনপিকেও হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি প্রত্যাহার করতে হবে। আর প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্তব্য ইসিকে সর্বতোভাবে সহায়তা করা। ইসিকে কথা নয়, কাজ দিয়েই প্রমাণ করতে হবে তারা দক্ষ, যোগ্য এবং নিরপেক্ষ। নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও এই কমিশনই অনেকগুলো সিটি করপোরেশন নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করতে পেরেছে। এখন কাজী রকিবউদ্দীন আহমদকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে তিনি এ টি এম শামসুল হুদা কিংবা মোহাম্মদ আবু হেনা হবেন, নাকি এম এ সাদেক ও এম এ আজিজ হবেন? এ টি এম শামসুল হুদা ২০০৮ সালে প্রতিকূল পরিবেশে একটি সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করেছিলেন। আবু হেনা শেখ হাসিনার প্রথম সরকারের আমলে কারচুপির অভিযোগ থাকায় ঘাটাইল উপনির্বাচনের ফলাফল গেজেট বিজ্ঞপ্তি করেননি। তাঁর পদত্যাগের পরই সেটি হয়েছিল। এম এ সাদেক ১৫ ফেব্রুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচন করে ব্যাপকভাবে নিন্দিত হয়েছিলেন। এম এ আজিজের আত্মম্ভরিতার কারণে ২০০৭ সালে নির্বাচনটিই করা সম্ভব হয়নি।
এবার কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ যদি সিটি নির্বাচনটি অবাধ ও সুষ্ঠু করতে পারেন, তাহলে তাঁর অতীতের অনেক ব্যর্থতা মানুষ ভুলে যাবে। তিনি সফল হলে রাজনীতিতেই কেবল সুস্থতা ফিরে আসবে না, পরবর্তী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে যে জট তৈরি হয়েছে, তা খোলার পথও সুগম হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আস্থার সম্পর্ক গড়ে উঠবে। একে অপরের বুকে ছুরি মারতে আস্তিনের ভেতরে ছুরি নিয়ে ঘুরবে না। সিটি নির্বাচন সুষ্ঠু হলে বিরোধী দল সরকারকে যতই চাপে রাখুক না কেন, হরতাল-অবরোধ চালিয়ে যেতে পারবে না।
কিন্তু নির্বাচনটি যদি সুষ্ঠু না হয়, তাহলে কী হবে কেউ বলতে পারে না। সরকারি দলের নেতারা যতই তারস্বরে বিরোধী পক্ষকে জঙ্গি বোমাবাজ হিসেবে চিহ্নিত করুন না কেন, মানুষ শুনবে না। দেশ আরও দীর্ঘস্থায়ী হরতাল-অবরোধের কবলে চলে যাবে। সরকারকে মনে রাখতে হবে, এটাই বাংলাদেশের শেষ নির্বাচন নয়।
নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ হলে বিরোধী দলের ধ্বংসাত্মক হরতাল-অবরোধের অবসান ঘটবে এবং সরকারের দমন-পীড়ন বন্ধ হবে আশা করা যায়। এমনকি আগামী নির্বাচনের সময় ও নির্বাচনকালীন সরকারের কাঠামো নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে আলোচনা শুরু হওয়াও অসম্ভব নয়। নির্বাচনের বিষয়ে উভয় পক্ষ কিছুটা নমনীয় মনোভাব দেখাচ্ছে বলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দায়িত্ব পালনকারী একজন সাবেক রাষ্ট্রদূত দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। সম্প্রতি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন, এই নির্বাচনের পর আরেকটি নির্বাচনও হতে পারে। তিনি কি সত্যি সত্যি জাতীয় নির্বাচনের ইঙ্গিত দিয়েছেন?
অন্যদিকে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া সর্বশেষ প্রস্তাবে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই নির্বাচন হতে হবে বলে জেদ ধরেননি। তিনি নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে আলোচনার কথা বলেছেন। তাই উভয়ে যদি দলীয় সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে দেশের ও জনগণের বৃহত্তর স্বার্থের কথা বিবেচনা করে, তাহলে একটি সমঝোতায় আসা সম্ভব বলেই মনে করি। নিকট বা সুদূর অতীতে
যা-ই ঘটুক না কেন, রাজনীতিকদের সামনেই তাকাতে হবে।
নির্বাচনে কে জয়ী হবে, সেটি ঠিক করবেন ভোটাররা। স্থানীয় সরকার সংস্থার এই নির্বাচনে সরকারি দল হেরে গেলেও সরকারের ক্ষতি নেই। ক্ষমতারও পরিবর্তন হবে না; বরং সরকার বলতে পারবে, তাদের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে। কিন্তু নির্বাচনে যদি জনগণ নির্বিঘ্নে ভোট দিতে না পারে এবং জনরায়ের প্রতিফলন না ঘটে, তখন বিরোধী দলের অভিযোগই সত্য প্রমাণিত হবে যে এই সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনই সুষ্ঠু হতে পারে না।
সিটি নির্বাচন নিয়ে ইতিমধ্যে দুই পক্ষই নানা কৌশলের আশ্রয় নিয়েছে। বিরোধী দল যেমন হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি খণ্ডিতভাবে হলেও জারি রেখে সরকারের ওপর চাপ অব্যাহত রাখতে চায়, তেমনি সরকারও বিরোধী দলকে ছাড় না দেওয়ার কথা বলে আসছে। প্রকৃতপক্ষে নির্বাচন ছাড় দেওয়া না–দেওয়ার বিষয় নয়। বিষয়টি ভোটারদের হাতে ছেড়ে দিতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত বৃহস্পতিবার আওয়ামী লীগের সংসদীয় কমিটির বৈঠকে বলেছেন, স্বচ্ছতাই শক্তি। ফল যা হোক, নির্বাচন স্বচ্ছ হতে হবে। এটি সাধু উপলব্ধি। কিন্তু নির্বাচনপ্রক্রিয়ায় তার প্রতিফলন ঘটবে কি না, সেটাই বড় প্রশ্ন। কোনো কোনো মন্ত্রী ইতিমধ্যে বলেছেন, যে করেই হোক তিন সিটিতেই জিততে হবে। আওয়ামী লীগের নেতা-মন্ত্রীরা একদিকে বলছেন, বিএনপির জনপ্রিয়তা শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে, দল নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। অন্যদিকে যে করেই হোক জেতার জন্য মন্ত্রীরা নির্দেশ দিচ্ছেন। এটি কি ভয়ের লক্ষণ নয়?
যদি আওয়ামী লীগ নেতারা নিজেদের জনপ্রিয়তা সম্পর্কে এতটাই আস্থাশীল হন, তাহলে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে নিয়ত বিষোদ্গার কেন? বাস্তবতা হলো, হরতাল-অবরোধের নামে নিরীহ মানুষকে পুড়িয়ে মারার কারণে জনগণ বিএনপির কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে এবং সেই ফিরিয়ে নেওয়া মুখ আওয়ামী লীগের দিকে ঝুঁকে পড়েছে—এমন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab০3@dhaka.net
No comments