মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস: নির্মাণ ও বিনির্মাণ
বলিউডকে যাঁরা ইতিহাসের উৎস হিসেবে বিবেচনা করেন, তাঁদের বুদ্ধিমত্তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা একদম অযৌক্তিক নয়। বলিউডি ফিল্ম মানেই গাঁজায় দম দিয়ে বানানো গল্প। বাস্তব অথবা সত্যের সঙ্গে যে ফিল্মের যোগ যত কম, সে ফিল্ম তত বেশি জনপ্রিয়। লোকজন সেসব দেখতে ভিড় জমায় ইতিহাস বইয়ে কী লেখা আছে বা বাস্তবে কী ঘটে, তা জানতে নয়; বরং দুদণ্ড সব ভুলে স্বপ্নের জগতে ঠাঁই নেওয়া যাবে, সে জন্য। ঠিক সে কারণে বলিউডের গুন্ডে ছবি নিয়ে বাংলাদেশে যে প্রতিক্রিয়া হয়েছে, তা কিছুটা কৌতুকপ্রদ মনে হতে পারে। ছবিটির প্রথম কয়েক মিনিট বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কল্পকাহিনি সাজানো হয়েছে, যার প্রতিবাদে সোশ্যাল মিডিয়ায় মহাতুলকালাম ঘটে যায়। ফেসবুক মুখ্যত তরুণদের দখলে, ফলে তারা যা খুশি বলবে, লিখবে, তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই। কিন্তু একদম সরকারি পর্যায়ে তা নিয়ে প্রতিক্রিয়া উঠবে, তা ভাবিনি। তর্ক-বিতর্কের উত্তাপ এতটা ছড়িয়ে পড়ে যে আমেরিকার অতি-সিরিয়াস ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল পর্যন্ত নাক গলাতে বাধ্য হয়। ব্যাপারটা উপেক্ষার সঙ্গে দেখাও খুব বুদ্ধিমানের কাজ নয়। তরুণেরাই এ নিয়ে প্রথমে প্রশ্ন তোলে, কিন্তু সেটি পরিহাসের বিষয় নয়। এ থেকে বরং বোঝা যায়, মুক্তিযুদ্ধকে এই প্রজন্মের সদস্যরা কতটা গুরুত্বের সঙ্গে নেয়। এই যুদ্ধের ইতিহাস, তার স্মৃতি, আগলে রাখার কাজ, যা আমরা বুড়োরা যোগ্যতার সঙ্গে করেছি বলা যাবে না।
নব প্রজন্মের সদস্যরা তাকে নিজেদের অস্তিত্বের সংগ্রাম বলে মনে করে। চলচ্চিত্রমাধ্যমের শক্তির সঙ্গে এদের পরিচয় আছে। নিজের জন্মের ইতিহাসের এই বিকৃত চলচ্চিত্রায়ণ দেখে তারা প্রতারিত বোধ করেছে। প্রতিবাদের তীব্রতাও সে কারণে এমন প্রবল। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও তার ন্যারেটিভ শুধু একটি, এ কথা আমি বলি না। ইতিহাস মানেই কোনো কাল, সময় অথবা ঘটনার ব্যক্তিগত ও সম্মিলিত স্মৃতি। বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান, সেই ইতিহাসের এই তিন প্রধান কুশীলব, যার যার নিজস্ব চশমায় সে ন্যারেটিভ নির্মাণ করবে, তাতেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। এই ইতিহাসের বহির্গত চরিত্র রয়েছে, তার কুশীলব ভিন্ন। নাকের ওপর ভিন্ন চশমা গুঁজে তাঁরা যখন এই ইতিহাস লিখতে বসেন, তার বহিরঙ্গটি যায় বদলে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বয়স এখনো অর্ধশতক পূর্ণ হয়নি। ফলে ইতিহাসের নৈর্ব্যক্তিকতা অর্জনের জন্য সময়ের যে দূরত্ব প্রয়োজন, তা অনুপস্থিত। ফলে, জাতিগত ও ব্যক্তিগত দৃষ্টিকোণ থেকে নির্মিত ভিন্ন ভিন্ন ন্যারেটিভের মধ্যে যদি বৈপরীত্য অথবা প্রতিদ্বন্দ্বিতা রয়ে যায়, তাতেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। অধিকাংশ ভারতীয় লেখকের বিবরণে একাত্তর পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের অভাবনীয় ও ঐতিহাসিক বিজয় ভিন্ন অন্য কিছু নয়। অতিসম্প্রতি প্রকাশিত শ্রীনাথ রাঘবনের গ্রন্থ ১৯৭১, এ গ্লোবাল হিস্টরি অব দ্য ক্রিয়েশন অব বাংলাদেশ গ্রন্থেও বাঙালির মুক্তি আন্দোলনের কোনো পরিচয় নেই। পাকিস্তানি লেখকের হাতে ১৯৭১-এর ইতিহাস বাঙালি মুসলমানের বিশ্বাসঘাতকতা ও কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা কমান্ডারের মূর্খতা ও অযোগ্যতা ছাড়া আর কিছু নয়।
যেমন একাত্তরের ওপর ফজল মুকিম খানের লেখা বই পাকিস্তানস ক্রাইসিস ইন লিডারশিপ। পরাজিত সমরনায়ক নিয়াজির গ্রন্থের নাম দ্য বিট্রেয়াল অব ইস্ট পাকিস্তান। মার্কিন অথবা ইউরোপীয় লেখক যাঁরা এই প্রতিদ্বন্দ্বী ন্যারেটিভে কোনো আনুভূতিক পুঁজি বিনিয়োগ করেননি বলে ভাবা স্বাভাবিক, তাঁরা একাত্তরকে বরাবরই ভারত ও পাকিস্তানের লড়াই এই দুই দেশের মধ্যে সংঘটিত তৃতীয় যুদ্ধ হিসেবেই বর্ণনা করেছেন। যে গ্রন্থটিকে একাত্তরের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ও বস্তুনিষ্ঠ বিবরণ বলে কেউ কেউ রায় দিয়েছেন, মার্কিন গবেষক রিচার্ড সিসন ও লিও রোজ-এর লেখা ইন্ডিয়া, পাকিস্তান অ্যান্ড দ্য ক্রিয়েশন অব বাংলাদেশ, সেখানেও ‘বাংলাদেশ যুদ্ধ’কে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে তৃতীয় যুদ্ধ হিসেবেই বর্ণনা করা হয়েছে। যাঁরা দৃশ্যত নিরপেক্ষ, যেমন ইংরেজ লেখক রবার্ট জ্যাকসনের সাউথ এশিয়ান ক্রাইসিস-এও, একাত্তর বড়জোর বাঙালির বিচ্ছিন্নতার আন্দোলন, তার বেশি নয়। হেনরি কিসিঞ্জারের মতো আত্মপ্রেমী মেকি-ইতিহাসবিদের চোখে একাত্তরের প্রকাশ ঘটে পরাশক্তিত্রয়ের, অর্থাৎ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীনের মধ্যে ‘প্রক্সি যুদ্ধ’ হিসেবে। তাঁর সুবিশাল হোয়াইট হাউস ইয়ার্স গ্রন্থে একাত্তরের ইতিহাস পুনর্নির্মাণ করতে ৮০ পাতার যে অধ্যায়টি তিনি লিখেছেন, বাঙালির মুক্তি আন্দোলনের কোনো পরিচয়ই তাতে নেই। কিসিঞ্জার সে পরিচ্ছদের শিরোনাম দিয়েছেন ‘দ্য টিলট: দি ইন্ডিয়া-পাকিস্তান ক্রাইসিস অব ১৯৭১’। অতিসম্প্রতি মার্কিন সাংবাদিক ও গবেষক গ্যারি বাস ‘ব্লাড টেলিগ্রাম’ নামে একাত্তরের যে বিকল্প ইতিহাস রচনা করেছেন, তাতেও অনুসন্ধিৎসু আলোটি পড়েছে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের ওপর নয়, একাত্তরে যে গণহত্যা হয়, তা রোধে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যর্থতার ওপর। কিন্তু বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের যে ইতিহাস, তার প্রধান চরিত্র যেমন তার, তার কথকও সে নিজে, অন্য কেউ নয়। বাঙালির অভিজ্ঞতা ও সম্মিলিত স্মৃতির ভিত্তিতে নির্মিত এ ইতিহাস। তার একমাত্র কুশীলব বাঙালি, এ কথা আমি বলি না।
কিন্তু জাতিরাষ্ট্রের জন্য বাঙালির সংগ্রামের এই ইতিহাস লিখতে হলে আসল নজর থাকতে হবে বাঙালির অভিজ্ঞতার ওপর। এর আনুপূর্বিক বিবরণ ও বিশ্লেষণ ছাড়া সে ইতিহাস পূর্ণাঙ্গ হবে না। ঔপনিবেশিক আমলে ইংরেজের হাতে আমাদের ইতিহাস লিখিত হয়েছিল। ইংরেজ দাবি করেছে, সভ্যতার দায়দায়িত্ব নিয়ে সে উপমহাদেশে এসেছে, ফলে তার লিখিত ইতিহাসে নির্বিকার শোষণের বদলে শ্বেত প্রভুর সভ্যতার জয়ডঙ্কা শোনা গেছে। ম্যাকলের মতো লেখকের হাতে যখন সে ইতিহাস লিখিত হয়, তাতে ইংরেজের নগ্ন শোষণের পক্ষে কৃত্রিম নৈতিকতার সাফাইও শোনা গেছে। আবার পাকিস্তানি আমলে যে নব্য উপনিবেশের সূচনা হয়, তাতে বিজাতীয় প্রভুদের হাতে রচিত ইতিহাসে বাঙালির স্থান হয় দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে, সেখানে বাঙালি চিত্রিত হয় ভীরু ও প্রভু তোষণপ্রিয় জাতি হিসেবে। এসব সমীকরণই বদলে যায় একাত্তরে। বাঙালি জাতিসত্তার উদ্ভব হয়েছিল অনেক আগেই। একাত্তরের রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের ভেতর দিয়ে অর্জিত হয় বাঙালির জাতিরাষ্ট্র সত্তার। অন্তর্গত বোধন ছাড়া যে অর্জন অসম্ভব ছিল। বিদেশি লেখক বা চলচ্চিত্রকার তা সে ভারতীয়, পাকিস্তানি বা আমেরিকান—যে-ই হোক, বাঙালির আত্ম-আবিষ্কার ও আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের দীর্ঘ সংগ্রামের ঘটনাবলি বিষয়ে অবহিত হলেও তার আনুভূতিক অভিজ্ঞতার অংশীদার তারা কখনোই হবে না। ঠিক এ কারণেই বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বাঙালিকেই লিখতে হবে। অন্য যারা সে ইতিহাস লিখবে, উৎস হিসেবে তাদের বাঙালির লেখা আকর গ্রন্থের দিকেই হাত বাড়াতে হবে। এই ইতিহাস রচনায় বাঙালির অধিকার কেবল স্বতঃসিদ্ধ ও মৌলিকই নয়, বাংলাদেশের লেখক-বুদ্ধিজীবী-সাংবাদিকদের দায়িত্বও বটে।
হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
No comments