বেতার-টিভি চ্যানেলের লাইসেন্স: কে পাবে কে পাবে না by মশিউল আলম
সেদিনের সেমিনারটি ছিল বাংলাদেশে বেসরকারি বেতার-টিভি বা সম্প্রচার গণমাধ্যমের সম্ভাবনা ও সীমাবদ্ধতা নিয়ে। এ বিষয়ে একটি লিখিত প্রবন্ধ পাঠ করেন যুক্তরাষ্ট্রের সাউদার্ন ইলিনয় ইউনিভার্সিটির গবেষক ফারহানা আফরোজ। বাংলাদেশে সরকারি-বেসরকারি মালিকানার বেতার-টিভির কার্যক্রম সম্পর্কে কিছু তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরার পাশাপাশি প্রবন্ধে বলা হয়, বর্তমানে এ দেশে কোনো সম্প্রচার আইন বা নীতিমালা নেই। বেশ কিছুদিন ধরেই দেশে একটি সম্প্রচার নীতিমালার দাবিতে লেখালেখি চলছে। ওই সেমিনারের মাধ্যমে বিষয়টির গুরুত্ব সরকারের সামনে আবারও তুলে ধরা হলো।
১৯৯৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করার পর এ দেশে প্রথম বেসরকারি খাতে একটি টেলিভিশন চ্যানেল প্রতিষ্ঠা করা হয়। একুশে টেলিভিশন (ইটিভি) নামে সেই চ্যানেলটিকে টেরেস্ট্রিয়াল সুবিধাও দেওয়া হয়েছিল। সম্প্রচার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় একচেটিয়ার অবসান ও প্রকৃতপক্ষে টেলিভিশন সাংবাদিকতার সূচনা ছিল সেটি। এর কৃতিত্ব সেই সময়কার আওয়ামী লীগের সরকারের; প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের নেতারা অনেকেই এ বিষয়টি গর্বের সঙ্গে উল্লেখ করে থাকেন। কিন্তু কী প্রক্রিয়ায় একটি মাত্র বেসরকারি উদ্যোক্তাকে এই সুযোগ দেওয়া হয়েছিল তা জানা যায়নি। সেদিনের সেমিনারে যিনি মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন, তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তিনি তাঁর গবেষণায় জানার চেষ্টা করেছিলেন কি না যে এ দেশে কী পদ্ধতিতে, কিসের ভিত্তিতে বেসরকারি বেতার-টিভির লাইসেন্স দেওয়া হয়। তিনি উত্তরে বলেন, তিনি জানার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ পরিষ্কার কোনো জবাব দেয়নি।
আমরা জানি, কোনো সুনির্ধারিত নীতি বা প্রক্রিয়া মেনে বেতার-টিভির লাইসেন্স দেওয়া হয় না। আওয়ামী লীগের সরকার বিদায় নিয়ে বিএনপি-জামায়াত সরকার ক্ষমতায় এলে একুশে টিভি যে কোপানলে পড়েছিল, তাতে তার মৃত্যুই হয়েছিল। প্রথমে নির্বাহী আদেশে চ্যানেলটির কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়, তারপর বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ায়। অনেক ঝক্কি-ঝামেলার পর চ্যানেলটি জীবন ফিরে পায়; তবে তার মালিকানা বদলে যায়। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার এসে নতুন কয়েকটি টিভি চ্যানেলের লাইসেন্স দেয়, যাঁরা লাইসেন্সগুলো পান তাঁরা সবাই কমবেশি সরকারের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি। অর্থাত্ সরকারের পছন্দমতো লাইসেন্সগুলো দেওয়া হয়। নিয়ম-নীতি নয়, এখানে কাজ করেছে সরকারের মর্জি।
এ কথাগুলো সেদিন তথ্যমন্ত্রীকে বলেছিলাম। এ জন্য নয় যে এসব তথ্য তাঁর জানা নেই; বরং এই প্রশ্ন করার জন্য যে বেতার-টিভির লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো নীতিমালা বা আইনকানুন তৈরির কথা বর্তমান সরকার ভাবছে কি না। কারণ শোনা যাচ্ছে, আরও কয়েকটি টিভি চ্যানেলের লাইসেন্স দেওয়া হবে; বেশ কিছু আবেদন জমা পড়েছে। এবারও কি আগের সরকারগুলোর মতোই স্রেফ মর্জিমাফিক লাইসেন্স দেওয়া হবে, নাকি একটি নির্দিষ্ট নীতিমালার ভিত্তিতে তা করা হবে। তথ্যমন্ত্রী এ বিষয়ে পরিষ্কার করে কিছু বললেন না। তিনি জানালেন, সরকারের সামনে অগ্রাধিকারভিত্তিক কিছু কাজ রয়েছে, যেসবের মধ্যে এই বিষয়টি আপাতত নেই।
আমাদের মনে হয়, শুধু অগ্রাধিকারভিত্তিক কাজগুলো নিয়েই পুরো সরকারের এমন ব্যস্ত হয়ে থাকা উচিত যে অন্য কাজগুলো হেলায় পড়ে থাকে। তথ্য মন্ত্রণালয়ের অগ্রাধিকারগুলো কী? তথ্য অধিকার আইন একটা অগ্রাধিকার ছিল। সেটা পাস হয়ে গেছে, এখন সেটা বাস্তবায়নের অবকাঠামো তৈরি করা একটা বড় অগ্রাধিকার হওয়া উচিত। তবে সম্প্রচার গণমাধ্যমের বিষয়টিও অবশ্যই গুরুত্ব পাওয়া উচিত। প্রথমত, যাঁরা বিশেষত টিভি চ্যানেলের লাইসেন্সের আবেদন করেছেন বা করতে যাচ্ছেন, তাঁদের কীভাবে লাইসেন্স দেওয়া হবে সেটা স্থির করা উচিত। নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, বিষয়টি এখনো সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল হয়ে আছে প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর। যাঁরা তাঁর সুনজরে আছেন, তাঁরা লাইসেন্স পেতে যাচ্ছেন, অন্যরা হয়তো পাবেন না।
এ রকম হওয়া উচিত নয়। অতীতে যা হওয়ার হয়েছে, এখন লাইসেন্স দেওয়ার প্রক্রিয়াটি ন্যায্য, স্বচ্ছ ও নীতিপূর্ণ হওয়া উচিত। সে জন্য প্রথমেই উচিত একটি আইন, তারপর সেই আইনের ভিত্তিতে রচিত কিছু সুনির্দিষ্ট বিধান। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৩৪ সালে গৃহীত হয়েছে কমিউনিকেশন্স অ্যাক্ট নামে একটি আইন, পরে বিভিন্ন সময়ে তাতে সংযোজন-সংশোধন করা হয়েছে। সে আইনের অধীনে সে দেশে গঠিত হয়েছে ফেডারেল কমিউনিকেশন্স কমিশন (এফসিসি)। বেসরকারি বেতার-টিভির লাইসেন্স দেওয়া, তা নবায়ন বা বাতিল করা, সম্প্রচার শিল্পের কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ করা, তাদের সম্পর্কে জনগণের কোনো অভিযোগ থাকলে সেসব অভিযোগ খতিয়ে দেখা, তার প্রতিকার করাসহ আরও অনেক দায়িত্ব পালন করে এফসিসি। যুক্তরাষ্ট্রের মতো যুক্তরাজ্যেও কমিউনিকেশন্স অ্যাক্ট নামে একটি আইন আছে; এ আইনের অধীনে চলে অফিস অব কমিউনিকেশন্স (অফকম), যার ভূমিকা যুক্তরাষ্ট্রের এফসিসির মতোই। অফকম-এর একটি ব্রডকাস্ট কোড বা সম্প্রচার নীতিমালা আছে। বেতার-টিভির লাইসেন্স কীভাবে দেওয়া হয়, লাইসেন্স পেতে হলে কী কী যোগ্যতা থাকতে হয়, কী কী শর্ত মেনে চলতে হয়—এ সবকিছু পরিষ্কারভাবে নিরূপণ করা আছে। শুধু তা-ই নয়, অফকম তাদের ওয়েবসাইটে লাইসেন্সের আবেদনপত্রের ফরমও দিয়ে দেয়, কীভাবে আবেদনপত্র দাখিল করতে হবে, সঙ্গে কী কী কাগজপত্র জমা দিতে হবে—এসব টিপস্ তারা তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে। অর্থাত্, একটি আইনের ভিত্তিতে রচিত সুনির্দিষ্ট কিছু বিধান অনুযায়ী, যথাযথ একটি কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে বেতার-টিভির লাইসেন্স প্রদানের প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হয়। সরকারের ইচ্ছা-অনিচ্ছা, মর্জি-নাখোশ এই ক্ষেত্রে কাজ করে না। সব যোগ্যতা থাকা এবং সঠিক প্রক্রিয়ায় লাইসেন্সের আবেদন করার পরও যদি কাউকে লাইসেন্স দেওয়া না হয়, তাঁকে ব্যাখ্যা করতে হবে কী কী কারণে তিনি লাইসেন্স পাবেন না।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের দেশে সম্প্রচার মাধ্যমে এর উল্টো চিত্র। বিএনপির সরকারের আমলে আওয়ামী লীগপন্থী কেউ লাইসেন্স পাবেন না, আওয়ামী লীগের সরকারের আমলে বিএনপিপন্থী কেউ লাইসেন্স পাবেন না—এটাই যেন স্বাভাবিক বলে ধরে নেওয়া হয়েছে। যাঁরা লাইসেন্সের জন্য আবেদন করেছেন, তাঁদের অনেকেই এটা জানেন এবং মানেন। কিন্তু একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে তো এভাবে চলতে পারে না, চলা উচিত নয়। আমাদের অবশ্যই একটি সম্প্রচার আইন প্রয়োজন, তার ভিত্তিতে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মতো একটি স্বাধীন সম্প্রচার কমিশন গঠন করা প্রয়োজন, যে কমিশন ওই আইন অনুযায়ী নির্দিষ্ট বিধান মেনে বেসরকারি খাতে বেতার-টিভির লাইসেন্স দেবে।
সেদিনের সেমিনারে অনেক কথার মধ্যে তথ্যমন্ত্রী কয়েকটি টিভি চ্যানেলের টক শো সম্পর্কে উষ্মা প্রকাশ করলেন এই বলে যে ওগুলোতে অনেক ভিত্তিহীন, নেতিবাচক ও দায়িত্বহীন কথাবার্তা প্রচার করা হচ্ছে। এটা অনেকাংশেই সত্য। অবশ্য মন্ত্রী এ বিষয়ে কোনো নিয়ন্ত্রণের কথা বলেননি। প্রবন্ধপাঠকের লিখিত প্রবন্ধে অনেক পরামর্শের মধ্যে এ রকম একটা পরামর্শও ছিল যে সম্প্রচার মাধ্যমের রেগুলেশন বা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থাও থাকা উচিত। আলোচকদের মধ্যে কেউ কেউ এর প্রতিবাদ করে বলেছেন, সম্প্রচার মাধ্যম ভালোভাবে না দাঁড়াতেই একে নিয়ন্ত্রণ করার পরামর্শ হিতে বিপরীত হতে পারে। তথ্যমন্ত্রী তাঁর বক্তৃতায় বললেন, বর্তমান সরকার বেতার-টিভি শুধু নয়, কোনো সংবাদমাধ্যমকেও নিয়ন্ত্রণের কোনো চেষ্টা করেনি, করছে না। উদাহরণ হিসেবে বলেন, বিডিআর বিদ্রোহের সময় কোনো টিভি চ্যানেল বা সংবাদপত্রের অফিসে সরকারের তরফ থেকে কোনো নির্দেশনা পাঠানো হয়নি।
যাহোক, সরকার যে কিছু টিভি চ্যানেলের আচরণে নাখোশ, তার ইঙ্গিত তথ্যমন্ত্রীর বক্তব্যে আঁচ করা কঠিন ছিল না।
বর্তমান সরকার যদি মনে করে বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার তাদের নিজেদের লোকজনকে টিভি-চ্যানেলগুলোর লাইসেন্স দিয়েছে, এখন আমরা আমাদের পছন্দের লোকদের দেব, তা হবে খুবই দুঃখজনক। পরিবর্তনের শপথ নিয়ে, দিনবদলের প্রতিশ্রুতি দিয়ে জনগণের বিপুল সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় আসার পর তো আর পুরোনো দিনের নেতিবাচক মানসিকতায় ফিরে যাওয়া চলে না। নিয়মকানুন, স্বচ্ছতা-ন্যায্যতার ভিত্তিতের পথ চলা তো শুরু করতে হবে।
মশিউল আলম: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
১৯৯৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করার পর এ দেশে প্রথম বেসরকারি খাতে একটি টেলিভিশন চ্যানেল প্রতিষ্ঠা করা হয়। একুশে টেলিভিশন (ইটিভি) নামে সেই চ্যানেলটিকে টেরেস্ট্রিয়াল সুবিধাও দেওয়া হয়েছিল। সম্প্রচার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় একচেটিয়ার অবসান ও প্রকৃতপক্ষে টেলিভিশন সাংবাদিকতার সূচনা ছিল সেটি। এর কৃতিত্ব সেই সময়কার আওয়ামী লীগের সরকারের; প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের নেতারা অনেকেই এ বিষয়টি গর্বের সঙ্গে উল্লেখ করে থাকেন। কিন্তু কী প্রক্রিয়ায় একটি মাত্র বেসরকারি উদ্যোক্তাকে এই সুযোগ দেওয়া হয়েছিল তা জানা যায়নি। সেদিনের সেমিনারে যিনি মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন, তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তিনি তাঁর গবেষণায় জানার চেষ্টা করেছিলেন কি না যে এ দেশে কী পদ্ধতিতে, কিসের ভিত্তিতে বেসরকারি বেতার-টিভির লাইসেন্স দেওয়া হয়। তিনি উত্তরে বলেন, তিনি জানার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ পরিষ্কার কোনো জবাব দেয়নি।
আমরা জানি, কোনো সুনির্ধারিত নীতি বা প্রক্রিয়া মেনে বেতার-টিভির লাইসেন্স দেওয়া হয় না। আওয়ামী লীগের সরকার বিদায় নিয়ে বিএনপি-জামায়াত সরকার ক্ষমতায় এলে একুশে টিভি যে কোপানলে পড়েছিল, তাতে তার মৃত্যুই হয়েছিল। প্রথমে নির্বাহী আদেশে চ্যানেলটির কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়, তারপর বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ায়। অনেক ঝক্কি-ঝামেলার পর চ্যানেলটি জীবন ফিরে পায়; তবে তার মালিকানা বদলে যায়। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার এসে নতুন কয়েকটি টিভি চ্যানেলের লাইসেন্স দেয়, যাঁরা লাইসেন্সগুলো পান তাঁরা সবাই কমবেশি সরকারের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি। অর্থাত্ সরকারের পছন্দমতো লাইসেন্সগুলো দেওয়া হয়। নিয়ম-নীতি নয়, এখানে কাজ করেছে সরকারের মর্জি।
এ কথাগুলো সেদিন তথ্যমন্ত্রীকে বলেছিলাম। এ জন্য নয় যে এসব তথ্য তাঁর জানা নেই; বরং এই প্রশ্ন করার জন্য যে বেতার-টিভির লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো নীতিমালা বা আইনকানুন তৈরির কথা বর্তমান সরকার ভাবছে কি না। কারণ শোনা যাচ্ছে, আরও কয়েকটি টিভি চ্যানেলের লাইসেন্স দেওয়া হবে; বেশ কিছু আবেদন জমা পড়েছে। এবারও কি আগের সরকারগুলোর মতোই স্রেফ মর্জিমাফিক লাইসেন্স দেওয়া হবে, নাকি একটি নির্দিষ্ট নীতিমালার ভিত্তিতে তা করা হবে। তথ্যমন্ত্রী এ বিষয়ে পরিষ্কার করে কিছু বললেন না। তিনি জানালেন, সরকারের সামনে অগ্রাধিকারভিত্তিক কিছু কাজ রয়েছে, যেসবের মধ্যে এই বিষয়টি আপাতত নেই।
আমাদের মনে হয়, শুধু অগ্রাধিকারভিত্তিক কাজগুলো নিয়েই পুরো সরকারের এমন ব্যস্ত হয়ে থাকা উচিত যে অন্য কাজগুলো হেলায় পড়ে থাকে। তথ্য মন্ত্রণালয়ের অগ্রাধিকারগুলো কী? তথ্য অধিকার আইন একটা অগ্রাধিকার ছিল। সেটা পাস হয়ে গেছে, এখন সেটা বাস্তবায়নের অবকাঠামো তৈরি করা একটা বড় অগ্রাধিকার হওয়া উচিত। তবে সম্প্রচার গণমাধ্যমের বিষয়টিও অবশ্যই গুরুত্ব পাওয়া উচিত। প্রথমত, যাঁরা বিশেষত টিভি চ্যানেলের লাইসেন্সের আবেদন করেছেন বা করতে যাচ্ছেন, তাঁদের কীভাবে লাইসেন্স দেওয়া হবে সেটা স্থির করা উচিত। নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, বিষয়টি এখনো সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল হয়ে আছে প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর। যাঁরা তাঁর সুনজরে আছেন, তাঁরা লাইসেন্স পেতে যাচ্ছেন, অন্যরা হয়তো পাবেন না।
এ রকম হওয়া উচিত নয়। অতীতে যা হওয়ার হয়েছে, এখন লাইসেন্স দেওয়ার প্রক্রিয়াটি ন্যায্য, স্বচ্ছ ও নীতিপূর্ণ হওয়া উচিত। সে জন্য প্রথমেই উচিত একটি আইন, তারপর সেই আইনের ভিত্তিতে রচিত কিছু সুনির্দিষ্ট বিধান। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৩৪ সালে গৃহীত হয়েছে কমিউনিকেশন্স অ্যাক্ট নামে একটি আইন, পরে বিভিন্ন সময়ে তাতে সংযোজন-সংশোধন করা হয়েছে। সে আইনের অধীনে সে দেশে গঠিত হয়েছে ফেডারেল কমিউনিকেশন্স কমিশন (এফসিসি)। বেসরকারি বেতার-টিভির লাইসেন্স দেওয়া, তা নবায়ন বা বাতিল করা, সম্প্রচার শিল্পের কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ করা, তাদের সম্পর্কে জনগণের কোনো অভিযোগ থাকলে সেসব অভিযোগ খতিয়ে দেখা, তার প্রতিকার করাসহ আরও অনেক দায়িত্ব পালন করে এফসিসি। যুক্তরাষ্ট্রের মতো যুক্তরাজ্যেও কমিউনিকেশন্স অ্যাক্ট নামে একটি আইন আছে; এ আইনের অধীনে চলে অফিস অব কমিউনিকেশন্স (অফকম), যার ভূমিকা যুক্তরাষ্ট্রের এফসিসির মতোই। অফকম-এর একটি ব্রডকাস্ট কোড বা সম্প্রচার নীতিমালা আছে। বেতার-টিভির লাইসেন্স কীভাবে দেওয়া হয়, লাইসেন্স পেতে হলে কী কী যোগ্যতা থাকতে হয়, কী কী শর্ত মেনে চলতে হয়—এ সবকিছু পরিষ্কারভাবে নিরূপণ করা আছে। শুধু তা-ই নয়, অফকম তাদের ওয়েবসাইটে লাইসেন্সের আবেদনপত্রের ফরমও দিয়ে দেয়, কীভাবে আবেদনপত্র দাখিল করতে হবে, সঙ্গে কী কী কাগজপত্র জমা দিতে হবে—এসব টিপস্ তারা তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে। অর্থাত্, একটি আইনের ভিত্তিতে রচিত সুনির্দিষ্ট কিছু বিধান অনুযায়ী, যথাযথ একটি কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে বেতার-টিভির লাইসেন্স প্রদানের প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হয়। সরকারের ইচ্ছা-অনিচ্ছা, মর্জি-নাখোশ এই ক্ষেত্রে কাজ করে না। সব যোগ্যতা থাকা এবং সঠিক প্রক্রিয়ায় লাইসেন্সের আবেদন করার পরও যদি কাউকে লাইসেন্স দেওয়া না হয়, তাঁকে ব্যাখ্যা করতে হবে কী কী কারণে তিনি লাইসেন্স পাবেন না।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের দেশে সম্প্রচার মাধ্যমে এর উল্টো চিত্র। বিএনপির সরকারের আমলে আওয়ামী লীগপন্থী কেউ লাইসেন্স পাবেন না, আওয়ামী লীগের সরকারের আমলে বিএনপিপন্থী কেউ লাইসেন্স পাবেন না—এটাই যেন স্বাভাবিক বলে ধরে নেওয়া হয়েছে। যাঁরা লাইসেন্সের জন্য আবেদন করেছেন, তাঁদের অনেকেই এটা জানেন এবং মানেন। কিন্তু একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে তো এভাবে চলতে পারে না, চলা উচিত নয়। আমাদের অবশ্যই একটি সম্প্রচার আইন প্রয়োজন, তার ভিত্তিতে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মতো একটি স্বাধীন সম্প্রচার কমিশন গঠন করা প্রয়োজন, যে কমিশন ওই আইন অনুযায়ী নির্দিষ্ট বিধান মেনে বেসরকারি খাতে বেতার-টিভির লাইসেন্স দেবে।
সেদিনের সেমিনারে অনেক কথার মধ্যে তথ্যমন্ত্রী কয়েকটি টিভি চ্যানেলের টক শো সম্পর্কে উষ্মা প্রকাশ করলেন এই বলে যে ওগুলোতে অনেক ভিত্তিহীন, নেতিবাচক ও দায়িত্বহীন কথাবার্তা প্রচার করা হচ্ছে। এটা অনেকাংশেই সত্য। অবশ্য মন্ত্রী এ বিষয়ে কোনো নিয়ন্ত্রণের কথা বলেননি। প্রবন্ধপাঠকের লিখিত প্রবন্ধে অনেক পরামর্শের মধ্যে এ রকম একটা পরামর্শও ছিল যে সম্প্রচার মাধ্যমের রেগুলেশন বা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থাও থাকা উচিত। আলোচকদের মধ্যে কেউ কেউ এর প্রতিবাদ করে বলেছেন, সম্প্রচার মাধ্যম ভালোভাবে না দাঁড়াতেই একে নিয়ন্ত্রণ করার পরামর্শ হিতে বিপরীত হতে পারে। তথ্যমন্ত্রী তাঁর বক্তৃতায় বললেন, বর্তমান সরকার বেতার-টিভি শুধু নয়, কোনো সংবাদমাধ্যমকেও নিয়ন্ত্রণের কোনো চেষ্টা করেনি, করছে না। উদাহরণ হিসেবে বলেন, বিডিআর বিদ্রোহের সময় কোনো টিভি চ্যানেল বা সংবাদপত্রের অফিসে সরকারের তরফ থেকে কোনো নির্দেশনা পাঠানো হয়নি।
যাহোক, সরকার যে কিছু টিভি চ্যানেলের আচরণে নাখোশ, তার ইঙ্গিত তথ্যমন্ত্রীর বক্তব্যে আঁচ করা কঠিন ছিল না।
বর্তমান সরকার যদি মনে করে বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার তাদের নিজেদের লোকজনকে টিভি-চ্যানেলগুলোর লাইসেন্স দিয়েছে, এখন আমরা আমাদের পছন্দের লোকদের দেব, তা হবে খুবই দুঃখজনক। পরিবর্তনের শপথ নিয়ে, দিনবদলের প্রতিশ্রুতি দিয়ে জনগণের বিপুল সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় আসার পর তো আর পুরোনো দিনের নেতিবাচক মানসিকতায় ফিরে যাওয়া চলে না। নিয়মকানুন, স্বচ্ছতা-ন্যায্যতার ভিত্তিতের পথ চলা তো শুরু করতে হবে।
মশিউল আলম: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
No comments