প্রেরণাদায়িনী ফজিলাতুন্নেসা মুজিব -সময়ের প্রতিবিম্ব by এবিএম মূসা
আইন করে বঙ্গবন্ধুর পরিবারের নিরাপত্তা বিধান করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু-তনয়া বাস করেন প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবনে। এই কারণে নতুন আইন অনুসরণে তাঁর জন্য অতিরিক্ত নিরাপত্তা বেষ্টনী থাকা স্বাভাবিক। পঁচাত্তরের আগে এই নিরাপত্তা বলয়টি যথেষ্ট না হলেও সামান্যতম হলেও ছিল গণভবনে আর বঙ্গভবনে। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডটি ১৫ আগস্টের খুনিরা এত সহজে বিনা বাধায় করতে পেরেছিল কারণ ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোডের বাড়িটির অবস্থানের কারণে। সেখানে একই মাত্রার সামান্যতম নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা সম্ভব ছিল না। অপরদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবের সরকারি বাসস্থান ছিল গণভবন (পুরোনো ও নতুন), পঁচাত্তরে রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর তাঁর বঙ্গভবনে থাকাটাই তো ছিল স্বাভাবিক। এই দুই স্থানের কোনো একটিতে থাকলেই কি সেদিন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ড তাঁর মুষ্টিমেয় দেহরক্ষীরা প্রতিহত করতে পারতেন? অনেকে মনে করেন হয়তো পারতেন, যদিও তখন এসএসএফ বা বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনী গঠিত হয়নি।
অনেকের এই মত যদি গ্রহণ করি তবে প্রশ্ন হলো, সারা দিনের কর্মমুখর দিবসের শেষে ক্লান্ত মুজিব ভবন দুটির সুরক্ষিত দুর্গে না থেকে কেন অরক্ষিত ৩২ নম্বরের বাড়িতে রাত কাটাতে আসতেন? উত্তর একটি, বেগম মুজিব ৩২ নম্বরের বাড়িটির দোতলার পূর্ব-দক্ষিণ কোণের কক্ষটি ছেড়ে আসতে রাজি হননি। তিনি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গী হয়ে অথবা রাষ্ট্রপতির পত্নী পরিচয়ে ‘ফার্স্টলেডি’ হতে চাননি। বহু বছর আগে স্বামীর সঙ্গে গ্রাম্য বধূর যে লেবাসটি পরে এসেছিলেন, গণভবন বা বঙ্গভবনে এসে তা ছাড়তে চাননি। তিনি রাজনীতি-নিবেদিত জননেতা স্বামীর দীর্ঘ রাজনৈতিক দুর্যোগপূর্ণ সময়ের সহযাত্রী ও সহমর্মী ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ অংশীদার হওয়ার কোনো বাসনা ছিল না। তার পরও স্বামীর জীবনযুদ্ধে, আদর্শের সংগ্রামে, এমনকি জনসম্পৃক্ততায় তাঁর একটি অপ্রকাশ্য ভূমিকা অবশ্যই ছিল। পারিবারিক জীবনে সুখ-দুঃখের ভাগীদার যেমন ছিলেন, তেমনি রাজনৈতিক জীবনে ছিলেন তাঁর আদর্শের ‘প্রেরণাদাত্রী বিজয়লক্ষ্মী একজন নারী’।
এ কথা বলেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে নজরুলের একটি কবিতাংশ দিল্লিতে অনুষ্ঠিত আন্তপার্লামেন্টারি বৈঠকে উদ্ধৃতির মাধ্যমে। নজরুলকে উদ্ধৃত করে বলেছিলেন, ‘জগতের যত বড় জয় বড় অভিযান, মাতা ভগ্নী ও বধূদের ত্যাগে হইয়াছে মহীয়ান।’ সেই সব মা ও বধূর উদাহরণে যোগ করেছিলেন একটি নাম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব। গান্ধীজির কথা যেমন লোকে জানে, তেমনি কস্তুরবাইয়ের কথাও ইতিহাসে সামান্যতম হলেও স্থান পেয়েছে। তিনি চরকা কেটেছেন, স্বামীর সঙ্গে জেলে গিয়েছেন। জওহরলাল নেহরু যেমন আলোচিত হয়েছেন, তেমনি বারবার উচ্চারিত হয়েছে কমলা নেহরুর কথা। রাজনীতিতে স্বামীর সঙ্গী হয়েছেন, তাঁর স্বাধীনতার সংগ্রামে কারাবরণ করেছেন। গান্ধী বা নেহরু যতবার বা যত দিন জেলে ছিলেন, বঙ্গবন্ধুর কারাবাসের সময়কাল তার চেয়ে কম নয়। কিন্তু ফজিলাতুন্নেসা তো স্বামীর কারাসঙ্গী ছিলেন না। তখন কোথায় ছিলেন, কী অবস্থায় ছিলেন মুজিব-পত্নী, কীভাবে নিত্যদিনের অভাবের সংসার চলেছে, ছেলেমেয়েদের আগলিয়ে চরম আর্থিক দুর্দশার মাঝে? সেই সব কাহিনী কেউ জানে না, জানতে চায়ও না। তাই তো ১৫ আগস্ট শোকের বন্যায় ভেসে যাঁরা সেমিনার আর স্মরণসভা করেন, তাঁরা কেউ এসব বলেন না, নামটিও উচ্চারণ করেন না। জীবন ও যৌবনের শ্রেষ্ঠ সময়টি যে নারীর জীবন থেকে বারবার ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে তাঁর কথা কেউ ভাবেন না। কারণ বোধহয়, বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব একজন সাধারণ গৃহবধূ হয়েও রাজনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে বা প্রকাশ্যে সংশ্লিষ্ট না থেকেও অন্তরালে থেকে যে অবদান রেখেছিলেন তার সব বিবরণ সবার জানা নেই।
অন্তরঙ্গ আলোকে সেই সংশ্লিষ্টতার কিছু বিবরণ রয়েছে এই প্রতিবেদনে। রাজনীতির উন্মাদনায় ছুটে বেড়ানো শেখ মুজিবের পত্নীকে আমি দেখেছি, কিন্তু প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির পত্নী ‘ফার্স্টলেডিকে’ দেখিনি। দেখেছি আটপৌরে কাপড়ে পালঙ্কে বসে বাটা হাতে পান সাজতে। রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের পাশে রাষ্ট্রীয় বাহনে দেখিনি, তাঁর সঙ্গী হয়ে বিমানে করে রাষ্ট্রীয় সফরে যেতে দেখিনি। সভা-সেমিনার সংবর্ধনায় জর্জেট পরা রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধানের স্ত্রীকে দেখিনি। কারণ সুদূর গ্রাম থেকে যে গ্রাম্য ছাপটি মুখে নিয়ে স্বামীর হাত ধরে শহরে এসেছিলেন, সেই ছাপটি কোনো দিন মুছতে দেননি। এই অনিচ্ছার প্রতিফলনে তিনি ‘ফার্স্টলেডি’ হতে পারেননি। দেখেছি ৩২ নম্বরের বাড়ির দোতলায় বিছানায় পা ছড়িয়ে বসে জাঁতি দিয়ে সুপারি কাটছেন, মুখে পান। কোনো দিন সকালবেলায় বাড়ির পেছনের সিঁড়িটি বেয়ে দোতলায় শোয়ার ঘরে দরজায় উঁকি মারতেই বলতেন, ‘আসুন, পান খান।’ আমাকে যখন পানটি এগিয়ে দিতেন পাশে আধশোয়া মুজিব ভাই পত্রিকার পাতায় চোখ রেখে মুখের পাইপের ফাঁকে মৃদু হাসতেন। আমার দিকে তাকিয়ে সুর করে বলতেন, ‘বাটা ভরে পান পাবে গাল ভরে খেয়ো।’ এই ছিল মুজিব-গিন্নির ঘরোয়া রূপ। এই ঘরোয়া পরিবেশের আকর্ষণে সুরক্ষিত ভবন ছেড়ে রাতে অরক্ষিত সাধারণ বাড়িতে ফিরতেন প্রধানমন্ত্রী, পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রপতি।
আচ্ছা, সেই পানের বাটাটি বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে তেমনি সাজানো আছে কি? জানি না, কারণ ১৫ আগস্টের পর কোনো দিন সেই বাড়িতে যাইনি। এই পানের পিতলের বাটা যার থরে থরে সাজানো থাকত পান, সুপারি, জর্দা, দোক্তা, সাদা-পাতা। এ নিয়ে একটি কৌতুকী কাহিনী মনে পড়ছে। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ঢাকায় এলেন, রেসকোর্স ময়দানে নির্মিত হলো ‘ইন্দিরা মঞ্চ’। জীবনে সেই প্রথম ও সেই শেষ বেগম মুজিব প্রকাশ্যে এলেন। অর্থাত্ বেগম মুজিব একবেলার জন্য ফার্স্টলেডি হয়ে অন্দর থেকে বাইরে এসেছিলেন। পরে জেনেছি, বঙ্গবন্ধু বহু খোশামোদ করে বেগম সাহেবকে সেই মঞ্চে আনতে পেরেছিলেন। মঞ্চে তাঁকে দেখে মনে হলো, চিরকাল আটপৌরে শাড়ি-পরা বেগম মুজিব বহু আয়াসসাধ্য প্রচেষ্টায় একটি কাতান পরেছিলেন। মঞ্চের কাছাকাছি ছিলাম তাই দেখলাম এক হাতে বারবার কাতান শাড়িটি সামলাচ্ছেন, অপর হাতে পানের বাটাটি ধরে আছেন। রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে কয়েক লাখ মানুষের উপস্থিতিতে রাষ্ট্রের সবচেয়ে সম্মানীয় মহিলাটি আঁচলের আড়ালে পানের বাটা আগলিয়ে রেখেছেন, দেখে আমারই হাসি পাচ্ছিল। অদূরে বসে শুনলাম, বঙ্গবন্ধু মৃদুস্বরে ধমকিয়ে উঠলেন, ‘এটি আবার নিয়ে আসলা ক্যান?’ বেগম মুজিবের মুখে দেখলাম অপ্রস্তুত হাসি, তারপর বাটাটি আঁচলের তলে ভালো করে ঢাকা দিতে থাকলেন। এ হচ্ছে সহজ-সরল গ্রাম্যবধূ প্রধানমন্ত্রী-জায়ার চিত্ররূপ।
আজ এই সাদাসিধে গৃহিণীর কাহিনী বিবৃত করা আমার মুখ্য উদ্দেশ্য নয়। নজরুলের ভাষায় ‘শক্তি-সাহস যুগিয়েছে’ যে নারী তাঁর অন্য পরিচয়ও পেয়েছি। সেই পরিচয়ে রয়েছে একজন প্রেরণাদানকারী মহিলার এই দেশের রাজনৈতিক পালাবদলে যুগান্তকারী অবদান। সেই কাহিনী নেহাত কিংবদন্তি নয়, হলেও সেই কিংবদন্তি ছিল আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা ভেস্তে যাওয়ার ইতিহাসভিত্তিক। ঢাকা সেনানিবাসে ষড়যন্ত্র মামলার বিচার চলছে। সাল ঊনসত্তরে সারা দেশে আগুন জ্বলছে, ‘জেলের তালা ভাঙব, শেখ মুজিবকে আনব’। এই স্লোগানে রাওয়ালপিন্ডির ক্ষমতার মঞ্চ কেঁপে উঠেছে। গণ-অভ্যুত্থানে বিধ্বস্ত ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান গোলটেবিল বৈঠক ডাকলেন। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের অবিসংবাদী নেতা শেখ মুজিবকে বাদ দিয়ে গোলটেবিল বৈঠক হয় কী করে? শেষ পর্যন্ত আইয়ুব খান বৈঠক সফল করতে রাজনৈতিক নেতাদের চাপে বাধ্য হলেন কারাবন্দী শেখ মুজিবুর রহমানকে আমন্ত্রণ জানাতে। কিন্তু দেশদ্রোহের দায়ে বিচারের আসামি, ক্যান্টনমেন্টে বন্দী আসবেন কীভাবে? অবশেষে আইয়ুব খান সিদ্ধান্ত নিলেন, প্যারোলে মুক্তি দিয়ে তাঁকে রাওয়ালপিন্ডি নিয়ে যাওয়া হবে। ফেব্রুয়ারির ১৭ বা ১৮ তারিখ থেকে বিভিন্ন মহল থেকে শেখ সাহেবের কাছে প্যারোলে যাওয়া প্রস্তাব আসতে থাকে। গোলটেবিল বৈঠক থেকে তত্কালীন রাজনৈতিক ফ্রন্ট এনডিএফের নেতা মৌলভি ফরিদ আহমদ সরাসরি তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করে অনুরোধ জানান প্যারোলে মুক্তি নিতে। একই সঙ্গে ঢাকার তাঁর অন্তরঙ্গ দুজন প্রভাবশালী সম্পাদক জেলে দেখা করে একই অনুরোধ জানান। ঢাকায় তখন তাঁর মুক্তির দাবিতে কারফিউ ভেঙে রোজ রাতে মানুষের ঢল নামছে রাস্তায়। এরই মাঝে প্যারোলের বার্তা রটে গেল জনগণের মধ্যে। চলছে জল্পনা-কল্পনা, শেখ সাহেব কি প্যারোলে মুক্তি নিয়ে আইয়ুবের বৈঠকে যাবেন?
ক্যান্টনমেন্টে বসে শেখ সাহেব কী ভাবছেন কেউ তা জানে না। সারা দেশের মানুষও কিছুটা বিভ্রান্ত। তারা প্রাণ দিচ্ছে, রক্ত দিচ্ছে প্রিয় নেতাকে মুক্ত করে আনার জন্য, মুচলেকা দিয়ে আইয়ুবের দরবারে যাওয়ার জন্য নয়। কিন্তু এই ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন যিনি তিনিও ছিলেন দ্বিধাগ্রস্ত। সেদিন মুচলেকা দিয়ে, নাকি নিঃশর্ত মুক্তি—সেই যুগান্তকারী সিদ্ধান্তটি নিয়েছিলেন এবং জানিয়েছিলেন একজন নারী। মুজিবের সহধর্মিণী যিনি রাজনীতি বুঝতেন না কিন্তু নিজের স্বামীকে জানতেন। বুঝতে পেরেছিলেন তাঁর স্বামীর মানসিক দ্বন্দ্ব। বন্দী স্বামীকে খবর পাঠালেন, ‘হাতে বঁটি নিয়ে বসে আছি, প্যারোলে মুচলেকা দিয়ে জীবনে বত্রিশ নম্বরে আসবেন না।’
এখন ভাবতে অবাক লাগে অর্ধশিক্ষিত সাধারণ গৃহবধূ রাজনীতি বোঝেন না রণচণ্ডিনী মূর্তি ধারণ করে একটি রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছিলেন। দূর থেকে শক্তি জোগালেন স্বামীকে। সত্যিই তিনি এ ধরনের কোনো খবর পাঠিয়েছিলেন কি না, তাঁরই প্রভাবে শেখ সাহেব প্যারোলে রাওয়ালপিন্ডি যেতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন কি না তা কোনো দিন জানতে পারিনি। অনেক দিন পর ভাবীর সামনেই বঙ্গবন্ধুর কাছে এর সত্যতা জানতে চেয়েছিলাম। তিনি হেসে আঙুল দিয়ে ভাবীকে দেখিয়ে বলতেন, ‘ওনাকে জিজ্ঞেস করো না।’ ভাবীর দিকে তাকাতে তিনি মুচকি হেসে এক খিলি পান এগিয়ে দিলেন। এই দেশের ভবিষ্যত্ ইতিহাস অন্যভাবে লেখা হতো যদি কিংবদন্তি সত্যি না হতো, শেখ মুজিব মুচলেকা দিয়ে সহবন্দীদের ক্যান্টনমেন্টে রেখে রাওয়ালপিন্ডি যেতেন।
প্রকৃতপক্ষে বেগম মুজিব স্বামীর প্রতিটি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত না থেকেও দেশে কী ঘটছে, জনগণ কী ভাবছে আর বলছে তার খোঁজখবর রাখতেন, কিন্তু রাষ্ট্রপরিচালক স্বামীর কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত হতেন না। এই প্রসঙ্গে একটি ঘটনার উল্লেখ করতে চাই। স্বাধীনতার পর আমি যখন মর্নিং নিউজ-এর সম্পাদক তখন উক্ত সংবাদপত্র বিলি-বণ্টন নিয়ে হকারস সমিতি ও বণ্টনের দায়িত্বে নিযুক্ত একটি এজেন্সির মধ্যে বিরোধ চরম পর্যায়ে পৌঁছানোতে পুলিশি হস্তক্ষেপের প্রয়োজন হয়। ঢাকার তখনকার এসপি মাহবুবকে, বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ আত্মীয় প্রতিদ্বন্দ্বী পত্রিকার মালিক-সম্পাদক আমাদের বিরুদ্ধে হকার্স সমিতির পক্ষে কঠিন পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য চাপ দিতে থাকেন। অবস্থা গুরুতর পর্যায়ে পৌঁছালে রাত ১২টায় ইত্তেফাক সম্পাদক আনোয়ার হোসেন মঞ্জু ও আমি বত্রিশ নম্বরে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে এসে তাঁকে সব অবহিত করলাম। সবকিছু শুনে প্রধানমন্ত্রী কিছু বলার আগেই ভাবী পরমাত্মীয় সম্পাদক-মালিকের নাম করে বললেন, ‘এদের কথাই তোমাকে বারবার বলেছি। এরাই শেষ পর্যন্ত তোমার কাল হবে।’ শেষ পর্যন্ত ব্যাপারটি কোথায় গড়িয়েছিল তা ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন নেই। তবে এটুকু বুঝেছিলাম, বত্রিশ নম্বরে খাটের ওপর বসে তিনি শুধু পান বানাতেন না। সারা দেশের রাজনীতি এবং প্রধানমন্ত্রীর প্রতিটি কার্যক্রম তাঁর জ্ঞাত ছিল। বঙ্গবন্ধুর কোনো পদক্ষেপ তাঁর উদ্বেগের কারণ ঘটালে প্রকাশ করতেন। এমনকি বাকশাল গঠনের পর তাঁকে বলতে শুনেছি, ‘এবার থেকে তুমি এই বাসায় নয়, তোমার সাঙ্গপাঙ্গদের নিয়ে গণভবনেই থাকবে।’ বেগম মুজিব কি তাঁর দূরদৃষ্টিতে ভবিষ্যত্ দেখতে পেয়েছিলেন?
গান্ধী-পত্নী কস্তুরবাই, নেহরুর কারাসঙ্গিনী কমলা, দেশবন্ধুর সহধর্মিণী বাসন্তী দেবী বা ম্যান্ডেলা-পত্নী উইনি ইতিহাসে স্থান পেয়েছেন। কিন্তু বাঙালি জাতির মুক্তিদাতার স্ত্রী শক্তিদায়িনী, প্রেরণাদায়িনী মহিলার স্থান কেন বাংলাদেশের ইতিহাসের পাতায় থাকবে না? আমার এই আফসোস অনেকখানি মিটিয়েছেন কয়েক দিন আগে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ টিএসসিতে স্মরণসভার আয়োজন করে। সেই সভায় এ জন্য তাদের মোবারকবাদ জানিয়েছিলাম।
পাদটীকা: সারা শহরে এখন কালো ব্যানারের ছড়াছড়ি। ব্যানারের এক প্রান্তে বঙ্গবন্ধু, অন্য প্রান্তে শেখ হাসিনা কেন? ফজিলাতুন্নেসা মুজিব নয় কেন?
এবিএম মূসা: সাংবাদিক, কলাম লেখক।
অনেকের এই মত যদি গ্রহণ করি তবে প্রশ্ন হলো, সারা দিনের কর্মমুখর দিবসের শেষে ক্লান্ত মুজিব ভবন দুটির সুরক্ষিত দুর্গে না থেকে কেন অরক্ষিত ৩২ নম্বরের বাড়িতে রাত কাটাতে আসতেন? উত্তর একটি, বেগম মুজিব ৩২ নম্বরের বাড়িটির দোতলার পূর্ব-দক্ষিণ কোণের কক্ষটি ছেড়ে আসতে রাজি হননি। তিনি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গী হয়ে অথবা রাষ্ট্রপতির পত্নী পরিচয়ে ‘ফার্স্টলেডি’ হতে চাননি। বহু বছর আগে স্বামীর সঙ্গে গ্রাম্য বধূর যে লেবাসটি পরে এসেছিলেন, গণভবন বা বঙ্গভবনে এসে তা ছাড়তে চাননি। তিনি রাজনীতি-নিবেদিত জননেতা স্বামীর দীর্ঘ রাজনৈতিক দুর্যোগপূর্ণ সময়ের সহযাত্রী ও সহমর্মী ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ অংশীদার হওয়ার কোনো বাসনা ছিল না। তার পরও স্বামীর জীবনযুদ্ধে, আদর্শের সংগ্রামে, এমনকি জনসম্পৃক্ততায় তাঁর একটি অপ্রকাশ্য ভূমিকা অবশ্যই ছিল। পারিবারিক জীবনে সুখ-দুঃখের ভাগীদার যেমন ছিলেন, তেমনি রাজনৈতিক জীবনে ছিলেন তাঁর আদর্শের ‘প্রেরণাদাত্রী বিজয়লক্ষ্মী একজন নারী’।
এ কথা বলেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে নজরুলের একটি কবিতাংশ দিল্লিতে অনুষ্ঠিত আন্তপার্লামেন্টারি বৈঠকে উদ্ধৃতির মাধ্যমে। নজরুলকে উদ্ধৃত করে বলেছিলেন, ‘জগতের যত বড় জয় বড় অভিযান, মাতা ভগ্নী ও বধূদের ত্যাগে হইয়াছে মহীয়ান।’ সেই সব মা ও বধূর উদাহরণে যোগ করেছিলেন একটি নাম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব। গান্ধীজির কথা যেমন লোকে জানে, তেমনি কস্তুরবাইয়ের কথাও ইতিহাসে সামান্যতম হলেও স্থান পেয়েছে। তিনি চরকা কেটেছেন, স্বামীর সঙ্গে জেলে গিয়েছেন। জওহরলাল নেহরু যেমন আলোচিত হয়েছেন, তেমনি বারবার উচ্চারিত হয়েছে কমলা নেহরুর কথা। রাজনীতিতে স্বামীর সঙ্গী হয়েছেন, তাঁর স্বাধীনতার সংগ্রামে কারাবরণ করেছেন। গান্ধী বা নেহরু যতবার বা যত দিন জেলে ছিলেন, বঙ্গবন্ধুর কারাবাসের সময়কাল তার চেয়ে কম নয়। কিন্তু ফজিলাতুন্নেসা তো স্বামীর কারাসঙ্গী ছিলেন না। তখন কোথায় ছিলেন, কী অবস্থায় ছিলেন মুজিব-পত্নী, কীভাবে নিত্যদিনের অভাবের সংসার চলেছে, ছেলেমেয়েদের আগলিয়ে চরম আর্থিক দুর্দশার মাঝে? সেই সব কাহিনী কেউ জানে না, জানতে চায়ও না। তাই তো ১৫ আগস্ট শোকের বন্যায় ভেসে যাঁরা সেমিনার আর স্মরণসভা করেন, তাঁরা কেউ এসব বলেন না, নামটিও উচ্চারণ করেন না। জীবন ও যৌবনের শ্রেষ্ঠ সময়টি যে নারীর জীবন থেকে বারবার ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে তাঁর কথা কেউ ভাবেন না। কারণ বোধহয়, বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব একজন সাধারণ গৃহবধূ হয়েও রাজনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে বা প্রকাশ্যে সংশ্লিষ্ট না থেকেও অন্তরালে থেকে যে অবদান রেখেছিলেন তার সব বিবরণ সবার জানা নেই।
অন্তরঙ্গ আলোকে সেই সংশ্লিষ্টতার কিছু বিবরণ রয়েছে এই প্রতিবেদনে। রাজনীতির উন্মাদনায় ছুটে বেড়ানো শেখ মুজিবের পত্নীকে আমি দেখেছি, কিন্তু প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির পত্নী ‘ফার্স্টলেডিকে’ দেখিনি। দেখেছি আটপৌরে কাপড়ে পালঙ্কে বসে বাটা হাতে পান সাজতে। রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের পাশে রাষ্ট্রীয় বাহনে দেখিনি, তাঁর সঙ্গী হয়ে বিমানে করে রাষ্ট্রীয় সফরে যেতে দেখিনি। সভা-সেমিনার সংবর্ধনায় জর্জেট পরা রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধানের স্ত্রীকে দেখিনি। কারণ সুদূর গ্রাম থেকে যে গ্রাম্য ছাপটি মুখে নিয়ে স্বামীর হাত ধরে শহরে এসেছিলেন, সেই ছাপটি কোনো দিন মুছতে দেননি। এই অনিচ্ছার প্রতিফলনে তিনি ‘ফার্স্টলেডি’ হতে পারেননি। দেখেছি ৩২ নম্বরের বাড়ির দোতলায় বিছানায় পা ছড়িয়ে বসে জাঁতি দিয়ে সুপারি কাটছেন, মুখে পান। কোনো দিন সকালবেলায় বাড়ির পেছনের সিঁড়িটি বেয়ে দোতলায় শোয়ার ঘরে দরজায় উঁকি মারতেই বলতেন, ‘আসুন, পান খান।’ আমাকে যখন পানটি এগিয়ে দিতেন পাশে আধশোয়া মুজিব ভাই পত্রিকার পাতায় চোখ রেখে মুখের পাইপের ফাঁকে মৃদু হাসতেন। আমার দিকে তাকিয়ে সুর করে বলতেন, ‘বাটা ভরে পান পাবে গাল ভরে খেয়ো।’ এই ছিল মুজিব-গিন্নির ঘরোয়া রূপ। এই ঘরোয়া পরিবেশের আকর্ষণে সুরক্ষিত ভবন ছেড়ে রাতে অরক্ষিত সাধারণ বাড়িতে ফিরতেন প্রধানমন্ত্রী, পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রপতি।
আচ্ছা, সেই পানের বাটাটি বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে তেমনি সাজানো আছে কি? জানি না, কারণ ১৫ আগস্টের পর কোনো দিন সেই বাড়িতে যাইনি। এই পানের পিতলের বাটা যার থরে থরে সাজানো থাকত পান, সুপারি, জর্দা, দোক্তা, সাদা-পাতা। এ নিয়ে একটি কৌতুকী কাহিনী মনে পড়ছে। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ঢাকায় এলেন, রেসকোর্স ময়দানে নির্মিত হলো ‘ইন্দিরা মঞ্চ’। জীবনে সেই প্রথম ও সেই শেষ বেগম মুজিব প্রকাশ্যে এলেন। অর্থাত্ বেগম মুজিব একবেলার জন্য ফার্স্টলেডি হয়ে অন্দর থেকে বাইরে এসেছিলেন। পরে জেনেছি, বঙ্গবন্ধু বহু খোশামোদ করে বেগম সাহেবকে সেই মঞ্চে আনতে পেরেছিলেন। মঞ্চে তাঁকে দেখে মনে হলো, চিরকাল আটপৌরে শাড়ি-পরা বেগম মুজিব বহু আয়াসসাধ্য প্রচেষ্টায় একটি কাতান পরেছিলেন। মঞ্চের কাছাকাছি ছিলাম তাই দেখলাম এক হাতে বারবার কাতান শাড়িটি সামলাচ্ছেন, অপর হাতে পানের বাটাটি ধরে আছেন। রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে কয়েক লাখ মানুষের উপস্থিতিতে রাষ্ট্রের সবচেয়ে সম্মানীয় মহিলাটি আঁচলের আড়ালে পানের বাটা আগলিয়ে রেখেছেন, দেখে আমারই হাসি পাচ্ছিল। অদূরে বসে শুনলাম, বঙ্গবন্ধু মৃদুস্বরে ধমকিয়ে উঠলেন, ‘এটি আবার নিয়ে আসলা ক্যান?’ বেগম মুজিবের মুখে দেখলাম অপ্রস্তুত হাসি, তারপর বাটাটি আঁচলের তলে ভালো করে ঢাকা দিতে থাকলেন। এ হচ্ছে সহজ-সরল গ্রাম্যবধূ প্রধানমন্ত্রী-জায়ার চিত্ররূপ।
আজ এই সাদাসিধে গৃহিণীর কাহিনী বিবৃত করা আমার মুখ্য উদ্দেশ্য নয়। নজরুলের ভাষায় ‘শক্তি-সাহস যুগিয়েছে’ যে নারী তাঁর অন্য পরিচয়ও পেয়েছি। সেই পরিচয়ে রয়েছে একজন প্রেরণাদানকারী মহিলার এই দেশের রাজনৈতিক পালাবদলে যুগান্তকারী অবদান। সেই কাহিনী নেহাত কিংবদন্তি নয়, হলেও সেই কিংবদন্তি ছিল আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা ভেস্তে যাওয়ার ইতিহাসভিত্তিক। ঢাকা সেনানিবাসে ষড়যন্ত্র মামলার বিচার চলছে। সাল ঊনসত্তরে সারা দেশে আগুন জ্বলছে, ‘জেলের তালা ভাঙব, শেখ মুজিবকে আনব’। এই স্লোগানে রাওয়ালপিন্ডির ক্ষমতার মঞ্চ কেঁপে উঠেছে। গণ-অভ্যুত্থানে বিধ্বস্ত ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান গোলটেবিল বৈঠক ডাকলেন। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের অবিসংবাদী নেতা শেখ মুজিবকে বাদ দিয়ে গোলটেবিল বৈঠক হয় কী করে? শেষ পর্যন্ত আইয়ুব খান বৈঠক সফল করতে রাজনৈতিক নেতাদের চাপে বাধ্য হলেন কারাবন্দী শেখ মুজিবুর রহমানকে আমন্ত্রণ জানাতে। কিন্তু দেশদ্রোহের দায়ে বিচারের আসামি, ক্যান্টনমেন্টে বন্দী আসবেন কীভাবে? অবশেষে আইয়ুব খান সিদ্ধান্ত নিলেন, প্যারোলে মুক্তি দিয়ে তাঁকে রাওয়ালপিন্ডি নিয়ে যাওয়া হবে। ফেব্রুয়ারির ১৭ বা ১৮ তারিখ থেকে বিভিন্ন মহল থেকে শেখ সাহেবের কাছে প্যারোলে যাওয়া প্রস্তাব আসতে থাকে। গোলটেবিল বৈঠক থেকে তত্কালীন রাজনৈতিক ফ্রন্ট এনডিএফের নেতা মৌলভি ফরিদ আহমদ সরাসরি তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করে অনুরোধ জানান প্যারোলে মুক্তি নিতে। একই সঙ্গে ঢাকার তাঁর অন্তরঙ্গ দুজন প্রভাবশালী সম্পাদক জেলে দেখা করে একই অনুরোধ জানান। ঢাকায় তখন তাঁর মুক্তির দাবিতে কারফিউ ভেঙে রোজ রাতে মানুষের ঢল নামছে রাস্তায়। এরই মাঝে প্যারোলের বার্তা রটে গেল জনগণের মধ্যে। চলছে জল্পনা-কল্পনা, শেখ সাহেব কি প্যারোলে মুক্তি নিয়ে আইয়ুবের বৈঠকে যাবেন?
ক্যান্টনমেন্টে বসে শেখ সাহেব কী ভাবছেন কেউ তা জানে না। সারা দেশের মানুষও কিছুটা বিভ্রান্ত। তারা প্রাণ দিচ্ছে, রক্ত দিচ্ছে প্রিয় নেতাকে মুক্ত করে আনার জন্য, মুচলেকা দিয়ে আইয়ুবের দরবারে যাওয়ার জন্য নয়। কিন্তু এই ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন যিনি তিনিও ছিলেন দ্বিধাগ্রস্ত। সেদিন মুচলেকা দিয়ে, নাকি নিঃশর্ত মুক্তি—সেই যুগান্তকারী সিদ্ধান্তটি নিয়েছিলেন এবং জানিয়েছিলেন একজন নারী। মুজিবের সহধর্মিণী যিনি রাজনীতি বুঝতেন না কিন্তু নিজের স্বামীকে জানতেন। বুঝতে পেরেছিলেন তাঁর স্বামীর মানসিক দ্বন্দ্ব। বন্দী স্বামীকে খবর পাঠালেন, ‘হাতে বঁটি নিয়ে বসে আছি, প্যারোলে মুচলেকা দিয়ে জীবনে বত্রিশ নম্বরে আসবেন না।’
এখন ভাবতে অবাক লাগে অর্ধশিক্ষিত সাধারণ গৃহবধূ রাজনীতি বোঝেন না রণচণ্ডিনী মূর্তি ধারণ করে একটি রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছিলেন। দূর থেকে শক্তি জোগালেন স্বামীকে। সত্যিই তিনি এ ধরনের কোনো খবর পাঠিয়েছিলেন কি না, তাঁরই প্রভাবে শেখ সাহেব প্যারোলে রাওয়ালপিন্ডি যেতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন কি না তা কোনো দিন জানতে পারিনি। অনেক দিন পর ভাবীর সামনেই বঙ্গবন্ধুর কাছে এর সত্যতা জানতে চেয়েছিলাম। তিনি হেসে আঙুল দিয়ে ভাবীকে দেখিয়ে বলতেন, ‘ওনাকে জিজ্ঞেস করো না।’ ভাবীর দিকে তাকাতে তিনি মুচকি হেসে এক খিলি পান এগিয়ে দিলেন। এই দেশের ভবিষ্যত্ ইতিহাস অন্যভাবে লেখা হতো যদি কিংবদন্তি সত্যি না হতো, শেখ মুজিব মুচলেকা দিয়ে সহবন্দীদের ক্যান্টনমেন্টে রেখে রাওয়ালপিন্ডি যেতেন।
প্রকৃতপক্ষে বেগম মুজিব স্বামীর প্রতিটি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত না থেকেও দেশে কী ঘটছে, জনগণ কী ভাবছে আর বলছে তার খোঁজখবর রাখতেন, কিন্তু রাষ্ট্রপরিচালক স্বামীর কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত হতেন না। এই প্রসঙ্গে একটি ঘটনার উল্লেখ করতে চাই। স্বাধীনতার পর আমি যখন মর্নিং নিউজ-এর সম্পাদক তখন উক্ত সংবাদপত্র বিলি-বণ্টন নিয়ে হকারস সমিতি ও বণ্টনের দায়িত্বে নিযুক্ত একটি এজেন্সির মধ্যে বিরোধ চরম পর্যায়ে পৌঁছানোতে পুলিশি হস্তক্ষেপের প্রয়োজন হয়। ঢাকার তখনকার এসপি মাহবুবকে, বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ আত্মীয় প্রতিদ্বন্দ্বী পত্রিকার মালিক-সম্পাদক আমাদের বিরুদ্ধে হকার্স সমিতির পক্ষে কঠিন পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য চাপ দিতে থাকেন। অবস্থা গুরুতর পর্যায়ে পৌঁছালে রাত ১২টায় ইত্তেফাক সম্পাদক আনোয়ার হোসেন মঞ্জু ও আমি বত্রিশ নম্বরে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে এসে তাঁকে সব অবহিত করলাম। সবকিছু শুনে প্রধানমন্ত্রী কিছু বলার আগেই ভাবী পরমাত্মীয় সম্পাদক-মালিকের নাম করে বললেন, ‘এদের কথাই তোমাকে বারবার বলেছি। এরাই শেষ পর্যন্ত তোমার কাল হবে।’ শেষ পর্যন্ত ব্যাপারটি কোথায় গড়িয়েছিল তা ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন নেই। তবে এটুকু বুঝেছিলাম, বত্রিশ নম্বরে খাটের ওপর বসে তিনি শুধু পান বানাতেন না। সারা দেশের রাজনীতি এবং প্রধানমন্ত্রীর প্রতিটি কার্যক্রম তাঁর জ্ঞাত ছিল। বঙ্গবন্ধুর কোনো পদক্ষেপ তাঁর উদ্বেগের কারণ ঘটালে প্রকাশ করতেন। এমনকি বাকশাল গঠনের পর তাঁকে বলতে শুনেছি, ‘এবার থেকে তুমি এই বাসায় নয়, তোমার সাঙ্গপাঙ্গদের নিয়ে গণভবনেই থাকবে।’ বেগম মুজিব কি তাঁর দূরদৃষ্টিতে ভবিষ্যত্ দেখতে পেয়েছিলেন?
গান্ধী-পত্নী কস্তুরবাই, নেহরুর কারাসঙ্গিনী কমলা, দেশবন্ধুর সহধর্মিণী বাসন্তী দেবী বা ম্যান্ডেলা-পত্নী উইনি ইতিহাসে স্থান পেয়েছেন। কিন্তু বাঙালি জাতির মুক্তিদাতার স্ত্রী শক্তিদায়িনী, প্রেরণাদায়িনী মহিলার স্থান কেন বাংলাদেশের ইতিহাসের পাতায় থাকবে না? আমার এই আফসোস অনেকখানি মিটিয়েছেন কয়েক দিন আগে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ টিএসসিতে স্মরণসভার আয়োজন করে। সেই সভায় এ জন্য তাদের মোবারকবাদ জানিয়েছিলাম।
পাদটীকা: সারা শহরে এখন কালো ব্যানারের ছড়াছড়ি। ব্যানারের এক প্রান্তে বঙ্গবন্ধু, অন্য প্রান্তে শেখ হাসিনা কেন? ফজিলাতুন্নেসা মুজিব নয় কেন?
এবিএম মূসা: সাংবাদিক, কলাম লেখক।
No comments