ঝুঁকিপূর্ণ কাজ ১২ লাখ ৮০ হাজার শিশুর by এমএম মাসুদ
গত
এক দশকের ব্যবধানে কর্মরত শিশুর সংখ্যার পাশাপাশি শিশুশ্রম অর্ধেকে নেমে
এসেছে। কিন্তু ঝুঁঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত শিশুর সংখ্যা কমেনি। বাংলাদেশে এখন
সাড়ে ৩৪ লাখ শিশু কর্মরত। ২০০৩ সালে কর্মরত শিশু ছিল প্রায় ৭৪ লাখ।
বর্তমানে কর্মরত শিশুদের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত আছে ১২ লাখ ৮০
হাজার। আর ২ লাখ ৬০ হাজার শিশু অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করে।
তাদের কাজের বৈশিষ্ট্য জীবন ও স্বাস্থ্যের জন্য বেশ হুমকিস্বরূপ। দেশে শিশুশ্রমের প্রায় ৯৫ শতাংশ অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মরত। এর মধ্যে শুধু শহরাঞ্চলেই কর্মরত রয়েছে ৫ লাখ ৮ হাজার ২৯৮ শিশু। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম (বিএসএএফ), বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
জানা গেছে, বিশ্বের প্রতি ১০ জন শিশুর একজন শিশু শ্রমিক। আর তাদের অর্ধেকই ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত। তবে নব্বই দশকের পর শিশু শ্রমিকদের সংখ্যা ১০ কোটি কমে গেছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) প্রকাশিত এক পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, বিশ্বে ১৫ কোটি ২০ লাখ শিশু শ্রমিক রয়েছে? তাদের আড়াই কোটি শিশুকেই জোর করে কাজা বাধ্য করা হচ্ছে।
২০০৬ সালে বাংলাদেশ শ্রম আইনে নির্দিষ্ট করে বলা হয়েছে, ১৪ বছরের নিচে কোনো শিশুকে কাজে নেয়া যাবে না। ১৪ থেকে ১৮ বছর পর্যন্ত কাজে নেয়া যাবে, তবে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নেয়া যাবে না। আর শিশুদের জন্য ৩৮ ধরনের ঝঁকিপূর্ণ কাজে নেয়া নিষিদ্ধ করা হয়।
সংশ্লিষ্টরা বলেন, এখনো পুরো বিশ্বের মোট শিশু শ্রমিকের ৫ শতাংশই বাংলাদেশে। সমাজ থেকে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম প্রত্যাহার ও নিরসনে সর্বস্তরের জনগণের মূল্যবোধের পরিবর্তন করতে হবে। এ ছাড়া একমাত্র সচেতনতাই শিশুশ্রম নিরসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। সে কারণে পরিবার থেকে শুরু করে সবাইকে সচেতন হতে হবে।
বিবিএসের ২০০৩ সালের জাতীয় শিশুশ্রম সমীক্ষায় দেখা গেছে, তখন প্রায় ৭৪ লাখ কর্মরত শিশু ছিল। এদের মধ্যে ৩১ লাখ ৭৯ হাজার শিশুর কাজ শিশুশ্রমের আওতায় ছিল। তবে এক দশকের ব্যবধানে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত শিশুদের সংখ্যা তেমন কমেনি, কমেছে মাত্র ১১ হাজার। ২০০৩ সালে দেশে ১২ লাখ ৯১ হাজার শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজে ছিল। বর্তমানে সাড়ে ৩৪ লাখ শিশু কর্মরত। সে হিসাবে প্রায় এক দশকের ব্যবধানে কর্মরত শিশুর সংখ্যার পাশাপাশি শিশুশ্রম অর্ধেকে নেমে এসেছে।
বিএসএএফ প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে ৫ থেকে ১৭ বছরের শিশু শ্রমিক রয়েছে ৩৪ লাখ ৫০ হাজার। এদের মধ্যে ৫ থেকে ১১ বছরের শিশু শ্রমিক রয়েছে ১৭ লাখ; যাদের কাজ করার কোনো অনুমতি না থাকলেও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করছে তারা। এসব শিশুর মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে নিয়োজিত রয়েছে ১২ লাখ ৮০ হাজার শিশু, যা উদ্বেগজনক।
শিশুদের অধিকার নিয়ে কাজ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ নাজমুজ্জামান ভূঁইয়া বলেন, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে যে ১৭টি লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে; এদের মধ্যে শিশুশ্রম রয়েছে ৮ নম্বরে। এই শিশুশ্রম নিরসনে ২০১২-১৫ সাল পর্যন্ত সময় নির্ধারণ করা হলেও তা বাস্তবায়ন না হওয়ায় আরো এক বছর বাড়ানো হয়। তবুও সম্ভব হয়নি শিশুশ্রম নিরসন করা।
সারা দেশে শিশু নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরে বিএসএএফ-এর পরিসংখ্যানে উল্লেখ করা হয়, বিভিন্ন বাসা-বাড়ি বা প্রতিষ্ঠানে চুরি করার অপবাদে ২০১৬ সালে দরিদ্র শ্রমজীবী ১০৬টি শিশুকে নির্মমভাবে পিটিয়ে নির্যাতন করা হয়েছে। এ ছাড়া ২০১৫ সালে এসব নির্যাতনের শিকার হয়েছে আরো ৯০ শিশু। ২০১৩-২০১৭ এর মে পর্যন্ত ৬৫ জন শিশু গৃহকর্মীকে শারীরিক নির্যাতন করা হয়েছে। একই সময় ২১ জন শিশু গৃহকর্মীকে ধর্ষণ ও ২১ জনকে হত্যা করা হয়েছে। ৩০ জন শিশু গৃহকর্মী আত্মহত্যা করে। এর বাইরেও অনেক শিশু বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছে।
বিএএসএফ’র চেয়ারপারসন মো. এমরানুল হক চৌধুরী বলেন, ২০২১ সালের মধ্যে শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ কাজের বাইরে নিতে হবে। ২০২৫ সালে দেশে শিশু শ্রমিক থাকবে না। কিন্তু সেটা বাস্তবায়নে যথেষ্ট উদ্যোগ নেই। ফলে লক্ষ্য অর্জন নিয়ে সন্দিহান রয়েছে।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) প্রতিবেদনে দেখা যায়, একটি শিশু দৈনিক গড়ে ৮ ঘণ্টা শ্রমের বিনিময়ে মাত্র ১০০ টাকা উপার্জন করে। তারা মাসে গড়ে সর্বোচ্চ ১০,৫০০ টাকা এবং সর্বনিম্ন ২৬০ টাকা উপার্জন করে। বেশির ভাগ শিশু (৭২%) তাদের রোজগারের এই অর্থ পরিবারের প্রয়োজনে ব্যয় করে।
শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় কর্তৃক ‘বাংলাদেশে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত শিশুশ্রম নিরসন’ (৩য় পর্যায়) শীর্ষক প্রকল্প ২০১০ সালের নভেম্বর থেকে ২০১৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত সমীক্ষা করা হয়। এতে বলা হয়, বাংলাদেশে ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সের শিশুর সংখ্যা ৩ কোটি ৯৬ লাখ, এদের মধ্যে ১৭ লাখ শিশু কোনো না কোনো ভাবে শ্রমে নিযুক্ত, যার ১২ লাখ ১০ হাজার শিশু জড়িত ঝুঁকিপূর্ণ কাজে যেমন, ওয়েল্ডিং ও মোটর ওয়ার্কশপ, যানবাহনের হেলপার, প্লাস্টিক ও রাসায়নিক কারখানা, বিড়ি কারখানা, নির্মাণ কাজ-ইট ভাটা, পাথর ভাঙ্গা, অটোমোবাইল স্টেশন, বর্জ্য অপসারণ, চামড়ার কারখানা, বিস্কিট কারখানা, হোটেল-রেস্টুরেন্টের কাজে নিয়োজিত।
সমীক্ষায় দেখা যায়, শ্রমজীবী শিশুদের গড় মাসিক পারিবারিক আয় ৮,৬০৭ টাকা। শ্রমজীবী শিশুরা গড়ে ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত পাস। শ্রমজীবী শিশুর ৮০% (ছেলে ৮১%, মেয়ে ৭৭%) বর্তমানে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত।
তথ্যে দেখা গেছে, ৬৯% অভিভাবক অবহিত আছেন যে, ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত শিশুদের দুর্ঘটনা বা শারীরিক ক্ষতির সম্ভাবনা আছে, তা সত্ত্বেও তারা বাধ্য হন শিশুদেরকে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত করতে। শতকরা ৬০% শিশু দিনে এবং ৪০% দিন ও রাত উভয় সময়ই তাদের শ্রমে নিয়োজিত থাকে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, দরিদ্রতা শিশুশ্রম নিরসনে বাধা। এ ছাড়া শিশুদের স্বল্পবেতন ও সহজ শর্তে কাজে নিয়োগদান, ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশুদের নিয়োগকারী মালিকপক্ষের সচেতনতা ও দায়বদ্ধতার অভাব, শিশু বান্ধব কাজের অভাব ইত্যাদি বিষয় ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম নিরসনে প্রতিবন্ধক। তবে দেশে সচেতনতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রতিবেদনে দেখা যায়, শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে সচেতনতা বৃদ্ধির ফলে শিশুশ্রম নিরোধ ও নিরসনে সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে শ্রমজীবী শিশুদের ঝুঁকি হ্রাস পেয়েছে।
বিবিএসের জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশে ১৮টি খাতে ১৬ লাখ ৯৮ হাজার ৮৯৪ জন শিশু ‘শিশুশ্রমে’ নিয়োজিত রয়েছে। তাদের মধ্যে ৭ লাখ ৪৫ হাজার ৬৯০ জন মেয়ে শিশু। শিশুশ্রমে নিয়োজিতদের ৫৭ শতাংশের কাজই অস্থায়ী। বর্তমানে শিশুশ্রমে নিয়োজিত আছে এমন ১০ লাখ ৭০ হাজার শিশু এক সময় স্কুলে গেলেও এখন আর যায় না। আর ১ লাখ ৪২ হাজার শিশু কখনই স্কুলে যায়নি।
শিশু শ্রমিকদের মজুরিও বেশ কম। প্রায় ৭ লাখ শিশু কোনো মজুরি পায় না। মজুরি পায় সব মিলিয়ে ১০ লাখ ১৯ হাজার শিশু। ৩ লাখ ৮৮,১৪২ শিশু মাসে ৫-৭ হাজার টাকা মজুরি পায়। আর প্রায় এক লাখ শিশু আড়াই হাজার টাকার কম পায়। সাড়ে সাত হাজার টাকার বেশি মাসে মজুরি পায় আড়াই লাখ শিশু। অন্যদিকে সপ্তাহে দৈনিক গড়ে ৫ ঘণ্টার বেশি কাজ করে বা ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত শিশুদের (১২ লাখ ৮০ হাজার শিশু) মজুরিও বেশ কম।
জাতীয় শিশুনীতি ২০১১ অনুসারে, ৫-১৮ বছরের শিশু কোন ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে পারবে না। ৫-১৪ বছর পর্যন্ত শিশুশ্রম নিয়োগকর্তার জন্য দণ্ডনীয় অপরাধ। কিন্তু এ আইন শুধু কাগজে-কলমেই।
তাদের কাজের বৈশিষ্ট্য জীবন ও স্বাস্থ্যের জন্য বেশ হুমকিস্বরূপ। দেশে শিশুশ্রমের প্রায় ৯৫ শতাংশ অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মরত। এর মধ্যে শুধু শহরাঞ্চলেই কর্মরত রয়েছে ৫ লাখ ৮ হাজার ২৯৮ শিশু। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম (বিএসএএফ), বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
জানা গেছে, বিশ্বের প্রতি ১০ জন শিশুর একজন শিশু শ্রমিক। আর তাদের অর্ধেকই ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত। তবে নব্বই দশকের পর শিশু শ্রমিকদের সংখ্যা ১০ কোটি কমে গেছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) প্রকাশিত এক পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, বিশ্বে ১৫ কোটি ২০ লাখ শিশু শ্রমিক রয়েছে? তাদের আড়াই কোটি শিশুকেই জোর করে কাজা বাধ্য করা হচ্ছে।
২০০৬ সালে বাংলাদেশ শ্রম আইনে নির্দিষ্ট করে বলা হয়েছে, ১৪ বছরের নিচে কোনো শিশুকে কাজে নেয়া যাবে না। ১৪ থেকে ১৮ বছর পর্যন্ত কাজে নেয়া যাবে, তবে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নেয়া যাবে না। আর শিশুদের জন্য ৩৮ ধরনের ঝঁকিপূর্ণ কাজে নেয়া নিষিদ্ধ করা হয়।
সংশ্লিষ্টরা বলেন, এখনো পুরো বিশ্বের মোট শিশু শ্রমিকের ৫ শতাংশই বাংলাদেশে। সমাজ থেকে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম প্রত্যাহার ও নিরসনে সর্বস্তরের জনগণের মূল্যবোধের পরিবর্তন করতে হবে। এ ছাড়া একমাত্র সচেতনতাই শিশুশ্রম নিরসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। সে কারণে পরিবার থেকে শুরু করে সবাইকে সচেতন হতে হবে।
বিবিএসের ২০০৩ সালের জাতীয় শিশুশ্রম সমীক্ষায় দেখা গেছে, তখন প্রায় ৭৪ লাখ কর্মরত শিশু ছিল। এদের মধ্যে ৩১ লাখ ৭৯ হাজার শিশুর কাজ শিশুশ্রমের আওতায় ছিল। তবে এক দশকের ব্যবধানে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত শিশুদের সংখ্যা তেমন কমেনি, কমেছে মাত্র ১১ হাজার। ২০০৩ সালে দেশে ১২ লাখ ৯১ হাজার শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজে ছিল। বর্তমানে সাড়ে ৩৪ লাখ শিশু কর্মরত। সে হিসাবে প্রায় এক দশকের ব্যবধানে কর্মরত শিশুর সংখ্যার পাশাপাশি শিশুশ্রম অর্ধেকে নেমে এসেছে।
বিএসএএফ প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে ৫ থেকে ১৭ বছরের শিশু শ্রমিক রয়েছে ৩৪ লাখ ৫০ হাজার। এদের মধ্যে ৫ থেকে ১১ বছরের শিশু শ্রমিক রয়েছে ১৭ লাখ; যাদের কাজ করার কোনো অনুমতি না থাকলেও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করছে তারা। এসব শিশুর মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে নিয়োজিত রয়েছে ১২ লাখ ৮০ হাজার শিশু, যা উদ্বেগজনক।
শিশুদের অধিকার নিয়ে কাজ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ নাজমুজ্জামান ভূঁইয়া বলেন, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে যে ১৭টি লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে; এদের মধ্যে শিশুশ্রম রয়েছে ৮ নম্বরে। এই শিশুশ্রম নিরসনে ২০১২-১৫ সাল পর্যন্ত সময় নির্ধারণ করা হলেও তা বাস্তবায়ন না হওয়ায় আরো এক বছর বাড়ানো হয়। তবুও সম্ভব হয়নি শিশুশ্রম নিরসন করা।
সারা দেশে শিশু নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরে বিএসএএফ-এর পরিসংখ্যানে উল্লেখ করা হয়, বিভিন্ন বাসা-বাড়ি বা প্রতিষ্ঠানে চুরি করার অপবাদে ২০১৬ সালে দরিদ্র শ্রমজীবী ১০৬টি শিশুকে নির্মমভাবে পিটিয়ে নির্যাতন করা হয়েছে। এ ছাড়া ২০১৫ সালে এসব নির্যাতনের শিকার হয়েছে আরো ৯০ শিশু। ২০১৩-২০১৭ এর মে পর্যন্ত ৬৫ জন শিশু গৃহকর্মীকে শারীরিক নির্যাতন করা হয়েছে। একই সময় ২১ জন শিশু গৃহকর্মীকে ধর্ষণ ও ২১ জনকে হত্যা করা হয়েছে। ৩০ জন শিশু গৃহকর্মী আত্মহত্যা করে। এর বাইরেও অনেক শিশু বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছে।
বিএএসএফ’র চেয়ারপারসন মো. এমরানুল হক চৌধুরী বলেন, ২০২১ সালের মধ্যে শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ কাজের বাইরে নিতে হবে। ২০২৫ সালে দেশে শিশু শ্রমিক থাকবে না। কিন্তু সেটা বাস্তবায়নে যথেষ্ট উদ্যোগ নেই। ফলে লক্ষ্য অর্জন নিয়ে সন্দিহান রয়েছে।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) প্রতিবেদনে দেখা যায়, একটি শিশু দৈনিক গড়ে ৮ ঘণ্টা শ্রমের বিনিময়ে মাত্র ১০০ টাকা উপার্জন করে। তারা মাসে গড়ে সর্বোচ্চ ১০,৫০০ টাকা এবং সর্বনিম্ন ২৬০ টাকা উপার্জন করে। বেশির ভাগ শিশু (৭২%) তাদের রোজগারের এই অর্থ পরিবারের প্রয়োজনে ব্যয় করে।
শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় কর্তৃক ‘বাংলাদেশে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত শিশুশ্রম নিরসন’ (৩য় পর্যায়) শীর্ষক প্রকল্প ২০১০ সালের নভেম্বর থেকে ২০১৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত সমীক্ষা করা হয়। এতে বলা হয়, বাংলাদেশে ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সের শিশুর সংখ্যা ৩ কোটি ৯৬ লাখ, এদের মধ্যে ১৭ লাখ শিশু কোনো না কোনো ভাবে শ্রমে নিযুক্ত, যার ১২ লাখ ১০ হাজার শিশু জড়িত ঝুঁকিপূর্ণ কাজে যেমন, ওয়েল্ডিং ও মোটর ওয়ার্কশপ, যানবাহনের হেলপার, প্লাস্টিক ও রাসায়নিক কারখানা, বিড়ি কারখানা, নির্মাণ কাজ-ইট ভাটা, পাথর ভাঙ্গা, অটোমোবাইল স্টেশন, বর্জ্য অপসারণ, চামড়ার কারখানা, বিস্কিট কারখানা, হোটেল-রেস্টুরেন্টের কাজে নিয়োজিত।
সমীক্ষায় দেখা যায়, শ্রমজীবী শিশুদের গড় মাসিক পারিবারিক আয় ৮,৬০৭ টাকা। শ্রমজীবী শিশুরা গড়ে ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত পাস। শ্রমজীবী শিশুর ৮০% (ছেলে ৮১%, মেয়ে ৭৭%) বর্তমানে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত।
তথ্যে দেখা গেছে, ৬৯% অভিভাবক অবহিত আছেন যে, ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত শিশুদের দুর্ঘটনা বা শারীরিক ক্ষতির সম্ভাবনা আছে, তা সত্ত্বেও তারা বাধ্য হন শিশুদেরকে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত করতে। শতকরা ৬০% শিশু দিনে এবং ৪০% দিন ও রাত উভয় সময়ই তাদের শ্রমে নিয়োজিত থাকে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, দরিদ্রতা শিশুশ্রম নিরসনে বাধা। এ ছাড়া শিশুদের স্বল্পবেতন ও সহজ শর্তে কাজে নিয়োগদান, ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশুদের নিয়োগকারী মালিকপক্ষের সচেতনতা ও দায়বদ্ধতার অভাব, শিশু বান্ধব কাজের অভাব ইত্যাদি বিষয় ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম নিরসনে প্রতিবন্ধক। তবে দেশে সচেতনতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রতিবেদনে দেখা যায়, শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে সচেতনতা বৃদ্ধির ফলে শিশুশ্রম নিরোধ ও নিরসনে সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে শ্রমজীবী শিশুদের ঝুঁকি হ্রাস পেয়েছে।
বিবিএসের জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশে ১৮টি খাতে ১৬ লাখ ৯৮ হাজার ৮৯৪ জন শিশু ‘শিশুশ্রমে’ নিয়োজিত রয়েছে। তাদের মধ্যে ৭ লাখ ৪৫ হাজার ৬৯০ জন মেয়ে শিশু। শিশুশ্রমে নিয়োজিতদের ৫৭ শতাংশের কাজই অস্থায়ী। বর্তমানে শিশুশ্রমে নিয়োজিত আছে এমন ১০ লাখ ৭০ হাজার শিশু এক সময় স্কুলে গেলেও এখন আর যায় না। আর ১ লাখ ৪২ হাজার শিশু কখনই স্কুলে যায়নি।
শিশু শ্রমিকদের মজুরিও বেশ কম। প্রায় ৭ লাখ শিশু কোনো মজুরি পায় না। মজুরি পায় সব মিলিয়ে ১০ লাখ ১৯ হাজার শিশু। ৩ লাখ ৮৮,১৪২ শিশু মাসে ৫-৭ হাজার টাকা মজুরি পায়। আর প্রায় এক লাখ শিশু আড়াই হাজার টাকার কম পায়। সাড়ে সাত হাজার টাকার বেশি মাসে মজুরি পায় আড়াই লাখ শিশু। অন্যদিকে সপ্তাহে দৈনিক গড়ে ৫ ঘণ্টার বেশি কাজ করে বা ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত শিশুদের (১২ লাখ ৮০ হাজার শিশু) মজুরিও বেশ কম।
জাতীয় শিশুনীতি ২০১১ অনুসারে, ৫-১৮ বছরের শিশু কোন ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে পারবে না। ৫-১৪ বছর পর্যন্ত শিশুশ্রম নিয়োগকর্তার জন্য দণ্ডনীয় অপরাধ। কিন্তু এ আইন শুধু কাগজে-কলমেই।
No comments