নূর হোসেনের ভুল বানান by ইফতেখার মাহমুদ
দিনের প্রতিবেদন লেখার কাজ শেষ করে
সন্ধ্যায় কী মনে করে কবি শামসুর রাহমান ও প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর
রহমানের লেখা শহীদ নূর হোসেন বইটি নাড়াচাড়া করছিলাম। বইয়ের ফাঁক গলে
কম্পিউটারে খোলা প্রথম আলো অনলাইনে চোখ গেল। দেখি, সদ্য সংবাদে ‘এরশাদের
আমলে কোনো খুন-গুম হয়নি’ লেখা। গত ১০ মে রাজধানীর কাকরাইলের ডিপ্লোমা
ইঞ্জিনিয়ার্স মিলনায়তনে জাতীয় পার্টির সহযোগী সংগঠন জাতীয় যুব সংহতির
এক সভায় এই সাবেক স্বৈরশাসক বলেছেন, ‘আমার আমলে একটাও গুম-খুন হয়নি।’
কাকরাইলের যে ভবনটিতে বসে এরশাদের এই ‘অমর বাণীটি’ রচিত হলো তার এক কিলোমিটারে নূর হোসেন চত্বরটি। ওই শনিবার সকালেই সংবাদ সংগ্রহের কাজে গুলিস্তান যাওয়া হয়েছিল। দুপুরে খাঁ খাঁ রোদে লাল ইটের নূর হোসেন চত্বরটির সামনে যেতেই এর লালচে ইটের গায়ে কতগুলো ছেঁড়া পোস্টার সাঁটানো দেখা গেল। নব্বইয়ের আগে জিরো পয়েন্ট নামে পরিচিত ছিল স্থানটি। নব্বইয়ের ৬ ডিসেম্বর স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের পতনের পর বলা হলো আমাদের গণতন্ত্র আবারও শূন্য থেকে যাত্রা শুরু করল। জিরো পয়েন্টের নাম বদলে বাংলাদেশি গণতন্ত্রের আবারও শূন্য থেকে যাত্রার প্রতীক নূর হোসেনের নামে রাখা হলো ‘নূর হোসেন চত্বর’।
নূর হোসেন চত্বরের সামনে দাঁড়িয়ে এক হকার পত্রিকা বিক্রি করছিলেন। পত্রিকাগুলোর প্রথম পাতায় অন্য এক নূর হোসেনের ছবিসহ প্রতিবেদন। নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের হোতা আওয়ামী লীগ নেতা নূর হোসেনকে নিয়ে লেখা ওই প্রতিবেদনগুলোর দিকে তাকিয়ে আমার বেদনার্ত মনে সেই গণতন্ত্রের শহীদ নূর হোসেনের ছবিটি ভেসে ওঠে। পুরান ঢাকার নবাবপুরের মহাজনপুর লেনে বেড়ে ওঠার সুবাদে পাশের মহল্লা বনগ্রামের যুবক নূর হোসেনকে কিছুটা চেনার সুযোগ হয়েছিল। ওয়ারীতে যে কিন্ডারগার্টেন স্কুলে পড়তাম সেখানকার আমার এক প্রিয় শিক্ষিকাকে নূর হোসেন পছন্দ করতেন বলে স্কুলের ইঁচড়ে পাকা শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রচার ছিল। স্কুলের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা নূর হোসেনকে দেখে ওই ছাত্ররা কানাঘুষা করত। তবে বনগ্রাম ও নবাবপুরের সবাই নূর হোসেনকে এরশাদ সরকারের পতনের আন্দোলনের মিছিলের নিয়মিত মুখ হিসেবেই চিনত। পাড়ার ছেলেদের এরশাদশাহির পতনের আন্দোলনে আনতে বাড়ি বাড়ি প্রচার চালাতেও নূর হোসেনকে দেখা যেত।
নূর হোসেনের মৃত্যুর পর পুরান ঢাকার নবাবপুর, ওয়ারী, মালিটোলা, সিদ্দিকবাজার থেকে মিছিলে যাওয়া যুবকের সংখ্যা বেড়ে গিয়েছিল। বাংলাদেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের লড়াইয়ের অসমাপ্ত বেদনার কাব্য ২৪ বছরের ওই তরুণের মৃত্যু যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য হয়েছিল, তা ওই ছোট্ট বয়সে বুঝে উঠতে পারিনি। শামসুর রাহমান ও মতিউর রহমানের লেখা নিয়ে শহীদ নূর হোসেন বইটি(প্রথমা প্রকাশন, ২০১৩) পড়তে পড়তে ১৯৮৭ সালের সেই দিনটিতে যেন ফিরে যাচ্ছিলাম।
বইটির ভূমিকায় মতিউর রহমান লিখেছেন, ‘নূর হোসেনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে তঁার বুকে–পিঠের স্লোগানে বানান ভুল থাকা সত্ত্বেও তা অবিকৃত রাখা হলো।’ হ্যঁা, নূর হোসেনের বুকে ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ লেখায় গণতন্ত্র বানানটিতে ভুল ছিল। মূর্ধন্য-ণ-এর স্থলে লেখা হয়েছিল দন্ত্য–ন। ভুলটা অবশ্য পুরান ঢাকার বনগ্রামের ছেলে নূর হোসেনের ছিল না। বুকে-পিঠে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার ওই ‘এপিটাফটি’ লেখার দায়িত্ব নিয়েছিলেন পুরান ঢাকার টিকাটুলীর আর্ট হ্যাভেন দোকানের এক চিত্রশিল্পী।
কিন্তু আর্ট হ্যাভেনের ওই শিল্পী সে সময়ে এরশাদবিরোধী আন্দোলনের অনেক পোস্টার-ব্যানার লিখতেন। তিনি িক সত্যি সত্যি ভুলবশত গণতন্ত্র বানানটিই ভুল করে লিখেছিলেন? সেই প্রশ্নের উত্তর নূর হোসেন বেঁচে থাকলে হয়তো দিতে পারতেন। নব্বইয়ের পর যাঁরা আমাদের ভাঙা গণতন্ত্রের হাল ধরেছিলেন, তাঁদের কাছেও উত্তর খোঁজা যেতে পারে।
শহীদ নূর হোসেন বইটিতে ভূমিকার পরেই শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী একটি ছোট্ট লেখা লিখেছেন। তাতে এই চিত্রশিল্পী লিখেছেন ‘ফরাসি বিপ্লবের ওপরে আঁকা ইউজিন দেলাক্রোয়ারের ছবি “জনগণের নেতৃত্বে স্বাধীনতা”তে স্বাধীনতার প্রতীক হিসেবে নারী জাতির একজনকে বেছে নিয়েছিলেন।’ নূর হোসেনের প্রতি অন্তরের গভীর শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য দেলাক্রোয়ার মতো অমর তুলিকা হস্তে কেউ িক এগিয়ে আসবেন?
শহীদ নূর হোসেন বইটির ভূমিকায় মতিউর রহমানের লেখনীতেও একই আকুতি ঝরে পড়ে। তিনি লিখেছেন, ‘নতুন করে প্রকাশিত শহীদ নূর হোসেন গ্রন্থটি যদি এই সময়ের তরুণ প্রজন্মকে কিছুটা হলেও উদ্বুদ্ধ করে, তাহলে সার্থক মনে হবে আমাদের প্রচেষ্টা। আর যদি কোনো তরুণ লেখক বা নাট্যকার নূর হোসেনকে নিয়ে কিছু ভাবেন, তাহলে কৃতজ্ঞ হব। আমরা পাশে থাকব।’
নব্বইয়ের ফেব্রুয়ারিতে শহীদ নূর হোসেন বইটির প্রথম প্রকাশ হয়েছিল। ২০১৩-এর ১০ নভেম্বর হলো দ্বিতীয় মুদ্রণ। এ দুই যুগে আমাদের রাজনীতিবিদেরা গণতন্ত্রের অনেক চেহারাই দেখিয়েছেন। শহীদ নূর হোসেনের মিছিলের সঙ্গী-সাথিরা রাষ্ট্রটিকে নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের হোতা নূর হোসেনদের হাতে তুলে দিতেও কুণ্ঠাবোধ করেননি। এসব কথা অবশ্য একদিন রাজনৈতিক ইতিহাসের বিষয় হবে। নূর হোসেনের খুনি এরশাদ ও তঁার সরকারের লোকেরা কীভাবে নূর হোসেনের বন্ধুদের মিত্র হলেন, সেই রহস্য নিয়ে একদিন হয়তো গবেষণাও হবে।
নূর হোসেনের লাশ ভয়ে গুম করেছিল এরশাদের সরকারি গুন্ডা বাহিনী। সেই লাশ আর তোলা হয়নি। নূর হোসেনের লাশের মতোই আমাদের গণতন্ত্রও যে গুম হয়ে যাচ্ছে। গণতন্ত্র ছাপিয়ে সবকিছুর ঊর্ধ্বে উঠে যাবে দলতন্ত্র। সেই অলীক গণতন্ত্রের মুকুটের পালক হয়ে আছেন এরশাদ। হয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত। এসব কথা হয়তো কল্পনাও করতে পারেননি নূর হোসেন ও তাঁর বাবা বৃদ্ধ মজিবুর রহমান। নূর হোসেন হয়তো ভাবতেই পারেননি তাঁর রেখে যাওয়া বাংলাদেশে এখনো গণতন্ত্রের বানান ভুলই থেকে যাবে। সংসদ সবাক হয়ে উঠবে না। মেরুদণ্ড সোজা করে নির্বাচন কমিশন দাঁড়াতে পারবে না। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) পক্ষপাতহীনভাবে কাজ করবে না। প্রশাসনযন্ত্র দলনিরপেক্ষ হবে না। আর জনগণের কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠা বিরোধী দল গড়ে উঠবে না।
হয়তো এসব কিছু ভেবেই নূর হোসেনের বুকে লেখা গণতন্ত্রের বানানটি ভুলভাবেই লেখা হয়েছিল। গণতন্ত্রকে সঠিক বানানে আনার দায়িত্ব যাঁদের ছিল, তাঁরা সেই ‘ভুলের’ ওপরেই বাংলাদেশের গণতন্ত্রের আজকের চেহারা রচনা করছেন। যেখানে গণতন্ত্র নিজেই গুম হয়ে যাচ্ছে। আর সেই ‘গণতন্ত্রের সৈনিক’ এরশাদ সগর্বে দাঁড়িয়ে বলবেন, ‘আমার আমলে একটাও গুম-খুন হয়নি।’
গণতন্ত্র, নূর হোসেন আর এরশাদকে নিয়ে এসব কথা ভাবতে ভাবতেই শহীদ নূর হোসেন বইটিতে প্রকাশিত শামসুর রাহমানের ‘একজন শহীদের মা বলছেন’ কবিতাটির কথা মনে ভাসল। নূর হোসেনের মৃত্যুর ৩৬ দিন পর সাপ্তাহিক দেশবন্ধুতে প্রকাশিত ওই কবিতায় কবি গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ টের পেয়ে কি না, কে জানে লিখে রেখে গেছেন।
‘হয়তো ভবিষ্যতে অনেকেই/ তার কথা বলে দিব্যি মাতাবে শ্রোতার ভিড় আর/ করবে এমন কেউ কেউ উচ্চারণ/ ওর নাম, হোমরা-চোমরা তারা, যারা/ তার কথা বলছে শুনলে সে আবার অকস্মাৎ/ জিন্দা হয়ে পতাকার মতো হাত তুলে/জনসভা পণ্ড করে জানাবে তুমুল প্রতিবাদ,/ ওদের মুখোশ-আটা ভণ্ড মুখে দেবে ছুড়ে থুথু, শুধু থুথু৷’
মুখোশ-আঁটা ভণ্ডদের মুখে থুতু দিয়ে এই সময়ের নূর হোসেনরা যেদিন জেগে উঠবে, সেই দিনই হয়তো শামসুর রাহমান, কাইয়ুম চৌধুরী আর মতিউর রহমানের স্বপ্ন পূরণ হবে। কোনো এক দেলাক্রোয়ার তুলির আঁচড়ে আমাদের মৃতপ্রায় গণতন্ত্র প্রাণ পাবে। তখনই হয়তো কোনো এক নুরলদিন উচ্চকণ্ঠে বলে উঠবেন, ‘জাগো বাহে কোনঠে সবাই।’
ইফতেখার মাহমুদ: সাংবাদিক।
বই: শহীদ নূর হোসেন৷ লেখক: শামসুর রাহমান, মতিউর রহমান৷ প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন ২০১৩৷ মূল্য: ১৩০ টাকা৷
কাকরাইলের যে ভবনটিতে বসে এরশাদের এই ‘অমর বাণীটি’ রচিত হলো তার এক কিলোমিটারে নূর হোসেন চত্বরটি। ওই শনিবার সকালেই সংবাদ সংগ্রহের কাজে গুলিস্তান যাওয়া হয়েছিল। দুপুরে খাঁ খাঁ রোদে লাল ইটের নূর হোসেন চত্বরটির সামনে যেতেই এর লালচে ইটের গায়ে কতগুলো ছেঁড়া পোস্টার সাঁটানো দেখা গেল। নব্বইয়ের আগে জিরো পয়েন্ট নামে পরিচিত ছিল স্থানটি। নব্বইয়ের ৬ ডিসেম্বর স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের পতনের পর বলা হলো আমাদের গণতন্ত্র আবারও শূন্য থেকে যাত্রা শুরু করল। জিরো পয়েন্টের নাম বদলে বাংলাদেশি গণতন্ত্রের আবারও শূন্য থেকে যাত্রার প্রতীক নূর হোসেনের নামে রাখা হলো ‘নূর হোসেন চত্বর’।
নূর হোসেন চত্বরের সামনে দাঁড়িয়ে এক হকার পত্রিকা বিক্রি করছিলেন। পত্রিকাগুলোর প্রথম পাতায় অন্য এক নূর হোসেনের ছবিসহ প্রতিবেদন। নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের হোতা আওয়ামী লীগ নেতা নূর হোসেনকে নিয়ে লেখা ওই প্রতিবেদনগুলোর দিকে তাকিয়ে আমার বেদনার্ত মনে সেই গণতন্ত্রের শহীদ নূর হোসেনের ছবিটি ভেসে ওঠে। পুরান ঢাকার নবাবপুরের মহাজনপুর লেনে বেড়ে ওঠার সুবাদে পাশের মহল্লা বনগ্রামের যুবক নূর হোসেনকে কিছুটা চেনার সুযোগ হয়েছিল। ওয়ারীতে যে কিন্ডারগার্টেন স্কুলে পড়তাম সেখানকার আমার এক প্রিয় শিক্ষিকাকে নূর হোসেন পছন্দ করতেন বলে স্কুলের ইঁচড়ে পাকা শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রচার ছিল। স্কুলের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা নূর হোসেনকে দেখে ওই ছাত্ররা কানাঘুষা করত। তবে বনগ্রাম ও নবাবপুরের সবাই নূর হোসেনকে এরশাদ সরকারের পতনের আন্দোলনের মিছিলের নিয়মিত মুখ হিসেবেই চিনত। পাড়ার ছেলেদের এরশাদশাহির পতনের আন্দোলনে আনতে বাড়ি বাড়ি প্রচার চালাতেও নূর হোসেনকে দেখা যেত।
নূর হোসেনের মৃত্যুর পর পুরান ঢাকার নবাবপুর, ওয়ারী, মালিটোলা, সিদ্দিকবাজার থেকে মিছিলে যাওয়া যুবকের সংখ্যা বেড়ে গিয়েছিল। বাংলাদেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের লড়াইয়ের অসমাপ্ত বেদনার কাব্য ২৪ বছরের ওই তরুণের মৃত্যু যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য হয়েছিল, তা ওই ছোট্ট বয়সে বুঝে উঠতে পারিনি। শামসুর রাহমান ও মতিউর রহমানের লেখা নিয়ে শহীদ নূর হোসেন বইটি(প্রথমা প্রকাশন, ২০১৩) পড়তে পড়তে ১৯৮৭ সালের সেই দিনটিতে যেন ফিরে যাচ্ছিলাম।
বইটির ভূমিকায় মতিউর রহমান লিখেছেন, ‘নূর হোসেনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে তঁার বুকে–পিঠের স্লোগানে বানান ভুল থাকা সত্ত্বেও তা অবিকৃত রাখা হলো।’ হ্যঁা, নূর হোসেনের বুকে ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ লেখায় গণতন্ত্র বানানটিতে ভুল ছিল। মূর্ধন্য-ণ-এর স্থলে লেখা হয়েছিল দন্ত্য–ন। ভুলটা অবশ্য পুরান ঢাকার বনগ্রামের ছেলে নূর হোসেনের ছিল না। বুকে-পিঠে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার ওই ‘এপিটাফটি’ লেখার দায়িত্ব নিয়েছিলেন পুরান ঢাকার টিকাটুলীর আর্ট হ্যাভেন দোকানের এক চিত্রশিল্পী।
কিন্তু আর্ট হ্যাভেনের ওই শিল্পী সে সময়ে এরশাদবিরোধী আন্দোলনের অনেক পোস্টার-ব্যানার লিখতেন। তিনি িক সত্যি সত্যি ভুলবশত গণতন্ত্র বানানটিই ভুল করে লিখেছিলেন? সেই প্রশ্নের উত্তর নূর হোসেন বেঁচে থাকলে হয়তো দিতে পারতেন। নব্বইয়ের পর যাঁরা আমাদের ভাঙা গণতন্ত্রের হাল ধরেছিলেন, তাঁদের কাছেও উত্তর খোঁজা যেতে পারে।
শহীদ নূর হোসেন বইটিতে ভূমিকার পরেই শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী একটি ছোট্ট লেখা লিখেছেন। তাতে এই চিত্রশিল্পী লিখেছেন ‘ফরাসি বিপ্লবের ওপরে আঁকা ইউজিন দেলাক্রোয়ারের ছবি “জনগণের নেতৃত্বে স্বাধীনতা”তে স্বাধীনতার প্রতীক হিসেবে নারী জাতির একজনকে বেছে নিয়েছিলেন।’ নূর হোসেনের প্রতি অন্তরের গভীর শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য দেলাক্রোয়ার মতো অমর তুলিকা হস্তে কেউ িক এগিয়ে আসবেন?
শহীদ নূর হোসেন বইটির ভূমিকায় মতিউর রহমানের লেখনীতেও একই আকুতি ঝরে পড়ে। তিনি লিখেছেন, ‘নতুন করে প্রকাশিত শহীদ নূর হোসেন গ্রন্থটি যদি এই সময়ের তরুণ প্রজন্মকে কিছুটা হলেও উদ্বুদ্ধ করে, তাহলে সার্থক মনে হবে আমাদের প্রচেষ্টা। আর যদি কোনো তরুণ লেখক বা নাট্যকার নূর হোসেনকে নিয়ে কিছু ভাবেন, তাহলে কৃতজ্ঞ হব। আমরা পাশে থাকব।’
নব্বইয়ের ফেব্রুয়ারিতে শহীদ নূর হোসেন বইটির প্রথম প্রকাশ হয়েছিল। ২০১৩-এর ১০ নভেম্বর হলো দ্বিতীয় মুদ্রণ। এ দুই যুগে আমাদের রাজনীতিবিদেরা গণতন্ত্রের অনেক চেহারাই দেখিয়েছেন। শহীদ নূর হোসেনের মিছিলের সঙ্গী-সাথিরা রাষ্ট্রটিকে নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের হোতা নূর হোসেনদের হাতে তুলে দিতেও কুণ্ঠাবোধ করেননি। এসব কথা অবশ্য একদিন রাজনৈতিক ইতিহাসের বিষয় হবে। নূর হোসেনের খুনি এরশাদ ও তঁার সরকারের লোকেরা কীভাবে নূর হোসেনের বন্ধুদের মিত্র হলেন, সেই রহস্য নিয়ে একদিন হয়তো গবেষণাও হবে।
নূর হোসেনের লাশ ভয়ে গুম করেছিল এরশাদের সরকারি গুন্ডা বাহিনী। সেই লাশ আর তোলা হয়নি। নূর হোসেনের লাশের মতোই আমাদের গণতন্ত্রও যে গুম হয়ে যাচ্ছে। গণতন্ত্র ছাপিয়ে সবকিছুর ঊর্ধ্বে উঠে যাবে দলতন্ত্র। সেই অলীক গণতন্ত্রের মুকুটের পালক হয়ে আছেন এরশাদ। হয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত। এসব কথা হয়তো কল্পনাও করতে পারেননি নূর হোসেন ও তাঁর বাবা বৃদ্ধ মজিবুর রহমান। নূর হোসেন হয়তো ভাবতেই পারেননি তাঁর রেখে যাওয়া বাংলাদেশে এখনো গণতন্ত্রের বানান ভুলই থেকে যাবে। সংসদ সবাক হয়ে উঠবে না। মেরুদণ্ড সোজা করে নির্বাচন কমিশন দাঁড়াতে পারবে না। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) পক্ষপাতহীনভাবে কাজ করবে না। প্রশাসনযন্ত্র দলনিরপেক্ষ হবে না। আর জনগণের কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠা বিরোধী দল গড়ে উঠবে না।
হয়তো এসব কিছু ভেবেই নূর হোসেনের বুকে লেখা গণতন্ত্রের বানানটি ভুলভাবেই লেখা হয়েছিল। গণতন্ত্রকে সঠিক বানানে আনার দায়িত্ব যাঁদের ছিল, তাঁরা সেই ‘ভুলের’ ওপরেই বাংলাদেশের গণতন্ত্রের আজকের চেহারা রচনা করছেন। যেখানে গণতন্ত্র নিজেই গুম হয়ে যাচ্ছে। আর সেই ‘গণতন্ত্রের সৈনিক’ এরশাদ সগর্বে দাঁড়িয়ে বলবেন, ‘আমার আমলে একটাও গুম-খুন হয়নি।’
গণতন্ত্র, নূর হোসেন আর এরশাদকে নিয়ে এসব কথা ভাবতে ভাবতেই শহীদ নূর হোসেন বইটিতে প্রকাশিত শামসুর রাহমানের ‘একজন শহীদের মা বলছেন’ কবিতাটির কথা মনে ভাসল। নূর হোসেনের মৃত্যুর ৩৬ দিন পর সাপ্তাহিক দেশবন্ধুতে প্রকাশিত ওই কবিতায় কবি গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ টের পেয়ে কি না, কে জানে লিখে রেখে গেছেন।
‘হয়তো ভবিষ্যতে অনেকেই/ তার কথা বলে দিব্যি মাতাবে শ্রোতার ভিড় আর/ করবে এমন কেউ কেউ উচ্চারণ/ ওর নাম, হোমরা-চোমরা তারা, যারা/ তার কথা বলছে শুনলে সে আবার অকস্মাৎ/ জিন্দা হয়ে পতাকার মতো হাত তুলে/জনসভা পণ্ড করে জানাবে তুমুল প্রতিবাদ,/ ওদের মুখোশ-আটা ভণ্ড মুখে দেবে ছুড়ে থুথু, শুধু থুথু৷’
মুখোশ-আঁটা ভণ্ডদের মুখে থুতু দিয়ে এই সময়ের নূর হোসেনরা যেদিন জেগে উঠবে, সেই দিনই হয়তো শামসুর রাহমান, কাইয়ুম চৌধুরী আর মতিউর রহমানের স্বপ্ন পূরণ হবে। কোনো এক দেলাক্রোয়ার তুলির আঁচড়ে আমাদের মৃতপ্রায় গণতন্ত্র প্রাণ পাবে। তখনই হয়তো কোনো এক নুরলদিন উচ্চকণ্ঠে বলে উঠবেন, ‘জাগো বাহে কোনঠে সবাই।’
ইফতেখার মাহমুদ: সাংবাদিক।
বই: শহীদ নূর হোসেন৷ লেখক: শামসুর রাহমান, মতিউর রহমান৷ প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন ২০১৩৷ মূল্য: ১৩০ টাকা৷
No comments