ডিসি সাহেবের গোসসা এবং সিডিএর উন্নয়ন by বিশ্বজিৎ চৌধুরী
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ)
ওপর প্রচণ্ড খেপেছেন জেলা প্রশাসক মেজবাহ উদ্দিন। তাঁর আবাসস্থলকে ঘিরে যে
পাহাড় ও পার্ক, তাঁকে না জানিয়ে তার উন্নয়নের পরিকল্পনা নেওয়ার ঘটনাটি
ইগোতে (অহং) লেগেছে তাঁর। তিনি এর বিরুদ্ধে নোটিশ দিয়েছেন, এমনকি মামলা
করার হুমকিও দিয়েছেন। ডিসি হিল পার্কের উন্নয়ন ও সংস্কারের নির্দেশ
দিয়েছিলেন গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী মোশাররফ হোসেন। তিনি নিজে সরেজমিনে এই
পাহাড় ও পার্ক পরিদর্শন করে এর উন্নয়নের দায়িত্ব দিয়েছিলেন সিডিএকে।
সে অনুযায়ী সিডিএ এই পার্কের জন্য ছয় কোটি ৬৫ লাখ টাকার একটি উন্নয়ন
প্রকল্প প্রস্তাব পাঠায় মন্ত্রণালয়ে এবং স্থানীয় দৈনিকে দরপত্র
বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে।
জেলা প্রশাসকের হুমকিতে কাজ হয়েছে। সিডিএ দরপত্র বিজ্ঞপ্তি স্থগিত করেছে। খোদ মন্ত্রী মহোদয় এ ঘটনাকে ভুল-বোঝাবুঝি বলে অভিহিত করে জানিয়েছেন, ‘আমরা জেলা প্রশাসকের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে কাজ করব। আমাদের মূল পরিকল্পনা জানলে আশা করি তিনি অমত করবেন না।’ এ কথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই সিডিএর উন্নয়ন-উদ্যোগ এবং দরপত্র আহ্বানের মধ্যে পদ্ধতিগত ত্রুটি ছিল। তবে যে কথাটি মন্ত্রী, জেলা প্রশাসক বা সিডিএ আদৌ উল্লেখ করার প্রয়োজন আছে বলে মনে করছে না, তা হলো, চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী এই পাহাড় ও পার্কটি উন্নয়নের ব্যাপারে সবার আগে মতামত নেওয়া দরকার ছিল সাংস্কৃতিক কর্মী ও নাগরিক সমাজের।
ঐতিহ্যবাহী ডিসি হিল পার্ক বাংলা নববর্ষ বরণসহ নানা ধরনের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। ভোরে ও সন্ধ্যায় এখানে প্রাতর্ভ্রমণ করতে আসেন শত শত নারী-পুরুষ। শহরের কেন্দ্রস্থলে বহুমাত্রিক সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা ও মুক্তবায়ু সেবনের জন্য এমন বিস্তৃত মনোরম পাহাড়ি অঞ্চল আর নেই। সুতরাং এর উন্নয়ন পরিকল্পনার ক্ষেত্রে নাগরিক সমাজ ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর সঙ্গে পরামর্শ করার বিকল্প নেই। নগর পরিকল্পনাবিদ, স্থপতি, প্রকৌশলীসহ সমাজের নানা শ্রেণি-পেশার মানুষকে নিয়ে গড়ে ওঠা ‘পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরাম’-এর (এফপিসি) মতো সংগঠনকেও এই পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত করা যেত। কিন্তু এসব কিছুই না করে সিডিএ নিজেরাই এমন একটি প্রকল্প তৈরি করেছে, যার মধ্যে রয়েছে ফুডকোট, পর্যবেক্ষণ টাওয়ার নির্মাণসহ অপ্রয়োজনীয় এবং বাণিজ্যমুখী কিছু পরিকল্পনা।
অন্যদিকে, জেলা প্রশাসক পাহাড়ের চূড়ায় তাঁর বাসভবনের সীমানা সংরক্ষণ নিয়ে সোচ্চার। তিনি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মতো ‘কোলাহল’ নিয়ে বিরক্ত এবং প্রাতর্ভ্রমণকারীদের অবাধ চলাফেরার ফলে তাঁর ‘প্রাইভেসি’ ক্ষুণ্ন² হওয়ায় রীতিমতো ক্ষুব্ধ। এর আগেও ডিসি হিলে ভ্রমণকারীদের যাতায়াত নিয়ন্ত্রণের জন্য দেয়াল তুলে, গেট স্থাপন করে নানা রকম প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছেন তিনি। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত সাউন্ড সিস্টেমের আওয়াজে তাঁর ঘুমের ব্যাঘাত হয়, সন্ধ্যার পর এখানে অসামাজিক কার্যকলাপ হয় ইত্যাদি নানা অভিযোগও তুলেছেন জেলা প্রশাসক। এ যেন অনেকটা মাথাব্যথার জন্য মাথা কেটে ফেলার ব্যবস্থা। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের সময়সীমা নির্ধারণ বা শব্দযন্ত্র ব্যবহার নিয়ে নিয়মনীতি অনুসরণ করা যেতে পারে, অসামাজিক কার্যকলাপ বন্ধের জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তদারকির ব্যবস্থাও করতে পারে প্রশাসন। কিন্তু এসব অসুবিধার জন্য ডিসি হিল পার্ককে ঘিরে গড়ে ওঠা মুক্ত সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিবেশকে রুদ্ধ করা কেন?
আগেই বলেছি, জেলা প্রশাসকের সঙ্গে বিরোধের কারণে স্থগিত করতে হয়েছে সিডিএর প্রায় সাড়ে ছয় কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প। এই সাফল্যে উজ্জীবিত হয়ে বা সিডিএকে একহাত দেখিয়ে দেওয়ার মানসিকতা থেকে কি না জানি না, জেলা প্রশাসক ও বিভাগীয় কমিশনারের বাসভবনকে ঘিরে তিন কোটি টাকার অন্য একটি উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করেছে জেলা প্রশাসন। প্রস্তাবিত প্রকল্পে জেলা প্রশাসক ও বিভাগীয় কমিশনারের বাসভবনে ওঠানামার রাস্তার পাশে এসএস রেলিংসহ সাইড ওয়াল নির্মাণ, জেলা প্রশাসকের বাসভবনের পেছনে গোলঘর ও ওয়াকওয়ে এবং বিভাগীয় কমিশনারের বাসভবনের সামনে একটি ফোয়ারা নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়েছে। অর্থাৎ ডিসি হিল পার্কের উন্নয়নের জন্য যে দীর্ঘদিনের দাবি চট্টগ্রামবাসীর, তাকে রূপান্তর করা হলো জেলা প্রশাসক ও বিভাগীয় কমিশনারের বাসভবনের সৌন্দর্যবৃদ্ধির প্রকল্পে। এরই নাম হয়তো আমলাতন্ত্র!
এসব উদ্যোগ-আয়োজন দেখে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘জুতা আবিষ্কার’ কবিতাটির কথা মনে পড়ে যায়। রাজার পায়ে ধুলাবালু লাগে, তাই রাজ্যের পথঘাট ঢেকে দেওয়ার ব্যবস্থা করার পরামর্শ দিয়েছিলেন তাঁর মন্ত্রীরা। কিন্তু রাজার পা মুড়ে দিলেই সমস্যাটির সমাধান হয়ে যায়, এই সাধারণ বুদ্ধিটা আসেনি তাঁদের মাথায়। জেলা প্রশাসক পত্রিকান্তরে বলেছেন, পার্ক করার মতো অনেক স্থান আছে, প্রয়োজনে তিনি সে রকম একটি স্থান নির্বাচন করবেন এবং বরাদ্দ দেবেন। কিন্তু এই সমাধানটি তাঁর মাথায় এল না যে নগরের বিভিন্ন স্থানে সরকারি যে ভবনগুলো আছে, সেখানে উপসচিব পর্যায়ের একজন সরকারি কর্মকর্তার বাসভবন স্থানান্তর কত সহজ ও বাস্তবসম্মত।
জেলা প্রশাসন ও সিডিএর উদ্যোগের বিরোধিতা করে মানববন্ধন হয়েছে। প্রতিবাদ সভার আয়োজন করেছেন সাংস্কৃতিক কর্মীসহ চট্টগ্রামের নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ। ডিসি হিলকে ঘিরে একটি পূর্ণাঙ্গ সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স নির্মাণের দাবি তুলেছেন তাঁরা। জেলা প্রশাসক ও বিভাগীয় কমিশনারের বাসভবন অন্যত্র স্থানান্তর করার দাবিও উঠেছে। এসব দাবি উপেক্ষা করে জেলা প্রশাসক তাঁর অহং প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্তে অবিচল থাকলে তার ফল ভালো হবে বলে মনে হয় না।
ডিসি হিল পার্ক নিয়ে সিডিএর উন্নয়ন পরিকল্পনার সাম্প্রতিক ব্যর্থতার সূত্রে এই সংস্থাটির কিছু কার্যক্রম সম্পর্কে বলতে চাই। এ কথা সত্য, সাম্প্রতিক সময়ে সিডিএ নামের সংস্থাটি যত সক্রিয় তার নজির বিরল। এবং এ কথাও সত্য, এ সংস্থার শীর্ষ ব্যক্তি আবদুচ ছালামের বিরুদ্ধে মোটাদাগে কোনো অসততা বা দুর্নীতির অভিযোগও ওঠেনি। তাঁর সদিচ্ছা নিয়েও প্রশ্ন নেই, প্রশ্ন দূরদর্শিতা নিয়ে, উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর কার্যকারিতা নিয়ে।
চট্টগ্রাম শহরে সিডিএর তত্ত্বাবধানে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড রীতিমতো দৃশ্যমান। কিন্তু এসব উন্নয়ন আদৌ কতটা সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার ফল, তা নিয়ে সংশয় তৈরি করার জন্য ১৪৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত উড়ালসড়কটিই তো যথেষ্ট। এই উড়ালসড়ক দিয়ে চলাচল করা সীমিতসংখ্যক যানবাহনের দিকে তাকিয়ে আজ স্বীকার করতেই হবে, এফপিসি বা বিশেষজ্ঞরা যে আপত্তি তুলেছিলেন, তা কতটা যুক্তিসংগত। অথচ এই উদাহরণ সামনে রেখেও আরও কয়েকটি ফ্লাইওভার নির্মাণের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে সিডিএ। ৪৬২ কোটি টাকা ব্যয়ে মুরাদপুর থেকে লালখান বাজার পর্যন্ত ৫ দশমিক ২ কিলোমিটার একটি উড়ালসড়কের দরপত্র চূড়ান্ত হয়েছে। অবিলম্বে এর কাজ শুরু হবে। বিমানবন্দর থেকে শাহ আমানত সেতু পর্যন্ত একটি উড়ালসড়ক নির্মাণও পরিকল্পনাধীন।
সম্প্রতি এফপিসির এক সংবাদ সম্মেলনে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরে উড়ালসড়ক নির্মাণকে ‘চমক’ ও ‘অপচয়’ বলে অভিহিত করে বলা হয়, এসব প্রকল্পে যে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করা হচ্ছে, তার সিকি ভাগও যদি ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় ব্যয় করা হয়, তাহলে নগরের যানজট সমস্যার সম্পূর্ণ নিরসন হবে। নগরের সড়ক প্রশস্ত করার ওপরও গুরুত্ব দিয়েছে এফপিসি। এ কথা ঠিক, সিডিএ নিকট অতীতে বেশ কিছু সড়ক সম্প্রসারণের কাজ সমাধা করেছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, সম্প্রসারিত সড়কের অধিকাংশই ইতিমধ্যে হকার, দোকানি ও ব্যবসায়ীরা দখল করে নিয়েছেন। সড়ক সম্প্রসারণের পাশাপাশি এর যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা ও দখলমুক্ত রাখার উদ্যোগ না নিলে এই বিরাট কর্মযজ্ঞ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে বাধ্য।
গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী মোশাররফ হোসেন নিজে প্রকৌশলী। তিনি বহদ্দারহাট উড়ালসেতু সরেজমিনে পরিদর্শন করে এফপিসির বক্তব্যের যথার্থতা খঁুজে পেয়েছেন। পত্রিকান্তরে এক প্রশ্নের কৌশলী উত্তর দিয়েছেন তিনি, বলেছেন, ‘ফ্লাইওভার নির্মাণের বিরোধিতা করে যাঁরা সংবাদ সম্মেলন করেছেন, আমি তাঁদের বিরোধিতা করছি না। এই ফ্লাইওভার চট্টগ্রামবাসীর আদৌ কোনো উন্নয়নে আসবে কি না, তা ভেবে দেখা প্রয়োজন।’
এই ভেবে দেখার কথাটিই বলতে চাই আমরা। সিডিএ তার উন্নয়ন পরিকল্পনা নিয়ে বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিরা বা পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের মতো সংগঠনের সঙ্গে মতবিনিময়ের আয়োজন করলে, আলোচনা-সমালোচনার পর একটি সঠিক পথের দিশা পেতে পারে। মনে রাখতে হবে, সদিচ্ছাই যথেষ্ট নয়, এর সঙ্গে দক্ষতা-যোগ্যতাও থাকতে হবে। দক্ষতা-যোগ্যতার অভাব ঘটলে উন্নয়নের নামে বহদ্দারহাট উড়ালসড়কের মতো চমক তৈরি করা যাবে, প্রকৃত উন্নয়ন রয়ে যাবে অধরা।
বিশ্বজিৎ চৌধুরী: কবি, লেখক ও সাংবাদিক।
No comments