আইনজীবীকে হত্যায় অনুতপ্ত র্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তা by আসিফ হোসেন
নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের মামলায় রিমান্ডে
থাকা র্যাব ১১-এর সাবেক তিন কর্মকর্তা ঘটনায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার
করেছেন৷ একই সঙ্গে তাঁরা আইনজীবী চন্দন সরকার ও তাঁর গাড়িচালককে হত্যার
ঘটনায় অনুতপ্ত৷ এ কথা তদন্তসংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র থেকে জানা গেছে৷
রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে এই তিন কর্মকর্তা বলেছেন, চন্দন সরকারকে তুলে নেওয়ার
কোনো পরিকল্পনা তাঁদের ছিল না৷ তিনি ও তাঁর গািড়চালক পরিস্থিতির শিকার
হয়েছেন৷ তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, তদন্তে প্রাপ্ত তথ্য ও
সাক্ষ্য-প্রমাণ অনুযায়ী, কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম ও তাঁর সঙ্গীদের অপহরণ ও
হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী পলাতক আসামি নূর হোসেন৷ তাঁর কাছ থেকে আর্থিক
সুবিধার বিনিময়ে র্যাব-১১-এর সদস্যরা এ ঘটনা ঘটিয়েছেন৷ যদিও রিমান্ডে তিন
কর্মকর্তা নূর হোসেন থেকে টাকা নেওয়ার কথা এখন পর্যন্ত স্বীকার করেননি৷ এ
ছাড়া কাউন্সিলর নজরুলের প্রতি ক্ষুব্ধ আওয়ামী লীগের সাংসদ শামীম ওসমানও এই
হত্যা পরিকল্পনা আগে থেকেই জানতেন বলে তদন্তে তথ্য মিলেছে৷ তদন্তের সর্বশেষ
অবস্থা ইতিমধ্যে সরকারের উচ্চপর্যায়ে জানানো হয়েছে৷ সবুজসংকেত পাওয়া গেলে
মামলার অভিযোগপত্র প্রস্তুত করার কাজ শুরু করা হবে৷
সাত খুনের ঘটনায় এ পর্যন্ত ২৮ জনকে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। এঁদের মধ্যে র্যাবের সাবেক তিন কর্মকতা লে. কর্নেল (অব.) তারেক মোহাম্মাদ সাঈদ, মেজর (অব.) আরিফ হোসেন ও লে. কমান্ডার এম এম রানাসহ ১৪ জনকে সুনির্দিষ্টভাবে হত্যা মামলায়, বািকদের ফৌজদাির কার্যবিধির ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। এর বাইরে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা ও কাউন্সিলর নূর হোসেনের কথিত বান্ধবী কাউন্সিলর জান্নাতুল ফেরদৌসকে অপর একটি হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, সাতজনকে অপহরণের পরপরই র্যাব-১১-এর তৎকালীন কর্মকর্তা মেজর আরিফ হোসেনের সঙ্গে নূর হোসেনের সার্বক্ষণিক যোগাযোগ ছিল। ২৭ এপ্রিল দুপুরে অপহরণের কিছুক্ষণ পরেই নূর হোসেন নারায়ণগঞ্জের রাইফেল ক্লাবে এসে সাংসদ শামীম ওসমানের সঙ্গে অবস্থান করেন৷ শামীম ওসমানের পাশে বসেই তিনি মুঠোফোনে মেজর আরিফের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন। মেজর আরিফ ও নূর হোসেনের মুঠোফোনের কথোপকথনের রেকর্ড পুলিশ ইতিমধ্যে সংগ্রহ করেছে৷
তদন্তসংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে র৵াবের সাবেক তিন কর্মকর্তা আইনজীবী চন্দন সরকার ও তাঁর গািড়চালককে খুনের ঘটনায় অনুতপ্ত বলে জানিয়েছেন৷ লে. কর্নেল (অব.) তারেক সাঈদ জানিয়েছেন, সিদ্ধিরগঞ্জের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির লক্ষ্যে নজরুল ও তাঁর অনুসারীদের তুলে আনা হয়েছিল৷ ওই দিন তাঁকে জানানো হয়েছিল, নজরুলসহ সাতজনকে তুলে আনা হয়েছে৷ কিন্তু তাঁদের মধ্যে কোনো আইনজীবী ছিলেন, সেটা তাঁকে বলা হয়নি৷ আর লে. কমান্ডার (অব.) এম এম রানা জিজ্ঞাসাবাদে দািব করেন, তিনি আইনজীবী চন্দন সরকার ও তাঁর গািড়চালককে হত্যা না করতে মেজর আরিফকে বলেছিলেন।
নূর হোসেনের কাছ থেকে ছয় কোটি টাকার বিনিময়ে র্যাব এই সাতজনকে খুন করেছে বলে নিহত নজরুলের শ্বশুর শহীদুল ইসলাম যে অভিযোগ করেছেন, জিজ্ঞাসাবাদে র্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তা তা স্বীকার করেননি৷ তবে মেজর আরিফ এর আগে বিভিন্ন সময়ে নূর হোসেনের কাছ থেকে বিপুল অঙ্কের আর্থিক সুবিধা নিয়েছিলেন, এমন তথ্য পুলিশ পেয়েছে৷
তদন্তসংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, নূর হোসেনকে গ্রেপ্তার করে র্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তাকে মুখোমুখি জিজ্ঞাসাবাদ করা গেলে প্রাপ্ত তথ্য যাচাই-বাছাই করাটা আরও সহজ হতো। নজরুল ও নূর হোসেনের মধ্যে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে আগে থেকেই দ্বন্দ্ব ছিল৷ কিন্তু দুজনই শামীম ওসমানের ঘনিষ্ঠ ছিলেন৷ এর মধ্যে নজরুলের সঙ্গে শামীম ওসমানের একটা দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছিল বলে তদন্তে পুলিশ তথ্য পেয়েছে৷ নজরুল বছর খানেক ধরে শামীম ওসমানের সভা-সমাবেশে আসতেন না। ২০১২ সালে বিজয় দিবসের শোভাযাত্রা করেন নারায়ণগঞ্জ মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেন। শোভাযাত্রায় মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী যোগ দেন। সিদ্ধিরগঞ্জ থেকে মিছিল নিয়ে এসে ওই শোভাযাত্রায় যোগ দেন নজরুলও৷ এতে তাঁর ওপর বেশ ক্ষুব্ধ হন শামীম ওসমান৷ গত ১৮ এপ্রিল শামীম ওসমান যে সমাবেশ করেন, তাতে নূর হোসেন দলবল নিয়ে যোগ দিলেও নজরুল আসেননি৷
তদন্তে পুলিশ জানতে পেরেছে, নজরুলের ওয়ার্ডে রাস্তা প্রশস্ত করার জন্য একটি দোকানের সামনের অংশ ভাঙা নিয়ে বিবাদের জের হিসেবে নূর হোসেনের ক্যাডাররা গত ২ জানুয়াির ওই এলাকায় হামলা চালিয়েছিল৷ সেদিনই নজরুলকে হত্যার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু নজরুল একটি বািড়তে আত্মগোপন করে প্রাণে বেঁচে যান। এ ঘটনায় নূর হোসেন তাঁর অনুগত এক ব্যক্তিকে দিয়ে নজরুল ও তাঁর সহযোগীদের আসািম করে সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় মামলা করান। ওই মামলা করার ক্ষেত্রেও শামীম ওসমানের ভূমিকা ছিল বলে তদন্তে তথ্য মিলেছে৷
ওই মামলায় নজরুল ও তাঁর সহযোগীরা হাইকোর্টের নির্দেশনা মোতাবেক নারায়ণগঞ্জ আদালতে হাজিরা দিয়ে ফেরার পথে অপহৃত ও খুন হন। এমনকি পরে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রেও নূর হোসেনকে সহায়তা করেছেন সাংসদ শামীম ওসমান৷ ২৯ এপ্রিল শামীম ওসমানের সঙ্গে নূর হোসেনের মুঠোফোনের কথোপকথনের পুরোটা পর্যালোচনা করেছেন তদন্তকারীরা৷ তাতে স্পষ্ট হয়েছে যে শামীম ওসমান নূর হোসেনকে আদালতে যেতে বলেননি। যে গৌড়দার সঙ্গে নূর হোসেনকে যোগাযোগ করতে বলেছিলেন, তাঁকেও চিহ্নিত করেছে পুলিশ। ওই গৌড়দার আশ্রয়ে নূর হোসেন এখন ভারতে রয়েছেন।
সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থা ও পুলিশের অপরাধ তদন্ত সংস্থা (সিআইডি) এ মামলার তদন্তে জেলা পুলিশকে নানাভাবে সহায়তা করছে৷
জানতে চাইলে এ মামলা তদন্ত-তদারককারী কর্মকর্তা জেলা পুলিশ সুপার খন্দকার মহিদ উদ্দিন গতকাল শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, তদন্তে যথেষ্ট অগ্রগতি আছে। পুলিশ সম্পূর্ণ পেশাগত দক্ষতা, যোগ্যতা দিয়ে তদন্তকাজ করছে। তবে তিনি তদন্তের প্রাপ্ত তথ্য সম্পর্কে কিছু বলতে রাজি হননি৷
No comments