ইউক্রেন- পশ্চিমা বিশ্বের উভয়সংকট by খলিলউল্লাহ্
ইউক্রেনকে ঘিরে পূর্ব ইউরোপের সাম্প্রতিক
সংকটটি বুঝতে হলে রাশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক কৌশলটির দিকে সবার আগে নজর দেওয়া
প্রয়োজন। তার পাশাপাশি পশ্চিমা দেশগুলো কী পদক্ষেপ নিতে পারে এবং তার
বাস্তবভিত্তিক সম্ভাবনা কতটুকু, তা-ও খতিয়ে দেখা উচিত। কারণ, সংকট সৃষ্টিতে
এবং সমাধানে এই দুটি বিষয়ই বেশি ভূমিকা রাখে। ইউক্রেনের জাতিগত
দ্বিধাবিভক্তি এ ক্ষেত্রে একটি উর্বর স্থান করে দিয়েছে। গত ১০ বছরের
নির্বাচনী পরিসংখ্যান দেখলে বোঝা যায় যে ইউক্রেনের রুশপন্থী প্রেসিডেন্ট
ইয়ানুকোভিচ পূর্ব ইউক্রেন (বিশেষ করে দোনেৎস্ক) এবং ক্রিমিয়ায় বিপুল সমর্থন
পেয়েছেন এবং যার ঠিক উল্টোটা ঘটেছে পশ্চিমাঞ্চলে।
রাশিয়ার পূর্বতন রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়ন বিংশ শতাব্দীর শেষ সময় পর্যন্ত ইউরেশিয়া অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করেছে, যার বিস্তৃতি ছিল মধ্য জার্মানি থেকে প্যাসিফিক হয়ে দক্ষিণ দিকে ককেশাস ও হিন্দুকোশ পর্যন্ত। কিন্তু স্নায়ুযুদ্ধে পরাজয়ের ফলে সেই বিশালত্বের ইতি ঘটে। রাশিয়ার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে এই অঞ্চল তার প্রভাববলয়ে রাখা জরুরি।
রাশিয়ার উত্তর সীমান্ত দিয়ে সেন্ট পিটার্সবার্গ পর্যন্ত অঞ্চলটি তার জন্য নির্দ্বিধায় ভীতিকর। এই দিক দিয়েই নেপোলিয়ন ও হিটলার রাশিয়া আক্রমণ করেছিলেন। ভূখণ্ডগত নিরাপত্তার জন্য তার ভৌগোলিক গভীরতা ছাড়া প্রাকৃতিকভাবে তেমন কোনো বাধার দেয়াল নেই। বাল্টিক থেকে রোমানিয়া সীমান্ত পর্যন্ত অঞ্চলটি ঐতিহাসিকভাবেই অনিশ্চিত এবং সংঘাতপূর্ণ। তাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন জার্মানির কেন্দ্র পর্যন্ত বিস্তৃত এই অঞ্চলটি নিজেদের আয়ত্তে নিয়ে আসে। বাফার এলাকা তৈরি করাই ছিল মূল উদ্দেশ্য। এখনো তার ভূখণ্ডগত নিরাপত্তার জন্য এটিই করণীয়, যা ২০০৮ সালে জর্জিয়ায় সেনা পাঠিয়ে আবখাজিয়া ও দক্ষিণ ওশেটিয়া স্বাধীন করতে সহায়তা করার মাধ্যমে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তারই ধারাবিহকতায় এখন ক্রিমিয়াও রাশিয়ার অধীনে আসার পথে।
রাশিয়ার এই পুনর্জাগরণ নিঃসন্দেহে ইউরোপের সঙ্গে তার সংঘাত বাড়িয়ে দেবে। রাশিয়ার বড় শক্তি সামরিক নয়, জ্বালানি। যে জন্য তার প্রভাববলয়ের রাষ্ট্রগুলো স্নায়ুযুদ্ধের সময়ের চেয়েও তার ওপর এখন বেশি নির্ভরশীল। ইউরোপ একদিকে যেমন জ্বালানি-ক্ষুধার্ত, অন্যদিকে জ্বালানিশক্তির জন্য প্রচণ্ড রকম নির্ভরশীল ওই রাশিয়ার ওপরই। এই সুযোগটিই রাশিয়া এখন কাজে লাগাচ্ছে। সে জানে যে পশ্চিমা শক্তি যতই হুমকি দিক,
তারা চাইলেই সামরিক হামলা চালাতে পারে না। যদিও ফ্রান্স হুমকি দিয়েছে, কিন্তু ইউরোপীয় ইউনিয়ন বলেছে যে তারা এখনো সিদ্ধান্ত নেয়নি রাশিয়ার ওপর অবরোধ আরোপের। কারণ, জ্বালানি রপ্তানি রাশিয়ার আয়ের বড় উৎস হলেও এ ক্ষেত্রে সে জ্বালানিনীতির ব্যাপারে
কী সিদ্ধান্ত নেয়, তা ইউরোপের জন্য চিন্তার বিষয় বৈকি। তা ছাড়া রাশিয়ার সামরিক শক্তি সে ধীরে ধীরে বাড়িয়ে তুলছে। জর্জ ফ্রিডম্যান তাঁর ২০০৯ সালে প্রকাশিত গ্রন্থ দি নেক্সট হানড্রেড ইয়ারস-এ ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে ২০২০ সালের মধ্যে এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষেও সম্ভব না রাশিয়াকে চ্যালেঞ্জ করা।
রাশিয়ার উদ্দেশ্য হলো এই অঞ্চলে নিজের প্রভাব বিস্তার করা এবং সেটিকে নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য এর বাইরেও বাফার অঞ্চল তৈরি করা। এর ইঙ্গিতও রাশিয়া দিয়েছে। রাশিয়ার বাইরে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে বসবাসকারী রুশ জাতিগোষ্ঠীকে নাগরিকত্ব প্রদানের পরিকল্পনা করেছে দেশটি। এর পাশাপাশি তাকে অবশ্যই রাশিয়াবিরোধী কোয়ালিশনগুলো থামাতে হবে, যেসব কোয়ালিশন শুরু থেকেই বিদ্যমান। রাশিয়া সেদিকেই হাঁটছে বলে মনে হয়। তা না হলে ইউক্রেনকে ‘শাস্তি’ দেওয়ার আরও অনেক রাস্তা ছিল, যেমন—গ্যাসের দাম বাড়িয়ে দেওয়া, ইউক্রেনের কাছে তার রাষ্ট্রীয় ঋণ পরিশোধের জন্য চাপ দেওয়া, সেই দেশের অভ্যন্তরে বিশাল রুশ জাতিগোষ্ঠীকে ইউক্রেনবিরোধী করে সামাজিক কাঠামো বিনষ্ট করা বা সেভাস্টপোলে রাশিয়ার ব্ল্যাক সি ফ্লিটের মাধ্যমে হুমকি দেওয়া।
পশ্চিমা বিশ্ব ইউক্রেনকে নিয়ে দ্বিমুখী সংকটে পড়েছে বলা যায়। ইউক্রেন তার পারমাণবিক অস্ত্র পরিত্যাগ করেছিল ১৯৯৪ সালে। কিন্তু সে জন্য রাশিয়াসহ পশ্চিমা দেশগুলো তাকে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিয়েছিল। অন্যদিকে স্নায়ুযুদ্ধের সময়ের মতো রাশিয়া আবার এই অঞ্চলে প্রভাব বিস্তারের পাঁয়তারা করলে তা পশ্চিমা মিত্রদের জন্য সুখকর হবে না। তাতে কী! জ্বালানির মাধ্যমে ইউরোপকে বিপদে ফেলার পাশাপাশি এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অনেকভাবে হুমকি তৈরি করতে পারে রাশিয়া। এসব বিবেচনায় নিয়েই পশ্চিমা শক্তিকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নিতে হবে।
চীনের সঙ্গে যৌথ অস্ত্র উন্নয়ন প্রকল্প চালু করা ছাড়াও অস্ত্রচুক্তির আওতা বাড়াতে পারে রাশিয়া। এ ছাড়াও প্রাকৃতিক জ্বালানি ও অন্যান্য সম্পদের ব্যবসাও চীনের সঙ্গে কম দামে করার পরিকল্পনা করবে। চীন যত শক্তিশালী হবে, ততই পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব হ্রাস পাবে। ইরানকে আরও বেশি পরিমাণে অস্ত্র ও পারমাণবিক সহায়তার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য মধ্যপ্রাচ্য আরও বিভীষিকাময় করে ফেলা যায়। সিরিয়া সংকটকে আরও উসকে দেওয়ার ক্ষমতা রাশিয়ার রয়েছে। রাসায়নিক অস্ত্র নিরসনের ব্যাপারে সহায়তা না করা এবং আসাদকে আরও অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত করতে পারে সে। এদিকে ক্রিমিয়া দখল করা মানে ইউক্রেনের একটি বড় অংশ নিয়ে নেওয়া। স্বাভাবিকভাবেই যুক্তরাষ্ট্রকে অধিক সামরিক নজর দিতে হবে এই অঞ্চলে যেন রাশিয়া পূর্ব ইউরোপের আর কোনো অঞ্চল দখল করতে না পারে। সেটার সামরিক মূল্য বহন করা এই অর্থনৈতিক মন্দার বাজারে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য নিঃসন্দেহে ব্যয়বহুল।
রাশিয়ার জন্য বড় সমস্যা হিসেবে দেখা দেবে তার অর্থনৈতিক সামর্থ্য। ২০০০ সাল থেকে লেভাদা সেন্টারের জরিপ অনুযায়ী পুতিনের জনসমর্থন ৬০ শতাংশের নিচে নামেনি। এর বড় কারণ হলো ২০০০-০৮ পর্যন্ত তিনি তাঁর দেশের বার্ষিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি গড়ে ৭ শতাংশ রাখতে পেরেছিলেন। এই মিরাকলের বড় কারণ ছিল তেলের দাম ও উদীয়মান বাজারগুলোতে তারল্যপ্র্রবাহ বৃদ্ধি এবং আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান, যেমন—বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা এবং উন্নয়ন সংস্থার সঙ্গে একীভূত হওয়া। পাশ্চাত্য অবরোধ রাশিয়ার এসব সহযোগিতার পথও বন্ধ করে দিতে পারে, যা তার ২০১১ সাল থেকে নিম্নমুখী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে আরও বিপদসংকুল করে দেবে।
জর্জিয়া আর ইউক্রেনে হস্তক্ষেপের মধ্যে একটি পার্থক্যও রয়েছে। সে সময় আন্তর্জাতিক গোষ্ঠী আইনত কিছু করতে পারেনি, কারণ জর্জিয়ার সেনারাই প্রথমে রাশিয়ার শান্তিরক্ষী এবং স্থানীয় দক্ষিণ ওশেটিয়ার বেসামরিক নাগরিকদের ওপর আর্টিলারি হামলা চালায়। কিন্তু ক্রিমিয়ায় তেমনটি ঘটেনি। অন্যদিকে পশ্চিমা বিশ্ব ক্রিমিয়ায় রাশিয়ার সেনা প্রবেশকে আগ্রাসন বলে আখ্যায়িত করার ক্ষেত্রে সমস্যায় পড়বে, কারণ ইতিমধ্যে ক্রিমিয়ার জাতীয় সংসদের ৮১ জন সদস্যের মধ্যে ৭৮ জন রাশিয়ার অংশ হতে ভোট দিয়েছেন। এ অবস্থায় ইউক্রেনের ব্যবসায়ী নেতারা যাঁরা অলিগার্ক নামে পরিচিত, তাঁরা সংকট নিরসনে অন্যতম ভূমিকা পালন করতে পারেন। কারণ, ইউক্রেন স্বাধীন হওয়ার পরই রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত সম্পত্তিগুলো বেসরকারীকরণ করা হয়, যার মাধ্যমে এই গোষ্ঠীটি শক্তিশালী হয়ে ওঠে। সব রাজনৈতিক দলগুলোই তাদের সমর্থন-সহযোগিতার ওপর নির্ভরশীল।
ইউক্রেনের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক মতৈক্যে আসতে হলে তাদের সমর্থনটাই বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে। এর বাইরে এই সংকটের সমাধান করতে পারে এমন অন্য কোনো পথ খোলা আছে বলে মনে হয় না। রাশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতায় এই নীতি যেমন ‘জরুরি’, তেমনি পশ্চিমা বিশ্বকেও তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষার্থে রাশিয়াকে থামানো ‘অপরিহার্য’। সুতরাং অসহায় ইউক্রেনকে উলুখাগড়া হয়ে প্রাণ দেওয়াই একমাত্র সমাধান!
খলিলউল্লাহ্: সহকারী সম্পাদক, প্রতিচিন্তা।
khaliljibon@gmail.com
No comments