মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী -‘ছায়াসুনিবিড় শান্তির নীড়’
এই লেখাটির আর একটি শিরোনাম দেওয়া যেত ‘বাংলাদেশের আদি সংবিধানে দেওয়া স্বদেশি সমাজ গড়ার নকশা’ এবং সেটাই উপযুক্ত হতো। কিন্তু সেটার বদলে একটি কাব্যিক শিরোনাম, যার সবই রবীন্দ্রনাথের বিশাল ভান্ডার থেকে নেওয়া। কেন দিলাম তার কৈফিয়ত দিতে হয়। যখনই খবরের কাগজে, বিশেষ করে ঢাকা ও মফস্বল শহরে অনাকাঙ্ক্ষিত দুঃখজনক ঘটনার বিবরণ পড়ি, তখনই রবীন্দ্রনাথের লেখা ‘স্বদেশী সমাজ’ প্রবন্ধটির কথা মনে হয়। তিনি লিখেছেন, ‘দেশের হূদয়লাভকেই যদি চরম লাভ বলিয়া স্বীকার করি, তবে দেশের যথার্থ কাছে যাইবার কোন কোন পথ চিরদিন খোলা আছে, সেইগুলিকে দৃষ্টির সম্মুখে আনিতে হইবে। ...আমাদের দেশ প্রধানত পল্লীবাসী। এই পল্লী মাঝে মাঝে যখন আপনার নাড়ীর মধ্যে বাহিরের বৃহৎ জগতের রক্তচলাচল অনুভব করিবার জন্য উত্সুক হইয়া ওঠে তখন মেলাই তাহার প্রধান উপায়। এই মেলাই আমাদের দেশে বাহিরকে ঘরের মধ্যে আহ্বান করে। এই উৎসবে পল্লী আপনার সমস্ত সংকীর্ণতা বিস্মৃত হয়—তাহার হূদয় খুলিয়া দান করিবার ও গ্রহণ করিবার এই প্রধান উপলক্ষ।’
তবে কি আমাদেরকে গ্রামে ফিরে যেতে হবে? রবীন্দ্রনাথ সেটাই বলেন। বাহাত্তরের সংবিধানও সেটাই বলে। আমিও সেটা বলি। তবে এত দিন সেটা লিখিনি কেন? এবং এখন লিখছি কেন? এটা লিখতে সাহসী হওয়ার পেছনে আছে প্রথম আলো পত্রিকার ২৩ আগস্ট সংখ্যায় ছাপা একটি বিশেষ প্রতিবেদন, যার শিরোনাম ছিল ‘উদ্ভাবন: পাথরকুচি পাতা থেকে বিদ্যুৎ’। এটা উদ্ভাবন করেছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কামরুল আলম খান। তিনি বলেন, ৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুেকন্দ্র যার কাঁচামাল হবে পাথরকুচির পাতা, তৈরি করতে লাগবে পাঁচ কোটি টাকা এবং প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের খরচ পড়বে এক টাকার কম। তা ছাড়া পল্লি অঞ্চলে তার প্রযুক্তি সহজেই ব্যবহার করা সম্ভব হবে এবং সেখানে প্রতিটি পরিবার নিজেদের প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ নিজেরাই উৎপাদন করতে পারবে। দেখা যাচ্ছে, কার্ল মার্ক্স ঠিকই লিখেছিলেন, বিশ্ববাজার শোষণের মাধ্যমে বুর্জোয়া শ্রেণী সব দেশে উৎপাদন ও ভোগব্যবস্থাকে এক আন্তর্জাতিক রূপ দিয়েছে। দেশীয় শ্রমশিল্প ধ্বংস করা হচ্ছে। তাদেরকে হটিয়ে দিয়ে নতুন শিল্প গড়ে তোলা হচ্ছে যেখানে দেশজ কাঁচামাল ব্যবহার করা হচ্ছে না, ব্যবহূত হচ্ছে দূরবর্তী অঞ্চলের কাঁচামাল। পুরোনো চাহিদাসামগ্রী যেগুলো নিজ দেশের উৎপাদনেই মিটে যেত, তার বদলে হাজির করা হচ্ছে নতুন সব চাহিদা। বুর্জোয়া শ্রেণী তাদের প্রতিবিম্বে পৃথিবী তৈরি করছে, তারা করছে দেশকে শহরনির্ভর। এই বক্তব্যের সঙ্গে যোগ করা যায়, ইউরোপ কিংবা আমেরিকার ঐতিহ্যে যেখানে রাষ্ট্রই প্রধান, সেখানে বাংলাদেশে সমাজই প্রধান এবং এই মৌলিক তফাতটি কোনোভাবেই অগ্রাহ্য করা যাবে না। সেটা করা হলে বাংলাদেশের হাজার বছরের ঐতিহাসিক ধারাকেই অগ্রাহ্য করতে হয়।
প্রথম আলোয় ছাপা ওই প্রতিবেদনটি পড়া শেষ হতেই আমি ফিরে গিয়েছিলাম আমার অতি বাল্যকালে। স্পষ্ট দেখতে পেলাম, একটি ছোট রেলস্টেশনের প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছি আব্বার হাত ধরে। পাশে মা দাঁড়িয়ে আছেন। আমরা গাঁয়ে দাদার বাড়িতে যাচ্ছি। তারপর কাঁচা মেঠোপথ ধরে আব্বার হাত ধরে হাঁটছি। মা চলেছেন ডুলিতে চড়ে। দুজন বেহারা একটা মোটা বাঁশের দণ্ডের আগে ও পেছনে কাঁধে নিয়ে দুলে দুলে চলছেন আর বাঁশদণ্ডটির মাঝখানে ঝোলানো চাদর দিয়ে ঢাকা ডোলায় মা বসে আছেন। আকাশের রং ঘন নীল, এখানে-ওখানে পেঁজাতুলার মতো মেঘ। যেদিকে তাকাই, সবুজ আর সবুজ গাছপালা। দাদাবাড়িতে পৌঁছে পরদিন চাচাতো বোনের সঙ্গে মাঠে ঘোরাঘুরি করছি। দেখি একটা গাছ বেয়ে একটি লতাগাছ উঠেছে আর সেখান থেকে ঝুলছে থোকা থোকা ছোট্ট লাল রঙের ফল, যাদের প্রতিটির নিচে কালো রঙের ফুটকি। বোনটি বললেন, এগুলো কুচফল। তারপর গাছের নিচে থেকে একটা গাছের পাতা ছিঁড়ে দেখালেন, পাতা থেকে শেকড় ঝুলছে। বললেন, এটা পাথরকুচি গাছ, পাতা মাটিতে পড়ে সেখান থেকে নতুন গাছ হয়।
এই যে চিত্রটি আমার মনের পটে আঁকা আছে, সেটাকে কি ফিরে পাওয়া যায় না কিংবা ধরে রাখা যায় না? এই প্রশ্নটির হ্যাঁ-সূচক উত্তর পাওয়া যাবে বাহাত্তরের আদি সংবিধানে। সংবিধানের ‘রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতি’ শিরোনামের দ্বিতীয় ভাগের অন্তর্ভুক্ত ১৬ অনুচ্ছেদটি পড়লেই সেটা স্পষ্ট হয়ে যাবে। ‘গ্রামীণ উন্নয়ন ও কৃষি বিপ্লব’ শিরোনামযুক্ত ১৬ অনুচ্ছেদটির উদ্ধৃতি এই: ‘নগর ও গ্রামাঞ্চলের জীবনযাত্রার মানের বৈষম্য ক্রমাগতভাবে দূর করিবার উদ্দেশ্যে কৃষি বিপ্লবের বিকাশ, গ্রামাঞ্চলে বৈদ্যুতিকীকরণের ব্যবস্থা, কুটিরশিল্প ও অন্যান্য শিল্পের বিকাশ এবং শিক্ষা ও যোগাযোগব্যবস্থা ও জনস্বাস্থ্যের উন্নয়নের মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলের আমূল রূপান্তর সাধনের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন।’
এই অনুচ্ছেদটি আচমকা সংবিধানে জুড়ে বসেনি, এটা লেখার ঐতিহাসিক বাধ্যবাধকতা ছিল। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ সঠিক অর্থে ছিল বাংলাদেশের কৃষকদের বিদ্রোহের ধারাবাহিকতায় এক সফল পর্যায় এবং বংশপরম্পরায় ব্যক্তিসমষ্টির ওই আকাঙ্ক্ষাগুলো যা বিকশিত হয়েছিল বাহাত্তরের সংবিধানে।
নোয়াম চমস্কি ‘ভবিষ্যতের সরকার’ শিরোনামের এক বক্তব্যে বলেছেন, যে জিনিসটা মানুষ নিজে বানায়, সেটাকে সে যতটা নিজের বলে ভাবে, তার তুলনায় যে জিনিসটার সে মালিক সেটাকে কখনো ততটা নিজের বলে ভাবে না। যে ভোগবিলাসীরা বাগানের ফলমূল বেশুমার উপভোগ করেন, তাঁদের তুলনায় যে শ্রমিক বাগানটার পরিচর্যা করেন, তিনি সম্ভবত অনেক বেশি সত্যিকার অর্থে সেটার মালিক। আর যেহেতু খাঁটি মানবীয় কাজ হলো সেইটা, যা আসে অন্তরের তাগিদ থেকে, তাতে করে মনে হয় যেন সকল কৃষক ও কারুকুশলীকে উন্নীত করে নেওয়া যেত শিল্পী পর্যায়ে, অর্থাৎ এমন মানুষের পর্যায়ে, যাঁরা তাঁদের শ্রমকে ভালোবাসেন শুধু শ্রমেরই খাতিরে, সেই শ্রমের উন্নতি ঘটান নিজস্ব নমনীয় প্রতিভা ও উদ্ভাবনী দক্ষতার সাহায্যে এবং সেই সূত্রে অনুশীলন করেন নিজেদের মেধার, মর্যাদাবান করে তোলেন নিজেদের চরিত্রকে, আর উল্লসিত ও পরিমার্জিত করে তোলেন নিজের আত্মসুখ। এ রকমটা হলে মানবিকতা ঠিক সেই সমস্ত জিনিসের জন্যই মর্যাদাসম্পন্ন হয়ে উঠত, যেসব জিনিস এখন প্রায়ই তার মর্যাদাহানি ঘটায়, যদিও জিনিসগুলো নিজেরা সুন্দরই বটে (অনুবাদ, সেলিম রেজা নিউটন)। নোয়াম চমস্কি বক্তব্যটি দিয়েছিলেন যদিও ১৯৭০ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি নিউইয়র্কে, কিন্তু সেটি ওয়েবসাইটে পোস্ট করা হয়েছিল ২০০৬ সালের ২১ নভেম্বর। অথচ কী আশ্চর্য! বাংলাদেশের বাহাত্তরের সংবিধান প্রণয়নকালে ওই একই নীতি উল্লেখ করা হয়েছিল ২০ অনুচ্ছেদের ২ দফাতে যার উদ্ধৃতি এই: ‘রাষ্ট্র এমন অবস্থা সৃষ্টির চেষ্টা করিবেন, যেখানে সাধারণ নীতি হিসাবে কোন ব্যক্তি অনুপার্জিত আয় ভোগ করিতে সমর্থ হইবেন না এবং যেখানে বুদ্ধিবৃত্তিমূলক ও কায়িক সকল প্রকার শ্রম সৃষ্টিধর্মী প্রয়াসের ও মানবিক ব্যক্তিত্বের পূর্ণতার অভিব্যক্তিতে পরিণত হইবে।’
প্রিয় পাঠক-পাঠিকা, আসুন, আমরা দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ শুরু করি। বিদেশি সাংস্কৃতিক পণ্য পরিহার করে দেশীয় সাংস্কৃতিক ধারা প্রাণবান করি। আমরা উপলব্ধি করি চরম সত্যটি, রাষ্ট্রের যেহেতু ঝোঁক হচ্ছে নাগরিকদের চাওয়া-পাওয়াকে উপেক্ষা করা, সেহেতু আমরা গ্রামসমাজকে শক্তিশালী করি। কৃষিব্যবস্থা ও তার পাশাপাশি চাহিদামতো কুটিরশিল্প গড়ে তুলি। আধুনিক অতিপ্রয়োজনীয় প্রযুক্তির জন্য বিদেশিদের দ্বারস্থ হওয়ার যে বাধ্যবাধকতা ছিল, তা থেকে মুক্তি পাওয়ার সম্ভাবনার পথ অধ্যাপক কামরুল আলম দেখিয়েছেন। আশা করা যায়, আরও অনেকে দেখাবেন। বাহাত্তরের সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতিগুলো বাস্তবায়ন করি। সার্থক করে তুলি জাতীয় সংগীতের চরণগুলো: ‘কী শোভা কী ছায়া গো, কী স্নেহ, কী মায়া গো, কী আঁচল বিছায়েছ বটের মূলে, নদীর কূলে কূলে।’
বিচারপতি মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী: অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, আপিল বিভাগ, সুপ্রিম কোর্ট।
তবে কি আমাদেরকে গ্রামে ফিরে যেতে হবে? রবীন্দ্রনাথ সেটাই বলেন। বাহাত্তরের সংবিধানও সেটাই বলে। আমিও সেটা বলি। তবে এত দিন সেটা লিখিনি কেন? এবং এখন লিখছি কেন? এটা লিখতে সাহসী হওয়ার পেছনে আছে প্রথম আলো পত্রিকার ২৩ আগস্ট সংখ্যায় ছাপা একটি বিশেষ প্রতিবেদন, যার শিরোনাম ছিল ‘উদ্ভাবন: পাথরকুচি পাতা থেকে বিদ্যুৎ’। এটা উদ্ভাবন করেছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কামরুল আলম খান। তিনি বলেন, ৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুেকন্দ্র যার কাঁচামাল হবে পাথরকুচির পাতা, তৈরি করতে লাগবে পাঁচ কোটি টাকা এবং প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের খরচ পড়বে এক টাকার কম। তা ছাড়া পল্লি অঞ্চলে তার প্রযুক্তি সহজেই ব্যবহার করা সম্ভব হবে এবং সেখানে প্রতিটি পরিবার নিজেদের প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ নিজেরাই উৎপাদন করতে পারবে। দেখা যাচ্ছে, কার্ল মার্ক্স ঠিকই লিখেছিলেন, বিশ্ববাজার শোষণের মাধ্যমে বুর্জোয়া শ্রেণী সব দেশে উৎপাদন ও ভোগব্যবস্থাকে এক আন্তর্জাতিক রূপ দিয়েছে। দেশীয় শ্রমশিল্প ধ্বংস করা হচ্ছে। তাদেরকে হটিয়ে দিয়ে নতুন শিল্প গড়ে তোলা হচ্ছে যেখানে দেশজ কাঁচামাল ব্যবহার করা হচ্ছে না, ব্যবহূত হচ্ছে দূরবর্তী অঞ্চলের কাঁচামাল। পুরোনো চাহিদাসামগ্রী যেগুলো নিজ দেশের উৎপাদনেই মিটে যেত, তার বদলে হাজির করা হচ্ছে নতুন সব চাহিদা। বুর্জোয়া শ্রেণী তাদের প্রতিবিম্বে পৃথিবী তৈরি করছে, তারা করছে দেশকে শহরনির্ভর। এই বক্তব্যের সঙ্গে যোগ করা যায়, ইউরোপ কিংবা আমেরিকার ঐতিহ্যে যেখানে রাষ্ট্রই প্রধান, সেখানে বাংলাদেশে সমাজই প্রধান এবং এই মৌলিক তফাতটি কোনোভাবেই অগ্রাহ্য করা যাবে না। সেটা করা হলে বাংলাদেশের হাজার বছরের ঐতিহাসিক ধারাকেই অগ্রাহ্য করতে হয়।
প্রথম আলোয় ছাপা ওই প্রতিবেদনটি পড়া শেষ হতেই আমি ফিরে গিয়েছিলাম আমার অতি বাল্যকালে। স্পষ্ট দেখতে পেলাম, একটি ছোট রেলস্টেশনের প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছি আব্বার হাত ধরে। পাশে মা দাঁড়িয়ে আছেন। আমরা গাঁয়ে দাদার বাড়িতে যাচ্ছি। তারপর কাঁচা মেঠোপথ ধরে আব্বার হাত ধরে হাঁটছি। মা চলেছেন ডুলিতে চড়ে। দুজন বেহারা একটা মোটা বাঁশের দণ্ডের আগে ও পেছনে কাঁধে নিয়ে দুলে দুলে চলছেন আর বাঁশদণ্ডটির মাঝখানে ঝোলানো চাদর দিয়ে ঢাকা ডোলায় মা বসে আছেন। আকাশের রং ঘন নীল, এখানে-ওখানে পেঁজাতুলার মতো মেঘ। যেদিকে তাকাই, সবুজ আর সবুজ গাছপালা। দাদাবাড়িতে পৌঁছে পরদিন চাচাতো বোনের সঙ্গে মাঠে ঘোরাঘুরি করছি। দেখি একটা গাছ বেয়ে একটি লতাগাছ উঠেছে আর সেখান থেকে ঝুলছে থোকা থোকা ছোট্ট লাল রঙের ফল, যাদের প্রতিটির নিচে কালো রঙের ফুটকি। বোনটি বললেন, এগুলো কুচফল। তারপর গাছের নিচে থেকে একটা গাছের পাতা ছিঁড়ে দেখালেন, পাতা থেকে শেকড় ঝুলছে। বললেন, এটা পাথরকুচি গাছ, পাতা মাটিতে পড়ে সেখান থেকে নতুন গাছ হয়।
এই যে চিত্রটি আমার মনের পটে আঁকা আছে, সেটাকে কি ফিরে পাওয়া যায় না কিংবা ধরে রাখা যায় না? এই প্রশ্নটির হ্যাঁ-সূচক উত্তর পাওয়া যাবে বাহাত্তরের আদি সংবিধানে। সংবিধানের ‘রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতি’ শিরোনামের দ্বিতীয় ভাগের অন্তর্ভুক্ত ১৬ অনুচ্ছেদটি পড়লেই সেটা স্পষ্ট হয়ে যাবে। ‘গ্রামীণ উন্নয়ন ও কৃষি বিপ্লব’ শিরোনামযুক্ত ১৬ অনুচ্ছেদটির উদ্ধৃতি এই: ‘নগর ও গ্রামাঞ্চলের জীবনযাত্রার মানের বৈষম্য ক্রমাগতভাবে দূর করিবার উদ্দেশ্যে কৃষি বিপ্লবের বিকাশ, গ্রামাঞ্চলে বৈদ্যুতিকীকরণের ব্যবস্থা, কুটিরশিল্প ও অন্যান্য শিল্পের বিকাশ এবং শিক্ষা ও যোগাযোগব্যবস্থা ও জনস্বাস্থ্যের উন্নয়নের মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলের আমূল রূপান্তর সাধনের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন।’
এই অনুচ্ছেদটি আচমকা সংবিধানে জুড়ে বসেনি, এটা লেখার ঐতিহাসিক বাধ্যবাধকতা ছিল। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ সঠিক অর্থে ছিল বাংলাদেশের কৃষকদের বিদ্রোহের ধারাবাহিকতায় এক সফল পর্যায় এবং বংশপরম্পরায় ব্যক্তিসমষ্টির ওই আকাঙ্ক্ষাগুলো যা বিকশিত হয়েছিল বাহাত্তরের সংবিধানে।
নোয়াম চমস্কি ‘ভবিষ্যতের সরকার’ শিরোনামের এক বক্তব্যে বলেছেন, যে জিনিসটা মানুষ নিজে বানায়, সেটাকে সে যতটা নিজের বলে ভাবে, তার তুলনায় যে জিনিসটার সে মালিক সেটাকে কখনো ততটা নিজের বলে ভাবে না। যে ভোগবিলাসীরা বাগানের ফলমূল বেশুমার উপভোগ করেন, তাঁদের তুলনায় যে শ্রমিক বাগানটার পরিচর্যা করেন, তিনি সম্ভবত অনেক বেশি সত্যিকার অর্থে সেটার মালিক। আর যেহেতু খাঁটি মানবীয় কাজ হলো সেইটা, যা আসে অন্তরের তাগিদ থেকে, তাতে করে মনে হয় যেন সকল কৃষক ও কারুকুশলীকে উন্নীত করে নেওয়া যেত শিল্পী পর্যায়ে, অর্থাৎ এমন মানুষের পর্যায়ে, যাঁরা তাঁদের শ্রমকে ভালোবাসেন শুধু শ্রমেরই খাতিরে, সেই শ্রমের উন্নতি ঘটান নিজস্ব নমনীয় প্রতিভা ও উদ্ভাবনী দক্ষতার সাহায্যে এবং সেই সূত্রে অনুশীলন করেন নিজেদের মেধার, মর্যাদাবান করে তোলেন নিজেদের চরিত্রকে, আর উল্লসিত ও পরিমার্জিত করে তোলেন নিজের আত্মসুখ। এ রকমটা হলে মানবিকতা ঠিক সেই সমস্ত জিনিসের জন্যই মর্যাদাসম্পন্ন হয়ে উঠত, যেসব জিনিস এখন প্রায়ই তার মর্যাদাহানি ঘটায়, যদিও জিনিসগুলো নিজেরা সুন্দরই বটে (অনুবাদ, সেলিম রেজা নিউটন)। নোয়াম চমস্কি বক্তব্যটি দিয়েছিলেন যদিও ১৯৭০ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি নিউইয়র্কে, কিন্তু সেটি ওয়েবসাইটে পোস্ট করা হয়েছিল ২০০৬ সালের ২১ নভেম্বর। অথচ কী আশ্চর্য! বাংলাদেশের বাহাত্তরের সংবিধান প্রণয়নকালে ওই একই নীতি উল্লেখ করা হয়েছিল ২০ অনুচ্ছেদের ২ দফাতে যার উদ্ধৃতি এই: ‘রাষ্ট্র এমন অবস্থা সৃষ্টির চেষ্টা করিবেন, যেখানে সাধারণ নীতি হিসাবে কোন ব্যক্তি অনুপার্জিত আয় ভোগ করিতে সমর্থ হইবেন না এবং যেখানে বুদ্ধিবৃত্তিমূলক ও কায়িক সকল প্রকার শ্রম সৃষ্টিধর্মী প্রয়াসের ও মানবিক ব্যক্তিত্বের পূর্ণতার অভিব্যক্তিতে পরিণত হইবে।’
প্রিয় পাঠক-পাঠিকা, আসুন, আমরা দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ শুরু করি। বিদেশি সাংস্কৃতিক পণ্য পরিহার করে দেশীয় সাংস্কৃতিক ধারা প্রাণবান করি। আমরা উপলব্ধি করি চরম সত্যটি, রাষ্ট্রের যেহেতু ঝোঁক হচ্ছে নাগরিকদের চাওয়া-পাওয়াকে উপেক্ষা করা, সেহেতু আমরা গ্রামসমাজকে শক্তিশালী করি। কৃষিব্যবস্থা ও তার পাশাপাশি চাহিদামতো কুটিরশিল্প গড়ে তুলি। আধুনিক অতিপ্রয়োজনীয় প্রযুক্তির জন্য বিদেশিদের দ্বারস্থ হওয়ার যে বাধ্যবাধকতা ছিল, তা থেকে মুক্তি পাওয়ার সম্ভাবনার পথ অধ্যাপক কামরুল আলম দেখিয়েছেন। আশা করা যায়, আরও অনেকে দেখাবেন। বাহাত্তরের সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতিগুলো বাস্তবায়ন করি। সার্থক করে তুলি জাতীয় সংগীতের চরণগুলো: ‘কী শোভা কী ছায়া গো, কী স্নেহ, কী মায়া গো, কী আঁচল বিছায়েছ বটের মূলে, নদীর কূলে কূলে।’
বিচারপতি মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী: অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, আপিল বিভাগ, সুপ্রিম কোর্ট।
No comments