একটি সমন্বিত স্বাস্থ্যনীতির পূর্বশর্ত by ইশতিয়াক আহমদ

১৯৮২ সালের ওষুধনীতির একটি দূরদর্শী লক্ষ্য ছিল দেশীয় প্রেক্ষাপটে রোগের প্রাদুর্ভাব অনুযায়ী অতি প্রয়োজনীয় ওষুধের তালিকা তৈরি করে ব্যবসায়িক দিকের চেয়ে ব্যবহারিক মূল্যকে প্রাধান্য দিয়ে তার উত্পাদন নিশ্চিত করা; তৃণমূল পর্যায়ে জনগণের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সরকারি তত্ত্বাবধানে একটি সমন্বিত ওষুধ কারখানা স্থাপন করা— ‘অ্যাসেনশিয়াল ড্রাগ ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি’ বা সংক্ষেপে ‘ইডিসিএল’ প্রতিষ্ঠার এই হচ্ছে প্রকৃত ইতিহাস।
কিন্তু পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, দীর্ঘ ২৪ বছরেও সংস্থাটি থেকে অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের একটি তালিকা (অ্যাসেনশিয়াল ড্রাগলিস্ট) তৈরি করা যায়নি। দেশের সরকারি হাসপাতালে সাধারণ অ্যান্টিবায়োটিকসহ কতিপয় ওষুধ সরবরাহের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট কতিপয় প্রভাবশালীর স্বার্থরক্ষা ছাড়া গঠনমূলক কর্মকাণ্ডে ইডিসিএলের কোনো কার্যকর ভূমিকা নেই। জনগুরুত্বপূর্ণ এই সংস্থাটির চরিত্রের আবর্তন ও বিবর্তন ঘটেছে সরকার পরিবর্তনের ধারার সঙ্গে রাজনৈতিক দাপটে, প্রয়োজনের তাগিদে নয়। অতিক্রান্ত সময়গুলোতে জনগুরুত্বপূর্ণ সংস্থাটির অবস্থান, উচ্চপর্যায়ের নীতিনির্ধারকদের ‘উদাসীনতা’ এবং এর পরিচালকদের প্রবেশ-প্রস্থানের ইতিহাস দেখলেই তা বোঝা যায়।
১৯৮২ সালে স্বাস্থ্যনীতির আগে দেশে ওষুধনীতি এসেছে। এর পেছনে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের কর্মকাণ্ডের এক দীর্ঘ ইতিহাস জড়িত। এই দুরূহ কাজটির যাত্রা শুরু হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ১৯৭৩ সালের জুলাই থেকে। ওষুধের ঢালাও আমদানি কমিয়ে শুধু অত্যাবশ্যকীয় ওষুধ আমদানি এবং প্রয়োজনীয় অন্যান্য ওষুধপত্র স্থানীয়ভাবে উত্পাদন করার পরিবেশ তৈরি করতে বঙ্গবন্ধু তাঁর ব্যক্তিগত চিকিত্সককে প্রধান করে ওষুধবিষয়ক একটি কমিটি গঠন করে দিয়েছিলেন। ’৭৫-এর ১৫ আগস্টের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর রাজনৈতিক উত্থান-পতন, ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে ১৯৮২ সালে জাতীয় অধ্যাপক নুরুল ইসলামের নেতৃত্বে জাফরউল্লাহসহ অন্য ওষুধ বিশেষজ্ঞরা ওষুধনীতি তৈরির প্রক্রিয়াটির অসমাপ্ত কাজটুকু অকল্পনীয় গোপনীয়তার মাধ্যমে সম্পন্ন করেন এবং নানা প্রতিকূল পরিস্থিতি ঠেলে তা প্রয়োগও করেন। বাংলাদেশে বর্তমানে স্থানীয় ওষুধ শিল্পের বিকাশ এবং এর সাফল্যের পেছনে ১৯৮২ সালের ওষুধনীতির অবদান অস্বীকার করার অবকাশ নেই। কিন্তু দুঃখের বিষয়, ২০০৫ সালে যুগোপযোগিতার নামে এই ওষুধনীতির গণমুখী চরিত্রকে নষ্ট করা হয়েছে।
একটি সমন্বিত স্বাস্থ্যনীতির পূর্বশর্ত হওয়া উচিত স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রগুলো নির্ধারণ করা। সর্বস্তরের জনগণের জন্য চিকিত্সাসেবা নিশ্চিত করতে হলে তার প্রয়োগ পদ্ধতির সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করে কয় স্তরে একে ভাগ করা প্রয়োজন। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দরিদ্র দেশের পক্ষে সব মানুষের জন্য বিনামূল্যে সকল প্রকার চিকিত্সাসেবা প্রদান সম্ভব নয় এবং দুঃসাধ্যও বটে। কিন্তু গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সরকার সবার জন্য সাধারণভাবে এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠী, নিম্ন আয়ের ও নিম্নবিত্ত মানুষের জন্য বিশেষভাবে মৌলিক চিকিত্সাসেবার নিশ্চয়তা এবং তার মানোন্নয়ন করতে সাংবিধানিকভাবে দায়বদ্ধ। সংবিধানে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিত্সা ও শিক্ষার সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অঙ্গীকার করা হলেও অর্থনৈতিক কারণে তার সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা করা হয় না। স্বাস্থ্যনীতির ক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের গণমুখী অবস্থান কার্যকরের লক্ষ্যে এর দিকনির্দেশনার ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলোর ক্ষেত্রগুলোকে চিহ্নিত করে এর বাস্তবসম্মত সমাধান অত্যন্ত জরুরি।
সরকারিভাবে না হলেও প্রাইভেট সেক্টরে সাধারণ ও বিশেষায়িত হাসপাতালের সংখ্যা বাংলাদেশে বাড়ছে। কিন্তু এর স্থাপনা বিভাগীয় শহরের চেয়ে আশঙ্কাজনকভাবে কেন্দ্রমুখী। ক্যানসারের চিকিত্সা, বাইপাস সার্জারি, কিডনি প্রতিস্থাপন ইত্যাদি জটিল চিকিত্সা ও অস্ত্রোপচারের জন্য আগের তুলনায় কম রোগী এখন বিদেশ যাচ্ছে। যদিও মনস্তাত্ত্বিকভিত্তিক এখনো চিকিত্সাসেবায় গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না, তবুও অনেক ক্ষেত্রে এসব চিকিত্সাসেবা বিদেশের তুলনায় কম মূল্যে এখন দেশেই পাওয়া সম্ভব হচ্ছে। কিন্তু এসব কর্মকাণ্ডের ওষুধপত্র এবং প্রয়োগ-সহায়ক মেডিকেল জিনিসপত্র যেমন বিশেষায়িত হাসপাতালের সার্জারি, ইমারজেন্সি, আইসিইউ, সিসিইউ ইউনিটগুলোতে প্রতিনিয়ত যেসব জীবনরক্ষাকারী ওষুধ, উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন বিভিন্ন গোত্রের অ্যান্টিবায়োটিক, অঙ্গ প্রতিস্থাপনসংক্রান্ত ওষুধ, ওষুধ প্রয়োগসহায়ক সামগ্রী এবং মেডিকেল যন্ত্রপাতি দরকার তার বেশির ভাগই আমদানিনির্ভর। আমদানি জটিলতা ইত্যাদির কারণে তাই এর বেশির ভাগ ওষুধ চোরাই পথে দেশে ঢুকছে, এবং অতি উচ্চ মূল্যে নিরুপায় জনগোষ্ঠী তা ক্রয় করছে এবং এর কারণে চিকিত্সার মান ও ব্যয়ে অনিয়ন্ত্রিত প্রভাব পড়ছে। এসব প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী তৈরির প্রযুক্তি দেশে থাকলেও এগুলো তৈরি করার উদ্যোগ নেই, কারণ এর ব্যবহারিক চাহিদা কখনো ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে প্রবেশ করে না। এ জন্য উন্নত বিশ্বের মতো প্রয়োজন স্বাস্থ্য ও ওষুধনীতির সমন্বয় করে এর উত্পাদন নিশ্চিত করা।
দেশে এখন আধুনিক প্রযুক্তির ওষুধ তৈরির পরিবেশ বিদ্যমান। পর্যাপ্তসংখ্যক অভিজ্ঞ ওষুধবিদও দেশে আছেন। ক্ষেত্রবিশেষে বিক্ষিপ্তভাবে নিজ উদ্যোগে তাঁরা কাজও করে যাচ্ছেন। বিক্ষিপ্ত উদ্যোগের চেয়ে প্রয়োজন সুষ্ঠু নীতিমালার। রাষ্ট্রসমর্থিত নীতিমালায় অত্যাবশ্যকীয় ওষুধগুলোর তালিকা তৈরি এবং এর উত্পাদনের পাশাপাশি ওষুধ-প্রয়োগ সামগ্রী এবং মেডিকেল যন্ত্রপাতি (বিশেষ করে জরুরি ও উন্নত প্রযুক্তির চিকিত্সাসামগ্রী) তৈরির সমন্বিত একটি পরিকল্পনা স্বাস্থ্যনীতি বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে ইডিসিএলের মাধ্যমে অনায়াসে নেওয়া যেতে পারে। তা ছাড়া এসব অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের কাঁচামাল তৈরি ও ক্ষেত্রবিশেষে জরুরি আমদানি ও ওষুধের মূল্য নির্ধারণে ইডিসিএল এক স্বচ্ছ, সক্রিয় ও বাস্তবসম্মত ভূমিকা রাখতে পারে।
শোনা যায়, গত জোট সরকারের আমলে বগুড়ায় ইডিসিএলের নতুন প্রকল্পে ওষুধ উত্পাদনের অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি স্থাপনের পরিকল্পনা হয়েছিল, যা এখনো সম্পন্ন হয়নি, চলছে। এও শোনা যায়, বিগত সরকারের সীমাহীন দুর্নীতির আঁচড় ইডিসিএলের সর্বাঙ্গে খোদাই হয়ে আছে। কথা হচ্ছে, এত দক্ষযজ্ঞের পরিণতি কী হয়েছে? অত্যাবশ্যকীয় ওষুধ তৈরির কোনো কার্যকর পরিকল্পনা গৃহীত হয়েছে কি?
২০১৫ সালের মধ্যে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য (গ্যাট, ট্রিপস্) চুক্তি বাস্তবায়নের আগে আমাদের দেশে এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া এখনই জরুরি। কালক্ষেপণ হবে আত্মঘাতী। স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) হিসেবে স্বাস্থ্য ও ওষুধ খাত নিয়ে জরুরি ভিত্তিতে ভাবনা-চিন্তার সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। আমাদের উচিত ১. পরিবেশ ভিত্তিতে রোগের ধরন চিহ্নিতকরণ, ২. সঙ্গে তার প্রয়োজনীয় ওষুধের তালিকা প্রণয়ন, ৩. এর উত্পাদন প্রক্রিয়াকে সচল ও কার্যকরকরণ এবং ইডিসিএলের পরিকাঠামোয় অত্যাবশ্যকীয় ওষুধ উত্পাদনের আরএনডি (রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট) সেল গঠন করা। অতি জরুরি এই কর্মকাণ্ডে প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট কাজে যোগ্যতার মাপকাঠিতে পর্যাপ্তসংখ্যক অভিজ্ঞ ওষুধ প্রযুক্তিবিদ নিয়োগ করে দূরদৃষ্টিমূলক একটি পরিকল্পনা তৈরি করা।
সরকারের স্বাস্থ্যসংক্রান্ত রাজনৈতিক ইশতেহার অনুযায়ী দেশের আপামর জনগণের জন্য যে খসড়া স্বাস্থ্যনীতি প্রণীত হয়েছে, তার পরিকাঠামোতে ওষুধবিদদের ভূমিকাকে উপেক্ষা করা হলো কেন? উপজেলাভিত্তিক সমন্বিত স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোতে, সরকারি হাসপাতালে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ডব্লিউএইচও নির্দেশিকা মোতাবেক ওষুধবিদদের নিয়োগনীতির কার্যক্রম কোথায়? এই বিষয়গুলো স্বাস্থ্যনীতি প্রয়োগের আগে গভীরভাবে ভাবার বিষয়। কাজটি দুরূহ বা দুর্বোধ্য নয়। সরকারের সদিচ্ছা ও অনুসরণযোগ্য উন্নয়নশীল দেশের স্বাস্থ্যনীতির প্রয়োগ পদ্ধতির পথ অনুসরণ করে এগোলেই এর পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন সম্ভব।
ইশতিয়াক আহমদ: সভাপতি, ফার্মেসি গ্র্যাজুয়েটস অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ।
sattuka@gmail.comr

No comments

Powered by Blogger.