সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ-খালেদা জিয়ার দিলি্ল সফর এবং রাজনীতির হিসাব-নিকাশ by আবু সাঈদ খান
গণমাধ্যমের চোখে বিরোধী দলের নেতা খালেদা জিয়ার ভারত সফর তাৎপর্যপূর্ণ। বাংলাদেশ-ভারতের সংবাদপত্র ও বৈদ্যুতিন মাধ্যমগুলো সফরের সংবাদ পরিবেশন করে থেমে নেই। এখন পর্যালোচনা ও বিচার-বিশ্লেষণ চলছে।
দুই দেশের কূটনীতি-বিশেষজ্ঞরাও মূল্যায়ন করছেন। তবে ক্ষমতাসীন সরকার এ সফরকে গুরুত্ব দিতে নারাজ। সফরের শুরুতেই পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি বিরোধী দলের নেতার সফরকে 'গুরুত্বহীন' আখ্যায়িত করেছেন। তবে সফরটি নিয়ে দীপু মনিসহ ক্ষমতাসীন জোটের মন্ত্রী-এমপিদের মনোযোগ ও তির্যক মন্তব্যগুলো শুনে মনে হচ্ছে যে, মুখে তারা যা-ই বলুক, বাস্তবে বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গেই নিয়েছেন।
খালেদা জিয়া ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বী দুই প্রধান দলের একটির চেয়ারপারসন ও সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা। দু'বার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। সঙ্গত কারণেই প্রতিবেশী দেশে তার সফর গুরুত্বপূর্ণ। তা আরও গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হচ্ছে এ জন্য যে, তার সফরের মধ্য দিয়ে ভারত সম্পর্কে দলটির নীতিগত অবস্থান নতুন মোড় নিয়েছে বলে প্রতীয়মান। যদিও গতকাল মঙ্গলবার খালেদা জিয়ার সফরসঙ্গী বিএনপি নেতা তরিকুল ইসলাম সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, 'বিএনপি তার নীতি থেকে সরে আসেনি। আগের অবস্থানেই আছে।'
দলটি জন্মলগ্ন থেকে ভারতবিদ্বেষী হিসেবেই চিহ্নিত। তবে প্রচার-প্রচারণায় যতটা ভারতবিরোধী বলে মনে হয়, বাস্তবে সেটির প্রমাণ মেলে না। বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের চেষ্টাই করেছে। অনেক ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থে ছাড় দিয়েও তা করেছে। অথবা বলা যায়, তাদের ছাড় দিতে হয়েছে। বিএনপি প্রকাশ্যে যতটা ভারতবিরোধী, বাস্তবে ততটা নয়। এটি ওপেন সিক্রেট যে, সাম্প্রদায়িক একটি গোষ্ঠীকে ভোটব্যাংক হিসেবে পাওয়ার কৌশল হিসেবে বিএনপি বক্তৃতা-বিবৃতিতে ভারতবিরোধী কার্ড ব্যবহার করে। সেটি সাম্প্রদায়িক ও সংকীর্ণ দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যবহৃত। যা নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ায় সহায়ক হলেও দলটির গণতান্ত্রিক ভাবমূর্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। প্রসঙ্গক্রমে বলা আবশ্যক যে, ভারত-কার্ড ব্যবহার করে অতীতে যতটা ফায়দা অর্জন সম্ভব হয়েছিল, এখন ততটা সম্ভব নয়। বিষয়টি ক্রমেই থিতিয়ে পড়ছে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে সাম্প্রদায়িক ও ভারতবিদ্বেষী বক্তব্য দিয়ে খালেদা জিয়াকে সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে। নির্বাচনী প্রচারকালে তিনি যখন বলেছিলেন, নৌকায় ভোট দিলে উলুধ্বনি শোনা যাবে। ফেনী পর্যন্ত ভারত দখল করে নেবে, তখন এ বক্তব্যে নতুন শিক্ষিত প্রজন্ম, দলনিরপেক্ষ ব্যাপক জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়েছিল। তখন থেকেই বিএনপির সমর্থক বুদ্ধিজীবীদের একাংশ প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে বিএনপিকে সাম্প্রদায়িক ও ভারতবিরোধী কার্ড না খেলার পরামর্শ দিয়ে আসছিলেন।
এমন প্রেক্ষাপটে খালেদা জিয়া ভারত সফরকালে ভারতকে ট্রানজিট ও বন্দর ব্যবহারের ক্ষেত্রে তার ইতিবাচক মনোভাব ব্যক্ত করেছেন। এ ক্ষেত্রে বিএনপির অবস্থান ছিল বরাবরই নেতিবাচক। বিভিন্ন সময়ে বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে বলা হয়েছে যে, ভারতকে বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না। সেটি ছিল ভারতকে ট্রানজিট-ট্রানশিপমেন্ট দেওয়ার ক্ষেত্রে বড় হুমকি। তাছাড়া বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে উত্তর-পূর্ব ভারতের উলফাসহ বিভিন্ন সশস্ত্র গ্রুপকে বাংলাদেশে আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ আছে। এবার দিলি্ল সফরে গিয়ে খালেদা জিয়া অঙ্গীকার করেছেন, আগামীতে ভারতবিরোধী কোনো কর্মকাণ্ডে বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না। ভারতের পক্ষ থেকে এই দুটি প্রতিশ্রুতি পাওয়াটাই গুরুত্বপূর্ণ।
কেবল বিএনপির নীতিগত পরিবর্তনই খালেদার সফরের গুরুত্ব বাড়ায়নি, এখানে ভারতের দৃষ্টিভঙ্গিগত পরিবর্তনও লক্ষণীয়। বরাবরই ভারত বিশেষ করে কংগ্রেস ও এর নেতৃত্বাধীন সরকার আওয়ামী লীগকে মিত্র বিবেচনা করে এসেছে। এর ঐতিহাসিক পটভূমি রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে এই বন্ধুত্বের ভিত তৈরি হয়। তবে দুটি দেশেই বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা রয়েছে। সে ক্ষেত্রে সম্পর্ক হওয়া উচিত ছিল বহুমাত্রিক। দু'দেশের জনপ্রতিনিধিত্বশীল দলগুলোসহ রাষ্ট্রিক পর্যায়ে সম্পর্কোন্নয়ন জরুরি। ভারত সম্পর্কোন্নয়নে এই নীতিগত অবস্থান গ্রহণ করায় কিছুদিন আগে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদও দিলি্লর আমন্ত্রণে ভারত সফর করেছেন। ভারত এখন এক ঝুড়িতে সব ডিম রাখতে নারাজ।
বলা যায়, পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে খালেদা জিয়া ও মনমোহন সিং উভয়েই পরস্পরের দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে রেখেছিলেন। খালেদা জিয়ার সফরের মধ্য দিয়ে সেটির এক ধাপ অগ্রগতি ঘটল। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এটি কি বন্ধুত্ব প্রদর্শনের মঞ্চায়ন, না বাস্তব উপলব্ধি?
বিএনপির সঙ্গে বন্ধুত্বের হাত বাড়ালেও আওয়ামী লীগকে আহত করতে চায়নি ক্ষমতাসীন ইউপিএ সরকার। তাই ইউপিএ ও কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী খালেদার সঙ্গে সাক্ষাৎ না করে বুঝিয়েছেন, কংগ্রেসের সঙ্গে আওয়ামী লীগের যে বন্ধুত্ব রয়েছে, তাতে অন্য কাউকে ভাগ বসাতে দেওয়া হয়নি। আর খালেদা জিয়াকে বুঝিয়েছেন, বন্ধুত্ব গাঢ় করতে আরও বোঝাপড়া দরকার। বাংলাদেশ ও ভারতের পর্যবেক্ষকরাও বলেছেন, খালেদা জিয়া অতীতে ভারতবিরোধী যে কার্ড খেলেছেন, হাওয়া বুঝে ভবিষ্যতে সেই কার্ড খেলবেন না তার গ্যারান্টি কই? বিএনপি রিজার্ভ ভোটব্যাংক গোছাতে অবস্থান বদলাবে কি-না, সেটিই দেখার বিষয়।
বলাবাহুল্য, খালেদা জিয়ার এই উপলব্ধি হঠাৎ করে ঘটেছে_ এমনটা নয়। তবে আকস্মিকভাবেই ভারতের মাটিতে তার এই পরিবর্তিত মনোভাবের কথা প্রকাশিত হয়েছে। এতে বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যে ইতি ও নেতি দুই ধরনের প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে। একাংশ এ অবস্থানকে বিএনপির জন্য আত্মঘাতীও মনে করছে। অপর অংশ বলছে, পুরনো ওই খেলা এ দেশে চলবে না। নেত্রী সময়োচিত পদক্ষেপ নিয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে বলা আবশ্যক যে, আওয়ামী লীগের সঙ্গে ভারতের দীর্ঘদিনের বন্ধুত্বের সম্পর্ক থাকার পরও তাদের শাসনামলে ভারতের কাছ থেকে অর্জন সামান্যই। আমাদের ভুলে যাওয়ার কথা নয় যে, এর আগে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে অধিকার ও ন্যায্যতার ভিত্তিতে গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি হয়। পার্বত্য শান্তি চুক্তির ক্ষেত্রে ভারতের সহায়তা ছিল। কিন্তু তখন কংগ্রেস নয়, বাম সমর্থিত দেবগৌড়া সরকার দিলি্লর ক্ষমতায় আসীন। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু চুক্তি সম্পাদনের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। কিন্তু এবার আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর আমরা কী দেখছি? আওয়ামী লীগ ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার করে ভারতের হাতে তুলে দিয়েছে, ট্রানজিট চুক্তি ছাড়াই পুরনো নৌ-চলাচল প্রটোকলের আওতায় বিনা মাশুলেই ভারতকে নৌ ও স্থলপথ ব্যবহারের সুযোগ দিয়েছে, বন্ধুত্ব রক্ষার জন্য অনেক কিছুই করছে এবং বলছে। কিন্তু ভারতের কাছ থেকে প্রাপ্তিযোগ কতটুকু? ভারত তাদের বাজারে গার্মেন্টসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার দিলেও অশুল্ক ও আমলাতান্ত্রিক বাধায় এটি আটকে যাচ্ছে। সীমান্তে রক্তপাত বন্ধ হচ্ছে না। বিএসএফের হাতে বাংলাদেশিরা প্রাণ হারাচ্ছে। বিভিন্ন অজুহাতে মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি বাস্তবায়ন বিলম্বিত করা হচ্ছে। অন্যান্য নদীর পানিপ্রাপ্তির ক্ষেত্রেও অগ্রগতি নেই। বিভিন্ন নদী থেকে ভারতের পানি প্রত্যাহার তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে।
এটি অস্বীকার করার জো নেই যে, জাতীয় স্বার্থরক্ষায় যে কূটনৈতিক দক্ষতা দেখানো দরকার, সরকার তা দেখাতে পারছে না। বন্ধুত্ব মানে নতজানু হওয়া নয়, একতরফা ছাড় দেওয়া নয়। পারস্পরিক বোঝাপড়া ছাড়া বন্ধুত্ব স্থায়ী হয় না। অন্যদিকে বিএনপির নেতিবাচক অবস্থানও ছিল বন্ধুত্বের জন্য বাধা।
খালেদা জিয়ার সফরের পর ধরে নেওয়া যায়, উভয় প্রধান দলই ভারতের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের বিষয়টি ইতিবাচকভাবে দেখছে। আর এটি যদি দেশের সামগ্রিক কল্যাণের পক্ষে হয়, তবে তা সাধুবাদযোগ্য। আর তা যদি হীনস্বার্থে ভারতকে খুশি করার জন্য হয়, তবে সেটি দুঃখজনক। এমন কথা চালু রয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র সন্তুষ্ট না থাকলে ক্ষমতায় যাওয়া যায় না। আবার গেলেও নাকি ক্ষমতায় থাকা যায় না। এখন এ-ও ভাবা হচ্ছে, কেবল যুক্তরাষ্ট্র নয়, ক্ষমতায় যেতে ও ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে হলে ভারতকেও খুশি রাখা দরকার। কিন্তু আমাদের অভিজ্ঞতা বলে, বাংলাদেশের জনগণের ভোটেই সরকার পরিবর্তন হয়, অন্য কোনো দেশের খবরদারিতে নয়। প্রসঙ্গক্রমে বলা যায়, এরশাদের পেছনে আন্তর্জাতিক শক্তির সমর্থন থাকার পরও তাকে জনগণের চাপে ক্ষমতা ছাড়তে হয়েছিল। ১/১১'র সেনা সমর্থিত সরকারও বিদেশি সমর্থন সত্ত্বেও ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারেনি। তবু এ ধরনের ভ্রান্তিবিলাসে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো আক্রান্ত।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুই দলই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মনোরঞ্জনের প্রতিযোগিতায় রয়েছে, জাতীয় স্বার্থ ছাড় দিয়ে মার্কিন কোম্পানির কাছে তেল-গ্যাস ইজারা দেওয়ার প্রতিযোগিতা করছে। মার্কিন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের কূটনীতিকদের কাছে একে অন্যের বিরুদ্ধে নালিশ করছে, সালিশের আমন্ত্রণ করছে। ভারতের ক্ষেত্রেও দল দুটির সে প্রবণতা দেখা দিলে তা হবে বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় ক্ষতির কারণ।
আজ প্রয়োজন জাতীয় পররাষ্ট্রনীতি। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক অঙ্গনে ঐকমত্য থাকতে হবে। সরকার ও বিরোধী দলকে একই অবস্থান থেকে একই সুরে কথা বলতে হবে। এ ক্ষেত্রে পররাষ্ট্র বিষয়ক সংসদীয় কমিটি হতে পারে অভিন্ন ভারত নীতিসহ পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণের উপযুক্ত স্থান। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে সে আলোকেই অগ্রসর হতে হবে। এটিই কূটনৈতিক সাফল্য অর্জনের যৌক্তিক পন্থা; অন্য কোনো উপায়ে তা সম্ভব নয়।
আবু সাঈদ খান : সাংবাদিক
ask_bangla71@yahoo.com
www.abusayeedkhan.com
খালেদা জিয়া ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বী দুই প্রধান দলের একটির চেয়ারপারসন ও সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা। দু'বার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। সঙ্গত কারণেই প্রতিবেশী দেশে তার সফর গুরুত্বপূর্ণ। তা আরও গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হচ্ছে এ জন্য যে, তার সফরের মধ্য দিয়ে ভারত সম্পর্কে দলটির নীতিগত অবস্থান নতুন মোড় নিয়েছে বলে প্রতীয়মান। যদিও গতকাল মঙ্গলবার খালেদা জিয়ার সফরসঙ্গী বিএনপি নেতা তরিকুল ইসলাম সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, 'বিএনপি তার নীতি থেকে সরে আসেনি। আগের অবস্থানেই আছে।'
দলটি জন্মলগ্ন থেকে ভারতবিদ্বেষী হিসেবেই চিহ্নিত। তবে প্রচার-প্রচারণায় যতটা ভারতবিরোধী বলে মনে হয়, বাস্তবে সেটির প্রমাণ মেলে না। বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের চেষ্টাই করেছে। অনেক ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থে ছাড় দিয়েও তা করেছে। অথবা বলা যায়, তাদের ছাড় দিতে হয়েছে। বিএনপি প্রকাশ্যে যতটা ভারতবিরোধী, বাস্তবে ততটা নয়। এটি ওপেন সিক্রেট যে, সাম্প্রদায়িক একটি গোষ্ঠীকে ভোটব্যাংক হিসেবে পাওয়ার কৌশল হিসেবে বিএনপি বক্তৃতা-বিবৃতিতে ভারতবিরোধী কার্ড ব্যবহার করে। সেটি সাম্প্রদায়িক ও সংকীর্ণ দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যবহৃত। যা নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ায় সহায়ক হলেও দলটির গণতান্ত্রিক ভাবমূর্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। প্রসঙ্গক্রমে বলা আবশ্যক যে, ভারত-কার্ড ব্যবহার করে অতীতে যতটা ফায়দা অর্জন সম্ভব হয়েছিল, এখন ততটা সম্ভব নয়। বিষয়টি ক্রমেই থিতিয়ে পড়ছে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে সাম্প্রদায়িক ও ভারতবিদ্বেষী বক্তব্য দিয়ে খালেদা জিয়াকে সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে। নির্বাচনী প্রচারকালে তিনি যখন বলেছিলেন, নৌকায় ভোট দিলে উলুধ্বনি শোনা যাবে। ফেনী পর্যন্ত ভারত দখল করে নেবে, তখন এ বক্তব্যে নতুন শিক্ষিত প্রজন্ম, দলনিরপেক্ষ ব্যাপক জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়েছিল। তখন থেকেই বিএনপির সমর্থক বুদ্ধিজীবীদের একাংশ প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে বিএনপিকে সাম্প্রদায়িক ও ভারতবিরোধী কার্ড না খেলার পরামর্শ দিয়ে আসছিলেন।
এমন প্রেক্ষাপটে খালেদা জিয়া ভারত সফরকালে ভারতকে ট্রানজিট ও বন্দর ব্যবহারের ক্ষেত্রে তার ইতিবাচক মনোভাব ব্যক্ত করেছেন। এ ক্ষেত্রে বিএনপির অবস্থান ছিল বরাবরই নেতিবাচক। বিভিন্ন সময়ে বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে বলা হয়েছে যে, ভারতকে বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না। সেটি ছিল ভারতকে ট্রানজিট-ট্রানশিপমেন্ট দেওয়ার ক্ষেত্রে বড় হুমকি। তাছাড়া বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে উত্তর-পূর্ব ভারতের উলফাসহ বিভিন্ন সশস্ত্র গ্রুপকে বাংলাদেশে আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ আছে। এবার দিলি্ল সফরে গিয়ে খালেদা জিয়া অঙ্গীকার করেছেন, আগামীতে ভারতবিরোধী কোনো কর্মকাণ্ডে বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না। ভারতের পক্ষ থেকে এই দুটি প্রতিশ্রুতি পাওয়াটাই গুরুত্বপূর্ণ।
কেবল বিএনপির নীতিগত পরিবর্তনই খালেদার সফরের গুরুত্ব বাড়ায়নি, এখানে ভারতের দৃষ্টিভঙ্গিগত পরিবর্তনও লক্ষণীয়। বরাবরই ভারত বিশেষ করে কংগ্রেস ও এর নেতৃত্বাধীন সরকার আওয়ামী লীগকে মিত্র বিবেচনা করে এসেছে। এর ঐতিহাসিক পটভূমি রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে এই বন্ধুত্বের ভিত তৈরি হয়। তবে দুটি দেশেই বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা রয়েছে। সে ক্ষেত্রে সম্পর্ক হওয়া উচিত ছিল বহুমাত্রিক। দু'দেশের জনপ্রতিনিধিত্বশীল দলগুলোসহ রাষ্ট্রিক পর্যায়ে সম্পর্কোন্নয়ন জরুরি। ভারত সম্পর্কোন্নয়নে এই নীতিগত অবস্থান গ্রহণ করায় কিছুদিন আগে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদও দিলি্লর আমন্ত্রণে ভারত সফর করেছেন। ভারত এখন এক ঝুড়িতে সব ডিম রাখতে নারাজ।
বলা যায়, পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে খালেদা জিয়া ও মনমোহন সিং উভয়েই পরস্পরের দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে রেখেছিলেন। খালেদা জিয়ার সফরের মধ্য দিয়ে সেটির এক ধাপ অগ্রগতি ঘটল। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এটি কি বন্ধুত্ব প্রদর্শনের মঞ্চায়ন, না বাস্তব উপলব্ধি?
বিএনপির সঙ্গে বন্ধুত্বের হাত বাড়ালেও আওয়ামী লীগকে আহত করতে চায়নি ক্ষমতাসীন ইউপিএ সরকার। তাই ইউপিএ ও কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী খালেদার সঙ্গে সাক্ষাৎ না করে বুঝিয়েছেন, কংগ্রেসের সঙ্গে আওয়ামী লীগের যে বন্ধুত্ব রয়েছে, তাতে অন্য কাউকে ভাগ বসাতে দেওয়া হয়নি। আর খালেদা জিয়াকে বুঝিয়েছেন, বন্ধুত্ব গাঢ় করতে আরও বোঝাপড়া দরকার। বাংলাদেশ ও ভারতের পর্যবেক্ষকরাও বলেছেন, খালেদা জিয়া অতীতে ভারতবিরোধী যে কার্ড খেলেছেন, হাওয়া বুঝে ভবিষ্যতে সেই কার্ড খেলবেন না তার গ্যারান্টি কই? বিএনপি রিজার্ভ ভোটব্যাংক গোছাতে অবস্থান বদলাবে কি-না, সেটিই দেখার বিষয়।
বলাবাহুল্য, খালেদা জিয়ার এই উপলব্ধি হঠাৎ করে ঘটেছে_ এমনটা নয়। তবে আকস্মিকভাবেই ভারতের মাটিতে তার এই পরিবর্তিত মনোভাবের কথা প্রকাশিত হয়েছে। এতে বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যে ইতি ও নেতি দুই ধরনের প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে। একাংশ এ অবস্থানকে বিএনপির জন্য আত্মঘাতীও মনে করছে। অপর অংশ বলছে, পুরনো ওই খেলা এ দেশে চলবে না। নেত্রী সময়োচিত পদক্ষেপ নিয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে বলা আবশ্যক যে, আওয়ামী লীগের সঙ্গে ভারতের দীর্ঘদিনের বন্ধুত্বের সম্পর্ক থাকার পরও তাদের শাসনামলে ভারতের কাছ থেকে অর্জন সামান্যই। আমাদের ভুলে যাওয়ার কথা নয় যে, এর আগে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে অধিকার ও ন্যায্যতার ভিত্তিতে গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি হয়। পার্বত্য শান্তি চুক্তির ক্ষেত্রে ভারতের সহায়তা ছিল। কিন্তু তখন কংগ্রেস নয়, বাম সমর্থিত দেবগৌড়া সরকার দিলি্লর ক্ষমতায় আসীন। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু চুক্তি সম্পাদনের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। কিন্তু এবার আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর আমরা কী দেখছি? আওয়ামী লীগ ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার করে ভারতের হাতে তুলে দিয়েছে, ট্রানজিট চুক্তি ছাড়াই পুরনো নৌ-চলাচল প্রটোকলের আওতায় বিনা মাশুলেই ভারতকে নৌ ও স্থলপথ ব্যবহারের সুযোগ দিয়েছে, বন্ধুত্ব রক্ষার জন্য অনেক কিছুই করছে এবং বলছে। কিন্তু ভারতের কাছ থেকে প্রাপ্তিযোগ কতটুকু? ভারত তাদের বাজারে গার্মেন্টসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার দিলেও অশুল্ক ও আমলাতান্ত্রিক বাধায় এটি আটকে যাচ্ছে। সীমান্তে রক্তপাত বন্ধ হচ্ছে না। বিএসএফের হাতে বাংলাদেশিরা প্রাণ হারাচ্ছে। বিভিন্ন অজুহাতে মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি বাস্তবায়ন বিলম্বিত করা হচ্ছে। অন্যান্য নদীর পানিপ্রাপ্তির ক্ষেত্রেও অগ্রগতি নেই। বিভিন্ন নদী থেকে ভারতের পানি প্রত্যাহার তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে।
এটি অস্বীকার করার জো নেই যে, জাতীয় স্বার্থরক্ষায় যে কূটনৈতিক দক্ষতা দেখানো দরকার, সরকার তা দেখাতে পারছে না। বন্ধুত্ব মানে নতজানু হওয়া নয়, একতরফা ছাড় দেওয়া নয়। পারস্পরিক বোঝাপড়া ছাড়া বন্ধুত্ব স্থায়ী হয় না। অন্যদিকে বিএনপির নেতিবাচক অবস্থানও ছিল বন্ধুত্বের জন্য বাধা।
খালেদা জিয়ার সফরের পর ধরে নেওয়া যায়, উভয় প্রধান দলই ভারতের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের বিষয়টি ইতিবাচকভাবে দেখছে। আর এটি যদি দেশের সামগ্রিক কল্যাণের পক্ষে হয়, তবে তা সাধুবাদযোগ্য। আর তা যদি হীনস্বার্থে ভারতকে খুশি করার জন্য হয়, তবে সেটি দুঃখজনক। এমন কথা চালু রয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র সন্তুষ্ট না থাকলে ক্ষমতায় যাওয়া যায় না। আবার গেলেও নাকি ক্ষমতায় থাকা যায় না। এখন এ-ও ভাবা হচ্ছে, কেবল যুক্তরাষ্ট্র নয়, ক্ষমতায় যেতে ও ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে হলে ভারতকেও খুশি রাখা দরকার। কিন্তু আমাদের অভিজ্ঞতা বলে, বাংলাদেশের জনগণের ভোটেই সরকার পরিবর্তন হয়, অন্য কোনো দেশের খবরদারিতে নয়। প্রসঙ্গক্রমে বলা যায়, এরশাদের পেছনে আন্তর্জাতিক শক্তির সমর্থন থাকার পরও তাকে জনগণের চাপে ক্ষমতা ছাড়তে হয়েছিল। ১/১১'র সেনা সমর্থিত সরকারও বিদেশি সমর্থন সত্ত্বেও ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারেনি। তবু এ ধরনের ভ্রান্তিবিলাসে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো আক্রান্ত।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুই দলই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মনোরঞ্জনের প্রতিযোগিতায় রয়েছে, জাতীয় স্বার্থ ছাড় দিয়ে মার্কিন কোম্পানির কাছে তেল-গ্যাস ইজারা দেওয়ার প্রতিযোগিতা করছে। মার্কিন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের কূটনীতিকদের কাছে একে অন্যের বিরুদ্ধে নালিশ করছে, সালিশের আমন্ত্রণ করছে। ভারতের ক্ষেত্রেও দল দুটির সে প্রবণতা দেখা দিলে তা হবে বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় ক্ষতির কারণ।
আজ প্রয়োজন জাতীয় পররাষ্ট্রনীতি। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক অঙ্গনে ঐকমত্য থাকতে হবে। সরকার ও বিরোধী দলকে একই অবস্থান থেকে একই সুরে কথা বলতে হবে। এ ক্ষেত্রে পররাষ্ট্র বিষয়ক সংসদীয় কমিটি হতে পারে অভিন্ন ভারত নীতিসহ পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণের উপযুক্ত স্থান। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে সে আলোকেই অগ্রসর হতে হবে। এটিই কূটনৈতিক সাফল্য অর্জনের যৌক্তিক পন্থা; অন্য কোনো উপায়ে তা সম্ভব নয়।
আবু সাঈদ খান : সাংবাদিক
ask_bangla71@yahoo.com
www.abusayeedkhan.com
No comments