মুক্তিযুদ্ধ- মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার by সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
অঙ্গীকারটা কি ছিল মুক্তিযুদ্ধের? ছিল মুক্তির, সে জন্যই যুদ্ধ, মুক্তির জন্য? শেখ মুজিব ৭ মার্চের সেই বিশাল জনসমাবেশে বলেছিলেন, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম। মুক্তির ডাকে পাকিস্তানি শাসকরা বিচলিত হতো না, বিচলিত হয়েছে তারা স্বাধীনতার ডাকে। মুক্তি লম্বা ব্যাপার, মূর্তও নয়, তার সংগ্রাম চলছে, চলবে, চলতে থাকুক; তাতে আশু কোনো বিপদ নেই শাসকদের জন্য।
কিন্তু স্বাধীনতা মূর্ত, প্রত্যক্ষ। স্বাধীনতা রাষ্ট্রকে ভেঙে দেবে। দিলে শাসকরা থাকবে না। তাদের পক্ষে বিচলিত হওয়ার কারণ ছিল বৈকি! রাষ্ট্র চলে গেলে তারা কোথায় যাবে? তারপর রাষ্ট্র সত্যি সত্যি ভেঙেছে। কিন্তু মুক্তি? মুক্তি তো আসেনি। বরঞ্চ চতুর্দিকে বন্ধন আরো কঠিন হয়ে উঠেছে। সবার জন্য নয় অবশ্য, তবে অধিকাংশের জন্যই। সাম্রাজ্যবাদের আবেষ্টনীর মধ্যে চলে গেছে বাংলাদেশ! স্বাধীনতার প্রাক্কালে তাজউদ্দীন আহমদ বলেছিলেন, বাংলাদেশ মার্কিন সাহায্য নেবে না। সেটা ছিল মুক্তিযুদ্ধের কথা। ফিরে এসে শেখ মুজিব বলেছেন, মার্কিন সাহায্য নেব, তবে শর্ত থাকবে না। সেটা ছিল পরবর্তী বাস্তবতার প্রকাশ। বাস্তবতা ক্রমশ নিষ্ঠুর আকারে প্রকাশ পেয়েছে। সাহায্য কখনোই শর্তহীন হয় না; ক্রমান্বয়ে তাই আরো বেশি আবদ্ধ হয়ে পড়েছে বাংলাদেশ, সাহায্য শর্তের জালে। মহাজনের গ্রাসে দরিদ্র কৃষকের মতো।
কিন্তু স্বাধীনতা মূর্ত, প্রত্যক্ষ। স্বাধীনতা রাষ্ট্রকে ভেঙে দেবে। দিলে শাসকরা থাকবে না। তাদের পক্ষে বিচলিত হওয়ার কারণ ছিল বৈকি! রাষ্ট্র চলে গেলে তারা কোথায় যাবে? তারপর রাষ্ট্র সত্যি সত্যি ভেঙেছে। কিন্তু মুক্তি? মুক্তি তো আসেনি। বরঞ্চ চতুর্দিকে বন্ধন আরো কঠিন হয়ে উঠেছে। সবার জন্য নয় অবশ্য, তবে অধিকাংশের জন্যই। সাম্রাজ্যবাদের আবেষ্টনীর মধ্যে চলে গেছে বাংলাদেশ! স্বাধীনতার প্রাক্কালে তাজউদ্দীন আহমদ বলেছিলেন, বাংলাদেশ মার্কিন সাহায্য নেবে না। সেটা ছিল মুক্তিযুদ্ধের কথা। ফিরে এসে শেখ মুজিব বলেছেন, মার্কিন সাহায্য নেব, তবে শর্ত থাকবে না। সেটা ছিল পরবর্তী বাস্তবতার প্রকাশ। বাস্তবতা ক্রমশ নিষ্ঠুর আকারে প্রকাশ পেয়েছে। সাহায্য কখনোই শর্তহীন হয় না; ক্রমান্বয়ে তাই আরো বেশি আবদ্ধ হয়ে পড়েছে বাংলাদেশ, সাহায্য শর্তের জালে। মহাজনের গ্রাসে দরিদ্র কৃষকের মতো।
এককথায় বলতে গেলে, অঙ্গীকার ছিল দারিদ্র্য থেকে মুক্তিরই। জতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র_সবই ওই লক্ষ্যের অন্তর্ভুক্ত। সমাজতন্ত্রই ছিল শেষ কথা। কিন্তু সে লক্ষ্য থেকেও আমরা দূরে সরে এসেছি। এর আগে ওই শেষ কথা এমন সর্বজনীন হয়নি। আওয়ামী লীগকে আর যাই বলা যাক, সমাজতন্ত্রী বলার উপায় ছিল না। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সময় সমাজতন্ত্রের অঙ্গীকার তাকে করতে হয়েছে। কেননা যে লক্ষ্যে যুদ্ধ হচ্ছিল তা অর্জন সমাজতন্ত্র ভিন্ন অন্য কোনো পথে সম্ভবপর যে নয়, তা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল সবার জন্য। পুঁজিবাদের পথ অনুসরণ করতে হলে পাকিস্তানের কাঠামোতেই তা সম্ভব ছিল, জনগণ উর্দুভাষী পুঁজিপতিদের জায়গায় বাংলাভাষী পুঁজিপতিদের প্রতিষ্ঠা করার জন্য লড়াই করেনি, তারা লড়েছে শোষণ থেকে মুক্ত হয়ে নিজেদের জীবনকে সুন্দর করার জন্য।
দারিদ্র্য দূর হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের আসল পরাজয় সেখানে। সমাজে রাজাকাররা পুনর্বাসিত হলো। মৌলবাদ হিংস্র হয়ে উঠল। সবই সত্য। কিন্তু এগুলো রোগ নয়, রোগের লক্ষণ। রোগটা হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার ছিল দারিদ্র্যমুক্ত, শোষণহীন, সমতাভিত্তিক সমাজ গড়ে তোলা_তা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়নি। বৈষম্য বেড়েছে। সবচেয়ে নিষ্ঠুর শোষণ হচ্ছে শ্রম-শোষণ। তাই ঘটছে বাংলাদেশে। শ্রম শোষিত হচ্ছে। উৎপাদনের ক্ষেত্রে শ্রমশক্তির যা করার, তা সে করতে পারছে না। উৎপাদন যতটা না বেড়েছে দারিদ্র্য বেড়েছে এর চেয়ে বেশি।
যতই বাড়িয়ে কিংবা কমিয়ে বলি, বিশ্বে আমাদের পরিচিতি দুই কারণে_এক. মুক্তিযুদ্ধ, দুই. দারিদ্র্য। একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধা-পরিচয়টি প্রধান হয়ে উঠেছিল। সে জন্য গৌরব ও সম্মান ছিল আমাদের, অত দুঃখ-দুর্দশা ও যন্ত্রণার মধ্যেও। পরে দ্বিতীয় পরিচয়টিই একমাত্র পরিচয় হয়ে দাঁড়ায়।
দারিদ্র্যকে কেউ পছন্দ করে না, ভিক্ষুক মনে করে। দারিদ্র্য মুক্তিকে গ্রাস করে ফেলেছে। মূল অঙ্গীকারের পথে স্বাধীনতা ছিল প্রথম পদক্ষেপ। সেটি অর্জিত না হওয়ায় স্বাধীনতাও তাৎপর্যপূর্ণ উঠতে পারছে না। দীর্ঘকাল আমরা পরাধীন ছিলাম। পরাধীনতা বড় মারাত্মক বস্তু। সে স্বাধীনতার মস্ত শত্রু। যে পাখি খাঁচায় ছিল অনেককাল, সে আকাশ ভুলেছে, গাছ চেনে না, উড়তে জানে না। তাকে ছেড়ে দিলে সে বিপদে পড়ে। কিন্তু এর জন্য দায়ী কে? কার ব্যর্থতায় এ পরিণতি? প্রধান দায়িত্ব অবশ্যই নেতৃত্বের।
একাত্তরে দক্ষিণপন্থীরা ছিল পাকিস্তানের সমর্থক। তারা অন্য কিছু করেনি, সংগ্রামকে নষ্ট করে দেওয়া ছাড়া। মধ্যপন্থীরা তত দূর এগিয়েছে যত দূর তাদের এগোবার কথা। তার অধিক আশা করা বৃথা। ১৯৪৭-এ যখন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়, সে সময় একটি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল বাংলার একটি স্বতন্ত্র ও স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার। উদ্যোগটা দক্ষিণপন্থীরা নিয়েছিল। মাউন্টব্যাটেন বলেছেন তাঁর স্মৃতিকথায়, তিনি খুব ভয়ে ভয়ে ছিলেন যে আর যাই হোক কলকাতার দাবি বাংলার মুসলমানরা ছাড়বে না। কেননা কলকাতা গেলে থাকে কী_তিনি ভেবেছেন। বাকিটা তো জলাভূমি, তাঁর ভাষায়। কিন্তু তিনি প্রসন্ন বিস্ময়ের সঙ্গে দেখলেন, মুসলমানরা বঙ্গ বিভাগ মেনে নিল। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর তিনি প্রশংসা করেছেন বাস্তববাদী রাজনীতিক বলে। সোহরাওয়ার্দী মাউন্টব্যাটেনকে বলেছিলেন, বাংলায় তিনি বিদেশি পুঁজির বিনিয়োগ চাইবেন। মধ্যপন্থী নেতৃত্ব ব্যবস্থায় সংশোধনই শুধু আনতে পারে, বিকল্প আনবে না; সাতচলি্লশে বোঝা গিয়েছিল। ১৯৭১-এর পর স্বাধীন বাংলাদেশে যার প্রয়োজন ছিল তা সংশোধন নয়, বিল্পব; সেই বিপ্লবই পারত মুক্তির অঙ্গীকার পূরণ করতে, পারত প্রকৃত অর্থে স্বাধীন করতে মানুষকে।
দক্ষিণপন্থীরা করবে না, মধ্যপন্থীরা চাইলেও পারবে না, পারার কথা বামের। দায়িত্ব ছিল তাদেরই। কিন্তু নানা ঐতিহাসিক কারণে বাম ছিল বিভক্ত, কোথাও আপসকামী; কোথাও বা বিপরীত ব্যাপার_উগ্রপন্থা। বাম পারেনি দায়িত্ব পালন করতে। ফলে দেশ এগিয়েছে, ভিন্ন পথে নয়, বিপরীত পথে। আজকের পৃথিবীতে এমনকি পুঁজিবাদী বিশ্বও স্বীকার করে, উন্নয়ন বলতে মাথাপিছু আয় বোঝায় না, বোঝায় জনগণের অবস্থার উন্নতি। অথচ বাংলাদেশে উন্নয়নের যে আদর্শ প্রতিষ্ঠিত তা জনগণের অবস্থার পরিবর্তন নয়, তা তেলে মাথায় তেল দেওয়ার, অবাধে লুণ্ঠনের। নতুন ব্যবস্থা গড়ে ওঠার পরিবর্তে সেই পুরনো ব্যবস্থাটাই আরো নির্মম হয়ে উঠেছে।
জনগণের ভাগ্য পরিবর্তন জনগণকেই করতে হবে। অন্য কেউ করে দেবে না। সে জন্য জনগণের স্বার্থ রক্ষাকারী রাজনৈতিক সংগঠন প্রয়োজন। বলা বাহুল্য, দক্ষিণপন্থী বা মধ্যপন্থীরা এ সংগঠন গড়ে তুলতে পারবে না, পারবে বামপন্থীরাই। পুঁজিবাদী পথে যে এ দেশের মুক্তি নেই সে আমরা একাত্তরে জেনেছি, পরবর্তী সময়ে ক্রমাগত জানতে পারছি। যথার্থ পথ সমাজতন্ত্রই। ওই অঙ্গীকারের আলোকেই বাংলাদেশের অগ্রগতিকে বিবেচনা করতে হবে, অন্য কোনো মানদণ্ড নেই। গাড়ি যতক্ষণ চলে ততক্ষণই সে গাড়ি থাকে, নইলে সে লোহালক্কড় বটে। মানুষও তাই, যতক্ষণ সে প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়ছে ততক্ষণই মানুষ, নইলে আত্মসমর্পণকারী প্রাণী মাত্র। মুক্তি অবশ্যই আসবে এবং সংগ্রামের মধ্য দিয়েই। কিন্তু প্রশ্ন থাকবে_কবে এবং কিভাবে?
============================
শক্ত ভিত ছাড়া উঁচু ভবন হয় না ট্রেন টু বেনাপোল বনের নাম দুধপুকুরিয়া নথি প্রকাশ অব্যাহত রাখার অঙ্গীকার অ্যাসাঞ্জের ছিটমহলবাসীর নাগরিক অধিকার শিক্ষা আসলে কোনটা জীবন ব্যাকরণঃ হিরালি ন্যাটো ও রাশিয়ার সমঝোতা ইরানের ওপর কি প্রভাব ফেলবে জার্নি বাই ট্রেন পারিষদদলে বলেঃ চরাঞ্চলের ভূমি ব্যবস্থাপনা সচেতন হলে শিশু প্রতিবন্ধী হয় না স্মৃতির জানালায় বিজয়ের মাস বিচারপতিদের সামনে যখন ‘ঘুষ’ কয়লানীতিঃ প্রথম থেকে দশম খসড়ার পূর্বাপর শ্বাপদসংকুল পথ মুক্তিযুদ্ধে গ্রাম ১২ বছর আগে বিষয়টি নিষ্পত্তি হয়েছে চট্টগ্রাম ইপিজেডে সংঘর্ষে নিহত ৪ ড. ইউনূস : প্রতিটি বাংলাদেশির গৌরব জলাভূমিবাসীদের দুনিয়ায় আবার.. আসুন, আমরা গর্বিত নাগরিক হই স্মৃতির শহীদ মির্জা লেন ইয়াংওয়ান গ্রুপের পোশাক কারখানা বন্ধ ট্রানজিটে ১১ খাতের লাভ-ক্ষতির হিসাব শুরু চট্টগ্রামের বনাঞ্চল ছাড়ছে হাতি ট্রেন স্বপ্নের সিঁড়ি বেয়ে জাতীয় শিক্ষানীতি মানবাধিকার লঙ্ঘন ও যুদ্ধাপরাধের বিচার মানবাধিকার লঙ্ঘন দেশে দেশে ক্ষমতা যেভাবে মানবাধিকার আর ন্যায়বিচারের পথ রুদ্ধ করে চাক্কু মারা 'মশা' কাহিনী উল্কির ভেলকি এইচআইভি/এইডস্ উইকিলিকসঃ জুলিয়ান চে গুয়েভারা! তিন কালের সাক্ষী বাবর আলীর ইশকুল এ মাটির মায়ায়
দৈনিক কালের কন্ঠ এর সৌজন্যে
লেখকঃ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
শিক্ষাবিদ ও সমাজ বিশ্লেষক
এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
শক্ত ভিত ছাড়া উঁচু ভবন হয় না ট্রেন টু বেনাপোল বনের নাম দুধপুকুরিয়া নথি প্রকাশ অব্যাহত রাখার অঙ্গীকার অ্যাসাঞ্জের ছিটমহলবাসীর নাগরিক অধিকার শিক্ষা আসলে কোনটা জীবন ব্যাকরণঃ হিরালি ন্যাটো ও রাশিয়ার সমঝোতা ইরানের ওপর কি প্রভাব ফেলবে জার্নি বাই ট্রেন পারিষদদলে বলেঃ চরাঞ্চলের ভূমি ব্যবস্থাপনা সচেতন হলে শিশু প্রতিবন্ধী হয় না স্মৃতির জানালায় বিজয়ের মাস বিচারপতিদের সামনে যখন ‘ঘুষ’ কয়লানীতিঃ প্রথম থেকে দশম খসড়ার পূর্বাপর শ্বাপদসংকুল পথ মুক্তিযুদ্ধে গ্রাম ১২ বছর আগে বিষয়টি নিষ্পত্তি হয়েছে চট্টগ্রাম ইপিজেডে সংঘর্ষে নিহত ৪ ড. ইউনূস : প্রতিটি বাংলাদেশির গৌরব জলাভূমিবাসীদের দুনিয়ায় আবার.. আসুন, আমরা গর্বিত নাগরিক হই স্মৃতির শহীদ মির্জা লেন ইয়াংওয়ান গ্রুপের পোশাক কারখানা বন্ধ ট্রানজিটে ১১ খাতের লাভ-ক্ষতির হিসাব শুরু চট্টগ্রামের বনাঞ্চল ছাড়ছে হাতি ট্রেন স্বপ্নের সিঁড়ি বেয়ে জাতীয় শিক্ষানীতি মানবাধিকার লঙ্ঘন ও যুদ্ধাপরাধের বিচার মানবাধিকার লঙ্ঘন দেশে দেশে ক্ষমতা যেভাবে মানবাধিকার আর ন্যায়বিচারের পথ রুদ্ধ করে চাক্কু মারা 'মশা' কাহিনী উল্কির ভেলকি এইচআইভি/এইডস্ উইকিলিকসঃ জুলিয়ান চে গুয়েভারা! তিন কালের সাক্ষী বাবর আলীর ইশকুল এ মাটির মায়ায়
দৈনিক কালের কন্ঠ এর সৌজন্যে
লেখকঃ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
শিক্ষাবিদ ও সমাজ বিশ্লেষক
এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
No comments