নির্বাচন ও মহত্ত্ব by সৈয়দ আবুল মকসু
মানুষের মহত্ত্ব ও সুকুমার বৃত্তির প্রকাশ সব সময় ঘটে না। যখন-তখন তার হূদয় স্নেহ-মায়া-মমতা ও সৌজন্যে উদ্বেলিত হয় না। বিশেষ বিশেষ সময় তার অন্তর স্নেহ-ভালোবাসায় ভরে যায়। যখন কেউ কোনো নির্বাচনে প্রার্থী হন, তখন ভোটগ্রহণ শেষ হওয়া পর্যন্ত তাঁর মধ্যে থাকে পূর্ণ মাত্রায় মহত্ত্ব, নম্রতা ও সৌজন্যবোধ। যাঁকে পারলে বুকে ছুরি বসিয়ে দেন, তাঁকে বুকে জড়িয়ে ধরেন। যাঁকে সম্ভব হলে গলা টিপে মারেন, তাঁর সঙ্গেও করেন গলাগলি।
নির্বাচনী প্রচারণার সময় ছাড়া সাধারণ সাংসারিক জীবনেও স্নেহ-ভালোবাসা প্রকাশের একটা সময় আছে, বিশেষ জায়গাও দরকার। বুদ্ধিমান মানুষ শাশুড়ির সামনেই শ্যালককে স্নেহ প্রদর্শন করে, আদর করে। শ্যালিকাকে আদর করতে হয় নিরিবিলি জায়গায়। বিশেষ করে স্ত্রীর আড়ালে। ডিজিটাল যুগে নির্বাচনের প্রচারাভিযানে স্নেহ-ভালোবাসা প্রকাশেরও মুহূর্ত আছে। ভোটারের কোলের নাতিটিকে আদর করতে হয় মিডিয়ার ক্যামেরার উপস্থিতিতে।
বস্তিতে ভোটভিক্ষা চাওয়ার সময়ও ক্যামেরা থাকা চাই। সেখানে গিয়ে প্রার্থী কোনো বুড়িকে জড়িয়ে ধরেন। বুড়িকে জড়িয়ে ধরে কোনো সুখ নাই, কিন্তু লাভ আছে। বুড়ির হাতটা টেনে নিজের মাথায় তুলে প্রার্থী বলেন, দোয়া করেন মা। আমার প্রথম কাজই হবে বস্তির আধুনিকায়ন প্রকল্প। বস্তিতে পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাস দেওয়াই আমার পয়লা কাজ।
নির্বাচন নির্বাচনই। তা জাতীয় নির্বাচনই হোক বা মহানগরের স্থানীয় সরকার নির্বাচনই হোক। নির্বাচন ব্যাপারটা চিরকাল ছিল না। যিশু খ্রিস্টের জন্মের তিন-চার হাজার বছর আগে হরপ্পার সভ্যতা-সংস্কৃতি নির্বাচন ছাড়াই সৃষ্টি হয়। হরপ্পার কোনো নির্বাচিত মেয়র ছিলেন বলে মনে হয় না। থাকলে নগর আরও ৫০০ বছর আগে ধ্বংস হতো। নগরের সবচেয়ে শিক্ষিত, যোগ্য ও মর্যাদাসম্পন্ন মানুষই নগর-শাসক মনোনীত হতেন। বাগদাদ, দামেস্ক, ইস্তাম্বুল, কর্ডোভা ও সেভিলে সভ্যতা গড়ে উঠেছিল সেখানকার সেরা মানুষদের সমন্বিত চেষ্টায়। ওইসব নগরের বিদ্বান ও বুদ্ধিজীবীরা রাত জেগে ভোট জোগাড়ের কসরত না করে মহৎ সভ্যতা গড়ে তোলার চেষ্টা করেছেন।
ভোটের বাজারে বিচিত্র কৌশল অবলম্বন নতুন কিছু নয়। ১৯৩৭-এ উপমহাদেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচনের প্রচারকাজ পুরোদমে চলছে। মুসলিম লীগ নেতারা দেখলেন মুহম্মদ আলী জিন্নাহর করোটির ভেতরে মগজ যথেষ্ট, কিন্তু মাথার ওপরটা খালি। জানুয়ারি মাসের উত্তর প্রদেশ। কনকনে শীত। কোনো এক বুদ্ধিমান একটা ভারীমতো টুপি শীর্ণ জিন্নাহর মাথায় এনে বসিয়ে দিলেন। তাতে কাজ হলো দুটো। জিন্নাহর মাথা শৈত্যপ্রবাহ থেকে বাঁচল এবং মুসলমান ভোটারদের বুকটা ভরল। তারা আর্জেন্টিনার সমর্থক দর্শকদের মতো আনন্দে লাফাতে লাগল। টুপিতে এইবার জিন্নাহকে মুসলমানের মতো দেখায়। ভোটাররা বুঝল, ইনিই আমাদের কায়দে আজম। জাতির নেতা। টুপির কারণে জিন্নাহর নতুন নাম হলো কায়দে আজম। ওদিকে অজ্ঞাত টুপিটি পেল নতুন নাম: জিন্নাহ ক্যাপ বা জিন্নাহ টুপি।
দ্বিতীয় সাধারণ নির্বাচন ১৯৪৬-এ। সেখানে এক দলনেতা বললেন, লীগের প্রার্থীকে ভোট না দিলে বিবি তালাক হয়ে যাবে। কেউই অটোমেটিক স্ত্রী তালাকের ঝুঁকি নিতে চায়নি। হক সাহেব নির্বাচনী প্রচারণার সময় বহু গ্রামে গিয়ে অনেক মরহুমের কবরে ফাতেহা পাঠ করেছেন। চুয়ান্নর নির্বাচনের দিন একজন এসে হক সাহেবকে বলল, ভোটাররা সব লীগের প্রার্থীরে ভোট দিতেছে। শেরে বাংলা মুহূর্ত চুপ করে থেকে বললেন, তাড়াতাড়ি একটা লুঙ্গি আর গামছা আন। তিনি হাঁটু অবধি লুঙ্গি পরে কাঁধে গামছা রেখে ভোটকেন্দ্রে গেলেন নিজের ভোটটি দিতে। বাংলার কৃষক তাঁকে ভোট না দিয়ে যাবে কোথায়?
ভোটারের মন জোগানোটাই বড় কথা—তা সেটা যেভাবেই হোক। আগেও হতো, এখনো হয়। একদল তরুণী হয়তো কলেজে যাচ্ছে। প্রার্থী তাদের পথরোধ করলেন: তোমরা এবার নতুন ভোটার। আমি পাস করলে বখাটে পোলাপান তো দূরের কথা, ওগো বাপেরও সাধ্য নাই তোমাগো উত্ত্যক্ত করে। গার্লস স্কুল বা কলেজের সামনে পাঁচ বখাটাকে বিচিত্র ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ওদের কাছেও মৃদু হেসে গিয়ে দাঁড়ান ভোটপ্রার্থী। যে ছোকরা দেখতে রণবীর কাপুরের মতো, তার পিঠে বাঁ-হাতটি রাখেন এবং ডান হাতে ওকে একটি ছোট খাম উপহার দেন। বলেন, বেহুদাই মানুষ তোমাগো বদনাম দেয়। এখনকার মেয়েগুলাই বদের বদ। বাবারা, তোমাগো প্রজন্মই দেশের ভবিষ্যৎ। ভোটের দিন পোলিং সেন্টারের আশপাশে থাইকো।
একালের ভোটপ্রার্থীরা হলেন সেই পূজারির মতো, যিনি যে দেবতা যে ফুলে সন্তুষ্ট তাঁকে সেই ফুল দিয়েই নৈবেদ্য নিবেদন করেন। বস্তির যে দরিদ্র দেবতা একটি লুঙ্গি ও শাড়িতে সন্তুষ্ট, তাঁকে তা-ই অর্ঘ্য হিসেবে দেওয়া হয়। যে যুবদেবতা একটি ছোট খামে খুশি—তাঁকে তা-ই। আর প্রতিশ্রুতি? যা দিতে কোনো খরচা নেই।
সাধারণ মানুষকে অবাস্তব ও মিথ্যা আশ্বাসে প্রলোভিত করতেও প্রচুর কর্মশক্তি ক্ষয় হয়। ওই শক্তি গঠনমূলক কাজে লাগালে এলাকার অনেকটাই উন্নয়ন সম্ভব। দোষটা গণতন্ত্রের নয়। নির্বাচনের রাজনীতিকে পঙ্কিল পথে টেনে নিয়ে স্বার্থ উদ্ধারের অপচেষ্টা দোষের। কারণ, তাতে নির্বাচিতদের ওপর শুধু নয়—বেচারা গণতন্ত্রের ওপরেই মানুষের আস্থাটা নষ্ট হয়ে যায়।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
নির্বাচনী প্রচারণার সময় ছাড়া সাধারণ সাংসারিক জীবনেও স্নেহ-ভালোবাসা প্রকাশের একটা সময় আছে, বিশেষ জায়গাও দরকার। বুদ্ধিমান মানুষ শাশুড়ির সামনেই শ্যালককে স্নেহ প্রদর্শন করে, আদর করে। শ্যালিকাকে আদর করতে হয় নিরিবিলি জায়গায়। বিশেষ করে স্ত্রীর আড়ালে। ডিজিটাল যুগে নির্বাচনের প্রচারাভিযানে স্নেহ-ভালোবাসা প্রকাশেরও মুহূর্ত আছে। ভোটারের কোলের নাতিটিকে আদর করতে হয় মিডিয়ার ক্যামেরার উপস্থিতিতে।
বস্তিতে ভোটভিক্ষা চাওয়ার সময়ও ক্যামেরা থাকা চাই। সেখানে গিয়ে প্রার্থী কোনো বুড়িকে জড়িয়ে ধরেন। বুড়িকে জড়িয়ে ধরে কোনো সুখ নাই, কিন্তু লাভ আছে। বুড়ির হাতটা টেনে নিজের মাথায় তুলে প্রার্থী বলেন, দোয়া করেন মা। আমার প্রথম কাজই হবে বস্তির আধুনিকায়ন প্রকল্প। বস্তিতে পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাস দেওয়াই আমার পয়লা কাজ।
নির্বাচন নির্বাচনই। তা জাতীয় নির্বাচনই হোক বা মহানগরের স্থানীয় সরকার নির্বাচনই হোক। নির্বাচন ব্যাপারটা চিরকাল ছিল না। যিশু খ্রিস্টের জন্মের তিন-চার হাজার বছর আগে হরপ্পার সভ্যতা-সংস্কৃতি নির্বাচন ছাড়াই সৃষ্টি হয়। হরপ্পার কোনো নির্বাচিত মেয়র ছিলেন বলে মনে হয় না। থাকলে নগর আরও ৫০০ বছর আগে ধ্বংস হতো। নগরের সবচেয়ে শিক্ষিত, যোগ্য ও মর্যাদাসম্পন্ন মানুষই নগর-শাসক মনোনীত হতেন। বাগদাদ, দামেস্ক, ইস্তাম্বুল, কর্ডোভা ও সেভিলে সভ্যতা গড়ে উঠেছিল সেখানকার সেরা মানুষদের সমন্বিত চেষ্টায়। ওইসব নগরের বিদ্বান ও বুদ্ধিজীবীরা রাত জেগে ভোট জোগাড়ের কসরত না করে মহৎ সভ্যতা গড়ে তোলার চেষ্টা করেছেন।
ভোটের বাজারে বিচিত্র কৌশল অবলম্বন নতুন কিছু নয়। ১৯৩৭-এ উপমহাদেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচনের প্রচারকাজ পুরোদমে চলছে। মুসলিম লীগ নেতারা দেখলেন মুহম্মদ আলী জিন্নাহর করোটির ভেতরে মগজ যথেষ্ট, কিন্তু মাথার ওপরটা খালি। জানুয়ারি মাসের উত্তর প্রদেশ। কনকনে শীত। কোনো এক বুদ্ধিমান একটা ভারীমতো টুপি শীর্ণ জিন্নাহর মাথায় এনে বসিয়ে দিলেন। তাতে কাজ হলো দুটো। জিন্নাহর মাথা শৈত্যপ্রবাহ থেকে বাঁচল এবং মুসলমান ভোটারদের বুকটা ভরল। তারা আর্জেন্টিনার সমর্থক দর্শকদের মতো আনন্দে লাফাতে লাগল। টুপিতে এইবার জিন্নাহকে মুসলমানের মতো দেখায়। ভোটাররা বুঝল, ইনিই আমাদের কায়দে আজম। জাতির নেতা। টুপির কারণে জিন্নাহর নতুন নাম হলো কায়দে আজম। ওদিকে অজ্ঞাত টুপিটি পেল নতুন নাম: জিন্নাহ ক্যাপ বা জিন্নাহ টুপি।
দ্বিতীয় সাধারণ নির্বাচন ১৯৪৬-এ। সেখানে এক দলনেতা বললেন, লীগের প্রার্থীকে ভোট না দিলে বিবি তালাক হয়ে যাবে। কেউই অটোমেটিক স্ত্রী তালাকের ঝুঁকি নিতে চায়নি। হক সাহেব নির্বাচনী প্রচারণার সময় বহু গ্রামে গিয়ে অনেক মরহুমের কবরে ফাতেহা পাঠ করেছেন। চুয়ান্নর নির্বাচনের দিন একজন এসে হক সাহেবকে বলল, ভোটাররা সব লীগের প্রার্থীরে ভোট দিতেছে। শেরে বাংলা মুহূর্ত চুপ করে থেকে বললেন, তাড়াতাড়ি একটা লুঙ্গি আর গামছা আন। তিনি হাঁটু অবধি লুঙ্গি পরে কাঁধে গামছা রেখে ভোটকেন্দ্রে গেলেন নিজের ভোটটি দিতে। বাংলার কৃষক তাঁকে ভোট না দিয়ে যাবে কোথায়?
ভোটারের মন জোগানোটাই বড় কথা—তা সেটা যেভাবেই হোক। আগেও হতো, এখনো হয়। একদল তরুণী হয়তো কলেজে যাচ্ছে। প্রার্থী তাদের পথরোধ করলেন: তোমরা এবার নতুন ভোটার। আমি পাস করলে বখাটে পোলাপান তো দূরের কথা, ওগো বাপেরও সাধ্য নাই তোমাগো উত্ত্যক্ত করে। গার্লস স্কুল বা কলেজের সামনে পাঁচ বখাটাকে বিচিত্র ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ওদের কাছেও মৃদু হেসে গিয়ে দাঁড়ান ভোটপ্রার্থী। যে ছোকরা দেখতে রণবীর কাপুরের মতো, তার পিঠে বাঁ-হাতটি রাখেন এবং ডান হাতে ওকে একটি ছোট খাম উপহার দেন। বলেন, বেহুদাই মানুষ তোমাগো বদনাম দেয়। এখনকার মেয়েগুলাই বদের বদ। বাবারা, তোমাগো প্রজন্মই দেশের ভবিষ্যৎ। ভোটের দিন পোলিং সেন্টারের আশপাশে থাইকো।
একালের ভোটপ্রার্থীরা হলেন সেই পূজারির মতো, যিনি যে দেবতা যে ফুলে সন্তুষ্ট তাঁকে সেই ফুল দিয়েই নৈবেদ্য নিবেদন করেন। বস্তির যে দরিদ্র দেবতা একটি লুঙ্গি ও শাড়িতে সন্তুষ্ট, তাঁকে তা-ই অর্ঘ্য হিসেবে দেওয়া হয়। যে যুবদেবতা একটি ছোট খামে খুশি—তাঁকে তা-ই। আর প্রতিশ্রুতি? যা দিতে কোনো খরচা নেই।
সাধারণ মানুষকে অবাস্তব ও মিথ্যা আশ্বাসে প্রলোভিত করতেও প্রচুর কর্মশক্তি ক্ষয় হয়। ওই শক্তি গঠনমূলক কাজে লাগালে এলাকার অনেকটাই উন্নয়ন সম্ভব। দোষটা গণতন্ত্রের নয়। নির্বাচনের রাজনীতিকে পঙ্কিল পথে টেনে নিয়ে স্বার্থ উদ্ধারের অপচেষ্টা দোষের। কারণ, তাতে নির্বাচিতদের ওপর শুধু নয়—বেচারা গণতন্ত্রের ওপরেই মানুষের আস্থাটা নষ্ট হয়ে যায়।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
No comments